লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

অনিন্দ্য রায়

জাপানি কবিতার কয়েকটি ফর্ম

হাইকু
(Haiku)

ধ্রুপদী জাপানি কবিতা হাইকু।

তিনটি পর্বে রচিত এই কবিতা, পর্বগুলির মাত্রাসংখ্যা যথাক্রমে ৫, ৭ ও ৫ (মোট ১৭) ‘অন’। অন হল জাপানি ধ্বনি-একক, Mora বা ‘কলা’-র সমতুল্য।

জাপানে পরম্পরাগতভাবে একটি উল্লম্ব পঙ্ক্তিতে হাইকু লেখার রীতিই স্বীকৃত। ইংরেজি ও অন্য ভাষায় তিন লাইনের হাইকু লেখার চল দেখা যায়, মাত্রাগণনায় কলা-র বদলে কেউ কেউ ব্যবহার করেন ৫-৭-৫ ‘দল’ (Syllable)।

কোনো দৃশ্য, যা আমাদের চেতনায় মূহূর্তে উদ্ভাসিত করে সত্যকে, প্রণোদিত করে হাইকুকে। হাইকু-মুহূর্তই এই হ্রস্বকবিতার প্রাণ, স্বল্প উচারণে প্রকৃতির দু-টি ছবির কাব্যিক প্রকাশে তা ফুটে ওঠে। ছবিদুটো জোড়া থাকে ‘কিরেজি’ দিয়ে; কিরেজিকে বলা যায় ছেদশব্দ, তা ছবিদুটোর ভেতর সমান্তরাল-ভাব বা জাক্সটাপজিশন তৈরি করে। হাইকুর অপরিহার্য অংশ হল কিরেজি; আর একটি ‘কিগো’। কিগো হল ঋতু-সম্পর্কিত শব্দ, যা নেওয়া হয় ‘সাইজিকি’ বা কিগো-অভিধান থেকে।হাইকুতে একটি কিগো থাকবেই।

হাইকুতে সাধারণত থাকে না কোনো মানুষের কথা, মানবিক ক্রিয়াকর্মের বিষয়। পরম্পরাগত জাপানি হাইকুতে থাকে না কোনো যতিচিহ্ন, অন্ত্যমিল, রূপক, চিত্রকল্প বা অন্য কোনো অলংকার। শুধু প্রকৃতির দু-টি ছবি আর তাদের অন্তর্গত অভিঘাতে জন্ম-নেওয়া বোধ— এই হল হাইকু।

হাইকু তাই ঋতুর কবিতা, প্রকৃতির কবিতা, মুহূর্তের কবিতা, সত্যের কবিতা। জেন ধর্মবিশ্বাস ও যাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক এর। গুরুত্বপূর্ণ হাইকুকাররা এই ধর্মাবলম্বী।

জাপানি কবিতা ‘রেঙ্গা’-র প্রারম্ভিক স্তবক ‘হোক্কু’-র থেকে এর জন্ম। মাসাওকা সিকি (১৮৬৭খ্রিস্টাব্দ-১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) এই আঙ্গিকের হাইকু নামটি দেন। মাৎসুও বাসো (১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ-১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ), ইয়োসা বুসান (১৭১৬ খ্রিস্টাব্দ-১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ), কোবায়াসি ইসা (১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ-১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ) ও সিকি-কে শ্রেষ্ঠ হাইকুকার হিসেবে গণ্য করা হয়। হাইকু লিখেছেন অজস্র কবি, লেখা হয়েছে অসংখ্য তিন-পর্বের আলোকিত শব্দসুষমা।

আমাদের সঙ্গে এই আঙ্গিকের পরিচয় করান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ)। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাপান ভ্রমণকালে তিনি এর সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং ‘জাপানযাত্রী’ (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে এর সম্পর্কে লেখেন, সঙ্গে বাসোর দু-টি হাইকুর অনুবাদ:

পুরোনো পুকুর,
ব্যাঙের লাফ,
জলের শব্দ।

এবং

পচা ডাল,
একটা কাক,
শরৎকাল।

বিশ্বকবি অবশ্য এই লেখাগুলিকে ‘হাইকু’ না, ‘তিন লাইনের কাব্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলা হাইকুর প্রথম বই সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র-এর ‘জাপানী ঝিনুক’ (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ)। বাংলা ভাষায় হাইকুচর্চার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। নানা কবি লিখেছেন নানা সময়ে। সবক্ষেত্রে যে হাইকুর নিয়মবিধি ঠিকঠাক পালিত হয়েছে এমন নয়।

তবে বাংলাতে নিয়মনিষ্ঠ হাইকুও আমরা পাই:

মাতাল চাঁদ
নিশার দারোয়ান
দাঁতাল শীত
(মুজিব মেহদী)

হাইকুকে বাংলা ভাষার উপযোগী করে মুজিব মেহদী (১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ- ) ‘বাইকু’ ফর্মটি তৈরি করেছেন। তাঁর লেখা:

বাগানে ভর্তি হলাম পাখিদের ক্লাসে
শিখছি পাতা কাঁপানো ও ফুল ফোটানো
এখনো অনেক দূরে পাতাঝরা দিন
(বাইকুসহায়/৪৯)

বাংলা হাইকু বা বাইকু তিন লাইনের কবিতা, কিন্তু কাঠামোগতভাবে মুক্ত, অর্থাৎ, কলাবৃত্তে ৫-৭-৫ রীতির অনুসারী নয়; এটি মুক্তক হাইকু হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

সারা পৃথিবীর কবিরাই মেতেছেন হাইকুর সৌব্দর্যে। হাইকু থকে জন্ম নিয়েছে আরও নানা ফর্ম। বিষয়ের দিক থেকেও হাইকু এখন অনেক বেশি প্রসারিত ও মানবিক।

হাইবুন
(Haibun)

সম্মিলিত গদ্য আর কবিতার একটি ফর্ম হাইবুন। এর জন্ম জাপানে। প্রথমে থাকে গদ্যটি, যা হতে পারে ভ্রমণকথা, দিনপঞ্জি, আত্মজীবনী, নিবন্ধ, গদ্যকবিতা— এইরকম কিছু। আর তার পরে থাকে একটি হাইকু।

১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে মাৎসুও বাসো (১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ-১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর শিষ্য কোরাই-কে লেখা একটি চিঠিতে হাইবুন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। বাসোর ‘গভীর উত্তরের দংকীর্ণ পথ’ (ওকু নো হোসোমচি) বইতে আমরা বেশ কিছু হাইবুন পাই। তা থেকে:

নাতোরি নদী পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম সেন্দাই-তে। সেই সময়ে তো লোকজন ঘরের চালের নীচে নীল আইরিশ টাঙিয়ে রাখে। একটা সরাইখানা খুঁজে নিয়ে কাটিয়েছিলাম চারপাঁচটা দিন।
কিমোন নামে এক আঁকিয়ে থাকত শহরটায়। তাঁর নিখাদ শিল্পবোধের ব্যাপারে শুনেছিলাম, আলাপও হল। কবিতায় উল্লেখিত জায়গাগুলোর খোঁজে তিনি অনেকগুলো বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন, বলেছিলেন আমাকে। সে সব ঠিকঠাক চিনতে পারা বেশ কঠিন। একদিন আমাদের নিয়ে গেলেন তেমনই কিছু জায়গা দেখাতে। ক্লোভারের ঝোপে ভরা মিয়াগিনো-র মাঠ; ভাবলাম, শরতে দেখতে কেমন হবে। তখন তো তামাদা, ইয়োকোনো, সুৎসুজি-গা-ওকা-র চারপাশে পিয়েরিসের ফুল। আমরা গেলাম এক পাইনবনের ভেতর দিয়ে, এত ঘন যে সূর্যের আলো একদমই ঢুকতে পারে না। নাম জানলাম, কোনোসিতা [গাছের তলা]। শিশির এখানে বহুকাল থেকেই পুরু খুব, একটি কবিতায় ভৃত্য তার মনিবকে বলছে, খড়ের টুপি নেওয়ার কথা। দিন শেষ হওয়ার আগে ইয়াকুসিদো আর তেনজিনের মঠে প্রার্থনা করলাম আমরা।

আসার সময় কিমোন আমদের মাৎসুসিমা, সিওগামা আর স্থানীয় কিছু জায়গার স্কেচ উপহার দিলেন। আর দিলেন ঘন আইরিশ-নীল ফিতেওলা দু-জোড়া খড়ের চটি। এই সব উপহার থেকেই বোঝা যায়, একজন মানুষের রুচি কতটা সমৃদ্ধ।

পায়ে বেঁধেছি
আইরিশের ফুল—
চটির ফিতে

পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য হাইবুন লিখেছেন ইয়োসা বুসোন, কোবায়াশি ইসা, মাসাউকা সিকি প্রমুখেরা।

জাপানের বাইরেও হাইবুনের চর্চা আমরা দেখতে পাই। আমেরিকান কবিজেমস মেরিল (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ-১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর ‘অন্তরের স্থান’ (The Inner Room)-এর ‘প্রস্থানের গদ্য’ (Prose to Departure) প্রথম দিকের ইংরেজি হাইবুনের একটি উদাহরণ।

বাংলাতেও সম্প্রতি আমরা হাইবুন নিয়ে উৎসাহ দেখতে পাচ্ছি।

সেনরু
(Senryu)

৫-৭-৫-এর আর একটি জাপানি কবিতার ফর্ম সেনরু। হাইকুর মতো মাত্রাগঠন হলেও সেনরু হাইকু থেকে আলাদা।

হাইকুর মতো কিরেজি (ছেদ-শব্দ) ও কিগো (ঋতুগত শব্দ) থাকে না এতে।

হাইকুর বিষয় প্রকৃতি, মানুষ স্থান পায় না।

সেনরু মানুষের কথা নিয়েই, বলা যায় ‘মানবিক হাইকু’। মনুষ্যচরিত্রের অসংগতি এখানে উপজীব্য।

হাইকুর প্রশান্তি, গাম্ভীর্য থাকে না সেনরুতে। বরং স্থূল রসিকতা লেখা হয় তির্যক ভঙ্গিতে।

কারাই হাচিমন (১৭১৮ খ্রিস্টাব্দ-১৭৯০ খ্রিস্টাব্দ, ছদ্মনাম সেনরু, কারাই সেনরু নামেও পরিচিত) এইরকম হাস্যরস আর বিদ্রুপাত্মক ছোটো কবিতাগুলির সংকলন ‘হাইফুইয়ানাগিদারু’ প্রকাশ করেন যা সে সময়ে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সেনরু ও অন্য সম্পাদকেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধ্রুপদী হাইকু আর পাঠকের মন ভোলাতে পারছে না, মানবিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে একটু মজার কবিতা হিসেবে সেনরু পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়।

কারাই সেনরু-র সংকলন থেকে একটি সেনরু:

ধরেছি যাকে
ডাকাত ভেবে এ কী
খোকা আমার

হাইকুর মতো বিষয় ও উপস্থনা নিয়ে নিয়মের নিগড় নেই এতে, ছন্দকাঠামো মেনে অনেকটা উন্মুক্ত মনে এই ধারায় পৃথিবীর নানা ভাষার কবিরা লিখে চলেছেন। এবং এই ধারাটি আজ যথেষ্টই জনপ্রিয়।

বাংলাতেও সেনরু লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। স্বল্প কথায় শাণিত বিদ্রূপে এই ফর্ম বাংলা কাব্যজগতে বেশ মানিয়ে যায়।

নাটক শেষ
মৃত সৈনিকটি
শুয়েই আছে

বা

ভাজা মাছটি
উলটে খেয়ে নেয়
ভেজা বেড়াল

কাতাউতা
(Katauta)

জাপানি কবিতার আর একটি ফর্ম কাতাউতা, তিন পর্বে রচিত, পর্বগুলির মাত্রাবিন্যাস ৫-৭-৫ অন; কখনো ৫-৭-৭ অনেও লেখা হয়েছে এই কবিতা।

কাতাউতা প্রেমের কবিতা, প্রিয়জনের উদ্দেশে লেখা, অন্ত্যমিলহীন।

ওঠো, ও প্রেম
ঘৃণার ঢেউ থেকে
না রবে বিছানাতে?

অষ্টম শতাব্দীর পর থেকে এই ফর্মের ব্যবহার বিরল। সম্প্রতি নানা ভাষায় নতুন করে এর চর্চা লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাতেও প্রেমের অনুকবিতা হিসেবে এই ফর্ম গৃহীত হতে পারে:

চোখের জলে
শেষ হয় না নুন
সাগর তোমার কে?

কাতাউতাকে বলা হয় ‘অর্ধেক কবিতা’, পরপর দু-টি কাতাউতা মিলে তৈরি হয় সেদোকা।

সেদোকা
(Sedoka)

সেদোকা দু-টি কাতাউতার সমষ্টি। মাত্রাবিন্যাস ৫-৭-৭-৫-৭-৭। সাধারণত অন্ত্যমিল থাকে না। প্রথম তিন লাইনে একটি দৃশ্য বর্ণিত হয় আর পরের তিন লাইনে অন্য প্রেক্ষিত থেকে দেখা হয় দৃশ্যটিকে। দু-টি অংশের মধ্যে একটি শাণিত ছেদ থাকে আর অংশদুটো স্বতন্ত্র কবিতা হিসেবে পড়া যায়। কখনো তা সংলাপধর্মী, প্রথম অংশে প্রশ্ন, উত্তর পরে।

একে ‘শীর্ষ-পুনরাবৃত্তির কবিতা’ও বলা হয়।

জাপানি কবি কাকিনোমোতো নো হিতোমারো (৬৬২ খ্রিস্টাব্দ-৭০৮ বা ৭১০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর সেদোকাগুলির জন্য খ্যাত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছন্দ’ বইয়ের ‘সম্পূরণ’ অংশে বলেছেন সেদোকার বিষয়ে, আছে একটি উদাহরণও:

সাগরতীরে
শোণিত-মেঘে হল
নিশীথ অবসান
পুবের পাখি
পূরব মহিমারে
শুনায় জয়গান

অন্ত্যমিল আছে। আর সে-বিষয়ে কবিগুরুর মন্তব্য, “বাঙালি পাঠকের অভ্যাসের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া নিজের অনুকৃতিগুলির মধ্যে একটু মিলের আভাস রাখা গেছে।”

অষ্টম শতাব্দীর জাপানি কাব্যসঞ্চয়ন ‘মানিওশু’-তে কাতাউতা-র দেখা মেলে। পরবর্তীতে এর চর্চা প্রায় বিলোপ পায়। ছয় লাইনে, তিন-তিন দুই স্তবকে, মোট ৩৮ মাত্রায় (৫-৭-৭-৫-৭-৭) সেদোকা লেখার প্রয়াস ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ভাষায়।

এর সৌন্দর্য বাংলা ভাষাতেও ফুটে উঠতে পারে:

এক শেয়াল
গোধূলির উঠোন
পেরিয়ে গেল ছুটে

বোঝা গেল না
সেইদিকে খাবার
না পেছনে খাদক

মনদো
(Mondo)

আর একটি জাপানি ফর্ম মনদো।

জেন ধর্মানুশীলন থেকে এর উৎপত্তি। লেখা হয় দু-টি তিন লাইনের স্তবকে।

প্রথম স্তবকে প্রশ্ন, উত্তর পরেরটিতে। মত্রাবিন্যাস ৫-৭-৭-৫-৭-৭ অন, বা কখনো ৫-৭-৫-৫৭-৫ অন।

সাধারণত দু-জন কবি লেখেন একটি একটি করে স্তবক।

সংলাপমূলক কবিতা হিসেবে বাংলায় এর ব্যবহার আমরা আশা করতে পারি।

মেঘ তো কালো
বৃষ্টিফোঁটা কেন
এমন ধবধবে?

মাটির দিকে
যা কিছু নেমে আসে
বাড়তি ঝেড়ে ফেলে

তনকা
(Tanka)

পরম্পরাগত জাপানি কবিতা আর একটি ফর্ম ‘তনকা’-র পাঁচটি পর্ব লেখা হয় যথাক্রমে ৫-৭-৫-৭-৭ অন মাত্রাবিন্যাসে। অনুবাদে, জাপানি ছাড়া অন্য ভাষায় পাঁচটি লাইনে প্রকাশিত হয় তনকা। ওপরের ৫-৭-৫-এর অংশটিকে বলা হয় ‘কামি-নো-কু’ আর নীচের ৭-৭-এর অংশটিকে ‘সিমো-নো-কু’।

মনিওশু-তে দীর্ঘ কবিতাকে চোকা আর হ্রস্ব কবিতাকে তনকা বলা হত। পরবর্তীতে সাধারণভাবে হ্রস্ব কবিতাকে ‘ওয়াকা’ বলা শুরু হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জাপানি কবি মাসাওকা সিকি (১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ-১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) তনকা সম্পর্কিত ধারণার পুনর্মূল্যায়ণ করেন।

সিকির লেখা:

সেই লোকটি
মুকুরে হত দেখা
আর সে নেই
নষ্ট মুখ দেখি
অশ্রু ঝরে যায়

তাকুবোকু ইসিকায়া (১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ)-র লেখা একটি তনকা:

পুব সাগরে
ছোট্ট এক দ্বীপে
সাদা বালিতে
অশ্রুভেজা মুখে
খেলি কাঁকড়া নিয়ে

বাংলা তনকাচর্চাও আমরা লক্ষ করছি বেশ কিছুদিন। তা লেখা হয় পাঁচ পঙ্‌ক্তিতে, পর্বের চরিত্র বজায় রেখে।

হাসির মাঝে
একটু করে থামি
আর দম নি’
নীরবতার ফাঁকে
কান্নাকে লুকোই

সমনকা
(Somonka)

জাপানি কবিতার আরেকটি ফর্ম সমনকা। দু-টি তনকা নিয়ে রচিত হয় সমনকা।

সমনকায় তনকাদুটোর কেন্দ্রীয় ভাবনা প্রেম আর তা লেখা হয় প্রেমিক-প্রেমিকাদের কথোপকথনের চালে, প্রথমটির যে-বক্তব্য তার প্রতক্রিয়া থাকে দ্বিতিয়টিতে। নরনারীর প্রেম ছাড়াও অন্য সম্পর্কভাবনায় এই শৈলীর কবিতা পাওয়া যায়।

এতে শিরোনাম থাকে, অন্ত্যমিল থাকে না। দু-জন কবি মিলে একটি সমনকা লেখেন।

ফর্মটি বেশ পুরোনো, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত সমনকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

৭০০ খিস্টাব্দের আশেপাশে মিকাতো নো সামি ও তাঁর স্ত্রীর রচিত একটি সমনকা:

বাঁধো, শিথিল
না বাঁধলে দীর্ঘ
প্রিয়ার চুল
দেখি না আজকাল
বেঁধে রেখেছে সে কি?

বলে সবাই
এমন লম্বা যে
বাঁধাই ভালো
যেটুকু দেখো তুমি
খোঁপায় জড়িয়েছি

সমকালীন বাংলা প্রেমের কবিতায় এই কবিতার আবেদন হয়ে উঠতে পারে চিত্তাকর্ষক। আর দুই কবি, প্রেমিক-প্রেমিকা যদি লেখেন একটি একটি করে স্তবক, তাহলে তো কথাই নেই:

মেঘের গায়ে
কার সে স্বাক্ষর
ফুটে উঠল
এমন আঁকাবাঁকা
চিনতে পারছ কি?

তা আমারই তো
তোমার ছোঁয়া লেগে
জ্বলেছে হাত
আর সে বিদ্যুতে
আঙুল গেছে কেঁপে

চোকা
(Choka)

পরম্পরাগত জাপানি কবিতার ফর্ম চোকা। লেখা হয় পর্যায়ক্রমে ৫-৭-৫-৭ অনে। শেষে থাকে ৫-৫-৭-এর একটি পর্ব। ‘মানিওশু’তে সংকলিত এই চোকাটির রচয়িতা কবি ইয়ামানোউ নো অকুরা (৬৬০? খ্রিস্টাব্দ-৭৭৩? খ্রিস্টাব্দ):

তরমুজ তো
খেলেই মনে পড়ে
বাচ্চাদের,
আরও মনখারাপ
বাদাম খেলে,
ভাবনাগুলো আসে
কোত্থেকে যে?
রাতের পরে রাত
ঘুম আসে না চোখে।

এই চোকাটির পরে আছে অকুরারই লেখা একটি তনকা যাকে হানকা বা অনুকথন বলতে পারি:

দাম কত হে
কণক, রূপা, হীরে?
অমূল্য না,
সন্তানের সাথে
তুলনীয় তো নয়

রবীন্দ্রনথ ঠাকুরের ‘ছন্দ’ বইয়ের ‘সম্পূরণ’ আমরা একটি চোকা পাই:

সাহসী বীর
দেখেছি কত অরি
করেছে জয়।
দেখিনি তমাসম
এমন ধীর—
জয়ের ধ্বজা ধরি
স্তবধ হয়ে রয় ।।

দোদোইৎসু
(Dodoitsu)

৭-৭-৭-৫ মাত্রাবিন্যাসের জাপানি কবিতা দোদোইসু। বিষয় প্রেম বা মানবিক ব্যাপার-স্যাপার। ভাবনার একটি মোচড় থাকে সাধারণত।

অনুবাদে একটি:

যখন রেগে যাই
নাড়াই পেয়ালাটি
নড়ে চোখের জল
দীর্ঘশ্বাস?

এদো (১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ-১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) কালখণ্ডের শেষ দিকে এর উদ্ভব। মনে করা হয় জাপানি লোকসংগীত থেকে বিকশিত এই ফর্মটি।

জাপানি ছাড়াও অন্য ভাষার কবিরা এই আঙ্গিক নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। বাংলাতেও এর সম্ভাবনা নিয়ে আমরা সচেষ্ট হতে পারি:

তোমার প্রতিটি না
সম্মতির কাছে
চোখ বন্ধ করে
দাঁড়িয়ে থাকে

বুসোকুসেকিকা
(Bussokuseki)

জাপানের নারা শহরের ইয়াকুসি মন্দিরে সুপরিচিত স্তম্ভ বুসোকুসেকি-কাহি। সেখানে রয়েছে একুশটি কবিতা খোদিত ‘বুদ্ধের পদচ্ছাপ’। কবিতাগুলি ৫-৭-৫-৭-৭-৭ মাত্রার, বুদ্ধের গুণগান, জীবনের অনিত্যতা ও বৌদ্ধমতের প্রচার সংক্রান্ত।

২০ সংখ্যক রচনাটি:

ঝোড়ো আকাশে
ক্ষণিক বিদ্যুৎ
এই শরীরে
মৃত্যুমহারাজ
দাঁড়িয়ে চিরকাল
কাঁপব না কি ভয়ে?

ইয়াকুসি মন্দির স্থাপিত হয় ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে, কবিতাগুলি রচনাকাল তার আশেপাশে। এই মন্দির ছাড়া কয়েকটি সংকলনে আমরা এই জাতীয় কবিতা দেখতে পাই। একে বলা যায় ওয়াকার আদিরূপ।

জাপ্পাই
(Zappai)

হাইকুর কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে আমরা জানি, কিন্তু তার বাইরে, সতেরো অন-মাত্রার অন্য কবিতাও আমরা দেখলাম। সতেরো অনের যে-সব কবিতা হাইকুর প্রকৃত নিয়মনিষ্ঠ ও কারুকৃতির চরিত্রের সাথে মানায় না তারাই হল জাপ্পাই। জাপ্পাইয়ের ঐতিহ্যও সমৃদ্ধ, এটি একটি স্বতন্ত্র আঙ্গিক; হাইকু লেখার ব্যর্থ প্রয়াস থেকে যে জাপ্পাই নয়, বুঝতে পারা যায়। আবার তা সবসময় সেনরুর মতো বিদ্রূপাত্মক হয় না।

৫-৭-৫ মাত্রার সঙ্গে ৭-৭-এও লেখা হয় জাপ্পাই।

অলসভাবে
শুনি ভোরবৃষ্টি
সেই মাঝির
(মিসাতোকেন)

চোখ-মু-কান নাই
বউ সৎমা বেশ
(ইসায়িতা ইয়ুমিকো)

বাংলায় হাইকু হিসেবে লেখা অনেক কবিতাই এই শ্রেণির। আবার সতেরো মাত্রার বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রেখে তিন লাইনে লেখা কবিতা হিসেবে জাপ্পাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মন ও মন
আয়নার দুপাশে
ছুঁতে পারে না

সিনতাইসি
(Shintaishi)

জাপানি ভাষায় ‘সিনতাইসি’ শব্দটির অর্থ ‘নব আঙ্গিকের কবিতা’; হাইকু, তনকার মতো পরম্পরাগত জাপানি কবিতার মাত্রাবিন্যাস ও আঙ্গিকের বাইরে লেখা এই কবিতাকে, বলা যেতে পারে মুক্ত কবিতা। উদীয়মান সূর্যের দেশে ‘মেজি’ (১৮৬৮ খৃস্টাব্দ-১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ) যুগে ‘আধুনিক’ অনুভূতিকে প্রকাশের তাগিদে এর উদ্ভব।

সিনতাইসি ধ্রুপদী জাপানি ভাষায় লিখিত। ওচিয়াই নাওবুমি ( ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) এই রীতির উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর লেখা ‘কোজো সিরাগিকু নো উতা’ (সাদা তারাফুল/White Aster) কাব্যকে এর প্রারম্ভিক উদাহরণ ধরা হয়।

শুরুর লাইনগুলি:

আসো পর্বতের এক জনমানবশূন্য দূর গ্রামে সূর্য অস্ত যাচ্ছে
আর ক্রন্দনরত পাখিরা পড়ছে ঘুমিয়ে
বৃষ্টির জলে-ভেজা কয়েকটি নীচু গাছ; শোনা যাচ্ছে দূরের মন্দিরের ঘণ্টা
একটি বাড়ির দুয়ারে বছর চোদ্দর এক মেয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে
বাবা গেছেন পশুশিকারে
সে খুবই ছোট্ট, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে পড়ে সুন্দর এক ফুলের কথা
হাওয়ায় এলোমেলো তার চুল, বাবার চিন্তায় বেশ কয়েকদিন ঘুম হয়নি তার

এই মেয়েটির কাহিনিই এই ‘সাদা তারাফুল’-এর বিষয়।

Facebook Comments

পছন্দের বই