লেখক নয় , লেখাই মূলধন

আশরাফ জুয়েলের গল্প

গলছে মেঘের হাতিটা

চিত্র: রেনে মাগরিত

—দোলেমোন, বালো, তি-ভী… সাড়ে তিন বছর বয়সী মুখ থেকে বের হয়ে আসা শব্দগুলো এখনও স্পষ্টতা পায়নি। কিন্তু অন্য বাতাস তাঁর কথায় প্রাণ যোগাচ্ছে।
—তিভী, দোলেমোন, শুন্দল… বিষণ্ণ শহরে হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলোর মতো হেসে ওঠে শিশু মুখ।
—মেগ, মেগ… মেগ সুন্দল। ড্যাডি, ড্যাডি। শিশু মুখ মুহূর্তেই সান্ধ্য-সূর্যের মতো মলিন হয়ে যায়, দেখে মনে হয়, তাঁর মুখের ঠিক বিপরীতেই ক্রমশ জেগে উঠছে একটি মৃত চাঁদ।
এই মৃদু দৃশ্যগুলোকে চাঁদের আলোয় হারিয়ে যাওয়া কুমারী রাতের মুখমণ্ডলের মতো মনে হতে পারে, টিউবওয়েলের স্বচ্ছ জলের প্রবহমান শরীরও মনে হতে পারে। আসলে কে কী মনে করল তাতে হাজেরা, মুনমুন বা এলিটা’র কিছুই যায় আসে না— সে-সময় তাঁরা পেরিয়ে এসেছেন।
—তারপর কী হল জানো? হুট করে আমার বিয়ে হয়ে গেল। মেট্রিকে খুব ভালো করেছিলাম। হাজেরার মুখ থেকে বের হয়ে আসা কথাগুলোর মধ্যে এখন থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের সেই সময়টাকে ছুঁয়ে দেখবার প্রবণতা দৃশ্যমান।
—আর্কিটেকচার ফার্ম খুলেছিলাম একটা। অল্প সময়ে দাঁড়িয়েও গেছিল। মুনমুন বলেন, আমি, আমার হ্যাজব্যান্ড আর এক বন্ধু— এই তিনজনে মিলে গড়ে তুলছিলাম স্বপ্নের ফার্মটা।
—তখনকার দিনে একজন মেয়ের কলেজে পড়ার ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে দেখা হতো। মেঘের আসনে ভেসে যেতে যেতে বলেন হাজেরা বেগম। পৃথিবী থেকে অনেক দূরের বিচিত্র সৌন্দর্য তাকে আটকে রেখেছে ভালোবাসার আদরে।
—বুয়েট থেকে পাশ করার পর চাকুরি করতে চাইনি, বরং নিজেরাই কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। আঠাশ বছরের মুনমুন, মানুষের চেহারায় আগুন জ্বলে তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল, বিশ্বাস করতে হলে মুনমুনের দিকে না তাকালে বোঝা যায় না।
—ছয় বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল আমাদের, তারপর বিয়ে, খুব কেয়ারিং ছিল আতিফ, খুব। ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মটা নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতাম আমরা।
—কলেজের দিনগুলোতে নিজের বানানো অরণ্যে রংবেরঙের ফড়িং হয়ে উড়ে বেড়াতাম। চালশে পড়া অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকেন হাজেরা।
—নতুন প্রতিষ্ঠান, একে দাঁড় করানোই ছিল আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। এই অন্য পৃথিবীর আলো-বাতাসে ইতোমধ্যেই নিজেকে খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছে মুনমুন। অন্য দুইজন মানুষের সাথে নিজের মিল খুঁজে পেয়ে ভীষণ আনন্দিত সে।
—তারপর কী হল? স্বামীকে খুব ভালোবাসতে?
—দ্যাকো, দ্যাকো! পাহাল… পাহাল… দ্যাকো না?
এলিটা’র উজ্জ্বল-বর্ণ মুখ হঠাৎ খেলে ওঠে, সূর্যোদয় যেমন সৌন্দর্যের তুফান তোলে তুষারাবৃত পর্বতের মুখে, ঠিক তেমনি। এলিটার দৃষ্টির অদৃশ্য সুতো ধরে মেঘ-পাহাড়ের দিকে তাকায় হাজেরা আর মুনমুন।
অকস্মাৎ চরিত্রগুলো সময়কে আঁকড়ে ধরবে কি না, তা এই গল্পের জানা নেই। তাঁদের এও জানা নেই, জানা নেই গল্পের বাকি অংশ পড়তে পাঠক আগ্রহী হয়ে উঠবেন কি না। গল্পের একেবারে শুরুতেই চরিত্রগুলো গল্পটিকে চমকিত করেছে কি না, তা নিয়েও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাঁদের। হয়তো এখন ভাবতে পারেন গল্পটা আসলে কার? ভাবতে পারেন এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কীভাবে নিজেকে গল্পের শরীরের সাথে মানিয়ে নিচ্ছে। অথবা আপনি গল্পের ভেতরের গল্পের কথা নিজের মতো করে ভেবে নিতে পারেন, এবং; গল্প আপনার কথা ভাবে না, চরিত্রগুলো গল্পের কথা ভাবে না, ভাববার মতো সময় তাদের নেই। সে শুধু সময়ের স্রোতে ভাসতে থাকে। কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা জানার চেষ্টাও করে না, গল্পটি কীভাবে অদৃষ্টের দিকে এগিয়ে যায়, তা নিয়েও কোনো মাথাব্যথা নেই চরিত্রগুলোর।
—বিয়ে করতে চাইনি, চেয়েছিলাম পড়াশোনা চালিয়ে যেতে, আমার কপালে পড়াশোনা জোটেনি, তবে বাবার কপাল আলো করে এসেছিল ইঞ্জিনিয়ার জামাই। মাত্রই পড়াশোনা শেষ করে চাকুরিতে ঢুকেছিল।
—আমাদের বিয়ের বয়স আর ফার্মটার বয়স ছিল একই। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করতাম আমরা। নিজেরাও ভাবতে পারিনি এত দ্রুত উন্নতি করব।
—আমার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী বাবাকে কথা দিয়েছিল, আমার পড়াশোনা বন্ধ করবে না। দূর পাহাড় থেকে হাজেরা মনোযোগ দেন মেঘের ভেলায় ভাসতে থাকা এলিটার দিকে।
—তার মানে আপনাকে আর পড়তে দেয়া হয়নি?
—না। এরপর থেকে সে আর কখনই কোনো কথা রাখেনি।
—বিয়ের মাত্র দেড় বছরের মাথায় আমাদের সংসার আলো করে আসে আমার প্রথম সন্তান।
—ফার্মের পার্টনার, আমাদের বন্ধু বিয়ে করে আমেরিকা চলে যায়, তাঁর অংশীদারিত্ব আমাদের কাছে বিক্রি করে দেয় সিক্তা।
—কী মদা! কী মদা! হাততালি দিয়ে ওঠে এলিটা।

গল্পের একেবারে শুরুতেই চরিত্রগুলো গল্পটিকে চমকিত করেছে কি না, তা নিয়েও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাঁদের। হয়তো এখন ভাবতে পারেন গল্পটা আসলে কার?

তিনজন মানুষ, একজন আরেকজনের কাছে গল্প হয়ে এসেছে। হাজেরা, মুনমুন আর এলিটা। হাজেরা, বয়স ঊনষাট। মুনমুন, আঠাশ। এলিটা, সাড়ে তিন বছর। মৃতদের বয়স বাড়ে না, জীবিতরা মৃতদের পরামর্শ দিতে পারে না, শাসন বা আক্রমণ করতে পারে না, মৃতরা জীবিতদের ইচ্ছাধীনও নন। তাই হয়তো গল্পের চরিত্রগুলোকে সংজ্ঞাতীত মনে হতে পারে, মনে হতে পারে বাস্তবে এঁদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, আবার এমনও হতে পারে নির্মিতব্য গল্পের প্রতি সহমর্মিতা, ঘৃণা বা কোনো কিছুর উদ্রেক হচ্ছে না।
—কাঁদছ কেন? এলিটা? মজা। মজা তো! তোমার চিবুকের ভাজে লুকিয়ে আছে অনেক মজা।
—কী হল এলিটা! দ্যাখো ঐ যে ওই মেঘের বনে একটা এলিফ্যান্ট!
—মএলিপ্যান্ত?
—হ্যাঁ, ওই যে, ওই খানে।
—এলিফ্যান্টের পিঠে চড়বে, এলিটা?
—কোতায়? এলিপ্যান্ত? ওতা তো ড্যাড।
—ড্যাড? ওটা তোমার বাবা? তোমার বাবাকে তোমার মনে আছে?
—হ্যাঁ, আছে, মনে তো, ড্যাড আইস্কিম, ড্যাড ডল, ড্যাড দোলেমোন… ড্যাড…
—দ্যাখো, দ্যাখো হাতিটা উড়ছে, তোমার কাছেই আসছে মনে হয়!
—ড্যাড আসছে? ড্যাড এলিপ্যান্ত।
গল্পে সংলাপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে এবং সংলাপগুলো কোন অর্থ বহন করে কী না?, অথবা এ কথা বলে গল্পটিকে বাতিলের তালিকায় তুলে রাখা যেতে পারে যে এটি আসলে কোন গল্প হয়ে উঠতে পারছে না। হয়তো আদৌ গল্পটি পাঠককে মনোযোগী করে তুলতে পারছে না। গল্পে এই পর্যন্ত যা কিছু বলা হয়েছে তার সবই মনঃকল্পিত বলেও মনে হতে পারে।
হাজেরা, মুনমুনের এগুলো নিয়ে ভাবার এতটুকুও সময় নেই। মেঘের হাতিটা বৃষ্টি হয়ে ঝরছে, সমস্ত ভাবনা সেটাকে নিয়ে।
—‘ড্যাডি…? কোথায় গেল? এলিপ্যান্ত? সব হালিয়ে গেল? আমিও হালিয়ে গেছি? আমি হালিয়ে গেছি। মাম্মাম খুঁদতে আমাকে? মাম্মাম কই?’ এলিটা’র কান্নার করুণ সুরে ভাসমান মেঘ গলে যাচ্ছে। হাজেরা আর মুনমুন দুইজনে মিলে এলিটার কান্না ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।
—এলিটা বাবুন তুমি চাঁদে যাবে?
—আয় আয় চাঁদ মামা/টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ/টিপ দিয়ে যা।/হাজেরা বেগমের সুরেলা গলায় ঘুমপাড়ানি গান, ধীরে ধীরে চোখ মুদে আসে এলিটার।
—আমার মা-ও আমাকে এই গান শুনিয়ে ঘুম পড়াতেন। মুনমুন অতীত স্মৃতিকে নবায়ন করার চেষ্টা করে।
—আমার মা আমাকে কখনই ঘুম পাড়ায় নি। হাজেরা বেগমের দীর্ঘশ্বাস।
—কেন?
—জন্মের কিছুক্ষণ পরেই মা যান।
—যাঁদের মা নেই তাঁদের কাছে পৃথিবী একটা খাঁচা।
—যাঁদের মা আছে, তাঁদের কাছেও।
—কীভাবে? মুনমুন বাধ্য ছাত্রী হয়ে যায়। সমস্ত মনোযোগ জড়ো করে।
—মেয়েরা খাঁচাবন্দী পাখি…
—এই যে দেখছ না, এলিটা পাখীটাকে, খাঁচা ভেঙে পালিয়ে এসেছে। হাজেরা আর মুনমুন দুইজনেই এলিটার ঘুমন্ত মুখের উপর জেগে থাকা বিষাদের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে।
—আমি আর আমার মা, আমরা এক সাথেই মারা যাই… মুনমুন বলে ওঠে।
—তোমার স্বামী? তখন তোমার বিয়ের কয় বছর?
—আমি তখন গর্ভবতী।
গল্প নির্মাণের জন্য এই প্লটটি কী দুর্দান্ত? গল্পের প্লট নির্বাচনে লেখকের অন্তর্গত ভাবনার ভেতর কতটুকু পরিকল্পনা লক্ষণীয়? গল্প বলতে গিয়ে কতটা সাবধানতা অবলম্বন করেছেন তিনি? গল্পটি কি পূর্ণসচেতন? গল্পে কি কোনো দ্বন্দ্ব প্রতীয়মান? প্রতীয়মান দ্বন্দ্ব কতটা প্রামাণিক? নাকি পুরোটাই কৃত্রিম? গল্প বয়ানে অস্থিরসঙ্কল্পটার উপস্থিতি পাঠককে কী পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে প্রবেশের জন্য উদ্‌গ্রীব করে? অবশ্য দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে গল্পটি নিজেকে কতটা আগলে রাখতে পেরেছে, তা গল্প বা চরিত্রের বিবেচনার বিষয় নয়। তাদের এটা জানাও মোটেও জরুরি নয় যে, গল্পটির শেষ দৃশ্য সংক্ষিপ্ত না কোনো দ্যোতক অর্থবহ। এমনও হতে পারে গল্পটি আসলে গল্পের উপর শকুনের দৃষ্টি হয়ে ঘোরাঘুরি করছে। এই পর্যন্ত যা কিছু বলা হয়েছে তা হয়তো কোনো ব্যাখ্যা দাবি করে কিম্বা করে না— কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল? নাকি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার বিবৃতি মাত্র?

দুই
ততক্ষণে ওড়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সে। তার দুই হাত প্রসারিত হয়ে বেগুনি রঙের দুইটি সুদৃশ্য ডানায় রূপান্তরিত হয়েছে। চোখের মধ্যে এসে বসেছে ভূমধ্যসাগর। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ লবণাক্ত— তাতে অস্থির মানচিত্র। ঠোঁটের উপর দুইটি উলম্ব জাহাজ। চুলের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের অবশিষ্টাংশ, উদ্দাম নৃত্যের তালে খেলছে। পায়ের আঙুলে বাঁধা আছে দশটি পৃথিবী। পেটের ভেতর আহত গোঙানি-তুমুল প্রদাহে জ্বরের গান। গান হল মেয়েটির ভাষা। গল্পে গল্পে শিশুরা মেয়ে হয়ে ওঠে।
—“টুইঙ্কল, টুইঙ্কল, লিটল স্টার,/হাউ আই ওয়ানডার হুয়াট ইউ আর
আপ অ্যাবাব দ্য ওয়ার্ল্ড সো হাই,/লাইক অ্য ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই।
হোয়েন দ্য ব্ল্যাজিং সান ইজ গন,/হয়েন হি নাথিং সাইনস আপন,
দ্যান ইউ শ্যু ইউর লিটল লাইট,/টুইঙ্কল, টুইঙ্কল, অল দ্য নাইট।”
দূরে কোথাও গল্পের ভাষা’রা ফিসফিস শব্দে কথা বলছে।
বসে বসে তাঁর উড়ে যাওয়া দেখছি, নিজের হাত দুটোকে কেটে ফেলা ব্যতীত কিছুই করতে পারিনি। দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গের জীবন আছে, উড়ে যাবার পূর্বে আমি মেয়েটিকে কথা দিয়েছি, আমার প্রত্যেকটি অঙ্গকে লবণের হ্রদে ভাসিয়ে দেব। কথা রাখতে পারিনি আমি, পুরুষ কথা রাখতে পারে না।
—জানি না, কে আমার এই সর্বনাশ করল।
—আমি অফিসে ছিলাম।
—হ্যাঁ, বাসায় সবাই ছিল, দুইজন বুয়া, কাজের ছেলেটি আর আব্বা আম্মা। আব্বা আম্মা ঘুমচ্ছিল।
—কাজের ছেলেটাকে পুলিশে দিয়েছি।
—ড্রাইভার ছিল, কিন্তু সে-তো গ্যারেজে ছিল।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ একবার নাকি বুয়ার সাথে নীচে খেলতে গেছিল, খেলে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
—পুলিশ কাজের ছেলেটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, প্রচুর মারধরও করেছে, সে কিছুতেই স্বীকার যাচ্ছে না।
—সে ছাড়া আর কে এই কাজ করবে? সেই করেছে, তার সর্বচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করব।
কর্পোরেট হাসপাতালগুলোর করিডোরে ডেটলের গন্ধ থাকে না, তাই এসব হাসপাতালকে ঠিক হাসপাতাল বলে মনে হয় না, মনে কোনো পাঁচতারা হোটেল।
—ডক্টর, আমার মেয়েটা বাঁচবে তো? যে করেই হোক ওকে বাঁচিয়ে তুলেন।
—আমি শিশুটির মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। কী বলব? কিছুই বলতে পারিনি, শুধু একটি ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছি।
—বসুন।
—কিছু কথা বলব আপনাকে।
—শান্ত হয়ে বসুন,আর কে কে আছে আপনার সাথে।
—আপনার বাবা-মাকে ডাকুন।
—আপনার হ্যাজব্যান্ডকেও ডাকুন, তিনি কোথায়?
—ওহ, তিনি নেই! সরি।
—জ্বি, জ্বি আসুন আপনারাও বসুন।
—ছেলেটি সব দোষ স্বীকার করেছে?
—ও আচ্ছা, পুলিশ ওকে মারতে মারতে একেবারে যখন প্রায় মেরেই ফেলছিল তখনই মুখ খুলেছে শয়তানটা? বলেছে, আপনার মেয়ের সাথে সে-ই এমন করেছে? তারপর আবার কাঁদতে কাঁদতে আবার বলেছে, আপু বাঁচত নি আম্মা? আপুরে আল্লা যান বাঁচাইয়া দ্যায়।
—আমরা অনেক চেষ্টা করেছি।
—শেষ পর্যন্ত ওর ব্লাড প্রেশার ওঠেনি।
—ওর যৌনাঙ্গের ভেতরের পর্দা ছিঁড়ে রক্তের নালী ফেটে যায়, এর ফলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
‘ফিজিক্যাল এন্ড মেন্টাল ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, এডমিট হবার পর আর জ্ঞান ফেরেনি ওর।’
—সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি আমরা।
—সরি…
পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে, পতনের শব্দ পাচ্ছি স্পষ্ট। দেখছি হাসপাতালের শাদা বিছানা উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে অনির্ধারিত আয়ু সীমানার দিকে, শিশুটি খলবল করে হাসছে।
এভাবেই শেষ হতে পারত গল্পটা। কিন্তু শেষ হয়নি… দুইদিন পর ডাঃ কিশওয়ার ডিউটিতে এসেই হন্তদন্ত ছুটে আসে।
—কী হয়েছে?
—যে বাচ্চাটি গত পরশু মারা গেছে, ঐ যে সেক্সুয়াল অ্যাসল্টের বাচ্চাটা, ওর নানু ফোন করেছিল।
—উনার কথা শুনে কী করব বুঝতে পারছি না।
—তোমাকেও বলতে নিষেধ করেছে…তুমি পুরুষ, তোমাদের বলতে নিষেধ করেছে।
—কিন্তু তোমাকে না বলে পারছি না…
—মেয়ে সেক্সুয়াল অ্যাসল্টে মারা গেছে বলে? না না। কাজের ছেলে এই কাজ করেছে বলেও না।
—আমি ঐ নাম্বারে বারবার কল করেছি, কিন্তু কথা বলার পর থেকেই বন্ধ পাচ্ছি।
—ফাইলে দেয়া সবগুলো নাম্বারেই কল করেছি।
—কী বলেছে?
—উনি আর উনার মেয়ে বলেছে, তাঁরা সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাচ্ছেন।
হাজেরা, মুনমুন আর এলিটা; এই তিনজন আকাশ হয়ে উড়ছে, ওঁরা বাতাসকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের দিকে, যাচ্ছে সৃষ্টিকর্তার কাছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে সম্ভবত ওদের কিছু প্রশ্ন ছিল, তবে সৃষ্টিকর্তা পুরুষ হলে তাঁর কাছেও ফিরবেন না তাঁরা…
—এমন কাজ কে করেছে?

পুলিশ ওকে মারতে মারতে একেবারে যখন প্রায় মেরেই ফেলছিল তখনই মুখ খুলেছে শয়তানটা? বলেছে, আপনার মেয়ের সাথে সে-ই এমন করেছে? তারপর আবার কাঁদতে কাঁদতে আবার বলেছে, আপু বাঁচত নি আম্মা? আপুরে আল্লা যান বাঁচাইয়া দ্যায়।

সে যেই হোক, কিছুতেই সে হাজেরা, মুনমুন, এলিটার— স্বামী, বাবা বা নানা হতে পারে না বরং সব সম্পর্ক চুকিয়ে যে একজন পুরুষ, দানব-পুরুষ।
সময়ের চরিত্রে আলতা-হাহাকার, গড়িয়ে আসছে মহাবিষের দিকে, কাঁপছে বিশ্ব। ডানা দুইটি নড়ছে, বাতাসের দেহে প্রবল আঘাত, শিশুটি উড়ছে, শ্বাস শ্বাস দূরত্বে জেগে উঠছে অনাবৃত গরল, কোথায় অভিশপ্ত নগর? দলিত কোথায় নগরের নকশা? সময়ের নখে থোকা থোকা বাঘ?
গলছে মেঘের হাতিটা…

Facebook Comments

পছন্দের বই