লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

তন্ময় ভট্টাচার্য

বাঁ-হাতে ছুড়ে দেওয়া লেখা

সময় আর দিনকাল— এ-দুই নিয়ে ভারি ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে মনে। অবশ্য দুয়ের মধ্যে ফারাকও কি আছে কোনো? নিজস্ব অবস্থান অনুযায়ী বিচার করি। মনে হয়, এখনকার মতো খারাপ সময় আর আসেনি। নাকি সময় বরাবরই খারাপ, আমি-অবধি এসে পৌঁছোয়নি বলে নিশ্চিন্ত ছিলাম এতদিন?

সমাজের দিকে তাকাই। বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে খারাপ আর কীই বা হতে পারে! ‘আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো’— এই স্পর্ধামাখানো বাক্য বলার সাহসই-বা দেখাতে পারছে কে! চরমতম পরিণতি যা— মৃত্যু— সেই সুন্দরই আজ ওঁৎ পেতে রয়েছে চারপাশে। মৃত্যুচিন্তার শরীর থেকে খসে পড়ছে বহুকল্পিত সৌন্দর্যও। কদর্য ডাক আর তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা— জীবৎকালের হিংস্রতম চোর-পুলিশ খেলার সামনে দাঁড়িয়ে, আর কোন চেতনাই-বা জরুরি হয়ে উঠবে!

যদি সমাজবিচ্ছিন্ন হতাম, কিংবা মারিসীমানার বাইরে নিরাপদ অবস্থান কোনো, সময় ‘কু’ হত না ততখানি। বরং দূর থেকে বিচার করতে পারতাম; কে জানে, হয়তো নিগূঢ় কোনো দর্শনও উঁকি দিত অবরে-সবরে। কিন্তু প্রবলভাবে জড়িয়ে থেকে এটুকু বুঝেছি, পেট আর পিঠ বাঁচানোর লড়াই-এর থেকে কঠিন কিছুই নেই। নিজের ও আত্মস্বজনের পিঠ বাঁচাতে বাঁচাতে, না-পেরে, সর্বাঙ্গে চাবুকদাগ নিয়ে আর যাইহোক, সাহিত্যবিলাস হয় না। তাও এই স্বল্প সময়ে— যখন ধাতস্থ বা অভ্যস্ত হতে অনেক দেরি, চাইছিও না হতে, বরং অসম লড়াইয়ে বার বার হার মানাতে চাইছি মৃত্যুকে। শব্দ খুঁটে-খুঁটে লেখার মন আজ মৃত। তবে মনের সুবিধা এই, উপযুক্ত সঞ্জীবনী ছিটিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলা যায় আবার। দৈহিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই বিকল্প নেই। ফলে, বেঁচে থাকলে, মনকে ফিরিয়ে আনা দুষ্কর হবে না ততটাও। আপাতত এই কেঠো, অপরিকল্পিত ও চলনসই গদ্যেই সময়ের কাছে নতিস্বীকার।

বিপরীতে অন্য চিন্তাও যে উঁকি দিচ্ছে না, তা নয়। এতখানি সীমাবদ্ধ হয়ে গেলাম? বর্তমান ও তার সমস্ত নেতি-কে অতিক্রম করার যে-পথ, তা থেকে পিছলে গেলাম এতখানি! আমারই অবহেলা এর জন্যে দায়ী, সন্দেহ নেই। নিজেকে ভেসে যেতে দিয়েছি, ঝাঁপিয়ে পড়েছি বাইরের কলরোলে। কিন্তু ভয়ংকর এ-বাহিরের সামনে আত্মসমর্পণ না করেই-বা উপায় কী! সমাজ তো বটেই, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে— মৌলিক ‘আমি’-র অস্তিত্বেও যখন ভয় ঢুকে পড়ে, মনে হয়, রেহাই নেই এবার। শিল্প-সাহিত্য সেই স্তর অবধি পৌঁছোতে পারবে না। অন্তত, স্বল্প জীবনকালে এমন সংকট এর আগে দেখিনি আমি। যে-মানুষ নিজের বা অন্যের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, সমস্ত শৈল্পিক সৌকর্য সে ঢেলে দেয় মুহূর্তের ওই ক্রিয়াতেই। কোনো কবিতা-গান তখন অস্ত্র হয়ে আসে না। অস্ত্র হয় না শব্দব্যবহারের অপার্থিব সূক্ষ্মতা। বরং, শিল্পের চোখে যা ‘স্থূল’, সেসবই বাঁচাতে পারে মানুষের প্রাণ।

তাহলে শিল্পের ভূমিকা কী? বার বার খুঁজছি এর উত্তর। মারিতে আক্রান্ত বা মৃত কোনো মানুষকে কেন বাঁচাতে পারল না শিল্প? কেন নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা-উচ্চারণেই থেমে গেল তার দৌড়?
উত্তর দিয়েছে শিল্প নিজেই। মনের সঙ্গে কারসাজি তার। এবং, মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেটুকু শরীর, তার সঙ্গে। শরীরের শরীর সে ভেদ করতে পারে না। ভাইরাস পারে।

এবং, এতদিনকার আলোড়িত সেই কথাই প্রতিধ্বনিত হল আবার। সামান্য ভাইরাসের কাছে আমাদের চর্চা কৃষ্টি বোধ সূক্ষ্মতা সব অসহায়। ফলে, যে-অস্ত্র অবশ্যম্ভাবী, তাকেই তুলে নিতে হত। আর এই লেখা? থেকে যাক সময়ের অভিশাপ হয়েই। এর বেশি কোনো ভূমিকাই নেই এর। দুঃসময় কাটলে, হয়তো ফিরে পড়ব। অস্তিত্বের চরমতম সংকটে, না, কবিতা পাশে এসে দাঁড়ায়নি। দাঁড়িয়েছিল চিকিৎসা। বন্ধু। ‘বন্ধুর কবিতা থেকে আমাকে আবার দেখা যায়।’ এই মারিকালে, বেঁচে থাকার চেয়ে বড়ো কবিতা আর নেই। ‘জীবন’ নামের সেই কবিতাই প্রতিফলিত করছে আমাকে-তোমাকে। বেঁচে থাকা দেখতে পাচ্ছি আমি। তোমার মধ্যে। আয়নায়। লিখে-ফেলা এই অসংলগ্নতায়।

মনে পড়ে চাঁদ সওদাগরের কথা। অনিচ্ছুক হয়েও মনসার পূজা। বাঁ-হাতে ছুড়ে দিয়েছিলেন ফুল। পরিবর্তে, ফিরে পেলেন বাণিজ্যতরী। আমার এ-লেখাও তেমনই, বাঁ-হাতে ছুড়ে দেওয়া। যতই তাৎক্ষণিক হোক, না-লিখে উপায় নেই। অধরা রইল নীরস তরুবরও। কিন্তু শুষ্কং কাষ্ঠং থেকে যাওয়ার সামর্থ্যটুকু ছিনিয়ে নিতে পারবে না কেউ।

বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, আবার স্বাভাবিক হবে সব। ফিরে পাব আগেকার ডুব। কোনো-না-কোনো মুহূর্তে, কারো কবিতা পড়ে আফশোস জন্মাবে আবার। মনে হবে, যদি লিখতে পারতাম এমনটি। বেঁচে থাকা সেই অতৃপ্তি উপভোগের জন্যেই। জীবন— কবিতা— এক-একটা হাতছানির নাম। সমুদ্রের বুকে বাড়তে থাকা ঘূর্ণিঝড়ের মতো। ডাঙায় আছড়ে পড়বে, ধ্বংসও আনবে; তবু না-পড়া অবধি, শান্তি নেই, শান্তি নেই তার…

Facebook Comments

পছন্দের বই