অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর
পঞ্চম পর্ব
গওহরজান: এক সুরেলা অধ্যায়
তখন রাত প্রায় ৯টা হবে। ফাল্গুনের হালকা হিমেল আমেজ তখনও রয়ে গেছে। কলকাতার ব্যস্ত চিৎপুর রোড আস্তে আস্তে নীরব হতে শুরু করেছে। রাস্তার দু-পাশের গ্যাসের টিমটিমে আলো ও রাতের আঁধার মিলে পরিবেশকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। কয়েকজন মাতাল মানুষের আনাগোনা, সওয়ারীর অপেক্ষায় থাকা ছ্যাঁকড়া গাড়ির কোচয়ান, বেলফুলের মালা ও কুলফিমালাই বরফ বিক্রেতা দু-চারজন ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে সওদার আশায়।
এমন সময় চার ঘুড়ির এক ফিটন গাড়িকে দেখা গেল নাখোদা মসজিদের পাশের বাড়ি ‘সেলিম মঞ্জিল’ থেকে বেড়িয়ে সোজা চিৎপুর রোড ধরে এগিয়ে আসতে। গাড়ির কোচম্যান সজোরে হাঁক দিচ্ছে, ‘তফাত যাও’। গাড়ির কিংখাবের পর্দার আড়ালে দেখা যাচ্ছে সলমা চুমকি ও জরির কাজকরা পোশাক পরিহিতা এক রমণীকে। সর্বাঙ্গে হিরে জহরতের অলংকারের ঝিলিক। গাড়িটি চলে যাবার পরেও আশপাশের বাতাসে আতরের হালকা খোশবু যেন ভেসে বেড়াচ্ছে।
ফিটন গাড়িটা কিছুক্ষণ চলার পরে পাথুরিয়াঘাটার জমিদার ঘোষেদের বাড়ির মূল ফটক দিয়ে ধীরে ধীরে অন্দরে প্রবেশ করল। ঘোষবাবুদের বাড়িতে আজ ম্যহফিল বসেছে। সংগীত জগতের দিকপাল ব্যক্তিত্বরা সব এসেছেন ম্যহফিলে আমন্ত্রণ পেয়ে। কাটগ্লাসের ঝাড়বাতি মোমের আলোয় ঝিকিয়ে উঠেছে। দেওয়ালে বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় তার প্রতিফলন কক্ষের শোভা আরও বৃদ্ধি করেছে। সুদৃশ্য, পুরু ও নরম পারস্যদেশীয় গালিচায় মোড়া ঘরের মেঝে। সাথে হেলান দিয়ে বসার জন্য তাকিয়া রয়েছে। পরিচারকেরা আতরদানি থেকে আতর ছিটাচ্ছে অতিথি অভ্যাগতদের উদ্দেশ্যে।
ফিটন থেকে নেমে সুবেশা মহিলাটি সোজা আসরে উপস্হিত হলেন। শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে একটা গুঞ্জন শোনা গেল। তবলা বাদক তবলা সুরে বেঁধে নিলেন। সারেঙ্গী বাদক তারে ছড় ছোঁয়াতেই সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি হল। সবাইকে যথোচিত অভিবাদন জানিয়ে মুখের উপর থেকে ওড়নার আবরণটি সরিয়ে তিনি খেয়াল গান শুরু করলেন সোহিনী রাগে। সুরেলা, তীক্ষ্ণ অথচ মর্মস্পর্শী কণ্ঠের জাদুকরী ছোঁয়ায় রাগটির স্বরবিস্তার, লয়কারী, কূট তান ও অতি দ্রুত সপাট তান সেরে গানের মুখরায় ফেরা ইত্যাদিতে সবাই মোহিত। খেয়াল শেষে মিশ্র গারা রাগে উনার নিজের সৃষ্ট একটি দাদরা ধরলেন।
“আন বান জিয়া মেঁ লাগি
প্যায়ারি চিত কৌন দিয়া, আন বসি ক্যায়সে ফসিঁ
পদন লাগি ছাব কে পইয়াঁ, মেহেরবান সইয়াঁ
তুম বিন মুঝে কলন পড়ে, তুমহারে কারণ জাগি
আন বান জিয়া মেঁ লাগি”।
সুরের মৌতাতে ম্যহফিল জমজমাট। গান শেষে শ্রোতার মধ্যে ‘এনকোর’, ‘এনকোর’ আওয়াজ, করতালির হররা উঠলো। কেউ কেউ বলে উঠলেন— বহতখুব গওহর জান সাহিবা, বহতখুব।
কিন্তু কে এই গায়িকা গওহর জান? যার জন্য এত বড়ো এক ম্যহফিলের আয়োজন? শোনা যায় আজ থেকে একশো বছরেরও আগে উনাকে প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য ১০০০ টাকা সাম্মানিক দেওয়া হত। তাহলে চলুন আমরা আরও অনেকটা সময় পিছিয়ে যাই তাঁর সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানার জন্য— এলিন এঞ্জেলিনা ইয়োওয়ার্ড থেকে তাঁর গওহর জান হয়ে ওঠার ইতিহাস। সেখানে সুর, তাল, ছন্দ ছাড়াও অনেক সংগ্রাম, বঞ্চনা, অশ্রু ঝরার কাহিনি রয়েছে।
হার্ডি হেমিংস এমন একজন ইংরেজ তরুণ যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে ভারতে (এলাহাবাদ) এসেছিলেন এবং একজন ভদ্র ও সুন্দরী ভারতীয় তরুণীকে (রুক্মিণী) নিজের সহধর্মিনী রূপে গ্রহণ করেন। ধর্মান্তকরণের পর যিনি মিসেস এলিজা হেমিংস নামে পরিচিত হন। তাঁদের দু-টি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। বড়ো মেয়ের নাম ভিক্টোরিয়া হেমিংস ও ছোটোমেয়ের নাম বেলা। সুখ স্বাচ্ছন্দে পরিপূর্ণ সংসারে আচমকা দুঃখ নেমে এল হার্ডির আকস্মিক মৃত্যুতে। এরপর এলিজা একটি শুকনো বরফ কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন। অভাবের কারণে দুই মেয়ের প্রথাগত শিক্ষালাভ হয়নি কিন্তু বড়ো মেয়েটি শৈশব থেকেই ছিল মেধাবী। সে ছিল সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের অধিকারিণী এবং নিজে থেকে ছোটো ছোটো কবিতা রচনা করতে পারত। বেশ কয়েক বছর পরে ওই বরফ কারখানার সুপারভাইজার হয়ে এলেন রবার্ট উইলিয়াম ইয়োওয়ার্ড নামের এক আর্মেনীয় ইঞ্জিনিয়ার। সেই সূত্র ধরে এলিজার সাথে এই তরুণের পরিচয় এবং তাঁর বাড়িতে যাতায়াত। তরুণী ভিক্টোরিয়াকে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হলেন রবার্ট এবং দু-জনের মধ্যে শুরু প্রণয়। ১৮৭২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর এলাহাবাদের হোলি ট্রিনিটি চার্চে এঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়।
১৮৭৩ সালের ২৬শে জুন এঁদের সংসারে আগমন এক অনিন্দ্যসুন্দরী এক কন্যার। ব্যাপটাইজড হবার পরে যাঁর নাম হয় এলিন এঞ্জেলিনা ইয়োওয়ার্ড। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই রবার্ট কর্মসূত্রে অন্যত্র বদলি হন। এই সময়ে একাকিত্বের যন্ত্রণায় ভিক্টোরিয়া আবার কবিতা লেখা শুরু করেন এবং মায়ের অনুমতিক্রমে প্রতিবেশী যোগেশ্বর ভারতীর কাছে গান শিখতে শুরু করেন। কিন্তু রবার্ট ভিক্টোরিয়া ও যোগেশ্বরের এই মেলামেশা সুনজরে দেখেননি যার ফলশ্রুতি হল দু-জনের বিবাহ বিচ্ছেদ। এই ঘটনায় ভিক্টোরিয়া প্রচণ্ড আর্থিক দুরবস্থায় পড়েন এবং তিনি কয়েকটি মেয়েকে গান শেখানো শুরু করেন। এতেও তাঁদের আর্থিক সমস্যার সমাধান হয় না শিশুকন্যা এঞ্জেলিনার অসুস্থতা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।
এমন সময়ে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন স্থানীয় এক মুসলমান ভদ্রলোক খুরশিদ। যিনি ছিলেন অত্যন্ত রুচিবান মানুষ এবং উর্দু কাব্য ও সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। তিনি নিজেও এস্রাজ বাজাতে জানতেন। ভিক্টোরিয়া এই পরিস্থিতিতে কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হন খুরশিদের সাহায্য গ্রহণ করতে। কিন্তু এর জেরে ভিক্টোরিয়ার জীবনে উঠল ঝড়। সমাজের নানা মানুষ এই সম্পর্ক নিয়ে নানান ধরনের কুমন্তব্য করতে শুরু করেন। সেই কারণে ১৮৭৯ সালে ভিক্টোরিয়া তার মেয়ে এঞ্জেলিনা এবং মা এলিজাকে নিয়ে খুরশিদের সাথে আজমগড় ত্যাগ করেন এবং কাছের বড়ো শহর বেনারস চলে যান।
বেনারস ছিল গঙ্গাতীরে অবস্থিত এক শহর যেখানে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থান। ভোরে বিশ্বনাথ মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনির সাথে মসজিদের আজান মিলে যেতো। বেনারস শহর বিখ্যাত ছিল পান, মিষ্টি, বেনারসী শাড়ি, সূক্ষ্ম কাজ করা ব্রোকেডের জিনিস ও পিতলের জিনিসপত্রের জন্য। এছাড়া ছিল সংগীতের এক পীঠস্থান ও বাইজিদের আস্তানা।
এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যেই ভিক্টোরিয়া ও এঞ্জেলিনা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ভিক্টোরিয়ার নাম হলো ‘মালকা’ ও তার মেয়ে এঞ্জেলিনার নাম হলো ‘গওহর’। ফারসিতে গওহর শব্দের অর্থ হল দামি রত্ন। সমাজের চোখে খুরশিদ ও মালকা ছিলেন স্বামী-স্ত্রী ও তাঁদের সন্তান ছিল গওহর। এর সাথেই মৃত্যু ঘটল ভিক্টোরিয়া ও এঞ্জেলিনা নামের পরিচয়ের।
খুরশিদ মালকাকে তার বিষাদগ্রস্ত জীবন থেকে বের করে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করতে লাগলেন এবং মালকার পছন্দের বিষয়ের প্রতি নজর দিতে শুরু করেন। তিনি হুসেন আহমেদ আসগর ও কাদের হুসেনকে নিযুক্ত করেন মালকাকে ফারসি শেখানোর জন্য। হাকিম বন্নো সাহিব ‘হিলাল’ মালকাকে উর্দু শেখানোর দায়িত্ব পেলেন। বেনারসের এক বিখ্যাত শিল্পী জিনাত বিবি পেলেন মালকাকে শাস্ত্রীয় নৃত্যগীত শেখানোর কাজ। এর পরবর্তীতে মালকা কণ্ঠসংগীতের তালিম নিয়েছিলেন বিখ্যাত কালু উস্তাদের কাছে ও শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখেছিলেন লখনউয়ের নৃত্যশিল্পী আলি বক্সের কাছে। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রভাবে এসে মালকা ধীরে ধীরে নিজের বিষাদগ্রস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন। ক্রমেই আশপাশের অঞ্চলের ধনী অথচ সংগীতের পৃষ্ঠপোষক ব্যক্তিদের কাছে তার কবিতা ও নাচ গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং শিল্পী রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেলেন।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)
