লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

মুদ্রণ যন্ত্রের আবির্ভাব

ভাষান্তর: নবনীতা মুখোপাধ্যায় ও কুন্তল মুখোপাধ্যায়

আমরা যাঁরা পড়াশোনা করি অথবা ছোটো পত্রিকা চালাই, আমাদের বেশিরভাগ সময়েই মুদ্রণ বিষয়ের ইতিহাস জানা হয়ে ওঠে না। ‘The Foundation of Early Modern Europe, 1460-1559’, এ-বিষয়ে একটি প্রামাণ্য বই। এ-বইয়ের লেখক ইউজিন এফ রাইস (জুনিয়র) এবং অ্যান্‌থনি গ্রাফটন। এ-বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদের একেবারে প্রথম অংশের উপনাম ‘The Invention of Printing’ (‘দ্য ইনভেনশন অব প্রিন্টিং’)। সেই শিরোনামের নীচের লিখিত অংশটুকু অনুবাদ করেছেন নবনীতা মুখোপাধ্যায় ও কুন্তল মুখোপাধ্যায়। লেখাটি পরিমার্জন করেছেন স্নিগ্ধা বর্ধন।

১৪৯২ এবং ১৪৯৮ সাল আমাদের চেনা। ১৪৯৮-এ ভাস্কো দ্য গামা ভারতবর্ষের মালাবার উপকূলে এসে উপস্থিত হন। এই সময়েই আরও কিছু পরিচিত আর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। ১৫০০ সালের অর্ধশতাব্দী আগে ইউরোপের মানুষ প্রথম ছাপা বই পড়তে পেল, আর ১৪৫০ থেকে ১৫২৫ সালের মধ্যে নতুন আগ্নেয়াস্ত্রগুলি যুদ্ধের পদ্ধতি পালটে দেয়। ১৫০০ সালে রোমে কোপারনিকাসের অঙ্কশাস্ত্রের উপর বক্তৃতা এবং এই সময়েই তাঁর ‘পৃথিবীর নিজের অক্ষের উপর আর সেইসঙ্গে সূর্যের চারপাশে পরিক্রমণ’ তত্ত্বের শিক্ষা দেওয়া শুরু। এই আবিষ্কার, অনুসন্ধান আর পুনরানুসন্ধান প্রভাবিত করতে পেরেছিল সমগ্র ইউরোপ তথা বিশ্বের ইতিহাসকে। এই সমস্ত কিছু পালটাতে পেরেছিল ইউরোপের সম্পর্ককে যা ছিল তার নিজের অতীতের সঙ্গে ও অন্যান্য অ-ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে। শৈলী ও সংস্কৃতির দিক থেকে ষোড়শ শতাব্দী অবধি ইউরোপ প্রাচীন গ্রিক, রোমান আর দূর ও নিকটবর্তী প্রাচ্য সভ্যতার ছাত্র। কলম্বাস ও ভাস্কো দ্য গামা-র অভিযান সেই নির্ভরশীলতা দূর করে নতুন রাস্তা দেখায়। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দাপটের সাথে সাথে ইউরোপ প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা অনুশীলন ও অর্জন করছিল। ১৫০০ সালের আগে ইউরোপ শৈলী ও ভাবনার আমদানি করত; ১৫০০ সালের পর ইউরোপের মানুষ সাংস্কৃতিক লগ্নিকারী (creditor) হয়ে উঠেছিলেন।

১৪৫০ সাল নাগাদ মেইন্‌জ্‌ শহরে চলন্ত ধাতব অক্ষরের (movable metal type) মাধ্যমে মুদ্রণকার্য শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে তিনটি নাম উল্লেখযোগ্য— যোহান গুটেনবার্গ (১৩৯৫-১৪৬৮), যোহান ফাস্ট (১৪০০-১৪৬৫) এবং পিটার স্কোফার (১৪২৫-১৫০২), যিনি ছিলেন ফাস্ট-এর জামাতা। এই সূত্রগুলি অপর্যাপ্ত, কখনো কখনো পরিষ্কার নয়, আর সংশয়াত্মক। অতএব মুদ্রণবিদ্যা ও অক্ষরশৈলীর পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে পারার জন্য কোনো একজন বিশেষ ব্যক্তিরই অবদান আছে, এ-কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে মুদ্রণের উৎস বিষয়ে আপেক্ষিকভাবে আমাদের অজ্ঞতাই বিষয়টিকে জানার উৎসাহ দেয়। এই অজ্ঞতার ফলে আমরা ভুল করে ভাবি যে, একটি জটিল প্রযুক্তি আবিষ্কারের কৃতিত্ব একজন ব্যক্তিবিশেষের। আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, একটি আবিষ্কার কোনোভাবেই একটি ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। একই কথা কবিতা বা ছবির ক্ষেত্রেও যা কিনা একটি সামাজিক উৎপাদন। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন বা টেলিগ্রাফের ক্রম-অগ্রগতির মতোই একটি পাঠ্যবস্তুর হুবহু নকলের যান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও তার উদ্ভাবন ছিল একটি সমষ্টিগত প্রয়াস। ১৪৫০ সাল নাগাদ মেইন্‌জ্‌ শহরের মুদ্রকেরা এই কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক প্রস্তাবনা ছিল।

পশ্চিম ইউরোপে অক্ষরশৈলীর মুদ্রণ সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দু-টি চৈনিক আবিষ্কার— ব্লক প্রিন্টিং এবং কাগজ। কাঠখোদাই শিল্প (xylography) অথবা ব্লক প্রিন্টিং-এর উদ্ভব হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে, চীনে। মুদ্রক একখণ্ড কাঠের ব্লকে উলটো করে আঁকতেন ছবি অথবা বিষয় যা তিনি হুবহু ছাপতে চাইছেন। মুদ্রক কাঠখণ্ডটিকে এমনভাবে খোদাই করতেন যাতে তা রিলিফের এবং গ্রাফিক আকার নেয়। এবং তারপর তা কাগজে বদলি করতেন। ভাবনার দিক থেকে প্রক্রিয়াটি ছিল সরল, কিন্তু প্রয়োগের সময় জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যায়বহুল। এছাড়া পশ্চিমী বর্ণমালার সঙ্গে এই পদ্ধতিটি ঠিক ঠিক প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ১২৫০ থেকে ১৩৫০ সালের মাঝামাঝি যখন ইউরোপের সঙ্গে চীনের সংযোগ অস্বাভাবিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল, তখনই পশ্চিমে এর প্রচার হয়। যদিও মুদ্রণপ্রক্রিয়ার উন্নতির সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ নেই, তবু এর পরোক্ষ গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। এটা সম্ভবত ইঙ্গিত করছিল পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি: একটি পুরোনো কাঠের ব্লক বর্ণমালার আকৃতি অনুযায়ী কাটা এবং তারপর তাকে নতুন পাঠ্যবস্তুর বানান পদ্ধতি অনুযায়ী পুর্নবিন্যস্ত করা। এই পদ্ধতিটি মুদ্রণের ধারণাটিকে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। তবে সরাসরি বাণিজ্যিক সাফল্য শুরু হয়েছিল চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে। খেলার তাস (অন্য একটি চৈনিক আবিষ্কার), ধর্মীয় প্রিন্ট আর স্থুল কাঠখোদাই করা বই প্রথম বাজারের গুরুত্ব বোঝায়। সম্ভাব্য লাভের উপরও জোর দেয়।

অর্থনীতির থেকেও প্রযুক্তিগত কারণে কাগজ অপরিহার্য। হাতে লেখা বই সাধারণত পার্চমেন্টের (যা ভেড়ার চামড়া থেকে তৈরি) অথবা ভেলামের (বাছুরের চামড়া) উপরে লেখা হত। এগুলি ধাতব মুদ্রণকারীরাও ব্যবহার করতেন, বিশেষত যখন লক্ষ্য উপযোগিতার থেকে উৎকর্ষের দিকে ঝুঁকে থাকত। যখন কাগজ ছিল না, সে-সময় একটি বাইবেলের মতো বড়ো বই ছাপতে প্রয়োজন হত প্রায় ১৭০টি বাছুরের অথবা ৩০০টি ভেড়ার চামড়া। কাগজ না থাকলে হয়ত বাতিল হয়ে যেত এই সম্ভবনাময় যান্ত্রিক অনুকরণের প্রক্রিয়ায় সস্তা দ্রুত এবং প্রচুর পুস্তক প্রকাশনা। আরবরা চীন থেকে কাগজ তৈরির কৌশল শিখে নিয়ে দ্বাদশ শতাব্দীতে স্পেনে কাগজ উৎপাদন করতে শুরু করে। পরের দুই শতাব্দী ধরে আস্তে আস্তে এই পদ্ধতি ইউরোপের একটি বড়ো অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন ইতালি (১২৭০), ফ্রান্স (১৩৪০), জার্মানি (১৩৯০) এবং সুইজারল্যান্ড (১৪১১)। ইউরোপের প্রধান কাঁচা মাল ছিল পুরোনো কম্বল। কাগজ প্রস্তুতকারকেরা কম্বলগুলি একটি জলশক্তি চালিত স্টাম্পিং মেশিনের নীচে রাখতেন। শনজাতীয় গাছকে জলে ভিজিয়ে নরম করে, তার থেকে তৈরি ফাইবার মেশানো হত। এরপর তাকে ভিজিয়ে রেখে একটা কাঠের ফ্রেমের বিশাল চালুনি দিয়ে ঢেলে একটা তরল মণ্ড করে ফেলা হত। এবারে সেটাকে তারজালির উপরে সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে যখন তার ছিদ্রগুলির ভিতর দিয়ে জল চালনা করা হয়, সে-সময় সেই খণ্ডগুলিকে একটি ছাপাখানায় পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে চাপ দেওয়া হত। এরপর সেই খণ্ডগুলিকে শুকিয়ে মাপ করে কাটা হত। ওয়াগনরের অপেরা ‘মেইসটারসিঙ্গার ভন ন্যুরন্বার্গ’ (von Nürnberg)-এর নায়ক চর্মকার-কবি হান্স সাক্স (১৪৯৪-১৫৭৬) এই পদ্ধতিটিকে একটি কবিতায় বর্ণনা দিয়েছেন যেটা কাগজ তৈরির প্রথম দিকের ছবি দেয় আমাদের:
এই মিলে আমি ব্যবহার করি কম্বল
এইখানে স্রোত ঘুরিয়েছে চাকা-কল
সেই জল র‍্যাগ ছিঁড়ে করে বহুখণ্ড,
তারপর জলে, পাত্রে ভেজাই মণ্ড।
ঠিকঠাক করে মোল্ড করি সেই কাগজ
সারাদিন প্রেসে জল নিঙরাই, রোজ
ঝুলিয়েছি তাকে, শুকোনোর দরকার;
বরফের মতো ফর্সা এবং চকচকে ওটা
চোখের আরাম সবার

গুটেনবার্গের যৌবনকালেই কাগজ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত আর তা পার্চমেন্টের ছয় ভাগের একভাগে বা এক ষষ্ঠাংশ দামেই পাওয়া সম্ভব ছিল।

পশ্চিমী অক্ষরশৈলী নিয়ে এল ইউরোপীয় পদ্ধতিও এবং এইসব ছিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুবই প্রাসঙ্গিক। মেইন্‌জ্‌ শহরে গুটেনবার্গ, ফাস্ট এবং স্কোফার (Schoffer) যেভাবে মুদ্রণ করতেন তার জন্য প্রয়োজন ছিল মানানসই কালি, কালি দিয়ে কাগজে বদলি করার ছাপযন্ত্র আর ধাতুর তৈরি অক্ষর (type)। সেই ধাতুর সঙ্গে সমভাবে আর মসৃণভাবে সেঁটে থাকতে হবে কালিটিকেও। সেজন্য তার উপাদানে তেলজাতীয় পদার্থ থাকা অবশ্যই জরুরি। পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফ্লেমিশ (Flemish; ফলান্ডার দেশের বাসিন্দারা) শিল্পীরা তেলচিত্র আঁকতে শুরু করেন। তেলচিত্র বলতে তখন বোঝাত মানানসই ছাপার কালি, যার মধ্যে থাকত পিগমেন্ট অর্থাৎ, ভুষোকালি বা কাঠকয়লা গুঁড়ো এবং তিসির তেলের সাহায্যে আনা ঔজ্জ্বল্য। দ্রুতই কাঠের ছাপাখানার উত্তরসূরিও পাওয়া গিয়েছিল হাতেনাতে। যে-প্রেসে জল নিংরে বের করা হত, সেই প্রেস ব্যবহার করে নতুন মুদ্রণের ক্ষেত্রে নতুন অভিযোজনের কথা হয়েছিল। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অক্ষরের (type) আবিষ্কার— বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের মুকুরকল্পের (Mirror Image) ধাতুনির্মিত ছাঁচের নিখুঁত নির্মাণ। এই দক্ষতা অক্ষর ঢালাইয়ের উন্নতিবৃদ্ধিতে সাহায্য করে আর তা, স্পষ্টতই, ধাতুবিদ্যার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন ধাতু খোদাইকারী, অথবা যিনি মুদ্রা এবং পদকের নকশা করতেন অথবা ছোটো-কিছু-তৈরিতে-দক্ষ স্বর্ণকার অথবা যাঁরা শীলমোহরের অক্ষর পেতলের উপরে খোদাই করতেন, দস্তার তৈরি পাত্রের উপরে কাজ করতেন এবং বই বাঁধাইয়ের কাজ করতেন। পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষ কারিগরেরা ইউরোপের বিভিন্ন অংশে টাইপ, অক্ষর, কালি, মুদ্রণযন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছিলেন— এমন কল্পনা করা যায়। এও ভাবা যায় যে, মুদ্রণযন্ত্রের সঠিক উদ্ভাবন, তার কিছু পরিচিত কৌশলকে নতুন এবং কাজে সুবিধাজনক পদ্ধতিতে পালটে ফেলার নাটকীয় মিশ্রণ পদ্ধতি (যা আমাদের কাছে এখন সহজ মনে হয়, এ-সব হওয়ার আগে যা অকল্পনীয় ও দুরূহ ছিল) বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনভাবে হয়েছিল। সব শেষে, গুটেনবার্গ, ফাস্ট এবং স্কোফারই প্রথম এই নতুন পদ্ধতিকে নিখুঁতভাবে সংগঠিত করে একটা ইন্ডাস্ট্রির (Industry, শিল্প ) রূপদান করতে পেরেছিলেন। তবে যেটা নিশ্চিত, সেটা হল এই যে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো বই মুদ্রিত হয়েছিল সঞ্চরণশীল ধাতব অক্ষরের সাহায্যে (Movable metal type) এবং সেটা হয়েছিল মেইন্‌জ্‌ শহরেই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বইগুলি এখনও টেকনিকের দিক থেকে নিখুঁত। এ থেকে এটা বলা যায় যে, মেইন্‌জের প্রকাশনা-বাড়িগুলি তাদের পূর্বসূরিদের থেকে এবং পূর্বসূরিকৃত প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে অনেকখানি দক্ষতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল। গুটেনবার্গ কৃত যে-লাতিন বাইবেল অত্যন্ত জনপ্রিয় বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে গ্রন্থপঞ্জিকারেরা যাকে বিয়াল্লিশ লাইন বাইবেল (forty-two-line Bible) বলেন (এবং তা অবশ্যি মেইন্‌জ্‌ শহরের প্রথম দিকের প্রকাশনা থেকে আলাদা করতে, কারণ, সেটা ছাপা হয়েছিল ছত্রিশ বাক্যের পাতায়) তা প্রকাশিত ও সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৪৫৫ সালে। এই বাইবেলের অক্ষরনৈপুণ্য, অক্ষর সংস্থাপনের কৌশল এবং মুদ্রণ নিখুঁত। স্পষ্টতই মেইন্‌জের মুদ্রণকারীরা মুদ্রণ প্রযুক্তিকে একটা শক্ত জমির উপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যিই, পরবর্তী তিনশো বছর ধরে গুটেনবার্গের উত্তরসূরিরা খাঁজ তৈরি, ছাঁচ করা, অক্ষরঢালাই, অক্ষর বিন্যাস এবং মুদ্রণের ব্যাপারে গুটেনবার্গ যা করেছিলেন সংক্ষেপে সেটাই করছিলেন। এর পরের মুদ্রকেরাও উৎকর্ষের দিক দিয়ে ও নান্দনিকতায় এর প্রতিষ্ঠাতাদেরকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। ১৪৫৭ সালের ১৪ই অগস্ট ফাস্ট ও স্কোফার একটি সাম (The Psalms) স্তোত্র মুদ্রণ করেছিলেন। এই খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ভেলাম বা বাছুরের চামড়ার উপরে। লাল আর কালো কালিতে ছাপা অক্ষরগুলি সুন্দরভাবে মানিয়ে গিয়েছিল পাতার সঙ্গে। প্রতিটি সামের শেষে মুদ্রকেরা গর্বিতভাবে লিখেছিলেন ‘প্রথম বিশাল অক্ষরের সৌন্দর্যভূষণ-সহ’ (adorned with the beauty of large initial letters) এই অক্ষরটির ঝালরের রূপে বিন্যস্ত, যা লাল কালো রঙে বহু ফুল ও পশুর চিত্রের সাহায্যে অলঙ্কৃত হয়েছিল— সত্যিই ছিল অসাধারণ। ফাস্ট এবং স্কোফারের সাম্‌স্‌ সবচেয়ে পুরোনো সাক্ষরিত ও তারিখবিধৃত বই। সারা ইউরোপে এর সৌন্দর্যের তথা সৌকর্যের জন্য এটি এখনও অন্যতম সুন্দরী বই।

প্রথম দিকের মুদ্রিত বইগুলির একটি বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক দিক ছিল। এদের পৃষ্ঠাগুলি ছিল প্রায়ই পাণ্ডুলিপির মতো দেখতে, ফলে অনভিজ্ঞ চোখে এইসব বই পাণ্ডুলিপির চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল না। স্পষ্টতই মুদ্রকের কৌশলগত, নান্দনিক এবং বাণিজ্যিক লক্ষ্য ছিল হুবহু হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা। এবং ওরা সেটা শুধু যে অলসতা অথবা খরিদ্দারের হাতে পরিচিত জিনিস তুলে দেবার জন্যেই করত, তা নয়। আসলে প্রথম দিকের প্রকাশকেরা তাঁদের আবিষ্কারের নিঁখুত সম্ভবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন না; তাঁরা মুদ্রণকে একটি নতুন অথচ নির্দিষ্ট ধরনের লেখা বলে মনে করতেন (“কলম ছাড়াই লেখার কৌশল”, বলেছেন স্কোফার); তাঁরা ভাবতেন যে, তাঁদের অল্প দামে প্রচুর সংখ্যক পাণ্ডুলিপি (manuscripts) বিক্রি করতে হবে। ঐতিহ্যবাহিত এই ধারণা থেকে মুক্ত না হওয়ার সমস্যাটি এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, যদিও অক্ষরশৈলীর আবিষ্কার রেনেসাঁর সবচেয়ে বড়ো ঘটনা, তবু এর প্রাথমিক উন্নতিবৃদ্ধি সম্পূর্ণভাবে চার্চ-সংক্রান্ত লোকজনের রুচি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল। মুদ্রণের ভৌগোলিক উৎস ইতালি থেকে অনেক দূরে। অথচ পঞ্চদশ শতকে ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির ও কারুকলার কেন্দ্র ছিল এই দেশ। মুদ্রণই প্রথম প্রাদেশিক যাজকশ্রেণির মূলধনের সাহায্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল এবং এই ব্যাবসার প্রসার ছিল প্রায় ৩০০০ লোকের মধ্যে এবং খুব কম আর স্বতন্ত্র কিছু বুদ্ধিজীবি মহলে। মঠ এবং ক্যাথিড্রালের অধ্যায়গুলি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল লাতিন বাইবেলের জন্যে। আর গির্জার নিত্যকর্ম পদ্ধতির বই, তার গানের বই এবং বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত প্রার্থনা সংগীতের বই ছিল এইসব মুদ্রকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষই মুদ্রণের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিল। যেমন চার্চের ক্ষমাপত্র-র (ইন্ডালজেন্স ফর্ম) জন্য একটি বরাত থাকত। প্রকাশকদের সস্তা বইয়ের তালিকায় (স্কোফারের) প্রাধান্য পাচ্ছিল সনাতন বিষয় যেমন— বাইবেলের সহজ ব্যাখ্যা, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের কাজ, সাধুসন্তদের জীবনী আর ‘ভালভাবে বাঁচা ও সুন্দরভাবে মারা যাওয়া’-র পথনির্দেশিকা এবং বীরত্বের রোমান্স কাহিনি।

মেইন্‌জ্‌ শহরে ১৪৬০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে বিস্ময়করভাবে প্রকাশনার হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হল বইয়ের অনন্ত চাহিদা। ব্যাবসায়ী-উকিল-কারিগর-সরকারি-কর্তা-ডাক্তার-শিক্ষকদের অনন্ত চাহিদা। ইউরোপের কৃষকদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত এবং পরের কয়েক শতাব্দী ধরে সেটাই চলবে। যাজক সম্প্রদায় ও নোব্‌ল শ্রেণির মানুষ এ-কথা মেনে নিতে শুরু করেছিলেন যে, রাজদরবারে এবং দেশোয়ালি জমিদারদের কাছে চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষিত হওয়াটা জরুরি। তবে তাঁদের প্রয়োজন এতদিন মিটিয়ে আসছিল ওয়ার্কশপের বহু নকলনবীশ, যাঁরা বইয়ের সংখ্যা বাড়াতেন হাতে লিখেই। এটা ঠিক যে, মুদ্রিত বইগুলি বেশ কিছু দশক ধরে ইতালির ধনবান ও কৃষিপ্রধান নায়েবদের থেকে স্বতঃস্ফূর্ত বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। তবে আমরা যাকে বলি, শহরের মধ্যবিত্তশ্রেণি— তাঁদের মধ্যে, এছাড়াও অন্যান্য মানুষের মধ্যে, তাঁদের ব্যাবসা ও নাগরিকতা রক্ষার জন্যে, লেখাপড়া ও হিসেবনিকেশের প্রয়োজন হত। এইসব মানুষ ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় শহরে ও গিল্ড স্কুলে শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন এবং এঁরা পঞ্চদশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগ বাড়িয়ে তুলছিলেন, মুদ্রিত বইয়ের একটি বিশাল বাজার তৈরি হয়েছিল। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মধ্যযুগে শুরু হওয়ায় নিরপেক্ষ শিক্ষার প্রসারই মুদ্রণের ব্যাপ্তির পিছনে কাজ করেছিল। শহরের জনসংখ্যা, বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে লাগল শিক্ষা-সচেতনতা, সম্পদ, শক্তি, আত্মসচেতনতা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক চাহিদা। বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে স্বশিক্ষিত ও আত্মসমৃদ্ধি লাভ করার জন্য যে-অদম্য উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, তারই ফলশ্রুতি হিসাবে তাঁরা কিনে নিতেন মনোরঞ্জক ও সবরকমের দরকারি বই: ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বই, লাতিন ভাষার ও মাতৃভাষার বই, ব্যাকরণ, অভিধান, বিশ্বকোষ, অঙ্কের মৌলিক বই, জ্যোতিষশাস্ত্রের বই, ওষুধপত্র এবং আইনসংক্রান্ত, আঞ্চলিক ও সামগ্রিক ইতিহাসের বই, আত্মত্যাগের জনপ্রিয় নির্দেশিকা আর কিছু হৃদয়-স্পর্শ-করা লাতিন ক্লাসিক— ভার্জিলের ঈনিড, সিসেরোর দি অফিসিস, টেরেন্স, প্লিনি আর সেনেকা। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের আগে শহরশাসিত বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি শহরের মানুষের পড়ার প্রয়োজন পরিবেশন করত। স্টেলনার (লেখার উপকরণ ও তৎসংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের বিক্রেতা) বলা হত তাঁদের। তাঁরা প্রয়োজনীয় বই চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতেন। বিশাল মূলধন নিয়ে এঁরা লেখক/নকলনবীশও ব্যাখ্যাকার ভাড়া করতেন, তাঁদের বিষয় ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিতেন। আর এঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ করে ফেলতেন সম্ভাব্য বইয়ের বিশাল বিশাল সব তালিকা। এইসব বই ব্যক্তির অগ্রিম টাকায় অর্ডারে খুচরো দোকানে (retail) বিক্রি করা হত। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা বিশাল মাপের সব কাজ করতেন। নিজের সংগ্রহের বিজ্ঞাপন করতে ডাইবল্ড লবার (ন্যুরেমবার্গের লেখক) ব্যবহার করছিলেন প্রায় একশোটা বিভিন্ন বিষয়ের হাতে লেখা তালিকা। এ-তালিকার textগুলি তাঁর দোকানেই পাওয়া যেত। ভেসপাসিয়ানো দ্য বিসটিচ্চি ছিলেন ফ্লোরেন্সের পুস্তকবিক্রেতা (cartolaio)। এই মানুষটি মুদ্রণের যুগে বেঁচে থেকেও মুদ্রণকে ঘেন্না করতেন। ইনিই পঁয়তাল্লিশ জন ‘লেখক’ ‘লাগিয়েছিলেন’ কুড়ি মাসে প্রায় দুইশোখানি বই লিখে ফেলতে কসিমো দ্য মেদিচি-র জন্যে। এঁর কাজের ব্যাপ্তিও ছিল বিশাল। অন্য দেশের শাসক ও সুদূরের কালেক্টরের জন্যেও কাজ করতেন। যেমন— ইংল্যান্ড। ভ্যাটিকান সিটি থেকে অক্সফোর্ডের লাইব্রেরি— সব জায়গায় ভেসপাসিয়ানোর শতাধিক অসাধারণ এবং ব্যাখ্যার বই (আলো করে রয়েছে) পাওয়া যেতে পারে। গ্রন্থাগারই হোক অথবা তাঁদের খরিদ্দার— সবার পছন্দের সুষ্ঠু নির্মাণ করতে এঁরা অনেক কিছু করেছিলেন। এঁরা হিউম্যানিস্টদের নতুন ও পরিষ্কার স্ক্রিপ্ট (script) রচনার ফ্যাশন চালু করেছিলেন। শিরোনামের পাতাটি, অর্থাৎ, প্রচ্ছদটিকে সাজানো, বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রে তাকে ধ্রুপদী বিষয়বস্তুর ও আবক্ষছবির ছাপ দেওয়ার ফ্যাশনও এঁদেরই চালু করা। তাছাড়া এ-সব মুদ্রণের যুগ পর্যন্ত চালুও ছিল। তাঁদের তৈরি গ্রন্থাগার এবং দোকানগুলি হয়ে উঠেছিল তাঁদের পৃষ্ঠপোষক ও বুদ্ধিজীবিদের আলোচনার ঝাঁ চকচকে কেন্দ্রবিন্দু। এইসব কেন্দ্রগুলি মঠ বা মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশাল সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না; বরং এদের সমস্ত কিছুকে বাণিজ্যিক জীবনে সংহত করেছিল এই কেন্দ্রগুলি। ভেসপাসিয়ানো নন, তবে অন্যান্য কিছু বইবিক্রেতা নতুন বিশাল প্রকাশনের স্বার্থে (মুদ্রণ) নিজের অপছন্দ চেপে রাখতেন, আর কেউ কেউ এই নতুন প্রকাশনের দিকে একেবারে ঝুঁকে পড়েছিলেন।

অক্ষরশিল্পের নিহিত সচলতা মুক্তি পেয়েছিল শহরের প্রচুর চাহিদা আর তৎকালীন অর্থব্যবস্থা ও তার বণ্টন পদ্ধতির সাহায্যে। ফলত দেখা গিয়েছিল বইয়ের অটল ও ক্রমবর্ধমান স্রোত। মুদ্রণ ছড়িয়ে পড়ছিল। মেইন্জ্ থেকে স্ট্রসবুর্গ (১৪৫৮), কোলন (১৪৬৫), অগস্বুর্গ (১৪৬৮), ন্যুরেমবার্গ (১৪৭০), লেইপজিগ (১৪৮১) এবং ভিয়েনায় (১৪৮২)। জার্মান মুদ্রকেরা অথবা তাঁদের ছাত্রেরা এই ‘স্বর্গীয়’ শিল্পটিকে ১৪৬৭ সালে ইতালিতে, সুইজারল্যান্ড ও বোহেমিয়ায় ১৪৬৮ সালে, ফ্রান্স আর নেদারল্যান্ড্স্-এ ১৪৭০ সালে নিয়ে এলেন। ১৪৭৪ থেকে ১৪৭৬ সালের মধ্যে স্পেনে, ইংল্যান্ডে, হাঙ্গেরি আর পোল্যান্ডে, ডেনমার্কে আর সুইডেনে ১৪৮২ থেকে ১৪৮৩ সালের মধ্যে। ১৫০০ সালের মধ্যে বেড়িয়ে গেল চল্লিশ হাজার সংস্করণ সমেত প্রায় ছয় লক্ষ বই; এবং আরও প্রচুর সংখ্যক বই যা সম্ভবত রোমের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপে প্রকাশিতই হয়নি।

বইয়ের এতখানি সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিল। সংস্কারের দিনগুলির আগে (the years before the Reformation) সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ছিল পাণ্ডিত্যের উপরে মুদ্রণের প্রভাব পাণ্ডুলিপির সবটাই নির্ভর করত লেখক/নকলকারীর শিক্ষা, দক্ষতা আর যত্নের উপরে। এবং তা সবসময়েই নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। সর্বোপরি এই ত্রুটি ও আস্থাহীনতা হয়ে উঠছিল ক্রমবর্ধমান, কারণ, নকলকারীর পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরসূরির ত্রুটিও নকল করে ফেলছিলেন এবং তৎসহ কিছু যোগও করছিলেন। মুদ্রণের মৌলিক অবদান, অন্য দিকে ছিল এই যে, এটা থামিয়ে দিয়েছিল এই চলতে থাকা পচনপ্রক্রিয়া এবং অতীতের মহতি পাঠ্যাংশকে তাদের আস্লি সংহতির কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ এবং অবিরাম প্রচেষ্টা প্রয়োগ করতে পারছিলেন মুদ্রকেরা। মুদ্রণ সারা ইউরোপের পণ্ডিত মানুষদের একইরকম পাঠ্যবস্তু দিচ্ছিল যা নিয়ে কাজ করা যায়। সংক্ষেপে একটি নির্দিষ্ট পাতার নির্দিষ্ট বাক্যের নির্দিষ্ট শব্দের উল্লেখ করে ব্যাসেলের (Basel) একজন পণ্ডিত একটি সংশোধনের প্রস্তাব দিতে পারতেন যা তাদের সহকারীরা রোমে অথবা ফ্লোরেন্সে সঙ্গে সঙ্গে দেখে নিতে পারছিলেন অথবা পারি শহরের মঠ-সংলগ্ন গ্রন্থাগারে একজন স্কলার আবিষ্কার করছিলেন একটি পাণ্ডুলিপি যার পাঠ্যাংশ বিচার করা সম্ভব হচ্ছিল এর আগের যে-কোনো জানা পদ্ধতির চেয়ে ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও সংক্ষেপিত পদ্ধতির সাহায্যে। এসে যাচ্ছিল এইসব আবিষ্কার ও সংশোধনের থেকে একটি সমালোচনামূলক সংস্করণ যা বাতিল হয়ে যাচ্ছিল আরও এবং আরও একটি সংস্করণের আবির্ভাবে। এবং এই প্রক্রিয়া ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে যতক্ষণ না একটি আদর্শ পাঠ্যাংশ পাওয়া যায়। অতীত তো কখনো কখনো বোঝা হয়েও যায়। আমরা তো কাজ করতে করতেই এটা জানি এবং এর অনেকখানির জন্যে আমরা মুদ্রণের কাছে কৃতজ্ঞ।

মুদ্রণ যেভাবে পাঠ্যাংশের সমালোচনা একটি সমষ্টিগত বিজ্ঞানে পরিণত করেছিল, তা একদমই একটি সাধারণ ঘটনার বিশেষ অংশমাত্র। মুদ্রণ বুদ্ধিবৃত্তির কাজটি ব্যক্তির নিঃসঙ্গ কর্ম থেকে সামগ্রিকভাবে সমবায়ী কাজে পরিণত করেছিল। যেভাবে শিল্পবিপ্লবের সময় বাষ্পচালিত যন্ত্র মানুষের শারীরিক শ্রমের থেকে বহুগুণ উৎপাদনের ক্ষমতা দেখিয়েছিল, ঠিক সেরকম মুদ্রণও একটি ব্যক্তির প্রযুক্ত বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্র বাড়িয়ে তুলেছিল। প্রকৃতিবিজ্ঞান ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই ব্রেইন পাওয়ারের এমন মহতি মনোযোগ লক্ষ্যণীয় ছিল না। যেমন, কোপারনিকাস উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁর সৌরকেন্দ্রিক প্রকল্পের তত্ত্ব ষোলোশো শতাব্দীর প্রথমার্ধে। কিন্তু ১৫৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি তা তিনি প্রকাশ করেননি। এই প্রধান বৈজ্ঞানিক সমস্যার উপর তিনি কাজ করেন ১৫০০ সাল থেকে ১৫৪৩ সালের মধ্যে, একা একা। ১৫৪৩ সালের পরে কোপারনিকাসের মুদ্রিত বইটি সে-সময় ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের নজরে আসে। তা একটি সমবায়ী সমস্যার, বিতর্কের ও পড়াশোনার বিষয় হয়ে ওঠে। এর সমাধানও খুব দ্রুত পাওয়া যায়, অথচ অন্য কোনো ক্ষেত্রে (মুদ্রণ ছাড়া) হলে অন্য কিছুও হতে পারত। এই নতুন বুদ্ধির যন্ত্রের সাহায্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর সব ধরনের পাণ্ডিত্য জনসাধারণের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। উপযুর্পরি পরীক্ষানিরীক্ষা, মনোযোগী এবং সমবায়ী পরীক্ষার সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত ও মুদ্রিত মহান ফলাফল বিনিময়ও জনসাধারণের কথাবস্তুর কেন্দ্র হয়। এই বিষয়ে মুদ্রণের আবির্ভাবকে কেবলমাত্র একদিকে লেখালিখির (writing) অন্য দিকে কম্পিউটারের আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

মুদ্রণ কেবলমাত্র পাণ্ডিত্যকেই যে নিখুঁত আর সম্পূর্ণ করেছে তাই নয়, এটা বিদ্যা অর্জনের পদ্ধতিটিকে করে ফেলেছিল অনেকখানি সহজ। মুদ্রণের মানের আরও উন্নতির ফলে পড়াশোনা শেখা অনেক সহজ হয়েছিল। আগে যেখানে পুস্তকাদি ছিল মঠ ক্যাথিড্রাল ও মহাবিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া অধিকার, সেইখানে একজন ব্যক্তি কিছু বইয়ের মালিক হবার ক্ষমতা পেয়ে গেছিল। মধ্যযুগের ছাত্রদের নিজেদেরকেই নিজের অভিধান তৈরি করতে হত। করতে বাধ্য করা হত। লেকচার রুমেই বেশিরভাগ সময় এদের কাটত নিজের পাঠ্যাংশের অনুলিখন শিক্ষকের কাছে নিতে নিতে। লেকচার করা মানে ছিল একটি বই চিৎকার করে পড়া যাতে ছাত্ররা সেটা লিখে নিতে পারে। এখন ছাত্ররা সেই পাঠ্যাংশ বাড়িতে পড়তে পারবে। শেখার অর্থ ছিল স্মৃতিতে ধরে রাখা। মুদ্রণ স্মৃতির মুক্তি ঘটালো। একটা ঘটনা মনে রাখার প্রয়োজন কম ছিল বিশেষত ওটা যখন শেল্‌ফের উপরে থেকে পাওয়া যেতে পারে। অক্ষরশৈলীর আবিষ্কারের প্রায় একশো বছর পরে, ১৫৮০ সালে, ফরাসি প্রাবন্ধিক মিশেল দ্য মতাঁইয়ঁ (১৫৩৩-১৫৯২) রেনেসাঁ শিক্ষাতত্ত্বের প্রধান বিষয়টিকে আলংকারিকভাবে পুনর্বিবৃত করলেন। তিনি শিক্ষার অন্তিমতাকে সংজ্ঞায়িত করলেন তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞানের বাহুল্যে নয় বরং শীলিত বুদ্ধি, গভীর অনুজ্ঞা ও চর্চিত রুচিময়তায়। মঁতাইয়ঁ-র কাছে একজন পণ্ডিত ছিলেন চলন্ত বিশ্বকোষ; কিন্তু তাঁকে তিনি যথার্থভাবে পণ্ডিতই বলবেন, কারণ, মুদ্রিত দরকারি বইগুলিই তখন স্মৃতিধরের ঐতিহ্যবাহী কাজটি করে যাচ্ছে।

বিশেষত ১৫০০ সালের পরেই যেটা সমানভাবে লক্ষ্যণীয় সেটা হল মুদ্রণ কিছু ইমেজ (বাক্‌প্রতিমা/রবীন্দ্রনাথ) ও ধারণার ব্যাপ্তিকে ত্বরাণিত করেছিল। দৃশ্যশিল্প (Visual Art) পৌঁছে যাচ্ছিল নতুন ও বিশাল অংশের মানুষের কাছে। ছাপচিত্র (Engraving) ছিল ফোটোগ্রাফি আবিষ্কারের আগে যে-কোনো শিল্পকর্মের পুনরুৎপাদনের পদ্ধতি (reproducing method)। এই ছাপচিত্রের প্রতিমাচিত্র ও আলংকারিক বিষয়বস্তু এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, একজন শিল্পীর কাছ থেকে অন্যান্য শিল্পীর কাছে ছড়িয়ে পড়ছিল। যেমনভাবে রটরডমের ইরাসমাজের (২) মতো পণ্ডিত ব্যক্তির প্রভাব দ্রুত ছুঁয়ে যাচ্ছিল ইউরোপের প্রায় সব বুদ্ধিজীবিদের বৃত্তগদি, তেমনি মিশেলএঞ্জেলোর কাজের ছাপচিত্র (Engravings) যেমন সিস্তিন চ্যাপেলের সিলিং-এ আয়োজিত নগ্নদেহের ভঙ্গিমাগুলি, তাঁর অতিদূরবর্তী সমসাময়িকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হতে পেরেছিল। তবে লুথারীয় ধর্মের প্রচার সর্বপ্রথম মুদ্রণকে ভয়াবহভাবে জয়ের গন্ধ-সহ বৈপ্লবিক গুরুত্বদান করেছিল, তার ধারণার প্রসারের জন্য। সংস্কারমুখী আন্দোলন প্রচারিত হয়েছিল আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে, মুদ্রণের মতোই দ্রুততায়। তার সাহায্য ছাড়া ওইরকম হওয়া সম্ভব ছিল না। সত্যিই ষোলোশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুদ্রণের ভূমিকা ভবিষ্যতের দ্বৈত ভূমিকার কথা ইঙ্গিত করে: তার আলোকিত করা ও জনশিক্ষার ইচ্ছা এবং বৈপ্লবিক সম্ভবনা ও বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তার হিংস্র বিরোধ। কিন্তু রাষ্ট্রদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও এ ছিল রেডিয়ো ও টেলিভিশনের আবিষ্কারের আগে কাজে লাগানোর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্র।

সেইজন্য মুদ্রণের আবির্ভাবের পরে সেন্সরশিল্প (অনুমোদন) পদ্ধতি চালু হয়েছিল। অথচ মধ্যযুগে এটা খুবই কম চালু ছিল। পড়াশোনাকে গণতন্ত্রী করতে গিয়ে, মুদ্রণব্যবস্থা আধুনিক সেন্সর উৎপাদন করেছিল। যাজক কর্তৃপক্ষ ও নিরপেক্ষপন্থী— দু-পক্ষই পুস্তকগুলি সেন্সর করতেন। কারণ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি রাখতে বইয়ের নিষিদ্ধকরণ ও পুড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হত। ১৪৯২ থেকে ১৫০৩ সালের কার্যকালের মধ্যেকার পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার ১৫০১ সালের একটি বুলেটিনে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে বলছেন। “মুদ্রণ কৌশল” তিনি বলছেন “খুবই প্রয়োজনীয়, যতক্ষণ সেটা প্রয়োজনের ও রুচির বইয়ের প্রসার ঘটায়; কিন্তু এটা খুবই ক্ষতিকর হতে পারে যদি একে বিষাক্ত কিছু কাজের ব্যাপ্তি ঘটানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। সেইজন্য মুদ্রকদের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, যাতে তাদেরকে ক্যাথলিক বিশ্বাসবিরোধী মুদ্রিত লেখাগুলিকে আনা থেকে নিরস্ত করা যেতে পারে। অথবা যা বিশ্বাসীদের সমস্যায় ফেলতে পারে এমন লেখাগুলিকে আনা থেকে নিরস্ত করা।” এমন ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে লুথারের ধর্মের সঙ্গে লড়াই করতে কয়েকটি নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায়। এইসব তালিকাই শেষে রোমের নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় (১৫৫৯) পরিণত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের অষ্টম হেনরি ১৫২৬ সালে এরকম একটি ক্যাটালগ প্রকাশ করার আদেশ দিয়েছিলেন। অন্যান্য প্রথম দিকের তালিকাগুলি করেছিল পারি ও লুঁভ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। নিরপেক্ষ শাহজাদারা যখন ধর্মীয় দায়বদ্ধতাকে তাদের মত থেকে শুধু আলাদা মতবিরোধী এবং রাজদ্রোহ বলতেন, সেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ ঠিক ক্যাথলিক বিশপদের মতোই ভাবাবেগের সাথে বিশ্বাসীদের রক্ষা করতেন। ১৫৬০ সাল নাগাদ সবরকমের বইয়ের সেন্সরশিপ সর্বজনীনতা পেয়ে গেছিল পশ্চিম ইউরোপে। একদিকে লেখক মুদ্রক এবং প্রকাশকের লড়াই, অন্য দিকে সরকারি ও যাজক সম্পর্কিত সেন্সর সে-সংগ্রামের একদিকে ছিল। যে-সংগ্রাম ছিল বুদ্ধিগত উদারতার আর বিবেকের স্বাধীনতার। সেই সময়ে যা ছিল মৌলিক ধারণার সংঘর্ষের সময়।

Facebook Comments

পছন্দের বই