লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গোলাম রসুলের দশটি কবিতা

পেন্সিলে লেখা ইতিহাস

দরজা দিয়ে বাড়িটা বেরিয়ে গেল আর ফেরেনি

তারপর কেটে গেছে বহুকাল
পেন্সিলে লেখা ইতিহাস

শরীরের কিছু অংশে এখন দিন রাত্রি হয় না
চোখের নদীতেও হারিয়েছে জোয়ার ভাটা

জন্মানোর আগের সেই টান ফিরে যাচ্ছে
উদাসীন বন্ধুত্বের মতো বিলীয়মান
নীল আকাশ
হলুদ হয়ে এসেছে দিগন্ত
যা কখনো দেখিনি আগে
গাঢ় সময়ের ভেতরে আমি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম দু চারটি হাড়

শূন্যতা

দরজা দিয়ে সেই যে বেরিয়ে গেল বাড়িটা আর কখনো ফেরেনি

ঘুম নেই

বৃষ্টিকে আমি অভূতপূর্ব সম্মান জানিয়ে কতদিন ভিজেছিলাম জানি না
আর যে শহরটা ডুবে যাচ্ছে তার ওপর ভাসছে সানাইয়ের সুর
দুহাতে ধরা মহান সমুদ্র

আছাড় মারছে হাওয়া
আর বদমায়েশি করছে আমাদের পোতাশ্রয়গুলো

ঘুম নেই
রাত্রিকে আমি চিনতে পারেনি
কসাইখানা
মানুষের হিংসার লালা স্রাবে স্ট্রিট লাইটের আলোগুলো তৈরী করেছে পরপর দূর্গ

জমে যাওয়া বদ রক্ত এই শহর

পিশাচ সন্ধ্যা নেমেছিল
ধর্মহীন সিঁড়িতে বসে গান গেয়েছিলো আমার হৃদয়
যখন গলিগুলো চরে বেড়াচ্ছিল উদাসীন

বড়ো খারাপ সময়
কলাগাছ রাজনৈতিক দল মনে করিয়ে দিল একবার ঈশ্বরকে

মিছিল চলে গেল
রাস্তায় এখনও ধোওয়া কাচা হচ্ছে আশা

রাজপ্রাসাদ ও কাঁদছে

কাকের দেহ রেখায় অন্ধকার
রাত্রির মধ্যভাগে পেতলের চাঁদ
ঘণ্টা বাজছে হাঁটুর ভেতরে
একটাও হাড় আস্ত নেই

কতদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম মনে নেই

নিরুদ্দেশ

নাভির গভীর থেকে ওঠে এসে শূন্যতা চলেছে নিরুদ্দেশ
আমি হাওয়ার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছি একাকী
আমার জন্ম হারিয়েছে গাছ
আমার কোনো দেশ নেই
কবে আমি মানুষ ছিলাম জানি না
বৃষ্টি পড়ছে ঈগলের চোখ থেকে
ভিজে যাচ্ছে পৃথিবী
দূরে অনন্ত কাল
মৃত্যুর ভিটে বাড়ি
উঠোনে রান্না ঘর
যেখানে সূর্য অস্ত যায়
মাটির দাওয়ায় বসে পাটের দড়ি পাকাচ্ছে ইতিহাস
খাল ধার থেকে নিষিদ্ধ আতরের গন্ধ আসছে
স্থাপিত নারী বংশের ওপর কুয়াশায় ঢাকা দিন রাত্রি

পুঞ্জীভূত ক্ষোভ একটি মেঘের মর্মর মূর্তি

আর দুঃখ একটি শিলালিপি

নৌকার শূন্যতা থেকে ওঠে এসে একটা হাহাকার উড়ে চলেছে নিরুদ্দেশ

বুনো রাত্রি
চরাচরে রাত্রির ভেতরে নৌকার মতো একটা বুনো রাত্রি
বাতি স্তম্ভ চাঁদ নীল শূন্যে ভাসছে
কুয়াশার হাহাকারের মধ্যে প্রাচীন শহরের ভাঙা গড়া
চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না তখনও কীভাবে পানশালার টেবিলে নষ্ট হত ভালোবাসাগুলো
আর সিঁড়ির আকাশে দাঁড়িয়ে মানুষ মাইলের পর মাইল নক্ষত্র গুলোকে স্থাপন করত

বালি ভরা মেঘ
রুক্ষ গাছ
দিগন্তে আমি একা
আমার হাত ব্যাগে বংশ পালা
থেমে দাঁড়িয়ে গাড়িটা হাঁপাচ্ছে
জীবনের ভয় তাকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে আর নিকট ছেড়ে যাচ্ছে দূর

বিড়ির আলো
নিকোটিনের ধোওয়া
হাওয়া খান খান করে আবার সেলাই করা

জানি না মধ্যযুগের একটি গির্জা এখানে ফেলে গেছে কারা
জলের দাগ রয়েছে
নদীর নাম ও আছে
দুঃখ বরাবর আমি হেঁটে গেলাম কিছু নেই
একেবারে এযুগের শেষমাথায় ডাকছে দু-একটি নিশাচর

জানি না কোথায় আমি

বিকেলে কোথায় বসে জানি না
অনেকদূরে আকাশ
দেখার কিছু নেই
তাই ছুঁড়ে দিচ্ছি দীর্ঘ নিঃশ্বাস

হাওয়া অবিকল একটা ভূতের ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে
তীব্র ঠান্ডায় কাঁপছে মাঠের চৌকাঠ
ভেতরে শূন্য মন্দির
একটি ভালোবাসার বিস্মৃতি এখন গাছ

আর কালরাত যে শুধু পুড়েছিল তার চোখের রং লেগে রয়েছে দেওয়ালে

দিগন্তে গায় অনন্ত পারাবার
পথিক নেই

গভীর ভাবনা
ছোট্ট একটি নৌকা
তারপর আর বিশ্বাস নেই

আমার অনুভূতি
ওখানে দেখার কিছু নেই
আমার জন্য শূন্য প্লেটে রাখা একা

সন্ধ্যা নামে
জলের নীচে প্রাচীনকাল

শহরের প্রতিস্থাপন

গলিটা চলে গেছে সূর্যাস্তের দিকে
পৃথিবীতে ছায়া পড়েছে
চাঁদের পোড়া গন্ধে ভরে গেছে বেশ কয়েকটি সোনার নকল করা পাড়া
দূরে নরকের স্তম্ভ ভাসছে একটি শহরের প্রতিস্থাপন
নৌকার মতো ডুবে গেছে অরণ্য
আমি কুয়াশা পাঠ করছি
উনুনের হাঁড়িতে বসানো আমার রক্ত

আমার শরীরে ফুলের মতো ফুটে রয়েছে কয়েকটি আঁচিল

আর আমার হৃদয় জনবসতি হীন একটি ধর্মগ্রন্থ

দুঃখ বরাবর খানিকটা হেঁটে গিয়ে দেখলাম নদী বয়ে যাচ্ছে
মাংসাশী পাখির ডানা
আকাশের এক জায়গায় ক্ষতস্থান
মেঘের ভেতরে শুকনো মাঠের ইতিহাস
জীবন আঁতুর ঘরের অন্ধকার
নিষিদ্ধ গাছ
গলিটার ভেতরে কি রয়েছে জানি না

পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ নিয়ে জাহাজটা ভেসে চলেছে

পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ নিয়ে জাহাজটা ভেসে চলেছে
ধরা না হলে ও অসংখ্য জীবজন্তুতে ভরা
কুয়াশা মেঘ আর শিশির খেয়ে নিয়েছে তার আত্মা
মাথার ওপর আকাশ একটি ডেকের মতো
যন্ত্রনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মলমের মতো গাছ
ধ্বংসের থাবা
ক্ষয়ে গেছে পাথর
চুনের প্রলেপ দেওয়া

সুমদ্র একটি হারানো ঠিকানা
কোনো অববাহিকা নেই
খুঁজে পাওয়া যায় না মরুভূমি
উপজাতিদের তাঁবু গুলো নষ্ট হয়ে যাওয়া পালকের স্থাপত্য
আর দু চারটি শহর শরীরের বিশ্রী আবের মতো
ছায়ায় কিছু ভালোবাসা রয়েছে জড়িয়ে রয়েছে
কয়েকটা যুগ বিকেলের সূর্য
নির্লিপ্ত পিরামিড যেমন হয়

সমাধিক্ষেত্রের ওপর হাত
এবং যুদ্ধ বিগ্রহ

পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ নিয়ে জাহাজটা ভেসে চলেছে মানুষের চোখের জলের ওপর দিয়ে

মেঘে বাঘের মূর্তি

আমার দেশ কুয়াশা
যদি মরণের পর স্বাধীন একটি রাষ্ট্র পাই তাহলে খুলে দেব আজন্ম হাত
দুঃখের ও কবর দেওয়ার জায়গা নেই
ছায়াপথ দিয়ে নক্ষত্ররা চলে যায় আমি ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম না তাই ওরা আমার সঙ্গে কথা বলেনি
খড়কুটোর মধ্যে জন্ম একটি গাছ আমি
জল্লাদের হাতে চাঁদ
আর একটি নরক খণ্ড
জ্বলন্ত ছুরিতে কাটা আঙুল

এ-কদিন কেউ ফেরেনি ঘরে
একটি প্রজাপতিকে ব্যবহার করেনি হৃদয়ে
আর যে পর্বতকে কামানের মতো সাজিয়ে রাখা হল আমাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য আমি তার ওপর রেখে এসেছি একটি মৃত গোলাপ
মেঘে বাঘের মূর্তি
আর আমাদের মাতৃভূমি কুয়াশা

হাওয়া একটি চাকার মতো ঘুরছে

ওল্ড স্ট্রিটের ছায়ার গায়ে আমি রক্ত দেখছিলাম
পুরোনো সূর্যের রঙের মতো
কুয়াশা খেয়ে নিয়েছে শহরটাকে আলোগুলো ভাসছে
আমার হেঁটে যাওয়ার বর্ণনায় তৈরী নৌকায় নিরুদ্দেশ আমি
আমার শরীরের জানালার ধারে আকাশ
হাওয়া একটি চাকার মতো ঘুরছে
ভাঙা গাড়ির মতো হয়ে এসেছে দূরত্ব
জানি আমি কখনো পৌঁছুতে পারবো আমার কাছে
ফিরে আসবে না আমার ছেলেবেলা
রাত্রি একটি অন্ধকার শুকনো জলাধার
যেখানে একটি সমাধি পর্যন্ত দেখা যায় না
ছায়ায় আমি রক্ত দেখছিলাম
আমি বেঁচে আছি যেভাবে এক ফোঁটা রক্তের ভেতরে

খরস্রোত মেঘ আমার ঠিকানা

মধ্যরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল আর সেই ভাঙনের মুখে চাঁদ নেমে এসে প্লাবনে ভাসিয়ে দিল আমার হৃদয়

আকাশ প্রাগৈতিহাসিক গাছ
নগ্ন জীবন
হাওয়ার উত্তরীয় গলায় শূন্য

মাথা নোয়ানো পর্বতমালা

জোনাকির আলোগুলো সাঁতার কেটে পার হচ্ছে মরুভূমি

রুক্ষ শহরের ওপর খালিপেটে আলো জ্বলছে
পোতাশ্রয়গুলো সব অসহায়
ধ্বংসের নিশাচর
আগামীকালে কোনো সূর্য নেই

অন্ধ একটি শতাব্দী

খরস্রোত মেঘ আমার ঠিকানা

Facebook Comments

পছন্দের বই