লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কুলদা রায়ের গল্প

লক্ষ্মী দিঘা পক্ষী দিঘা

গোলরুটির চেয়ে গোলারুটিই বেশি মজার। বড়ো মামী এ ব্যাপারে ফার্স্টক্লাস। নানারকমের গোলারুটি বানাতে তার জুড়ি নেই। আটা গুলে তার মধ্যে পিঁয়াজ কুচি দিয়ে পিয়াজ রুটি। কাঁচা মরিচ দিয়ে মরিচ রুটি। আর কালো জিরা দিলে বেশ টোস্ট টোস্ট ভাব আসে।

আজিমার পছন্দ শুকনো মরিচ। এটা ছোটোদের জন্য একেবারে নো। তাদের জন্য গুড়ের ঢেলা। না পেলে ছেঁচকি শাক। কখনো পুঁই রুটি। পুঁইশাক কেটে গোলা রুটির মধ্যে ছেড়ে দেবেন। ভাপে সিদ্দ হবে। তার বর্ণ দেখে দেখে, ‌ওগো মা, আঁখি না ফেরে।

এ-বাড়ির পুরোনো আদ্যিকালের কড়াইটার একটা হাতল নাই। ৯ মাস পুকুরে চোবানো ছিল। সারা দিনমান পুকুরে ডুবে ডুবে খুঁজে বের করে এনেছিল নিমুইমামা। আজিমা পেয়ে মহাখুশি। বলেছিল, পলানোর সুমায় হাতলডাও ছেলো। দেখ, খুঁইজা পাস কি না। আবার ডুব দে মন কালী বলে।

মামা ডুবে ডুবে পিতলের ঘণ্টা পেয়েছিল। আজিমা মুখ ব্যাজার করে বলেছিলেন, এইটা দিয়া কী করুম।

— ক্যান পূজা করব। ঘণ্টা বাজাইয়া আরতি দিবা।

— পূজা তো হারা জীবন ভইরাই করছি। তবুও তো সব হারাইছি। ভিটা ছাড়ছি। বাপকাগারা বেঘোরে মরছে। পূজা কইরা লাভ কী রে বাপ। হাতলডা খোঁজ।

হাতলডা খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাতল ছাড়াই এই কড়াইতে বড়ো মামী সুন্দর করে গোলারুটি ভাজতে পারে। ছেঁচকি শাক রানতে পারে। ভাতউয়া টাকির ঝোল বেশ তেড়মেড়ে হয়। সুযোগ হলে ফস ফস করে ফ্যান ত্যালানিও করা যায়। আর কী চাই। শুধু কড়াইটা ধরতে হবে একটু সাবধানে। সাবধানের মাইর নাই। নিমুই মামা বলে, সময় আইলে আরেকটা নতুন কড়াই কেনা হবে।

মামী ফিস ফিস করে বলে, ওগো সুমায়, তুমি সত্যি সত্যি আসিও। হ্যালা কইরো না বাপ।

আজামশাইর কিছু বাহ্যে সমস্যা আসে। তার জন্য গোলারুটির বদলে রান্না হয় নোঠানি। আটার ভাত। সঙ্গে থানকুনির ঝোল। শিংমাছ দিতে পারলে বেশ হয়।

আজা মশাই পেঁপে গাছটার নীচে বসে নোঠানি খেতে খেতে দেখতে পেলেন, আগামি ঋতু এলে মাঠে মাঠে ধান ফলবে। আর তরী বেয়ে রবীন্দ্রমশাই বেড়াতে আসবেন। ঘাটে এসে ঝরঝরে গলায় বলবেন, দুটো ফেনা ফেনা ভাত রাঁধতে বলো তো হে। মেলা দিন পরে জুত করে খেতে চাই।

খেয়ে দেয়ে তিনি গগন হরকরার খোঁজে বের হবেন। তার ইচ্ছে আজামশাই আজ তার সঙ্গে থাকুক। কিন্তু আজা মশায়ের মনটা আজ খারাপ। রবীন্দ্রমশাইকে তিনি বেশ মানেন। কিন্তু মাত্র পাঁচটি ছেলেমেয়ে। তিনটি আগেভাগে মরে গেছে। বউটাও নাই। চৌদ্দটি হলে আরেকজন রবীন্দ্রকে পাওয়া যেত। সেটা সম্ভব হল না। আজা মশাই অবশ্য নিজে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বারো-তে তাকে থেমে যেতে হয়েছে। আজ হাহাকার জাগে।

রবীন্দ্রমশাই রিনরিনে গলায় বলবেন, চিন্তা কোরো না বনিকবাবু। কেউ না কেউ পারবে। অপেক্ষা করতে হবে।

এই বলে কবিমশাই নাও ছেড়ে দেবেন। দাঁড় টানবেন। রাশি রাশি ধান তার নাও ভরা। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো সে-তরী। একটু কাত হলেই জলের মধ্যে ভুস। এর মধ্যে আজামশাই চেঁচিয়ে বলছেন, সাবধানে যাইয়েন গো মশাই।

ধান কই। সব শুকনো খড়। বন্যায় সব শেষ। খড় ডুবলে ক্ষতি কী!

নৌকা ততক্ষণে আড়াল হয়ে হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রমশাই শুনতে পেলেন কি পেলেন না বোঝা গেল না। শুধু দূর থেকে ভেসে এলো— আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আসতে আসতে গানটি আবার বহু দূরেই ভেসে যাচ্ছে। এরপর খুব চুপ। কয়েকটা দাঁড় টানার শব্দ শুধু। ছপ। ছঅপ। ছঅঅপ।

এইবার আজা মশাইয়ের ডাক পড়েছে। আজিমার জন্য গন্ধ ভাদুল তুলতে যেতে হবে। দুপুরে ভাতউয়া টাকির সঙ্গে রান্না হবে। টাকি বঁড়শিতে ধরা পড়েছে। বড়মামী দুটো রসুন কোঁয়া খুঁজতে লেগেছে। সঙ্গে ধানী লঙ্কা। রসুন কোথায়? ঘরের চালের আড়ায়। আড়াটি দরমার বেড়ার। তার উপরে পুরোনো রসুন শুকিয়ে কড়কড়া। কবেকার বলা মুশকিল।

ততক্ষণে উত্তরপাড়ার সালাম মামা এসেছে। বরইতলা থেকে ঊঠোনে আসতে আসতে সামান্য হেঁকে বলছে, নিমুই, বাড়ি আছিস?

নিমুই মামা বাড়ি নেই। তালতলা গেছে। পথে জাঙ্গালিয়া যাবে। শেখ বাড়ি ঘুরে আসবে। তালতলায় ফেলা পাগলার থানে পৌঁছাবে।

সালাম মামার কাঁধে ধামা। আজা মশায়ের পেছন দিয়ে পা টিপে টিপে রান্নাঘরে এসেছে। কাঁধ থেকে ধামাটি রেখেছে। আজিমা চল্লায় ধানী লঙ্কা খুঁজছে। মামী রসুনের আশায় ঘরের মধ্যে আড়ার নীচে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটা টিকটিকির কঙ্কাল পায়ের কাছে ঝরে পড়েছে।

চুলার পাশে হাতল ভাঙা কড়াই। সেখানে একটা গোলারুটি ঢাকা দেওয়া। নিমুই মামা এলে খাবে। ঢেঁকির উপরে চোখ বুজে আছে তিলকি বিড়াল। ধামা দেখে বলল, মিঁয়াও।

এই বাড়িটির উঠোন পশ্চিমে নীচু হয়ে নেমেছে পুকুরে। সেখানে রোদ্দুর থিকথিক করছে। তারপর শূন্য মাঠ। দূরে জাঙ্গালিয়া গাঁও দেখা যায়। মেঘের পরে তালতলা। সেখানে নিমুই মামা গেছে।

সালাম মামা ঢাকনা তুলে এক টুকরো গোলারুটি ছিঁড়ে মুখে দিয়েছে। মুখটা ভরে গেছে। এ-স্বাদের বাক্য নাই। আরেক টুকরো খাবে কি খাবে না ভাবতে ভাবতে দেখতে পেল, বড়ো মামী ঘর থেকে রান্নাঘরে এসে পড়েছে। সালাম মামাকে কড়াইয়ের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলল, খাও না সালাম দাদা, খাইয়া নেও।

— কার জন্যি রাখছিলা গো বড়ো ভাবী?

— নিমুই— নিমুইর জন্যি।

বড়ো মামীর খিদে পেয়েছে। তার কপালে ফোঁটা নেই। পেটের মধ্যে কে একজন গোটা গোটা উসক করছে। বলছে খিদে, খিদে খিদে। তবু রুটির টুকরোটি সালাম মামার হাতে গুঁজে দেয়। বলে, খাও।

সালাম মামা গোলারুটি খেতে খেতে বলে, তুমার হাতে অমেত্ত আছে। শিখলা কোথায়?

— ইন্ডিয়ায়। রিফুজি ক্যাম্পে। ৯ মাস ছিলাম।

— ও। সালাম মামা গোলারুটি চিবোয়। এক মাথা ঘুরিয়ে পেঁপে গাছটার দিকে আড়চোখে তাকায়। তারপর বলে, ও, ইন্ডিয়ায়। আমিও গেছিলাম। বছর তিন আগে।

আলগোছে হাঁটুর নীচু হাত রাখে। হাঁটুতে একটা গুলির দাগ আছে। মাঝে মাঝে টাটায়। শেখ বাড়ির বড়ো শেখই প্রথম দেখেছিল। রক্ত ঝরছে। সালাম মামা গুলি করতে ব্যস্ত। ব্যথা ট্যাথা টের পাচ্ছে না। নিমুই কাঁধে নিয়ে না ছুটলে সব শেষ হত। এর মধ্যে শকুন উড়ে এসেছিল। বুকটা শিউরে ওঠে। সালাম মামা আস্তে করে বলে, ফেলা পাগলা কী কয়?

— কিছু কয় না।

— এই অভাব কি যাবে?

— শুধু আশমান পানে চায়। মুখে বাক্যি নাই।

শুনে সালাম মামা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে। রান্নাঘরের পিছনে বেড়াটা ভেঙে পড়েছে। উত্তরে নালাখালায় নলবন দেখা যায়। শুকনো পাকা। খটখটে। পটপট করে শব্দ হয়।

ধামাটি মামীর কাছে ঠেলে দিতে দিতে বলে, আম্মায় দিছে। লক্ষ্মী দিঘার পয়া চাল। আর নাই। কইছে, বিনার পোলা আইছে মামাবাড়ি। হ্যারে কি খালি গোলারুটি দেওন যায়? একটা কুড়হা হলে ভালো হত। কুড়হা আছেও। উমে বসেছে। এখন ক-দিন কুক কুক করে না। ক-দিন পরে বাচ্চা ফুটবে। এখন কুড়হা দেওন যায় না।

মামীর চোখ ভিজে আসে। পেটের মধ্যে কচি কুড়হা নড়েচড়ে। মাথাটি ঘুরিয়ে মাটির হাড়ির সন্ধান করে। মেলা দিন পরে দিঘা ধানের ভাত রান্না হবে। ভাতউয়া টাকির সালুন হবে। রসুন হলে স্বাদে গন্ধে হবে অমেত্ত। আড়ার উপরে রসুন। রোদে কড়কড়া। গন্ধে পোকা পলায়— পিশাচ দৌড়ায়। খাম বেয়ে কেউ না কেউ পেড়ে দেবে।

সালাম মামা তখন উঠে পড়েছে। বটবাড়ি যেতে হবে। সেখানে একটা লঙ্গরখানা খোলার আলাপ আছে। বড়ো মামীকে জিজ্ঞেস করল, বাপের বাড়ির খবর পাইছ কিছু?

— সেখানে শকুন নামছে। গেল সপ্তায় শুনতি পাইছি।

— চিন্তা কইরো না ভাবি। ফেলা পাগল বাক্যি দেবেন। শকুন তো শকুন— শকুনের বাপেও খাড়াতি পারবি না। চইল্যা যাবেআনে।

সালাম মামা পশ্চিম দিকে পুকুর পাড়ের দিকে নেমে যাচ্ছে। আজা মশাই ততক্ষণে গন্ধ ভাদুলের কথা কিছুটা ভুলে গেছেন। কিছুটা ঝিমুনিতে পড়েছেন। মাথার উপরে পেঁপে গাছে ফুল নাই। ক-টা দড়ি দড়ি পেঁপে ঝুলে আছে।

এ-সময় ঝিমের মধ্যে আজা মশাই মাথাটা নীচু রেখেই বলে উঠেছেন, সালাম আইছিস?

সালাম মামা পুকুর পাড় পার হয়ে যাচ্ছে। পেছন ফেরার ইচ্ছে নেই। যেতে যেতে বলছে, আমি আসি নাই। আসি নাই।

আজা মশাই আরও আরও গভীর ঝিমের মধ্যে ডুবে যান। ডুবে যেতে যেতে বলেন, কবে আসবি রে বাপ?

— জানি না। জানি না।

আজা মশাই ঝিমের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে পড়তে পড়ে যান না। দু-হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুঁজে দেন। কানদুটো হাঁটুতে চেপে ধরেছেন। গলা থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে গলা থেকে। রোদ্দুর এইবার মাথার উপরে উঠে যায়। আকাশটা খনখনে করে ওঠে।

এই ছন্ন ভাবটা পেঁপে গাছটার পছন্দ নয়। শ্মশান শ্মশান লাগে। ফিস ফিস করে বলে, মাস্টার মশাই ঘুমাইলেন নি কি?

আজা মশাই হাউশী ছাড়েন। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মন খারাপ। দুটো ফেনা ভাত হলে রবীন্দ্র মশাইকে নেমতন্ন করা যেত। কবি মানুষ। কোনোদিন খেতে চান না। আজ চেয়েছিলেন। আজা মশাই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখেই উত্তর দেন— না, ঘুমাই নাই। ঘুমাই কী কইরা?

চারদিকে বিল। মাঝখানে এই বাড়িটা। খাঁ খাঁ করে। পেঁপে গাছ বলে, কিছু কথা কই আপনের লগে?

— আজা মশাই, মাথা নাড়ে। বলেন, কইয়া কইয়া তো জীবন গেল। কইয়া লাভ কী?

আজা মশাই বিড় বিড় করেন। পেঁপে গাছের গা শির শির করে। ফির ফির করে জানতে চায়—

এই গেরামে আপনেরা আইলেন কুন সুমায়?

— চার পুরুষ আগে।

— হ্যার আগে আছিলেন কোথায়?

— ভুষণায়। নদ্যা জেলায়। রানি ভবানীর কালে।

— সেখান থিকা আইলেন ক্যান?

— শকুন নামছেল।

— শকুন কী করে?

— মরা ধরা খায়।

— তারপর কী করে?

— আসমানে ওড়ে।

— আশমানে যাইয়া কি করে?

— আবার নাইমা আসে। মাঠে ঘাটে বাড়িতে নাইমা আসে।

— তারপর কী হয়?

— আমরা পলাই।

— পলান ক্যান?

— পলান ছাড়া এই জীবনে আর কুনো উপায় আছে রে বাপ?

এইটুকু শুনে পেঁপে গাছটার পাতা নড়া থেমে যায়। দড়ি দড়ি পেঁপেগুলো সামান্য কাঁপে। কাঁপতে থাকে। ঘরের আড়ায় রসুন শুকোচ্ছে। আরেকটা টিকটিকি গড়িয়ে পড়ে। গন্ধ ভাসে। আজা মশাই এইবার আর কোনো কথা বলেন না। মুখটা হাঁ। হাঁ-এর মধ্যে অন্ধকার। বহু পুরোনো। এই অন্ধকারের কটু কটু ঘ্রাণ আছে।

এই ঘ্রাণ লক্ষ্মী দিঘা ধানের। মাটির হাড়িতে ফেনা ভাতের মধ্যে এই ঘ্রাণ পটর পটর করে। পটর পটর থেকে টগবগ হয়ে যায়। শোনা যায়।

এইবার পাড়া জুড়াবে। রসুন শুকোচ্ছে।

Facebook Comments

পছন্দের বই