লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুপ্রিয় মিত্রের গদ্য

অমুকের গৃহদর্শন

বৃষ্টি যে হয়েছিল একটানা, ছেদরানো কাদা লেপটানো পাতাদের শবদেহ ছাড়া কে বুঝবে। শেডের তলায় যে গুল্মটি ছিল গার্হস্থ্য স্পর্ধার টবে, একদলা মাটির ওপর একখান পাতা মূর্ছা গিয়েছে কাল রাতে; শেষ হাওয়ার ট্রিগারে খামোখা। সে পাতা পাথরকুচি, শেকড়ের সুরক্ষা তাকে বাঁচাবে— আশঙ্কা নেই, জল ঘোষণা করেছে। স্প্রিংকল মগ থেকে সহায়তা ঝরে পড়বে, বেলা হওয়ার অপেক্ষা। গুল্মের মগডাল বারান্দা থেকে অই পাতাদের দিকে চেয়ে আছে, তার আর কোনো কাজ নেই। মিঠুর মা আজ একটু হাঁফ ছেড়ে বেলা এগারোটায় তিনদিন স্নানহীন চুলের জটে চিরুনির তল্লাশি গাঁথতে পেরেছে, ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে পেরে স্বস্তি। নয়তো অশান্ত ঘর। মিঠুর মা মুসলিম, বাবা হিন্দু। ঘরে ‘পড়তে বস’, ‘খা রে’, ‘চানে যা’, ‘এটা কী বাজার হয়েচে’— চেঁচামেচির আওয়াজ হলেই পাড়া-পড়শি মন্দ বলে না, বলে ‘দাঙ্গা’ লেগেছে। কিন্তু এখন গান শোনার সময়, রেডিয়োতে নব ঘোরালে গানের স্মৃতি, ঝিরঝির ঘ্যাসঘ্যাস গতকালের আবহ। গতকালগুলো যেন এই যন্ত্রে ঢুকে পড়েছে, এইটুকু তাদের হল্লা; সমস্ত গান বুঝি অতীতকামী, তাই বুঝি ভবিষ্যৎমুক্ত? তার বুকে কোনো ক্ষত নেই, সে বুঝি বুলেট, সে ক্ষত করে? সিমেন্টের দেওয়াল। খসে পড়া পুট্টি। ইঁটের দাঁত-মাড়ি চষে পোকা খুঁটে খাচ্ছে শান্তির পায়রা। শাদা। তালব্য স-এ আকার দ-এ আকার। শান্তিকে দীর্ঘায়িত করার এর চেয়ে ছোটো উপায় আর নেই। পোকারা জনগণ, তাদের কি দূর থেকে দেখা যায় বোকা? পায়রাকেও তো বাঁচতে লাগে। হাবজি-গাবজি ভাবনা। মিঠুর মা আজ-এর জানলায় চোখ বড়ো করে।
ক্ষতিপূরণের মতো রোদ এসে ছাতে পড়িয়াছে। সাধু রোদ। এ রোদ বাঁচাবে। অন্যান্য ছাতে দ্যাখো। ছাতের ঘেরাও, তার ওপর কাপড় শোকানোর দড়ি। আকাশ আর ছাতের সীমান্ত রেখা। মাঝের দু’দিকে কিছু ফাঁক। সেটুকু কারো জন্যে নয়। শুধু হাওয়া। শুধু রোদ। কত প্রার্থনা, সাধনার অ্যভি না যাও ছোড় কর, কড়, কড়াৎ এবং করোজ্জ্বল রোদ। গোটা বাড়ির জামা, শাড়ি, নাইটি, গেঞ্জি, প্যান্টি, জাঙ্গিয়া, ব্রা, গামছা, পিলো কভার, চাদর, রুমাল দড়িতে শুকোচ্ছে। সীমান্তরেখার খেয়ালে দুলছে, তারা শরীরহীন, অশরীরী। হাওয়ায় দুলছে। মিঠুর মা’র কেমন বুক ছ্যাঁতছ্যাঁত। বারোটার রোদ। বারান্দায় রোদ নেই, শেডের ছায়া সোওজ্জা নীচে মুখ থুবড়ে পড়েছে। পাতাদের গায়ে কাদা শুকিয়ে পোঁপড়া, কেমন লালচে-খয়েরি ভাব। গুল্মের মগডাল এসব বারোটা-একটা বোঝে না। দু’জনেই আকাশের দিকে তাকায়। বাড়িগুলোয় আছে তো লোকজন? ওই নীল বাড়িতে চার মাসের বাচ্চা। কাঁদছে। থামছে না কেন?

ক্ষতিপূরণের মতো রোদ এসে ছাতে পড়িয়াছে। সাধু রোদ। এ রোদ বাঁচাবে। অন্যান্য ছাতে দ্যাখো। ছাতের ঘেরাও, তার ওপর কাপড় শোকানোর দড়ি। আকাশ আর ছাতের সীমান্ত রেখা। মাঝের দু’দিকে কিছু ফাঁক। সেটুকু কারো জন্যে নয়।

এরকম ভুলভাল ভাবনা ভালো নয়। এই ভাবতে ভাবতে মিঠুর মায়ের নিজের বাড়ি মনে পড়ে। ছিটমহল। বাড়ি আছে, কিন্তু সেই বাড়ির নেই ঠিকানা। আছে সিলেট কথ্যরূপ। কিন্তু সিলেট রূপে লেখা বই নেই। উচ্চারণ কেবল চোখে চোখে পড়ে নিতে হয়। বইয়ে ছাত লেখা থাকে না, লেখা থাকে ছাদ। মিঠুর মা তখনও মিঠুর মা নয়। নাম তার ফিওনা তখন। ফিওনা খানুম। ফিওনা ছাদকে পড়ত ‘সাদ’। সাদ। সাদ। স্বাদ।

হঠাৎ কান্না থেমে যায়।
মিঠুর মা ফিওনার হাত ছাড়িয়ে ফিরে আসে বাস্তবের একলা তরঙ্গে। রোদ পড়ে এসেছে। —যাই, বাড়ির স্বাদ নিয়ে আসি।

Facebook Comments

পছন্দের বই