লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রঘু জাগুলীয়ার কবিতা

হাসিঘর


গেঁও‐গরাণ গাছের লাল-হলুদ পাতার ফাঁকে ফাঁকে
কেঁপে-কেঁপে ওঠে বেলা
নোনাধুলো-ঝরা বাড়িগুলির পিছনে
ঝোপের ভিতর সাপের মতো ফণা তুলে আছে মেঘ
পুকুরে শিশুগুলির ডুবসাঁতারে ঘোলা হয়ে ওঠে জল
এই সব দেখে আকাশের দেহ থেকে একটানা বাতাসের মতো ভেসে আসছো তুমি
দূরের জোঁক-চলাচল বিলে’ এখনও কৃষিকাজে যারা ব্যস্ত
তাদের জলভরা মেঘের ছাউনি দিয়ে নিয়ে যাবে গৃহে।


ঠোঁটে খড়ের টুকরো নিয়ে পাখিটি যে দিক দিয়ে নীড়ে ফিরে যায়—
তার ফেলে যাওয়া পথে
অকূল দরিয়া থেকে ভেসে আসে গান
সেই গান নিয়ে
লুকিয়ে পড়েছো জানি হৃদয়ে নিভৃত লাল—

ভাবি স্বপ্নের মাধবীবনে একদিন তোমাকে পাব
অথবা টলটলে আঁধারে
গাছ থেকে পড়া পাকা ফলের মতো পরিত্যক্ত বাড়িটির পিছনে।

ডুমুরগাছটির ছায়ায় নিদ্রারত ভোরের হলুদ পাখিটি
রাতের গ্রামটি থেকে দেখি বহুদূরের আকাশ—
কচ্ছপের পিঠের মতো একেকটা নিথর আকাশ ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়
আর নদীর পাড়ে যেখানে মিন তোলে ওরা শুক্তি দিয়ে
ওইখানে বসে থাকি সারারাত
দেখি শৈশবের বন্ধুদের ঘরগুলি
আজও পরস্পর আলোবাতাসের নিকট সম্পর্কের মতো ভেসে ওঠে, অথৈ জলে।

যাওয়া

দেবীর বস্ত্রের মতো এই গ্রাম—

আঁচলের ভিতর থেকে যে মুখ লুকিয়ে দ্যাখে
পোকামাকড়ের খেলা,
তার ঘুম যেন টগরফুলের কুঁড়ি

অদূরে কুমিরের পিঠের মতো ভাসমান চর,
আকাশপথ থেকে পাখিরা এসে আবার আকাশে মিলিয়ে যায়
হেঁতালগাছগুলির পাশে পড়ে থাকা চলৎশক্তিহীন ডুবোনৌকো—
আর একটু ঘন জঙ্গলে বনবিবির ঘর

এদের কাছে বিকেলে ঘুরতে বেরোই।

অনেকরাতের বর্ষায় শিউলি ফুলগুলো উঠে আসে বারান্দায়—
দরমার বেড়ার পাশে সংঘর্ষময় তারা দুটি;
দেওয়ালে ঝুলন্ত রাধাকৃষ্ণর উপর লালা দিয়ে মহাকাল বুনছে ঊর্ণনাভ।

মাঝে মাঝে দেখি জলের বুকে
অসংখ্য মাটির হাঁড়ির ভিতর প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ ভাসে— ঠিক নক্ষত্রদের ঘরের মতো শান্ত ব্যবধান।

এইসব পথহারানো রাতে অকস্মাৎ স্বপ্নের ভিতর
একটানা বিরতির পর
ভেসে আসে কারা যেন আমার চোখের কাছে
তারা সব ডিমের মতো হাত-পা নেই।

নাচ

মঞ্চের উপর বটের ঝুরি মতো আলো
ওদের নুপূরের ঝিনিঝিনি
যেন বৃষ্টিপতনের মায়াশব্দরাশি।
বিলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আকাশে ডুবো-পাহাড়ের মতো মেঘে মেঘে
ভেসে যেতে ইচ্ছে হয় তখন
আরও দূর আরও দূর
যেখানে নির্জনতর বাতাসে পাকুড়ের পাতাগুলি নাচে
গোধূলিবেলায় মাঠের পরে ধেনু
সেখানে, একাকী শিশুকালের নাচ দেখি আমি।

Facebook Comments

পছন্দের বই