লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অর্ণব রায়ের গল্প

সাইনেস্থেশিয়া

চিত্র: রেনে মাগরিত

—বাবা সাড়া দিচ্ছে না যে, ও বকুল। আমার কিন্তু ভালো ঠেকছে না। তুই ছুট্টে যা, মাকে ডেকে নিয়ে আয়। ওই দেখো, দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছে। শিগগির চামচটা দিয়ে যা। এখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস? বাবা, ও বাবা, সাড়া দাও। এই দেখো, আমি টুনি, বাবা!
দিদির গলা ভেঙে যাচ্ছে। প্রত্যেকবার ‘বাবা’ ডাকছে আর সেই ডাক বেঁকেচুরে যাচ্ছে। ঘর থেকে বেরোবার সময় বকুল চামচ আর দাঁতের খটাখট শব্দ পেল একবার। চামচের লোহা লোহা স্বাদ শুনতে পেল। ধাতব শব্দ খেলে গেল তার জিভের ওপর।
বকুল এখন ছুটছে। সিঁড়ি, ঘোরানো সিঁড়ি, বঙ্কুদাদের ঘর তার পরে বারান্দা তারপর ঢাকা বারান্দা আবার সিঁড়ি গলি, আগে না পরে? ‘রাম জয় ভয় ক্ষয়’। আগে গলি না আগে সিঁড়ি? বকুল এখন ছুটছে। উঠোন চৌবাচ্চা ভাঁড়ার ঘর গুলের ঘর গোয়াল চাতাল উঠোন। বকুল এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে?
কাঁঠালের কোয়ার ভেতর থেকে বিচি পাওয়ার মতন, এই বিরাট পুরোনো বাড়িটার কোনো একটা ঘর থেকে মা-কে পাওয়া গেল। মা থাকলে কি আর গোলমাল হতে পারে? উঠোন উঠোনের জায়গায়, গোয়াল গোয়ালের জায়গায়, সব ঠিকঠাক। দু’মিনিটের মধ্যে উড়ে উড়ে বকুল একেবারে ওদের ঘরের সামনে। এই দু’মিনিটে ও দেওয়াল উড়তে দেখল, থাম রেলিং চৌকাঠ ছোপ ধরা পাথরের মেঝে, সব উড়তে দেখল। তার সাথে ওর কানের পাশ দিয়ে যে বাতাস কেটে গেল, তার শোঁ শোঁ-কে অনেকগুলো নানা রঙের দাগের মতো তার চারপাশের ড্রেন দরজা কলঘর সবকিছুর গায়ে আটকে থাকতে দেখল।
এই যে পুরো ঘটনাটা, মানে এরপরও যা যা ঘটবে, তার ফল হিসেবে বকুল না বালক হিসেবে বড়ো হবে, না বালিকা হিসেবে। এই যে সে ‘বাবা সাড়া দিচ্ছে না, বকুল, শিগগির যা তো…’ শুনে ফেলবে, এরপর সে মনের ভেতর দৌড়োতেই থাকবে। হয়তো সে মাকু হিসেবে বড়ো হল, বা পিস্টন হিসেবে।
মা বাবার পড়ে থাকা শরীরের সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ালো। বাবার জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। সারা মুখ ঘামে জবজব করছে। নাকি মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া হয়েছে? দিদি ভাঙাচোরা মুখ তুলে মাকে দেখে হাউমাউ ক’রে কেঁদে ফেলল। মাও এখুনি দিদির সাথে যোগ দেবে। তার আগে বাবার বুক ধরে হাত ধরে মাথা ধরে ঝাঁকাতে লাগল। মা একবার বাবার দিকে দেখছে, একবার এদিক ওদিক দেখছে। দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে কী জানি ওষুধ ছিল। হোমিওপ্যাথিই হবে। এক ঝাপটে সেটা এনে বাবার মুখে ঢোকানোর চেষ্টা করতে লাগল। তখনই বকুলের নজর গেল, বাবার মাথার পাশে চামচটা পড়ে আছে। হ্যান্ডেল বেঁকে গেছে। দিদি চেষ্টা করেছিল দাঁতে দাঁত লাগা খুলতে। পারেনি। বকুল যেন কিছু একটা ঘটার জন্য অপেক্ষা করছিল, হল। মা বলল, ঠিক দিদির মতন করে, আবার দিদির মতন করেও না, বকুল, শিগিগির যা, রাস্তার মোড়ে ডাক্তারবাবুর চেম্বার, একছুটে ডেকে নিয়ে আয়। আর যাবার সময় ওপরের জেঠিমাদের ডেকে দিয়ে যা। বল, বাবার খুব শরীর খারাপ।
বকুল দৌড়োল।

মা বাবার পড়ে থাকা শরীরের সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ালো। বাবার জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। সারা মুখ ঘামে জবজব করছে। নাকি মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া হয়েছে? দিদি ভাঙাচোরা মুখ তুলে মাকে দেখে হাউমাউ ক’রে কেঁদে ফেলল।

বড়োঠাম্মা যে ঘরে থাকে, তার সামনে সরুবারান্দা। যেখানে পুন্যপিসি সারাদিন বসে একটা কালো হাঁড়িতে কী যেন জ্বাল দিত। সেই কাঠের উনুনের পাটকাঠির জ্বালে সারা বারান্দাটা জুড়ে সেই যে কালিঝুলি পড়ল, সেই কালি সে দেওয়াল ভেঙে পড়ার পরে, কুড়ি বছর পরে এক একটা ইটে আলাদা আলাদা কালো হয়ে লেগে থাকবে আর বাড়ির হাড়ে মজ্জায় কালো কালো অশান্তি ঢুকবে। বড়োঠাম্মা সারাদিন, যতক্ষণ জেগে থাকে, কাকে যেন ‘অ নলেন’, ‘অ নলেন’ বলে মাঝে মাঝেই ডেকে ওঠে। আর একথা ফুলকাকার সদ্য পা পাওয়া ছোট্ট মেয়েটা অবধি জানে যে, এ বাড়িতে সাতপুরুষে নলেন বলে কেউ নাই। বড়োঠাম্মার ছেলেদের নাম রমেন্দ্রনাথ (ডাকনাম বোঁচা) আর সমরেন্দ্রনাথ (ডাকনাম গোবরা)। মেয়ে ইন্দুমতি (পুঁটি বা পুঁটে)। এমনকী বাড়ির চাকর মুনিশ রাখাল মাহিন্দার, কারো নাম নলেন নয়। তবে বড়োঠাম্মা কাকে ডাকে?
বকুলের পেছন পেছন ‘অ নলেন’, ‘অ নলেন’ ডাক রবারের বলের মতন ড্রপ খেতে খেতে আসছে। বকুল ওপরে যাচ্ছে জেঠিমাকে খবর দিতে। কিন্তু সিঁড়িগুলো নীচের দিকে যাচ্ছে। বকুলদের গোয়াল আছে। গোয়ালে গরুকে জাবনা দেওয়ার বড়ো বড়ো নাদা আছে। গরু নাই। বকুল শুনেছে, ওর জন্মের বছরই বাড়ির গোরুগুলোকে বেচে দেওয়া হয়। তাহলে বকুলের কেন মনে হচ্ছে যে, এই মুহূর্তে ও একটা পাটকিলে রঙের গরুর খরখরে গায়ে হাত বোলাচ্ছে! এখনও বকুল এত বড়ো হয়নি যে, রাস্তার যে-কোনো গোরুর গায়ে সাহস করে হাত বোলাবে। গোরুর গায়ে হাত বোলালে কেমন লাগে, তা-ই জানার কথা নয় ওর। আর গোরুটা পাটকিলে রং-এর? পাটকিলে রং কাকে বলে? বকুল তাহলে কবে কোনো গোরুর গায়ে হাত বোলাবে? কত বড়ো হয়ে?
ডাক্তারবাবু ঘরের ভেতর চেম্বার থেকে একটু গলা তুলে বলবেন, তোমার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এখানে কিছু হবে না। ঘরের বাইরে বারান্দা। বারান্দায় সরু সরু থাম। বারান্দায় দুই ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ির রং লাল। ঘর আর বারান্দার মাঝে সবুজ রঙের দরজা। সবুজ চৌকাঠ। ওপরের চৌকাঠে মাথার কাছে তিনখানা লাল রঙের দাগ। সিঁদুরগোলার। সবুজ রঙের দরজার ডানপাশে সবুজ শিক দেওয়া দরজা সাইজেরই জানলা। বকুল রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারবাবু গলা তুলে বলছেন…। কিন্তু ওর দিকে দেখছেন না। বকুল জানে, ডাক্তারবাবু বাইরে আসবেন না। যতোই জরুরি ডাক আসুক, বেরোবেন না। বেরোলেই, উনি যে দড়জা দিয়ে না বেরিয়ে জানলা দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন, সেটা সবাই দেখে ফেলবে যে!
কয়েক মাসের মধ্যেই, সন্ধের অন্ধকার লেগে গেলেও বকুল কোথায় যেন বসে আছে। চারিদিকে উঁচু উঁচু গামার গাছ। গাছের গুঁড়ি ঘিরে গোল গোল সিমেন্টের বাঁধানো বসার জায়গা। গাছের ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশ আর কয়েক মুঠো তারা দেখা যায়। দিদি এসে বসল। খানিক পাশে, খানিক পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে। গাছগাছালির ফাঁকেও সবুজ সবুজ তারা চরে বেড়াচ্ছে। জ্বলছে আর নিভছে। থেমে থেমে ঝিঁঝি ডাকছে। যেন কাল পরশুতেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো ভিজে গেছে। কেউ হাঁটলে মশ্‌মশ্‌ শব্দ হবে। বাতাসে ভিজে ভিজে গন্ধ। দিদি সিনেমার মতন করে ডাকছে, বকুল!
—উঁ!
—আচ্ছা, বাবা যদি হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়ায়?
বকুল ঘুরে বসল। খসখস আওয়াজ হল।
—সেই যে সে-বার যেমন বাবা কলকাতা থেকে একদিন আগে চলে এল। কাউকে না বলে। সদর দরজা খোলা ছিল। সোজা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেরকম যদি আবার এসে দাঁড়ায়?
বকুলের চোখের সামনে এক দুই তিন চার অসংখ্য সম্ভাবনা একসাথে খুলে যেতে থাকে। সে প্রায় অগুন্তি দৃশ্য একসাথে দেখতে পায়। পাশাপাশি নয়। একসাথে। কোনোটাতে সে বাবাকে আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে, কোনোটায় সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুকের জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে, কোনোটায় বাবা বলছে কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেছিল, কোনোটায় সে বাবাকে খেতে দিচ্ছে। বাবা হামলে পড়ে খাচ্ছে আর বলছে, আরও দে, কতদিন ভালো করে খাইনি! আর এসবের সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে (যদিও ব্যাকগ্রাউন্ড কী বুঝতে বকুলের অনেক দেরি) গান চলছে, এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব।
একসাথে অনেকগুলো বাবা একই দিনে একই ঘরে ফিরে আসার মতন, একসাথে অনেকগুলো বকুল, কখনও স্কুলের বেঞ্চে কম্পাস দিয়ে চোখ আঁকছে, কখনও প্রচুর চোরকাঁটাওয়ালা একটা মাঠের মধ্যে কে যেন ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে, আর ওর গোটা গায়ে চোরকাঁটা ফুটছে, সেই চোরকাঁটা, বিশুকাকা মাঠ থেকে ফুটবল খেলে ফিরে ফিরে ওর দিকে পায়ের হোর্স মোজা ছুঁড়ে দিচ্ছে আর বকুল সেই ভেজা মোজা থেকে চোরকাঁটা এক দুই তিন চার করে ছাড়াচ্ছে আর পাশে সাজিয়ে রাখছে। লাল মেঝের ওপর সেই হলদেটে চোরকাঁটা ছোট্ট ছোট্ট বল্লমের ফলার মতন লাগছে।

কোনোটাতে সে বাবাকে আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে, কোনোটায় সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুকের জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে, কোনোটায় বাবা বলছে কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেছিল, কোনোটায় সে বাবাকে খেতে দিচ্ছে।

বকুল পায়ে চটি পরে বেরোয়নি। চটি পরার কথা মনেই আসেনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই ছোট ছোট বল্লমের ফলার মতো পিচের কুচি ওর পায়ে ফুটছে। সাথে সারাদিনের রোদে তেতেপুড়ে থাকা পিচের রাস্তার গরম। বকুল পা দিয়েই চিড়বিড়িয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন আর ঘুরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তার চেয়েও বড়ো কথা, সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে নিজেদের ঘর খুঁজে পাওয়া, তারপর সেই ঘরের কোথায় ওর চটিজোড়া আছে এদিক ওদিক উবু হয়ে খোঁজা। এদিকে বাবা সেই ঘরেরই মেঝেয় পড়ে আছে। মা আর দিদি ঘড়ির টিকটিক গুনছে। কখন বকুল আসবে। কখন ডাক্তারবাবুকে নিয়ে আসবে। তার বদলে মা আর দিদি দেখবে, হয়তো মেঝে থেকে মাথা তুলে বাবাও দেখবে, বকুল ডাক্তারবাবুর কাছে না গিয়ে অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরে এসেছে। কেন? না, চটি খুঁজতে! বকুল খালি পায়ে দৌড়োলো।
জেঠিমাদের ঘরের মেঝেতে মাদুরের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিল বকুল। ভর সন্ধেবেলা। মাথায় একটা বালিসও দেয়নি কেউ। ঘুম যখন ভাঙল, মুখের পুরো বাঁদিক জুড়ে, কান গাল কপালের বাঁ পাশ জুড়ে মাদুরের ছাপ লাল হয়ে উঠে এসেছে। মুখের এদিকটা মরুভূমির মতন লাগছে। কিংবা লাল সাদা জেব্রা। এত লোক কখন জড়ো হয়ে গেল? এরপরেও, বকুলের মাকু হয়ে বড়ো হওয়া, পিস্টন হয়ে বড়ো হওয়া, ট্যাপকল বা টিনের বাক্স হয়ে বড়ো হওয়া জুড়ে বকুল খেয়াল করে দেখবে, লোক সবসময়ই জড়ো হয়ে যায়। কিছু একটা ঘটলেই হল।
এরা কারা ওর চারপাশে বসে আছে? ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলোয় এদের গা ছায়া ছায়া। একজনের ভেতর দিয়ে আর একজনকে আবছা দেখা যাচ্ছে। ওই যে ন্যাতানো শাড়ি পরা মহিলাটি, খাটের ওপর বসে আছে। বকুল ওকে এই নীচে থেকে দেখছে। এই নীচে থেকে ওর পা, পায়ের ভেতর দিয়ে ওর কোলে ফেলে রাখা হাত, সেই হাতের ভেতর দিয়ে চোখের ডিমের সাদা দেখা যাচ্ছে। বকুলের মনে হল, ও গড়িয়ে গড়িয়ে খাটের তলায় চলে গেলে, খাটের তলা থেকে খাট ভেদ করে ওপরের সবকিছু দেখতে পাবে। তবে এই সমস্ত কিছুই, এই পায়ের ভেতর দিয়ে হাত, হাতের ভেতর দিয়ে চোখের ডিমের সাদা— সবটাই বুলাই দাদার কালো সানগ্লাসটা পরে দেখার মতন দেখা যাবে।
এদিকে আবার এই খাটের তলায় ঢুকে পড়লেই ঘরের ও বাইরের সকলের কথা, যতই ফিসফিস করে বলো, চাইলেই দেখতে পাওয়া যায়। বনি মাসির বর একবার একটা নষ্ট ফিল্মের রোল বকুলকে দিয়েছিল খেলার জন্য। আলোর দিকে ধরলে সেটার ভেতরের মানুষজনকে আবছা বোঝা যায়, কিন্তু কাউকে চেনা যায় না। খাটের তলার জগতে, সেই ধুলো ঝুল মরা পোকাদের জগতে ঢুকে পড়লে বাইরের সব কথা ফিসফিস দেখা যায়, কিন্তু কে বলছে কী বলছে কিচ্ছু বোঝা যায় না।
যদি বুঝতে পারত, যখন পাড়ার অচেনা ছেলেরা ওকে নিতে এল, বকুল অবাক হতো না। বকুল অবাক হল, যখন ওরা (এরা কারা! আমি তো চিনি না!) বলল, তোমার বাবা তোমাকে দেখতে চাইছে। (এরা বকুলকে তুমি বলছে কেন? কেউ তো বকুলকে তুমি বলে না। বলবেও না কোনোদিন)। বকুল বলল, বাবা ঠিক হয়ে গেছে তাহলে? ওরা ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, হ্যাঁ। এখন তাড়াতাড়ি চলো। (বাবা নিজে এল না কেন? বকুলকে স্কুল থেকে, সন্ধ্যে হয়ে গেলে মাঠ থেকে আনতে তো কক্ষনও অন্য কাউকে পাঠায় না! এদের কি বাবা চেনে? এরা কি ছেলেধরা? তাহলে জেঠিমারা ওকে এদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে কেন? মা কোথায়? দিদি কোথায়?)
‘দিদি কোথায়’–টা বকুল জোরে, গলায় আওয়াজ বের করে বলল।
—তোমার দিদি আগেই চলে গেছে।
—ও, আমি তো ঘুমিয়ে গেছিলাম, তাই ডাকোনি?
—হুঁ।

বকুল উড়তে শিখেছিল বাবা আর মা-র মাখখানে থেকে। রাস্তায় বেরোলেই একদিকে বাবা একদিকে মা, দু’জনে দু’হাত ধরে বকুলকে উঁচু করে তুলে ধরত। বকুল সেই হাতের ভরে মাটি থেকে দুই শূন্যে পা তুলে দিত আর উড়ত। পরে যতবারই সে এই দৃশ্যের কথা ভেবেছে, দেখেছে সে বাবা আর মা একখানা সমুদ্রের ধারে হাত ধরে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে। এদিকে সে কখনও সমুদ্রের ধারেকাছে যায়নি সারাজীবনে। তাহলে নিশ্চই টিভিতে দেখেছে। তাদের সাদাকালো টিভির সামনে একখানা নীল কাঁচ লাগানো ছিল। তখন সব বাড়িতেই টিভিতে আলাদা করে একখানা নীল কাচ লাগানো থাকত। ফলে, এই পুরো দৃশ্যটাই বকুলের কাছে সারাজীবনের মত নীল রঙের হয়ে রইল।
যখন যে রাস্তা দিয়ে পাড়ার অচেনা দু’জন দু’হাতে ধরে বকুলকে উড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনই সেই রাস্তা দিয়েই বকুল ডাক্তারবাবুকে হাত ধরে চাঁদে হাঁটার মতন করে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রায় মাটি না ছুঁয়ে না ছুঁয়ে নিয়ে আসছিল। অনেক আগের কোনো একসময় থেকেই বকুল জানত, ওই যে দু’জন তার হাত ধরে আছে, তাদের একজনের হাতের তালু ঘামে জবজব করবে। মাঝে মাঝেই তার হাত থেকে বকুলের ছোট্ট হাতের তালু পিছলে যাবে। যেন বকুলের ছোট্ট হাতের পাতাটা আইসক্রিমে তৈরি। পিছলে যাবে, কিন্তু ছাড়িয়ে যাবে না। বকুল উড়বে আর পিছলোবে। বকুলের ভয় করবে। গা ঘিনঘিন করবে। তার নিজের হাতও স্যাঁতসেঁতে মিয়ানো মতন হয়ে যাবে। অন্য লোকটির হাত খড়খড়ে, কড়া, যেন পাথরের তৈরি। এতটাই পাথরের যে, বকুলের হাতটা চিরে চিরে যাচ্ছে। বকুল চমকে চমকে উঠছে।
ডাক্তারবাবুকে হাত ধরে নিয়ে আসাটা বরং অন্যরকম। এই প্রথম বকুলকে কেউ এতবড় দায়িত্বের কাজ বিশ্বাস করে দিয়েছিল। (সম্ভবত এই শেষবারও)। বকুল ডাক্তারবাবুকে তাঁর বাড়ির দরজা দিয়ে হোক জানলা দিয়ে হোক দেওয়াল দিয়ে হোক— বের করে আনতে পারছে কি না তার ওপর নির্ভর করছে বাবা মেঝেতে শোয়া থেকে উঠে বসবে কিনা। যেমন মাঝে মাঝে বাবা শুয়ে থাকে আর পিঠ আটকে যায়, উঠতে পারে না। শুয়ে থাকে আর ডাকে, টুনি রে বকুল রে উমা কই গেলে, হাতটা ধরো তো, তোলো তো আমাকে! যেন এখন তার গোটা পরিবারটা তার দিকে হাত তুলে আছে, আর বকুলকে টেনে তুলতে বলছে।
ডাক্তারবাবুকে হাতে ধরে বাড়ি নিয়ে আসাটা তাই অন্যরকম। অনেকটা ঢেউয়ের মতন। গ্যাস বেলুন নিয়ে বাড়ি ফেরার মতন। একবার নামছে একবার ভেসে উঠছে।
কিন্তু কী আলো কী আলো! আশেপাশে অন্ধকার। কোথাও একটা শব্দও নেই। ঝিঁঝিঁপোকাও ডাকে না। পরে বকুল ভেবেছে, পাশ দিয়ে তো মা গঙ্গাও বয়ে যাচ্ছিল। তারও তো একটা শব্দ আছে! সে শব্দও তখন গেছিল কোথায়? মা গঙ্গাও কি বয়ে চলা বন্ধ করে দিয়েছিল তখন? সেরকম আলোহীন শব্দহীন অন্ধকারের ভেতর একখানা বিরাট হলদে আলো আকাশের মতো উঁচু বাঁশের ওপর জ্বলছে। আর সেই আলো বকুলকে দেখেই সোজা নেমে এসে বকুলের গা হাত পা শিরা খুলি সব ঝাঁ করে পুড়িয়ে দিল।
—ও বকুল, দেখ বাবার কী হয়ে গেল! ও বকুল বাবা সাড়া দিচ্ছে না ও বকুল আমাদের সব শেষ ও বকুল তোর বাবা ও বকুল আমাদের কী হবে ও বকুল…
এই সেই ধুয়ো। এই সেই ধ্রুবপদ। এই সেই খোলের আওয়াজ। এই সেই খালি গায়ে দই-এর ওপর গড়াগড়ি। এই সেই ঠান্ডা মুখে ঘি মাখানো। এই সেই দাড়ির খড়খড় থচ মানুষটি নেই। এই সেই কয়েকটি বাঁধাধরা কথা যা গোল গোল ঘুরে ঘুরে বকুলের জীবনে এরপর থেকে এর আগে থেকে বকুলের বকুলবোধ আসার আগে থেকে, বকুলের বকুলজন্মের আগে ও বকুলজন্ম পার করে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে আসছে। আর কোনো সুর নেই। আর কোনো কেন্দ্রবিন্দু নেই।
বকুলকে খেয়াল রাখতে হয়। এই যে এই উঁচু মতন জায়গাটায় এত লোক। সকলের কালো কালো গা। একজনের ভেতর দিয়ে আর একজনকে দেখা যায়। ঐ যে ছোটোকাকা এসে পৌঁছেছে। ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সেরকমই কালো কালো কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের কাছে নিয়ে গেল। দিদির কাছে নিয়ে গেল। ছায়া লোকটা তাকে জড়ানোতে তার গায়ে কাগজ পোড়া ছাইয়ের মতো পাতলা কালোমতন কিছু লেগে গেল। কিন্তু সেসব খেয়াল করার সময় তখন কই! বকুল দেখছে মায়ের হাত পা গলা মাথা সব কিছু বিন্দু বিন্দু বলের মতো ছিটকে ফেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার ফিরে এসে জোড়া লেগে মা হয়ে যাচ্ছে। যেন তার মা, অত্যন্ত সুষমভাবে, তার শরীরের প্রতিটি অংশ, তার চোখের জল গড়িয়ে পড়া, চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে দম হারিয়ে ফেলে শুধু হাঁ করে থাকা, আলুথালু কাপড়চোপড়— সব নিয়ে একটি বোমা বিষ্ফোরণে বারবার উড়ে যাচ্ছে, আবার জোড়া লেগে যাচ্ছে।
বকুলকে তাই খেয়াল রাখতে হয়। মা যাতে মা-র জায়গায় থাকে। দিদি যাতে মিলিয়ে না যায়। এই যে মা ওর ছোট্ট কাঁধে ভর দিয়ে চোখ বুঁজে আছে আর জায়গাটা ট্রাকের সামনে ড্রাইভারের কেবিন, এই যা বাবা পেছনের খোলে মাচায় বাঁধা হয়ে শুয়ে আর কতগুলো লোক কোমরে গলায় গামছা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, হাওয়ায় তাদের গামছা উড়ছে, এই যে বকুল বারবার মা-র মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর অজান্তে লক্ষ করছে, দাঁতে দাঁত লেগে গেল কি না আর ভাবছে যদি মা-র ও দাঁতে দাঁত লেগে যায় তাহলে এখন ও চামচ পাবে কোথায়— এসব কি আজকে থেকে ঘটছে? এ চাকা কি কোনওদিন থামবে? বকুল কি জানে?

অনেক আগের কোনো একসময় থেকেই বকুল জানত, ওই যে দু’জন তার হাত ধরে আছে, তাদের একজনের হাতের তালু ঘামে জবজব করবে।

জানে বৈকি। তাই তো এখন এই ফাঁকে ছাদের অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে আছে। কারণ, ডাক্তারবাবুরও ফাইনালি বলা হয়ে গেছে, হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তারবাবু আরও বলেছেন, ইমিডিয়েটলি। কারণ, এই বিরাট বাড়ির কাঁঠালের কোয়ার মতন ঘরগুলো থেকে কাঁঠালের বিচির মতন ফ্যাকাশে সব লোকজন কে জানে কতদিন পর বেরিয়ে এসে একজায়গায় জড়ো হয়েছে। কেননা বকুলদের ঘরের সামনেটা সরু। দাঁড়ানো মানুষকেই বেরোতে কসরত করতে হয়। শোয়া মানুষকে কীকরে বের করা যায়? তারপরও রয়েছে মানুষের নাড়িভুঁড়ির মতো প্যাঁচ খাওয়ানো সিঁড়ি। বাবাকে কী করে নিয়ে যাওয়া হবে? এতদিন বাবা তাদের নিয়ে গেছে। আজ বাবাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর মানে কবে থেকেই যেন বকুল জানে। তবু আজ নতুন মাছের মতো, এই কথার মানে পুকুরের ঘোলা জলের কোন তলা থেকে ভুস করে উঠে আসছে।
ওরা ধরে ধরে কাত করে বাবাকে নামাচ্ছে। ঠিক সেবার মেজকাকারা চলে গেলে তিনচারটে লোক মিলে যেভাবে আলমারিটা নামাচ্ছিল। ধরে ধরে নামাতে নামাতে বাবার বোধহয় ঝাঁকুনি লাগল। বোধহয় আর একটু কষ্ট হল। বাবার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো, গরররর।
বাবা কি বাঘ হয়ে গেল? না সিংহ? বকুল জানে হাসতে নেই। বকুল জানে, সব শেষ হতে চলেছে, হাসিখুশি শুকিয়ে যাবে। তবু, জগতের শিশুদের মতোই, শেষবারের জন্যই হয়তো, সম্পূর্ণ বেখাপ্পাভাবে মনে পড়ল, এরকম আওয়াজ করে হাঁদাভোঁদার পিসেমশাই। হাঁদাভোঁদার যে বইটা ওর কাছে আছে, তার নাম ‘পিষে দিল পিসেমশাই’।
বাবাকে নিয়ে চলে যাওয়া হয়ে গেছে। ও এখন অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে। পাশে একটা ছোট্ট সাদা ফুলের গাছ আর আকাশের অগুন্তি তারা ছাড়া কেউ তাকে খেয়াল করছে না। তার বৃত্তাকার জীবনের বাইরে একটি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, সব কিছু এক মুহূর্তে জেনে বুঝে যাওয়ার আগের বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, হাঁদা ভোঁদার পিসেমশাইয়ের কথা মনে করে, হাঁদাভোঁদার গল্পে বাবার মুখ মনে করে, বকুল মুখে হাত চাপা দিয়ে একবার হেসে নিল— হি হি।

Facebook Comments

পছন্দের বই