লেখক নয় , লেখাই মূলধন

করোনার দিনগুলিতে: অমর মিত্র

মহামারির আরও বিবরণ

মার্কো পোলোর ঘুমের ভিতরে স্বপ্নটি হানা দিয়েই যায়। হয়তো প্রত্যেক রাতে নয়, কোনো কোনো রাতে। তখন তাঁকে অন্ধকারে চুপ করে শুয়ে থাকতে হয়। মনে পড়ে কলিকাতা নগরের রাস্তা আর রাস্তা, মানুষ আর মানুষ। ট্রেনভরতি মানুষ এসে নামছে হাওড়া, শিয়ালদা স্টেশনে। দলে দলে মানুষ বেরিয়ে আসছে স্টেশনের হাঁ-মুখ গহ্বর থেকে, ছড়িয়ে পড়ছে নগরে। গঙ্গা পার হয়ে কলকাতায় ঢুকে পড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে, ট্রামে বাসে কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষগুলি রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে এমন হয়ে গেছে যেন কোনো ভাইরাস তাদের ছুঁয়ে দেখতে পারবে না। আসলে কী হয়েছে মার্কো তার কতটুকু জানে। এমনি সেই দিল্লি, মুম্বই, বাঙ্গালুরু, ঢাকা শহর, ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরা, সেখানে শিশুরা সব চুপ করে বসে আছে পথের ধারে, বাগানে, পার্কে, লেকের ধারে। শিশু নয় তারা বৃদ্ধ। বৃদ্ধরা শিশু হয়ে গেছে অথবা শিশুদের গ্রাস করেছে বার্ধক্য। এই স্বপ্ন অনেকদিন বাদে দেখলেন ভূপর্যটক। কলিকাতা, ঢাকা, নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলস, সিডনি, লন্ডন… কত শহর ফিরে আসতে লাগল তাঁর স্মৃতিতে। ঘুমের ভিতর। জাগরণে। ফিরতে লাগল অতীত, দূরতর অতীত, আরও দূর সেই কত দূর। সেই দূর অতীতের বিবরণ দিয়েছেন মার্কো সেযান শহরের মেয়রকে। মেয়র তা রেকর্ড করে নিচ্ছেন যে তা মার্কো জানেন না। এই শহরে কোনো শব্দই মেয়রের অশ্রুত থাকে না। সমস্ত ধ্বনি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা আছে। কোথায় কোন কোকিলটি ডাকল, তা অসংরক্ষিত থাকে না। দিনান্তের এক সময় সেইসব ধ্বনি আবর্জনা স্তূপে ফেলে দেওয়া হয়। ট্র্যাশ। ট্র্যাশ সংরক্ষিত থাকে। তারপর তারও এক এক অংশ একসময় মুছে দেওয়া হয়। কিছু পড়ে থাকে। প্রয়োজনে তা আবার তুলে আনা হয়।

মার্কোর বিবরণ কিছুটা এমন…, সেই বিবরণ খবরিয়া পেনসিলিয়া পেয়েছে, তার পেনসিলে লেখা বিবরণ এমন।

৫৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ, এই দীর্ঘ সময়কালে বুবোনিক প্লেগ বারবার মহামারি হয়ে এসেছে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইওরোপে। এই মহামারি প্রথম আরম্ভ হয় মিশরে। তিন রকম প্লেগের একটি হল বুবোনিক প্লেগ। এই রোগ ছোটো প্রাণীর দ্বারা সংক্রামিত মাছির মাধ্যমে মানব দেহে ছড়ায়। প্লেগে মৃত প্রাণীর দেহ নিঃসৃত রসেও এই রোগ ছড়ায়। বুবোনিক প্লেগ রোম সম্রাট, সাধু জাস্টিনিয়ান দ্য গ্রেটের নামেও চিহ্নিত। জাস্টিনিয়ান প্লেগ। মিশরে আরম্ভ হয়ে কন্সট্যান্টিনোপলে পৌঁছে যায় এক বসন্তে। সেই সময় এক-একদিন ১০,০০০ পর্যন্ত মানুষ মারা গেছে এই মহামারিতে। প্লেগ মহামারি হয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি সময়ে ইওরোপের জনসংখ্যা অর্ধেক করে দিয়েছিল।

১৩৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫৩, এই দীর্ঘ সময়ে ইওরোপে প্লেগ ফিরে এসে ৭৫ লক্ষ থেকে ২ কোটি মানুষের প্রাণহানি করেছিল। ব্ল্যাক ডেথ নামেই চিহ্নিত হয়েছিল এই মৃত্যু-মহামারি। ৮০০ বছর বাদে এই ফেরা। এশিয়ায় শুরু হয়ে এই রোগ ভূমধ্যসাগরীয় এবং পশ্চিম ইওরোপে ১৩৪৮ সালে পৌঁছে যায়। ৬ বছরে ইওরোপে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। মনে হয় বণিকদের দ্বারাই এশিয়া থেকে ইওরোপে সংক্রমণ হয় এই রোগ। নগরেই ছড়িয়েছিল এই মহামারি তখন। ইওরোপে প্লেগ মহামারি হয়েছে বারবার। ঘুরে ঘুরে এসেছে এই ভয়ানক মহামারি। অষ্টাদশ শতক অবধি ক্রমান্বয়ে ইওরোপ প্লেগে বিধ্বস্ত হয়েছে। ১৬৬৫-৬৬ সালে লন্ডনে প্লেগ রোগ ১ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। এই সংখ্যা সেই সময়ের লন্ডন শহরের জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ তো হবেই। প্লেগের কারণে ১৬০৮ সাল থেকে ৫ বছর সেক্সপীয়রের নাটক বন্ধ ছিল।

কলকাতা, লন্ডন, নিউইয়র্ক শহরে কবে আবার দর্শকভরা রঙ্গালয়ে থিয়েটার ফিরে আসবে কেউ বলতে পারেন না। প্রবীণ নাটককার নির্দেশক বলছেন, টেলিফোনে রিহার্সাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। কবে কী হবে জানেন না। নতুন নাটকের প্রথম অভিনয়ের দিন ছিল ২৮শে মার্চ।

চিন দেশ থেকে ভারতে প্লেগ এল ১৮৫৫ সালে। সেই প্রথম। প্লেগের বিবরণ শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ উপন্যাসে আছে। রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে আছে। ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয় প্লেগে। ১৯০০ থেকে ১৯০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রানসিস্কো শহরে প্লেগের সংক্রমণ হয়। ওই দেশে সেই প্রথম।

শৈলেশ গুহ নিয়োগীর নাম আমরা ভুলে গেছি। নাট্যকার। তাঁর একটি নাটক আমরা অভিনয় করেছি ছেলেবেলায়। নাটকটির নাম ছিল ফ্লু। নাটকের চরিত্রগুলি ছিল বিভিন্ন রোগ, ফ্লু, কলেরা, ম্যালেরিয়া, বসন্ত ইত্যাদি। মনে নেই সমস্তটা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্প্যানিশ ফ্লু, ১৯১৮-১৯২০-র ভিতরে, ৫ কোটি মানুষ সংক্রামিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্বে। ১০০ বছর আগের কথা। স্প্যানিস ফ্লু সংক্রমণ হয়েছিল দূর-দূরবর্তী বিশ্বে, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলিতে পর্যন্ত। ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ১০০ বছর আগে। শিশু, এবং বৃদ্ধরাই মারা গিয়েছিল বেশি। সেনাবাহিনীর থেকেই এই জ্বর ছড়ায়। ভাইরাস দ্রুত নিজেকে রূপান্তরিত করে শিকার খুঁজে নেয়।

ইওরোপীয় অভিযাত্রীদের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য অংশের মানুষের সংস্পর্শ মহামারির জন্ম দিয়েছে বারবার। ষোড়শ শতাব্দীতে আটলান্টিক মহাসাগরের ক্যান্যারি দ্বীপপুঞ্জের আদিম আধিবাসীদের অর্ধেক ফ্লু মহামারিতে মেরে ফেলে। স্পেনের দক্ষিণ সমুদ্রে, মরোক্কোর ১০০ কি.মি., পশ্চিমে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের আদিম উপজাতিদের কাছে অভিযাত্রীরা নিয়ে গিয়েছিল গুটি বসন্ত। ঝাড়ে বংশে শেষ করে দিয়েছিল নিরীহ আদিম উপজাতিদের। গুটি বসন্ত মেক্সিকোয় প্রবেশ করে অভিযাত্রীদের সঙ্গে, ১৫২০ সালে ১,৫০,০০০ মানুষকে মেরে দিয়েছিল, স্থানীয় রাজাও মারা যান এই মহামারিতে। সপ্তদশ শতাব্দীতে হাম ২ লক্ষ মেক্সিকো, এবং পেরুর উপজাতিকে শেষ করে দিয়েছিল। ১৬১৮-১৯ সালে, এক বছরে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস উপসাগরীয় অঞ্চলের আদিম উপজাতিদের শতকরা ৯০ ভাগ নির্মূল হয়ে যায় গুটি বসন্তে। ১৭৭০ সালে গুটি বসন্ত শতকরা ৩০ ভাগ নেটিভ আমেরিকানকে শেষ করে দেয় প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। আমেরিকার আদিম উপজাতিরা শেষ হয়েছে ইওরোপীয়দের বয়ে আনা রোগে। অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গুটি বসন্ত মহামারি হয়ে প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে নেটিভ আমেরিকান, রেড ইন্ডিয়ান উপজাতিরা, ১৭৮০-৮২, এবং ১৮৩৭-৩৮। অস্ত্র দরকার হয়নি হাম, বসন্ত, ফ্লু— এইসব রোগ বয়ে এনে আদিম উপজাতিদের শেষ করে দিয়েছে ইওরোপীয় শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রীরা। তার আগের একশো বছর ধরে এইসব রোগে আক্রান্ত হয়ে ইওরোপীরা অর্জন করেছিল এইসব রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা। আমেরিকার আদিম উপজাতিরা এসবের সংস্পর্শে এসে প্রতিরোধ না করতে পেরে শেষ হয়ে যায়। গুটি বসন্ত অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের আদিম উপজাতিদের অর্ধেককে শেষ হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের দ্বারা সংক্রামিত হয়ে। ১৮৪৯-৫০ সালে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ৪০,০০০ মানুষ মারা যায় হাম, হুপিং কাশি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জায়। এ-সব অসুখ হাওয়াই দ্বীপের মানুষের কাছে অজানা ছিল। ইস্টার আইল্যান্ডের আদিম উপজাতিদের শেষ করেছে গুটি বসন্ত। ১৮৭৫ সালে ফিজি দ্বীপপুঞ্জের এক তৃতীয়াংশ মানুষ গুটি বসন্তে মুছে গেছে। বোঝাই যায় উন্নত সভ্যতা এইভাবে আদিম উপজাতিদের শেষ করে তাদের জন্মভূমি দখল করে নিয়েছে। মহামারি হয়েছে আগ্রাসনের অস্ত্র। সর্বকালে। মহামারি নিয়ে আসে যারা, তারা মরে না, মরে নিরীহ মানুষ। শুধু মৃত্যু নয়, মহামারি সামাজিক জীবনে গভীর অন্ধকার নিয়ে আসে।

কলেরা রোগ মহামারি হয়ে ১৮১৭ থেকে ১৮২৪ সাল পর্যন্ত অগণিত ভারতীয়র মৃত্যু ঘটিয়েছিল। গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের উপন্যাস ‘লাভ ইন দ্য ডেজ অফ কলেরা’ উপন্যাসে কলেরার ভয়াবহতা রয়েছে। লাতিন আমেরিকার দেশে কলেরা কীভাবে মানুষ মেরেছিল তা আছে এই উপন্যাসে। আর আছে অবিনশ্বর এক প্রেমের কাহিনি।

পরিসংখ্যান দেব না। শুধু একটি অজানা জ্বরের কথা বলি, বলেছিল বন্ধু অলোক গোস্বামী, শিলিগুড়ির ঘটনা। চিকিৎসাবিল অনাদায়ে এক নারসিং হোম মৃত্যুর পর শবদেহ আটকে রেখেছিল। সেই মৃতদেহ থেকেই ভাইরাস জন্মায় এবং শিলিগুড়িতে অজানা জ্বরে মৃত্যু ডেকে আনে। জ্বর এবং মৃত্যু। মধ্যে কোনো আরোগ্য নেই। যে-ডাক্তার এই দেহ আটকে দিয়েছিল, তাঁর মৃত্যু হয়, স্বাস্থ্যকর্মীদেরও মৃত্যু হয়। এরপর রোগ বাইরে আসে। শিলিগুড়ির সাধারণ মানুষ অজানা ভাইরাসে সংক্রামিত হয়ে মারা যায়। সেই সময়ে মানুষ প্রাণ হাতেই অফিস-কাছারি করেছে। কেউ-ই কোয়ারেন্টাইনে যায়নি। এই শব্দ, এই ধারণাই ছিল অচেনা। সরকার কিছুই করেনি। বরং প্রথিতযশা ডাক্তাররা সব ত্যাগ করেছিলেন শিলিগুড়ি। শুধু পৌরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য একা লড়েছিলেন এই ভাইরাসের ভয়ানক হনন ক্ষমতাকে আন্দাজ করে। ভাইরাসটিকে আজও শনাক্ত করা যায়নি। তবে ধীরে ধীরে সে লুকিয়েও পড়েছিল, অথবা তার মৃত্যু হয়েছিল নানা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করায়। স্যানিটাইজেশন করায়। সেই নারসিং হোম ছিল উৎস। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবে?

ভাইরাসের কথা শুনেছি, ১৯৮৪ নাগাদ। জ্বর এবং হাত-পা ঝিনঝিন করে মানুষ মারা যাচ্ছিল উত্তর ২৪ পরগণার বেড়াচাঁপা-দেগঙ্গা অঞ্চলে। বালতি বালতি জলে স্নান করিয়ে রোগীকে সুস্থ করা হচ্ছিল। এই ভাইরাস এসেছিল বসন্তের সময়ই। সরেও গিয়েছিল আপনা-আপনি।

আজ ৮-ই এপ্রিল। সকাল ১১-২৫ মিনিট সময়ে বাঁকুড়ায় ভূমিকম্প। ২ সেকেন্ড ছিল স্থায়িত্ব। এপিসেন্টার খুব সম্ভত মেজিয়া। বিষ্ণুপুরের কবি স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন তাঁদের প্রাচীন দালানে ফাটল দেখা গেছে অনেক। করোনা আক্রান্তর হিসেব এখন নিচ্ছি না। তিমিরকান্তি বাঁকুড়া বেলিয়াতোড়ের ছেলে। বাড়িতেই রয়েছে। ওকে ফোন করে কিছু খবর নিলাম। কী বেদনাভরা একটি কবিতা পড়লাম রাতে, তিমিরকান্তি ঘোষ লিখেছে—

আবার জীবন

এই সময়
একদিন নিজেই
শ্বাসকষ্টে ঘুমিয়ে পড়বে।
ঝুঁকি নিয়ে
অসুখ সারিয়ে দেবে
এই মানুষই একদিন।
শুধু আমরা কয়েকজন
উল্লাস করেছি সাময়িক
জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম জঙ্গল।
ঝলসে গেছে
গাছেদের ত্বক
শেয়াল পালাচ্ছে সন্তান মুখে নিয়ে…
আমি আর বাবা
আবার বেরিয়েছি খাদ্যের সন্ধানে।

শুশুনিয়া পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন জ্বালিয়ে কত প্রাণী, কত অমূল্য অরকিড, ভেষজ লতা পুড়িয়ে দিয়েছে কাষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। মহামারির সুযোগ নিয়েছে বৃক্ষ নিধনকারীরা। এ এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। যে যেভাবে পারে সুযোগ করে নিচ্ছে। এমনি দিন তো সহজে আসে না, সুতরাং লুটে নাও।

কয়েকদিন কাটল ভয়ে। ভয় আর যাচ্ছে না। উদ্বেগ বাড়ছে। বেড়েই যাচ্ছে।

আজ ১১-ই এপ্রিল ভোরে বাজারে গিয়ে শুনলাম স্থানীয় বৃহত্তম বস্তিতে দুটি করোনা পজিটিভ রোগীর সন্ধান মিলেছে। দোকানদার সমরের বাড়ি আমতা। দোকানদার সমর ভয় পেয়েছে। আগামীকাল খুলবে দোকান। তারপর বন্ধ করে বাড়ি চলে যাবে। গোষ্ঠী সংক্রমণ হওয়ার ভয় করছে সমর। বাড়ি থেকে ফোন আসছে বারবার। ফিরে যেতে বলছে। বস্তিটিতে মানুষের জীবনযাত্রা অবর্ণনীয়। ঘরে জায়গা নেই তো ঘরে থাকবে কীভাবে। তাও চেষ্টা করছে। আর ধর্মগুরুদের উৎপাত তো আছেই। উৎসব উপলক্ষে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ থেকে মানুষকে বাঁচাবে কে?

আমার যে সাবানগুঁড়ো দরকার। আমি সমরকে বললাম।

নেই তো, তেল বলেছিলেন, এনে দিলাম।

সমরের মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। বলল, বুঝতে পারছেন না, বস্তিতে ছড়ালে কী হতে পারে।

আমি উদ্বেগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাজারের ভিতর থেকে। সমরের দোকান থেকে মুড়ি, চিড়ে, হলুদ, চাল, আটা কিনে থাকি আমি। ভোরে খোলে। আমিও ভোরে যাই। বন্ধ হয়ে গেলে খুব অসুবিধে হবে। ডিম যার কাছ থেকে কিনি সে বলল, ফোন নং রেখে দিন দাদা, কী হবে জানি না, শুনেছেন তো সব, বাজারই বন্ধ করে দেবে ‘গরমেন্ট’, এদিকে ছড়াচ্ছে, ধরা পড়ছে।

যেন চোর ধরা পড়েছে। যেন অপরাধী ধরা পড়েছে? এসেছে চিনের উহান প্রদেশ থেকে নানা দেশ ঘুরে ডাকিনির ঝাঁটায় বাহিত হয়ে। বিমানে উড়ে। তাতে কি সেই মানুষটি দায়ী। এত বিদ্বেষ কেন রোগীর বিরুদ্ধে? তার পরিবার কেন অচ্ছুৎ হয়ে যাবে? সমাজটা একেবারে অন্ধকার কুয়োয় ঢুকে বসে আছে। বাইরের পৃথিবীর প্রতি চোখ নেই।

বাজারে শুনে বাড়ি এলাম। অনাথনাথ দেব লেন আটকে দিয়েছে। কেন দিয়েছে, না সংক্রামিত বস্তির মানুষ যেন অনাথনাথ দেব লেনে না ঢুকতে পারে। মানুষের ভিতরে সাম্প্রদায়িকতা জেগে উঠছে যে তা কথাবার্তায় টের পাচ্ছি। যে যা বলছে শুনছি। হট-স্পট, রেড জোন হয়ে যাবে আমাদের এলাকা। বাড়ি ফিরে কেমন অসুস্থ অসুস্থ লাগল। একে ওকে ফোন করতে লাগলাম। লেখক অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় থাকে বরা’নগর। সে ডাকাবুকো। ক-দিন আগে ফোন করে বলেছিল, দাদা কোনো সাহায্য লাগলে বলো। তাকে ফোন করে ওষুধ চাইলাম। এনে দেবে অপূর্ব? সে ঘণ্টাখানেকের ভিতর মোটর সাইকেলে চেপে ওষুধ নিয়ে হাজির।

এত যে ভয়ের কথা সকালে বাজারে শুনলাম, দুপুরে টেলিভিশনে কোনো খবর নেই। বেলগাছিয়া ব্রিজের ওপারে আর, জি, কর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া তিনজনের ভিতরে দু-জনকে পাঠানো হয়েছে আই ডি হাসপাতালে। জোড়াসাঁকো মদনমোহনতলার একজন ৮৩ বছরের বৃদ্ধ হৃদরোগ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। শেষের দিকে সন্দেহ হওয়ায় তাঁর লালারস পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। ইতিমধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়, এবং লালারসের রিপোর্ট আসে পজিটিভ। হাসপাতালের দুটি ওয়ার্ডকে বন্ধ করে স্যানিটাইজ করা হয়েছে। বৃদ্ধের ওই ওয়ার্ডে যুক্ত সকল স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসককে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইরিনে পাঠানো হয়েছে। এর সঙ্গে বেলগাছিয়ার সম্পর্ক কোথায়?

এখন এমনি হয়েছে আজানের শব্দ দূর থেকে এলেও মনে হচ্ছে, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাস ছড়াচ্ছে সত্যি। তা একেবারে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ। দাঙ্গার কালে যেভাবে ছড়ায়, সেইভাবে ছড়াচ্ছে। আমাদের এলাকার এই কল্প-কাহিনি বাগবাজারেও রটেছে, বন্ধু প্রবুদ্ধ তা জানাল। গুজব এই ক্রান্তিকালে সব চেয়ে ভয়ের। অনাথনাথ দেব লেন আটকে দিয়েছে কারণ ওখানেও কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে নাকি? কোথায় কী হয়েছে তা জানা নেই কারো। ব্যাঙ্কে দীর্ঘ লাইনের ভিতরে। টাকা না হলে মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করবে কীভাবে? ব্যাঙ্কে যে-জমায়েত তা খুব ভয়ের হয়ে উঠতে লাগল।

মেয়র শুনতে শুনতে বললেন, এই সমস্ত ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীর দূর অতীতে তা তাঁর জানা ছিল না, আর যা ঘটছে বর্তমানে অন্য নগরে তাও তাঁর কাছে বিস্ময়ের।

আপনি সেযান শহরকে ভালো রেখেছেন, এখানকার মানুষ আপনাকে মনে রাখবে।

মার্কো পোলো দুপুরে টেলিভিশনে দেখতে লাগলেন, পৃথিবীর সব শহর ভূতুড়ে হয়ে গেছে। ভূতুড়ে শহরগুলির কথা বলছে এক নারী। সে জয়িত্রী। টেলিভিশনে খবর বলার কাজও রয়েছে তার। মার্কো পোলো ভাবলেন সেযান শহরের চেহারাটি দেখায় না কেন জয়িত্রী? দ্বিপ্রহরে তিনি জানালার ধারে বসে সেযান শহরটিকে দেখছিলেন। এই সেই শহর যে-শহরে তিনি লকডাউনের কালে এসে লকডাউনের আগের পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন যেন। পূর্ব স্মৃতিতে ফিরে গেছেন যেন। এমনিই ছিল সেযান শহর। তারপর কী হয়েছে কিংবা হয়েছিল তা মার্কো জানেন না, জয়িত্রীও জানে না, মেয়র জানেন কিনা, তা মেয়রই জানেন।

Facebook Comments

পছন্দের বই