লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মানিক সাহার গুচ্ছকবিতা

ভ্রম

আমাদের বিষন্নতা মানে ভেঙে যাওয়া চশমার কাচ।
মেঝেভর্তি ছড়িয়ে থাকা রুমাল-চুরির স্মৃতি।
এই অস্তগামী সূর্যের পৃথিবীতে তুমি আর কার কাছে যাবে!
যে সীমান্ত দিয়ে নদী বয়ে যায়, যার ছায়ায় ধানের
ছরা, ঘরমুখী পরিযায়ী প্রাণ, তার বাদামী বর্ণ দেহে
গাছের অক্ষর লেগে আছে। তাকে মুছে দিতে চেয়ে
কত মানুষের রক্ত বইয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রনায়কেরা।
সেইসব কথা থাক।
সত্য যত কম বলা যায় তত নিরাপদ।
অথচ এই অস্থির সময়েও প্রেমিকার কথা ভাবতে
ভালো লাগে। তার বেইমানি, মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ভালো
সেজে থাকার নাটক— ভালো লাগে। যতবার মুখোমুখি
হই এত অমায়িক হাসি ফুটে ওঠে, সব ভুলে যাই।
শুধু মনে থাকে, আমাদের যৌবন একদিন শেষ হয়ে
যাবে অথচ বার্ধক্য কোনোদিনই আসবে না।

***

গানের মুদ্রাদোষ

এই পূতিগন্ধময় দেহ। হবিষ্যান্নে লুব্ধ দৃষ্টি রাখা
অদৃষ্টের কাক। এদের অবকাশ বলে কিছু নেই।
যতদিন আমাদের স্বপ্নের বিনিময় নিয়ে রাহাজানি
কারবার চলবে, ততদিন সুন্দর বলে কিছুই নিরাপদ নয়।
যাকে চোর বলে পিটিয়ে মেরেছ একদিন, তার
রক্তস্রাব আজও তোমাদের মোহিত করে। অশ্বত্থের
ডালে আজও তার ছেঁড়া কৌপীন চাঁদের আলোয়
মায়াবী হয়ে ওঠে। তার ভূত ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমরা
ছড়া লেখো, গান লেখো। গানের প্রাচীন এক মূদ্রাদোষ—
যা-কিছু মায়াবী তাকে আরও বেশি মায়াময় করে।
এই হত্যা, রক্ত, অবিশ্বাস, ধর্মের জটল ঘেরাটোপ
ধীরে ধীরে গান হয়ে গেলে ভালো হত।

***

সংখ্যা

এখন আর আমাদের ঘুম আসবে না। এই অনন্ত রাত
কীভাবে কাটাবো তা-ই ভাবি—

আজ দেবযান শেষ হল। বিভূতির।
অথচ এই ছলনা ও ভ্রমের জগৎ তবু ভালো লাগছে।
এই মৃদু ও জটিল নশ্বরতা মনোরম ও প্রিয় মনে হয়।

এখন আর দিন নেই। সন্ধ্যাও জমে গিয়ে রাত হয়ে গেছে
সারারাত টিভি চলে। পর্দায় মৃতের সংখ্যা ভাসে

সংখ্যা সংখ্যা সংখ্যা
আমাদের অস্তিত্ব এই সংখ্যায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়

***

গন্তব্য

অতঃপর আমরা বিভ্রান্তির দিকে হাঁটতে শুরু করি।
আমাদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। মাথার
উপর থেকে মেঘের চাঁদোয়া। আমরা প্রব্রাজকের মুখে
নিষেধাজ্ঞা শুনেছি। অথচ মানিনি কোনোদিন।

এই যাত্রার অন্তহীনতা কাউকে তেমন ক্লান্ত করে না
অথচ প্রত্যেকের বুকের ভেতর থেকে মাটির
পুতুলগুলি হারিয়ে গিয়েছে

এখানে বন ও বনান্তের মাঝে সূক্ষ্ম এক নদী বয়ে
যায়। তার জলের রং পান্ডুর। তার উৎসের দিকে
যেতে যেতে আমাদের চোখ পুড়ে গেছে। সারা দেহে
ভষ্ম মেখে নিজেদের আড়াল করতে চেয়েছি। আর
প্রতিটি চিকন আলো বিদ্ধ করেছে এই জাগতিক ভ্রম।

বিষয় আশয় নিয়ে বেশ সুখে আছি ভেবে চরম
বিভ্রান্তির দিকে আমরা যাত্রা শুরু করি। ক্ষুধা ও মৃত্যু
আমাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে পাশাপাশি হাঁটে।
মাথার উপর কালরূপী গৃধ চক্রাকার পরিক্রমন করে।
আমাদের গন্তব্য হারিয়ে যায়।

***

শান্তি

কোনো কোনো বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ছাদে উঠে যাই। দেখি—
নিচে— একটু দূরে— দুঃসময়ের আগুন নিয়ে যুবকের দল খেলা করছে
আরও একটু দূরে— টাওয়ারের মাথায় লাল আলো জ্বলছে টিমটিম করে।
ওই আলো, আগুন, নিয়ম ভেঙে রাস্তায় বেরনো যুবকের দল
আর ওই— ঝিম মেরে থাকা কোয়ারেন্টাইন সেন্টার—
সকলের সম্ভাব্য গন্তব্য এক

বিষন্ন সন্ধ্যায় তারাদের মনোরম মনে হয়
ইচ্ছে করে
পৃথিবীর সমস্ত কৃত্রিম আলো নিভিয়ে দিয়ে
চাঁদ ও তারাদের নীলচে আলোয় গাছ আর মানুষের বিবাহ দিয়ে দিই
আমি পুরোহিত হব, আমিই সম্প্রদান করব
আমারই আদ্যশ্রাদ্ধে পৃথিবীর আদি পুরুষের শান্তি লিখিত হবে

***

দেখা হবে

আলোর সংকেতে আবার আমাদের দেখা হবে
যখন নৈঃশব্দ্যের বুক চিড়ে
শব্দেরা সুর হয়ে বেড়িয়ে আসবে
মাটির ভেতর থেকে আজলা ভরে
জল তুলে আনবে যক্ষিনীর দল

আমাদের দেখা হবে

ক্রমে নীল হতে থাকা এই স্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে
অনেক দূরের কোনো দ্বীপে
জল ও অগ্নি দিয়ে তৈরি হবে আমাদের ঘর
আমাদের প্রিয় সন্তান-সন্ততি
ফুলের রেকাবিতে চয়ন করবে প্রিয় নক্ষত্রগুলি

সেই নক্ষত্রের আলোয়
ধ্বংসস্তুপ সরিয়ে, ভাঙা ডানার পাখি সরিয়ে, অনাদি অন্ধকার
ধুয়ে ফেলে, অগ্নিতে স্নান সেরে, আবার আমাদের দেখা হবে।

Facebook Comments

পছন্দের বই