লেখক নয় , লেখাই মূলধন

করোনার দিনগুলিতে: সেলিম মল্লিক

লকডাউন ডায়ারির এক পাতা

রাস্তার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, একমাত্র রাস্তাই বিকল্প। অতএব এই পথ ধরতেই হল। বিচ্ছিন্ন হতেই হল। সবার হাত ছেড়ে দিয়ে এমন একটা আকাশের তলা দিয়ে হেঁটে চলার সংকল্প করতে হল, যেখানে চন্দ্র সূর্য নেই তারাদের নিশ্চিত ইশারা নেই। মানুষের কোলাহল ছাড়া মানুষের পায়ের শব্দ ছাড়া পেরোতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। বাঁচার জন্য তবে একলা হতে হচ্ছে। একলা গান গাইতে হচ্ছে। তোমাকে ছেড়ে থাকার সে-গান, এবং এটাই না কি তোমাকে কাছে পাওয়ার অনিবার্য গান। প্রথম প্রথম বিশ্বাস করেছিলাম, তাই হাজার কল্পনার কাচপোকা দিয়ে সাজিয়েছিলাম তাকে। কাচপোকাদের মিথ্যা শোভার দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত তো হয়েছিলাম বটে, নইলে কেন তাদের মৃত্যুতেও বিচলিত হইনি একটি বারের জন্যও!


কয়েক দিন পর প্রথম যে-দিন বাড়ির বাইরে, পাড়ার মোড়ে এলাম, সে-দিনই জীবনে প্রথম বারের জন্য অনুভব করলাম ‘সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে’ কেমন করে। রচনার সত্তর বছর পর জীবনানন্দের একটি কবিতার মর্ম কেমন চোখের সামনে খুলে গেল। অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে কীভাবে জানাতে হয়, তারপর কীভাবে একা অন্ধকারে বাকি সত্য আঁচ করতে হবে— এই বাস্তবতাকে কাছ থেকে দেখা গেল। ‘মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা’ এতদিন শুধু একটা ধারণা হয়ে ছিল, কত বছরের পর তাকে প্রত্যক্ষ করলাম— সবাই কেমন চুপি চুপি সকলের আগে নিজের ভাঁড়ারে সামনের বহু দিনের জন্য খাদ্য মজুত করছে। নিজে নিশ্চিন্ত না হওয়ার আগে অবধি অন্যের অসহায়তার জন্য কপালে দুর্ভাবনার রেখা ফুটিয়ে তোলা যে কতখানি অসাধ্য মানুষের পক্ষে, এই দিনগুলিতে এসে না পড়লে এভাবে জানা হত না। লক্ষ লক্ষ লোক এ-সব না জেনেই মরে যেতে যেতে ভেবেছে, মানুষের কাছে হৃদয়ের ঋণ রয়ে গেল। কত ভুল বিশ্বাস নিয়ে তারা যে মরেছে! এসবের পরেও এরকম ভুল আশ্বাস বুকে ধরে আমাদের ঘুরে বেড়াতে হবে। কারণ, সকলকে ফাঁকি দিয়ে সকলেই এগিয়ে চলেছি।


‘আজ তবু কণ্ঠে বিষ রেখে মানবতার হৃদয় স্পষ্ট হতে পারে পরস্পরকে ভালোবেসে।’ এখনও যে আলোপৃথিবীর স্বপ্ন মানুষের পাঁজর থেকে মুছে যায়নি, তাকেও দেখতে পেলাম। নিজেদের চিহ্নহীন চলার পথে কত প্রবীণ তুর্কি ঘোড়ার মতো পিঠ পেতে দিয়েছে তার প্রবীণার জন্য। কত যুবক তাদের যুবতীকে স্কন্ধে তুলে নিয়েছে। আর রাত্রিকেই তারা বেছে নিয়েছে মরা থেকে বাঁচায় ফেরার জন্য। ওইসব পরিযায়ী জীবনের সাথে সাথে আমরাও জেনে গেলাম, ওদের যন্ত্রণা আর মৃত্যুর বিনিময়ে আমরা চাক্ষুষ করলাম, আমাদের কোনো স্বদেশ নেই, রাষ্ট্র আসলে এক যন্ত্র, যার ভেতরের কলকবজা থেকে শুধু ধাতব গর্জন বার হতে পারে। ‘উঁচু লোকদের দাবি’-র কাছে সে কেবল গাধার মতো ঘাড় নেড়ে চলে অবিরাম।


আর ধর্ম যে এখন মরা পশুর পচে যাওয়া লাশ, তার দুর্গন্ধ-মেশা দমকা বাতাস নাকে এসে লাগল এই বিচ্ছিন্নবাসের দিনগুলিতেও। সাধনার ভারতবর্ষ আজ নেহাতই ওদের যৌথ ভাগাড়। কেন যে এখানে ‘মৃত্যুর আগে হয় না মরণ’! তবে কি বেঁচে থাকতে হবে এই আশা নিয়ে, ‘আলো ঝলকাবে অন্য এক সূর্যের শপথে’! জানি না। আপাতত দেখতে পাচ্ছি, সূর্যের গা থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে মরচের গুঁড়ো। মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তরের মানুষকে বিষাক্ত ধাতুর কবল থেকে বাঁচবার জন্য এবার শরীরে লাগাতে হবে মাটির প্রলেপ।

করোনার দিনগুলিতে: সেলিম মল্লিক

পছন্দের বই