লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ভারভারা রাও-এর গদ্য

 ভাষান্তর: তৃপ্তি সান্ত্রা

মহামান্য আদালত,

হেড ইনজুরির রুগী কিন্তু ভিডিয়ো কলে সাড়া দিতে পারবেন না। কোভিড-১৯ এসে বাঁচিয়ে দিল আপনাদের। স্ত্রী, কন্যাকে মুখোমুখি দেখা করার অনুমতি দেবার দায় থেকে বাঁচলেন।

ভিডিয়ো কলে আবছা লাগবে প্রিয় মুখগুলো…

জেলখানায় অসুস্থ কবি বেশ কিছুদিন থেকেই বিভ্রমে আছেন— দেখছেন বাবা, মাকে।

জেলখানায় বন্দী সন্তানরা বুঝি তাদের মায়ের মুখ-ই দেখেন!!

নীচে থাকল ভারভারা রাও-এর ‘CAPTIVE IMAGINATION’-এর মায়ের স্বরূপ (MOTHER IMAGE) অধ্যায়ের আংশিক ভাষান্তর।

মায়ের স্বরূপ (MOTHER IMAGE)

‘আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি রন্ধ্রে রয়েছে মহিয়সী মাতৃমূর্তির দ্বৈত সত্তা’
— ঋত্বিক ঘটক

ঘাতক মেঘ
বিচারের গলা চেপে ধরলে
রক্ত হয় স্রোতহীন
বৃষ্টি নামে না চোখে
বিদ্যুৎ বজ্র হয়ে যায়
বৃষ্টিফোঁটা আঁধি
জেলের গরাদের বাইরে দাঁড়িয়ে
মা চোখ মুছলে
কবির গাথাকাব্য
প্রলেপ হয়ে ছুটে যায়
সে-ক্ষতের দিকে…

এই লাইনগুলো লিখেছিলাম বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন মোলায়েজের মৃত্যুর পর। দক্ষিণ আফ্রিকার কবি, স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা বেঞ্জামিনকে ফাঁসি দিয়েছিল বর্ণদ্বেষী বোথা শাসকদল।

লাইনগুলো লিখেছিলাম একটা খবর পড়ে। ফাঁসিতে ঝোলানোর আগের দিন তাঁর মা এসেছিলেন জেলখানায় দেখা করতে। শেষ বিদায় জানিয়ে মা জেল থেকে বেরোলেন বার্তা নিয়ে। জনগণের কাছে ছেলের বার্তা— স্বাধীনতার যুদ্ধ চলবে। যেন থেমে না যায়। সেই মুহূর্তে তিনি মাতৃত্বের, মায়েদের যাবতীয় গুণাবলীর প্রতীক নন। আমার কাছে তিনি শুধু মাত্র— মোলায়েজের মা। সেটাই সব।

মাকে নিয়ে কবিতার বীজ তখনই উপ্ত হয়ে যায়— কাঁথাকানি জড়ানো সদ্যজাত শিশু যেন চোখ মেলছে। আমি তখন জেলের বাইরে।

এক বছর পর, এই লেখাগুলি ছাপার অক্ষরে দেখলাম। নতুন ভাবনা জেগে উঠল। বিস্মিত হলাম। আমাকে আর আমার মাকে নিয়ে তো লিখিনি কিছু!

আর ছ-মাস বাদেই, কবি বালগোপাল, হঠাৎ করেই মা শব্দটির অনুবাদ করল— পৃথিবী মা। বিপ্লব এবং বৈপ্লবিক সংস্কৃতির জন্য মা এবং পৃথিবী মা সমার্থক। আমি লিখলাম,

বাচ্চারা, বিপ্লবের জয়গান গাও
সে-ই তো মা আমাদের…

মানুষ নিজের মায়ের মধ্যে অন্য মায়েদের মূর্তি দেখে। এইভাবেই সব মাকে নিয়ে পৃথিবী মা। আর তাই তাঁদের প্রতিজ্ঞা। তারা মাকে সান্ত্বনা দিতে চায়। এই সান্ত্বনা (জ্যাক লন্ডন অন্য জায়গায় এ নিয়ে যেমন বলেছেন) মায়ের কাছে যত না উপশম, শক্তি ছেলেদের কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি।

কবি দ্রোণাচার্য ঘোষ যেমন বলেছেন:

কেন ভয় পাও মাগো?
আমি চলে গেলে কত ছেলে এসে দাঁড়াবে তোমার পাশে
আমার জন্য তোমার গর্ব হবে মা।

তোমার আঙুল আঁকড়ে ধরতে দাও
আমি বেড়াই আর খেলি
ইশকুলে যাই
তারা গুনি
পড়া শেষ করি
আর আকাশ কালো হবার আগে
তোমার চোখের জলের স্বপ্নকে ছোঁবার জন্য
কান্নাকে ধারালো কিরিচ করি
আমি লড়ব মা
রামধনু থেকে খসে পড়া
সায়কের দ্রুততায়
সাত সমুদ্দুর পেরোব
প্রথম মাটিতে পা ফেলার সময়
যে-আঙুল ধরেছিলাম
সেখানে কি রাখব আলোর ফুলকি?
গরাদের এই পার থেকে
তোমার খালি বুকে পৌঁছাবার জন্য
আমি কি ডাকব— মা– মা–মা
তোমার বুকের গভীর কোটর থেকে
ধ্বনিটির, প্রতিধ্বনি ফিরে আসবে না?

এইভাবে জেলে, নিভৃত কুঠুরিতে, কেউ নেই আমাদের সহায় আশ্রয়। আর এই আবেগ, কারো নজরদারি পর্যন্ত নেই। আমরা শিশু হয়ে যাই।

Facebook Comments

পছন্দের বই