লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কৌশিক দাসের কবিতা

শম

সুস্থ হয়ে গেলে হাসপাতালের
কথাগুলো মনে পড়ে।

সবুজ রঙের পর্দা সারদা রঙের
নার্সের পাশে সাবুদানা হয়ে আছে

সেসব তথাগত বিকেলে
শিশু হয়ে পড়ি ক্রমাগত ;

যেভাবে জল তা দেয়— পাথর ভাঙতে ভাঙতে বালি

বলো তুমি আমায় কখনো ফুঃ দিয়ে
উড়িয়ে দেবে না তো আরোগ্য?

অঙ্ক

রাত তখন তিনটে, অঙ্কের মাস্টারমশাই এলেন।

কী সাংঘাতিক সেইসব অঙ্ক;

আমরা কষতে শুরু করলাম পাতার পর পাতা।

একটু ভোরের দিকে; রাফের জায়গাটায় হঠাৎ
জেগে উঠল চর। সেইসঙ্গে আমাদের কলমগুলো সাদা বালিতে ঢেকে গেল;

একটা-দুটো ঘাসের দাগ খাতা জুড়ে।

দূর থেকে একজন কৃষক এসে জানাল
—বসতি গড়ব| আজ থেকে এখানেই চাষ
হবে!

ততক্ষণে অঙ্কের সমস্ত শিরোনাম সামুদ্রিক হাওয়া দখল করে নিয়েছে।

অপেক্ষা

জানলার কাঁচে বঙ্গাব্দের ঘষা লেগে খোলা সিঁদুর কৌটার মতো বৈশাখ প্রথম যেদিন এল
সেদিনই মনে পড়ে গেল আলতা পেষা তোমার একজোড়া পা, সুগন্ধী গোড়ালি!

এখনো তুমি কাঠিতে সুতির-কাপড়-টুকরো পেঁচিয়ে পায়ের গোড়ালিতে আলতাকে বশ করতে শিখলে না?

তাই বারবার বৈশাখ তোমায় দেখতে আসে প্রতিবছর

তার উৎকন্ঠা তুমি কবে বুঝবে?
এবার আর ভুল কোরো না; বিকেলের হাওয়া দিলে জানলা গুলোর ফিতে আলগা করে রেখো…

দেশ

হাসপাতালে শুয়ে আছো

অনেকেই শুয়ে থাকে যেভাবে

একটা রাগ চটা বেড— আড়াই জন মানুষ

কষ্ট কিছুটা ঝুঁকে আছে নীচে

নার্স আসবে— নিজেকে শক্ত করো

সামান্যই তো ইনজেকশন— এতো ভয়!

কিছুক্ষণ আগেই যে গুলি খেলে…

ফুলমনি মাহাতো

ফুলমনি মাহাতোর বুক চিরে মেঘের জন্ম হয়;

সে মেঘ সলজ্জ। শুকনো পাতার জঙ্গলে একা একা হাঁটে— জল’গুলো টুকরো টুকরো হয়

ফুলমনি মাহাতো খুলে ফেলে বাদামি রঙের বুক— কুঁড়িতে ভাঙে জল

ভেতরের মেঘ পড়শির মতো ঘষাঘষি করে
—বজ্রে বজ্রে ফুলমনিও ঘামায়;

ঘষাঘষির দাবানল জঙ্গলকে নিশানা করে—
ভয়ের চোটে বেরতে গিয়ে ফুলমনি নিজেই শেষ হয়!

জল

অভিমানের গাছে জল দাও
অল্প অল্প করে

রাতের অন্ধকারে একই বিছানায়
অথচ দৃশ্যেরা এপাশ ওপাশ হয়

কোলবালিশ— সেও আর কত
বোঝাবে আমাদের?

তবুও ঘুম আসে না;
সারারাত ঘুমের বোতাম খোলা
—ব্লেডের গুঁড়ো অল্প হাওয়ায় মেশে

ঢেলে দেওয়া জলে অভিমান-গাছ
অল্প অল্প করে বেড়ে চলে

কখনো ভেবেছো—
তোমার ওই ঢেলে দেওয়া জলের উৎসমুখ আমার এই চোখ— ভোরের দিকে কীভাবে মৃত্যু লেখে জলের ছোবলে ?

চা’পাতা

এভাবে কথা বোল না— বিরতি রাখো

বিকেলের নরম চা-পাতা আর উষ্ণ
জলের মতো চিনি মেশানো আবহ এখন

দূরে নয়,পাশে এসে বসো— বেতের চেয়ার শান্ত বিকেল হয়ে আছে

আর
পাহাড়ের পাশে নিরীহ নদী ঠোঁটের কামড় খাওয়া চা’পানের আধখানা বিস্কুট

তার পাশে
চিনামাটির কাপ তার শীর্ণ হাতলে যেভাবে নারীকে টানে প্রথমে ধীরে পরে জোড়ালো
সেভাবে চোরাবালি হব নিজস্ব চুমুকে।

সুতরাং
এভাবে কথা বোলো না
—মধ্যযামে বিরতিটুকু রাখো!

অন্নপূর্ণা হেঁসেল

হৃদয় উৎখাত হলে তবুও চলে
ভেতরে ভেতরে জমি জরিপের কাজ

বাড়িটি নেই সেখানে,নেই উঠোনকে শাসন করবার গোবরজল। তবুও ভিটের দাগ আর কালি—
কড়াইয়ের গৃহকাজ কোমরের ওই চাবির গোছায় লেগে আছে

সে গোছা অন্ধকারে একা একা হাঁটে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাড়ির বড়ো বউয়ের মতো

হেজে যাওয়া শূন্যতায় এখনো অন্নপূর্ণা হেঁসেলের গন্ধ পাই আর এই পাঁচফোড়ন— তোমাকে ভাতের আগে সম্মোহনী শিল্পাঞ্চলে নিয়ে যাবে

হৃদয় উৎখাত হলে তবুও চলে
দলা পাকানোর কাজ, বিচালির ঘ্রাণে এক তাল মাটি

বুকের বাম দিক থেকে ডান দিকে তাঁবু পড়ে;
খনন শুরু হয়— বুকের মধ্যে বড়ো বউ রান্নাঘর খুলে পায়সান্ন রাঁধে।

সমতল

তোমাকে যখন জড়িয়ে ধরি
তখন পাহাড়ের কথা মনে পড়ে

শুনতে পাই নাকের সদর দরজা দিয়ে
খুব গোপনে অথচ অস্থির নিশ্বাসের মধ্যে ঘনঘন
পাথর ভাঙার শব্দ

জড়িয়ে ধরবার পরেও
আরও একবার জাপটে ধরলে
লুকিয়ে রাখা ঝর্ণা আমার কাঁধ ভিজিয়ে দেয়

ভিজিয়ে দেওয়া জল গড়াতে গড়াতে
জানি একদিন সমতলে নেমে যাবে

তুমিই বলো জড়িয়ে ধরা ভালোবাসায়
নদীর মধ্যগতি কি ভালো?

Facebook Comments

পছন্দের বই