লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কুমারেশ তেওয়ারীর গুচ্ছকবিতা

ছুঁচসুতো

সেলাই শেখার পাঠ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। যেখানে যা ছেঁড়াফাটা, শিক্ষানবিসি রাখি। আলোর পর্দার যে ফাটা অংশ দিয়ে ঢুকে আসে অন্ধকার কাল স্রোত হয়ে, সেখানে সেলাই দিই তড়িঘড়ি হাতে।

ছুঁচের ভেতরে সুতো পরাবার কালে দেখি ছিদ্রপথে পরকীয়া, বৃন্দাবন আর বিনোদিনি রাই, গোপন হাঁড়িতে রাঁধে ভাতের সুঘ্রাণ।

বিত্রস্ত আলোকে বিভঙ্গের সামান্য বদল, টেরিকাটা শ্যাম দেয় ফুঁ, এখনও অপাপবিদ্ধ বাঁশিটি, থেকে থেকে মর্মধ্বনি তোলে।

সুতোতে নিদান রেখে সযত্নে ছিদ্রে পরাই। রাই অঙ্গ ছুঁয়ে সুতো শ্যামতনু কেমনে বেড়ায়।

মালী ও ফুল বিষয়ক কবিতা

যে মালী পাহারা দেয় ফুলের বাগান, সে বড়োই স্বভাবে কোমল। যারা ফুল নিয়ে যেতে আসে স্বরে খুব মধু রেখে বলে, ফুলের ভেতরে বড়ো অনুরাগ থাকে, হাত ধুয়ে এসেছো তো বাবু।

তবু ফুল ছেঁড়া হয় কত। মালীটি নির্বাক দেখে, ফুল তোলার সময় কীভাবে বদলে যায় মানুষের চোখ! চোখের ভেতরে কত ভুল অন্ধকার। কারো কারো বর্ণচাপা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে যেন ব্ল্যাকহোলে।

বেণুকাকা ফুল নিতে এলে, মালী তার সাজি ভরে দেয় পরমার্থ ফুলে। দেবতার পায়ে যাবে বলে, ফুলের ভেতরে কীট আনন্দ সাগরে দোলে।

ছুরি

বাড়িতে রাখা ছুরিটি নিয়ে আর ভয় নেই কোনো। জানি বলে ছুরিকে কীভাবে আগলে রাখতে হয়। সকাল ও সন্ধ্যাবেলা প্রতিদিন নিরামিষ মন্ত্রোচ্চারে তার কানে ভরে দিতে হয় ভৈরবী ও সন্ধ্যারাগ।

ছুরিও ভীষণ সহবৎ প্রেমি হয়ে ওঠে দিনদিন। পুজো উপচার দেখে তার অন্তরের তারে খুব টুংটাং বাজে। বোঝে এইবার ফল কাটা হবে, নৈবেদ্য থালায়।

তবু কোনো কোনো দিন ঘটে যায় বিপর্যয়। দেখি ঘরে আনা কাঁচা মাংসের দিকে কী তীব্র হিংসা আর লোলুপ তাকিয়ে ছুরি। যেন ছুটে গিয়ে বিঁধে যাবে মাংস শরীরে।

তৎক্ষণাৎ আড়াল করি মাংস-বিকার। ছুরিকে আদর দিয়ে তার কানে ঢেলে দিতে থাকি কৃষ্ণ-রাই কথা।

আরও কিছুকাল

এসবই তো ছেড়ে চলে যেতে হবে একদিন। ঊষা লগ্নে লগ্নে বয়ে গেলে প্রাণের সংকেত
পাপারাৎজির ক্যামেরাও যখন খুঁজে পাবে না আর স্পন্দনের চিরায়ত মুহূর্তটি। ভেঙে ভেঙে যাবে কার্নিসে ঢেউ আর আয়নার সুরম্য মহল।

শুধু জানালাটি খোলা রাখতে দাও হে প্রভু,
মাছের সাঁতার মেখে কাছে আসা সাত রং
আরও কিছুকাল প্রকৃত লালন দিক।

ঘুমোতে যাবার আগে যেন পায়রাদের ডানা থেকে ঝেড়ে দিতে পারি নক্ষত্র আগুন। নিশ্চিন্তে নিভাতে পারি অস্বস্তি তাড়িত সিন্ধুবিষাদের মুখ

ধারণা

যে কোনো ধারণা মজবুত শেকড় ছড়িয়ে নিলে ভালো। কেননা ধারণা বড়ো পাতলা গড়ন, পলকা ভীষণ। হাওয়া দিলে , উড়ে যেতে পারে নশ্বরের দিকে।

ধারণাকে সাদা কাগজের পিঠে লিখে রাখা প্রয়োজন। আসলে কাগজ হলো বুকের ভেতরে থাকা ফাঁকা শস্যখেত। যার গর্ভে বীজ বিশেষ ছড়ানো হলে ফনফনে উঠে আসে ফসল শরীর। সে ফসল দেখে কত আউলবাউল ঘরে ফিরে আসে। উঠোনে গেরস্ত নাচে বিপুল রঙের।

যে কোনো ধারণা খুব পুজার্থী স্বভাবে। প্রকৃত আধার পেলে কম্পিত পুজোই বসে।

প্রতিবিম্ব

নিজেরই প্রতিবিম্বের কাছে মাঝে মাঝে হাঁটু মুড়ে বসি। আপাদমস্তক দেখি। চুম্বনের নিখুঁত ভঙ্গিমা এঁকে দেখি,প্রতিবিম্ব ঠিকঠাক সাড়া দেয় কিনা। জটিল কুটিল কোনো ভঙ্গিমায় গেলে ভীষণ শিউরে উঠে প্রতিবিম্ব খাড়া করে লোম।

নম্র হাসি হেসে তাকে স্বাভাবিক করি। ছদ্ম ক্রোধ নিয়ে কাছে গেলে হো হো হেসে ওঠে আয়নার আমি। টের পাই মনের ভেতরে চোরাবালি জেগে উঠে টেনে নেই ক্রোধের শরীর।

অন্তর্লোক জেগে ওঠে আমারই এ ঘরের ভেতর

Facebook Comments

পছন্দের বই