লেখক নয় , লেখাই মূলধন

উত্তমকুমার পুরকাইতের গল্প

পরলোকে রবীন্দ্রনাথ

অধুনা পরলোকে আজকাল ইন্দ্রলোক বা বিষ্ণুলোকের প্রতি মোহ নেই। বরং মৃত্যুর পূর্বে যাঁরা রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন, মৃত্যুর পরে ভিড় বাড়াচ্ছেন রবীন্দ্রলোকে। পৃথিবীর সব রবীন্দ্রানুরাগী এক জায়গায় সমবেত হতে পেরে ধন্য-ধন্য করছেন।
পরলোকের একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে। সারাবছর শরৎ ও বসন্ত। প্রায় প্রতিদিন উৎসব। নাচ-গান, গল্প, কবিতা পাঠ, চিত্র প্রদর্শনী, নাটক… পারিষদবর্গ বেষ্টিত রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ আবেশে দেখছেন তাঁর সৃজনীশক্তির স্বর্গীয় দ্যুতি। হঠাৎ তাঁর সিংহাসন টলমল। পাশে পুত্র শমী এবং রথীন। বাবার মুখে চিন্তার ভাঁজ দেখে রথীন বললেন, কী হয়েছে বাবা?
পৃথিবী থেকে আবার এক টান, কেউ যেন টেনে নামাতে চাইছে।
শমী চিন্তিত। হাসলেন, আমার মৃত্যুর পর তুমিও এমনভাবে টান দিতে। প্ল্যানচেট করতে। পৃথিবীর মানুষের তো এই ভূতুড়ে নেশাটাই বেশি। জীবিতকে বাদ দিয়ে মৃতকে নিয়ে যত্ত আদিখ্যেতা।
নীচে আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই রবীন্দ্রনাথের। স্বর্গ থেকে স্পষ্ট দেখা যায় পৃথিবীতে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা কমছে। ওখানে আজকাল তাঁর সংগীতকে নিয়েও বিতর্ক। কেউ কেউ তাঁর সুর-ছন্দে কলম চালাচ্ছে।
সিংহাসন তীব্র দোল খায়। রথীন বললেন, বাবা যাও, হয়তো কোনও ভক্ত তোমাকে নিয়ে রিসার্চ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে।
ইথার তরঙ্গে ভাসলেন রবীন্দ্রনাথ। একুশে শ্রাবণের রাত। মাইকে-মঞ্চে জোর প্রস্তুতি। সকাল হলেই তাঁর প্রয়াণ উৎসব। পরলোকে কোনও জন্ম-মৃত্যু কিংবা বিশেষ কোনও উদযাপন ব্যবস্থা নেই বলে ক্যালেন্ডার প্রথাও নেই। পৃথিবীর ভক্তরা ডাক দিলে নেমেই বুঝতে পারেন কোনটা বাইশে শ্রাবণ, পঁচিশে বৈশাখ। সবসময় যে নামেন তা নয়, পৃথিবীর মানুষ তাঁকে নিয়ে মাঝে-মাঝে এমন কাণ্ড করেন নামতে বাধ্য হন।
ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি পেরিয়ে তাঁর অশরীরী আত্মা ঢুকে পড়ে তিনতলার এক ফ্ল্যাটে। অন্ধকার ঘরে চার ভক্ত ধাতব বোর্ডে বাতি জ্বালিয়ে প্ল্যানচেটে বসেছে। তেকোনা চাকতিতে হাত রেখে একজন বলে, ভাল আছেন স্যার?
ছোকরাকে দেখে তাঁর রাগ হয়। বোঝাই যাচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম। তাঁকে বিশেষ পড়েনি। কৌতূহলবশত ডাকছে। গম্ভীর হয়ে তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ।
মাঝরাতে এভাবে ডাকায় রেগে গেছেন?
ঠিক আছে, বলো।
স্কুল-কলেজের সিলেবাসে আপনার লেখা কমে গেছে।
উত্তেজিত হলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বর্গে তাঁকে নিয়ে মাতামাতি, আর এখানে তামাশা? এই মস্করার মীমাংসা করার জন্য তাঁকে ডাকা! তাঁর প্রতিক্রিয়া চাওয়া! কী ভেবেছে এই ছোকরারা?
তোমাদের দায়িত্ব নেই আমাকে রক্ষা করার? আমার সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার?
রাগ করবেন না স্যার। আপনাকে নিয়ে আমরা এখানে কোণঠাসা। তবে আমরা ছাড়ব না। কাল আপনার প্রয়াণ দিবসে আন্দোলনে নামব। রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ, আপনাকে নিয়ে রাজনীতি করা চলবে না।
খবর্দার! আন্দোলনের নামে কোনও উচ্ছৃঙ্খলা আমি বরদাস্ত করি না। আমি চাই না আমাকে মুখোশ করে মিছিলে হাঁটো। তোমাদের অভিনব প্রতিবাদ আমার সহ্য হয় না। আর কখনো আমাকে ডেকো না।
ওরা চমকে ওঠার আগে রবীন্দ্রনাথ বেরোলেন। নিজের উপর একটু রাগ হল। জীবিতকালে তো কখনো এত রাগেননি। কেন এত ক্ষোভ, আভিমান! তাঁর কানে গিয়েছে তাঁকে নিয়ে চর্চা আর বেশিদিন থাকবে না। তাহলে পৃথিবীতে কি তাঁর অমরত্ব শেষের মুখে?
মেঘ ফেটে বেরিয়ে আসছে আকাশের চাঁদ। মিহি বৃষ্টির গুঁড়োয় গাছপালা কাঁপছে। হঠাৎ পৃথিবীটার উপর লোভ হল। এই পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে তো তিনি ইতিহাস। ইচ্ছে হল সবার অলক্ষে একটু থাকতে।
সারা পৃথিবীতে ভাসলেন। ঘুরে-ঘুরে দেখলেন। ভোর নামছে। পূবের আকাশে লালিমা। সূর্য ওঠার আগে তাঁকে যেতে হবে। মাইকে তাঁর গান বেজে ওঠে। ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও / মনের কোণে সব দীনতা, মলিনতা ধুইয়ে দাও…’
রবিঠাকুরের আত্মা বুঝি তৃপ্ত। পরিচিত হাসিটি হাসেন। যা-হোক এই জরা-জীর্ণ সময়ে কিছু মানুষ তো তাঁকে চায়।

ছবি: ইন্টারনেট

Facebook Comments

পছন্দের বই