লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রিয়ম্বদর গল্প

দর্শক

ভাষান্তর: ইন্দ্রনীল তেওয়ারী

আমরা দু’জনে এক ম্যাজিকের ভিতর ছিলাম। যেমন প্রেম, স্বপ্ন, বা দুঃখের ভেতরে থাকি।

প্রথমবার আমরা এরকম ছিলাম যদিও বাকি সবকিছুই আগের মতোই ছিল। একফালি লন, পেয়ারা গাছ, রাত দুটোর চাঁদের আলো, অক্টোবরের শেষ দিন, শিশির, নৈঃশব্দ্য, ছাদের কার্নিশে ঘুমে ঢুলতে থাকা বিড়াল। এ’সবকিছুই সবসময় সেই ইন্দ্রজালের অংশ ছিল বা সেই ইন্দ্রজাল রচনা করত, অথচ আগে কখনো আমরা এর ভিতর ছিলাম না। আজ ছিলাম।
“আমি একবার মাকে দেখে আসি।” মদের গেলাসটিকে বেঞ্চের কোনায় নামিয়ে রেখে উঠে গেল সে।
“তোমার কিছু লাগবে?”
মাথা নেড়ে বললাম “না”। টলমল করে প্রথম পা ফেলেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভেতরে চলে গেল সে।
চুপ করে ওর চলে যাওয়া আমি দেখছিলাম। ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে অন্ধকারে ঢুকে গেল। প্রথমবার অনুভব করলাম এইভাবে আচমকা উঠে যাওয়ার দরুন সে নিজের পেছনে কিছু ফেলে রেখে গেছে। অত্যন্ত কাছের এক শূন্য। বেঞ্চের একফালি শূন্যতা।
আমি আবার ঘরের দিকে তাকালাম। ভেতরের ঘরের পর্দা নড়ে উঠল। বাইরের ঘরের অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে ধীরে ধীরে বাইরে এল সে। ওকে দেখছিলাম আমি। ওর শরীর জুড়ে অদ্ভুত আলো। স্নিগ্ধ তরল খোলা চুল, আলোয় ভরা ওর ছোটো শরীর, হাত, সুডোল বাজু, ঘাড় আর মুখশ্রী।
এসে বসল বেঞ্চের সেই খালি জায়গাতেই। হাতে তুলে নিল গেলাস। এক গভীর লম্বা শ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
খুব দেরি করে ফেললাম নাকি?
না। কিন্তু ভেতরে কী করছিলে? এত রাতে ঘুমোনো ছাড়া আর কী হওয়ার থাকতে পারে?
ঘুমের ট্যাবলেট রেখে এসেছিলাম। দেখে এলাম খেয়েছে কিনা।
তো?
দেখলাম খেয়ে নিয়েছে।
চুপ করে গেলাম। দেখছিলাম তাকে। মুখের ত্বক যেন কেউ টেনে রেখেছে তবলার চামড়ার মতো। শুধুমাত্র মদ খেলেই ত্বক এরকম টানটান হয়ে যায় তার। ফলত ত্বকের নীচের শিরা, ধমনী, ত্বকের শ্বাস নেওয়া আরও সাদা আরও ধপধপে হয়ে ওঠে।
এই সময়ে সে একবার কেঁপে উঠল। ওর হাতের পাতা ঘাসের উপর রাখা ছিল। শিশিরের ঠান্ডা লাগায় উঠিয়ে হাতটিকে বেঞ্চের উপর রাখল।
“ঢেকে নাও।” চাদরের একটা কোণা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম আমি। “নাকি ভিতরে যাবে?”
নিঃশব্দে চাদরের কোণায় নিজের হাত ঢুকিয়ে একটু ঘুরে বসল সে। তার কোমল মুখশ্রী এইবার একেবারে আমার চোখের সামনে ছিল। পা মুড়ে সে আমার মুখোমুখি বসল। আমরা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
“বলতে পারো জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে হয়?” খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল সে।
“কীরকম সিদ্ধান্ত?”
“যার উপর সমস্ত জীবন নির্ভর করবে বা যার ফলে সমস্ত জীবন বদলে যাবে।”

কোনো জবাব না দিয়ে আমি ঘুমন্ত বিড়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বিড়ালটা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল আবার। দূরে কোথাও চিৎকার করে উঠল একটি পাখি। আমি মুখ ঘুরিয়ে আবার তার চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম সে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। একটি আঙুল, চাদরের নীচে তার হাতের পাতার উপরে রাখলাম। নীল ফুলে ওঠা শিরাগুলোকে অনুভব করতে পারছিল আমার আঙুল। তার চোখে এক বিষণ্ণতা নেমে এল। আমার আঙুল বোলানোর জন্য নয়, বিষণ্ণতা নেমে আসছিল সমগ্র আলো থেকে যা ওর শরীরকে ঘিরে রেখেছিল।
“এরকম দ্বিধাগ্রস্ত সিদ্ধান্ত কখনো অন্তর থেকে নিতে নেই। বরং অন্তরকে শুধুমাত্র দর্শক বানিয়ে রাখো।”
“কেন?”
“দুটো কারণ আছে। প্রথমত অন্তরের কখনো এরকম দ্বিধাগ্রস্ত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন পড়ে না। জীবনের অন্য সবকিছুর এর প্রয়োজন পড়ে। দ্বিধাগ্রস্ততা বুদ্ধির হয়, চেতনার হয়, অর্জিত অনুভবের হয়। যেখানে দ্বিধা থাকে সেখানে আত্মা থাকে না, অন্তর থাকে না। কারণ, দ্বিধাগ্রস্ততা অন্তরের নৈসর্গিক সত্য নয়। অথবা ধরে নাও যেখানে আত্মা থাকে না সেখানেই সংশয় থাকে। বস্তুত দ্বিধা তোমার ভেতরের সত্য নয়, তুমি তাকে নিয়ে আসো। আর দ্বিতীয়ত যদি কখনো এরকম সিদ্ধান্ত ভুলও হয় তুমি কখনো দুঃখ পাবে না যা তোমাকে তোমার জীবনে এক চিরঅন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতরে নিয়ে যাবে। তোমার অন্তর তখনও মুক্ত থেকে যাবে সেসব ভুলের পরিণামে শুধুমাত্র একজন দর্শকের মতো। নির্লিপ্ত, নিরপেক্ষ, নাটকের চরিত্রদের উপর হাততালি দিতে দিতে।
সে কিছু না বলে কয়েকবার নিজের আঙুল নাচিয়ে নিজের হাতের পাতার ভেতর আমার আঙুল চেপে ধরে রইল। তার চোখে একধরনের আর্দ্রতা নেমে এসেছে দেখলাম। কোন জ্যান্ত মাছের মতো দেখতে লাগছে তাকে। সে নিজের হাতের চাপ বাড়াতে শুরু করল আমার আঙুলে, এত জোর, যেন মনে হচ্ছে আমার আঙুল ভেঙে যাবে। ঠোঁট ফুলতে শুরু করেছে তার। এই প্রথমবার আমি কোনো ঠোঁটকে উদাস হতে দেখলাম।
নিজের আঙুল টেনে নিলাম আমি। গ্লাস খালি হয়ে এসেছিল আমার, ঘাসের উপর রেখে দিলাম।
“এবার বেরোতে হবে।” আমি বললাম।
“এখুনি নয়। একটু দাঁড়াও।” আরও একটু ঘন হয়ে এল সে। আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
“কতক্ষণ?”
“যতক্ষণ বিড়ালটা ছাদে বসে আছে।”
আমি কার্নিশের দিকে তাকালাম। বিড়ালটা আঠার মতো সেঁটে ছিল ওখানে। খুব গভীর ঘুম মনে হয়। সকালের আগে বিড়ালটা ওখান থেকে নড়বে বলে মনে হয় না।
গ্লাস উঠিয়ে আমি কিছু মদ ঢেলে নিলাম। সে নীচু হয়ে নিজের গ্লাসে চুমুক দিল।
“তো অন্তরকে দর্শক হয়ে উঠতে হবে। জীবন-নাটকের দর্শক” ওর গলার স্বর ভারী হয়ে উঠেছে। হয়তো শীত কিংবা মদ অথবা ভেতরের তরল বেদনার জন্য।

“হুম। যখনই সেরকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
এও কি সম্ভব?
হুম।
সহজ?
হুম।
না! এতটা অঙ্ক জীবনে চলে না। দৃষ্টি কখনো পরমহংস হতে পারে না। তুমি কি পেরেছ কখনো?
কী?
ঐ, এরকম কোনো সিদ্ধান্ত যাতে তোমার জীবন দাঁড়িয়ে আছে, অন্তরকে লিপ্ত না করে শুধুমাত্র দর্শক বানিয়ে রেখে।
যে মুহূর্তে আমি তার কথা শুনলাম ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার ভেতর এক বিন্দু পরিস্ফুট হল। উদ্ভাসিত হতে হতে আমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হতে শুরু করল এক গভীর বিমর্ষ হয়ে। আমি অবাক হয়ে গেলাম বা চেতনাশূন্য। যাকে আমরা জীবন বলি, অদৃশ্য পরিস্থিতি দ্বারা নির্মিত কিন্তু এক অত্যন্ত পরিচিত শরণ বলে মনে করি, বাস্তবে তা কতটা অপরিচিত, রহস্যময়, অবিশ্বস্ত।

“বলো?” সে আবার জিজ্ঞেস করল আমার দিকে তাকিয়ে।
আমি ওকে এই প্রথমবার দেখলাম শুধুমাত্র শরীর হিসাবে। ঐ চাঁদের আলোয়, ইন্দ্রজালের ভেতর নেমে আসা এক শরীর। কোমল। লঘু। তরল শুভ্রতায় আলোকিত। ওর বাহুর সোনালি লোম, হাতের পাতার ছোটো ছোটো আঙুল, সফেদ গলা তবলার চামড়ার মতো টানটান ত্বক আর ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসা কামুক গন্ধের জঙ্গল!
আমি জানি বিগত চার বছর ধরে আমার কাছে সে বিয়ের প্রস্তাবের অপেক্ষা করে বসে আছে। মূক, শান্ত, অব্যক্ত। আমাদের সমস্ত পরিচিত মানুষজন এই ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছিল যে সবদিক থেকে যোগ্য মেয়েটির জন্য কেন আমি এখনো এরকম কিছু করে উঠিনি। আমি জানি না ঠিক ঠিক কেন আমি এরকম করিনি। অথচ এটাও আমি জানি যে ও আমাকে খুব গভীর ও ঘন প্রেম করে। এতই গভীর যে, শেষ পর্যন্ত ও মৌন হয়ে গেছে, কোনোরকম প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে। মাঝেমধ্যেই আমি এভাবে তার সঙ্গে বসি। মাত্র একবার আমি ওর হাত ধরে ছিলাম ভবিষ্যৎ দেখার অছিলায়, এখনো স্মৃতিতে রয়ে গেছে ওর হাতের স্পর্শ, তার চোখে গাঁথা ঐ এক মুহূর্তের সুখ বা স্বপ্ন।
এই মুহূর্তে সেই স্পর্শই আমার ভেতরে পাখির মতো ছটফট করে উঠেছিল। তার সারা শরীর আমার সামনে ছিল। প্রস্তুত, তৎপর। আশ্বস্ত করার মতো। তার শরীরের বিচার, তার গভীর কামনা সেই ইন্দ্রজালেরই প্রতিফলন ছিল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল জীবনের সেই সিদ্ধান্ত কখনো নিয়েছি কিনা যাতে আমার জীবন নির্ভর করে, যেখানে অন্তর শুধুমাত্র সাক্ষী হিসাবে নাটকের দর্শকের মতো শুধুমাত্র তালি বাজাবে? হ্যাঁ, এইরকম সিদ্ধান্ত এখনই নিয়েছিলাম। ওর শরীর ছোঁয়ার অর্থ ছিল, তার সমস্ত স্বপ্ন সকল আকাঙ্ক্ষার উড়াল দেওয়া, এক নতুন সম্পর্কের জন্ম দেওয়া। ওর আকাঙ্ক্ষা, অধিকার, অস্তিত্ব ওর কল্পনাকে গতিশীল করে দেওয়া। এক অব্যক্ত ভ্রূণকে জীবনের প্রকাশ দেওয়া। সম্ভবত এই দেহভোগের পর আমাদের মাঝে শুধুমাত্র চাওয়া পাওয়াটুকুই থেকে যাবে, সম্ভবত কেবল নির্মম সংবেদনহীন প্রতিক্রিয়াটুকু থেকে যাবে। হয়তো বা এই সম্পর্ক কুরূপ এবং নিরর্থক হয়ে থেকে যাবে। খুব কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল এটা। আমাদের দু’জনের জীবনের এমন এক রন্ধ্রের জন্ম দেওয়ার ছিল, যার ওপারে এক অন্য পৃথিবী ছিল যা আমার অভীষ্ট নয়। যা আমার মনোবাঞ্ছা নয়। স্বভাব এমনকী সত্য নয়। আমার আত্মা নিশ্চিতভাবেই এর জন্য তৈরি ছিল না। আমার লালসা, সংশয়, উত্তেজনা আমার আত্মার নির্লিপ্ততা সবকিছু এসবেরই দ্বন্দ্ব ছিল, যে প্রশ্ন সে আমাকে করেছিল। এবং এইমাত্র যা কিনা এক দর্শন স্বরূপ আমিই তাকে দিয়েছিলাম।
“তো?” জিজ্ঞেস করল সে।
“হ্যাঁ। এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” মৃদু স্বরে বললাম আমি। এত মৃদু যে তাতে আমার আত্মশক্তি ছিল না। কেবলমাত্র শরীরের উত্তেজিত ফিসফিসানি ছিল।
“কীরকম?”
“অন্য কোনোদিন বলব।” হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। নিঃসঙ্কোচ হাসল সে। নিজের ছোটো হাত আমার থাবার ভেতর রেখে দিল। তাতে হালকা চাপ দিলাম। আমার চোখের দিকে তাকালো। মুঠোর ভেতর তার ছোটো হাত চড়ুই-এর মতো ছটফট করে উঠলো। ধীরে ধীরে তার মুখের উপর সুখ নেমে এল। নরম হয়ে এল চেহারার নরম ভাবটুকু।
আমি আমার নিমন্ত্রণটুকু পেয়ে গেছিলাম। আস্তে করে তাকে নিজের দিকে টেনে নিলাম।
“একটু দাঁড়াও,” এটুকু বলে ঘাসের উপর দাঁড়াল সে। পড়ে থাকা মদটুকু এক চুমুকে শেষ করে গ্লাসটিকে ঘাসে গড়িয়ে আমার পাশে বসে পড়ল।
“হয়তো বিড়ালটা উঠে যাবে।” সে কার্নিশের দিকে ইশারা করে আমার বুকের ভিতর সেঁধিয়ে গেল। ওর কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে ওখানে জিভ বুলোতে বুলোতে বললাম “মনে রেখো এর আগেও আমাদের ভেতর কিছু ছিল না এবং এর পড়েও কিছু থাকবে না। শুধু এই, এইটুকুই সত্য, যেটুকু মুহূর্ত আমরা যাপন করছি। বিলকুল এইটুকুই। জন্মালো আর শেষ হল।” প্রথমবার নিজেরই আওয়াজ দুর্বল, নিরীহ মনে হল আর মনে হল জীবনের যে অংশে আত্মা থাকে না তা শুধু জীবনের ছায়ামাত্র। বিভ্রম।
মুখ তুলে চাইল সে। তার চোখ আমার চোখের পাশেই ছিল। অনেক কাছে। তার চোখের খয়েরি আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। ওর চেহারায় চাঁদের আলো ছিল। ঠোঁটে লেগে থাকা ভেজা ভাব। নাকের পাতায় ছিল কল্পিত শিশির। সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টির ভেতর এক মহাদর্শন ছিল, সৃষ্টির সমস্ত রহস্য। জীবনের সকল গুহ্য ও সূক্ষ্মতম অণু। তার দৃষ্টির উপর এক মুহূর্তের জন্য জল নেমে এল সড়সড় করে যেরকম ডাল থেকে পাতা ঝরে যায়। মুহূর্ত পড়েই সেই জল মিলিয়ে গিয়ে দেখলাম ওখানে প্রেম নেমে এসেছে, মদের শিথিলতা আর কামনার চাকচিক্য নিয়ে।
সে হাসল। আমি যা বলেছিলাম তার স্বীকৃতিস্বরূপ।
জানতাম এইটায় হবে। আমার যেকোনোরকম সুখ তার স্বীকার্য হবে এ আমার জানা ছিল।
সে বুকের ভেতর নিজের মুখ গুঁজে দিল।
“হ্যাঁ, এখানেই।” ফিসফিস করে উঠল সে। “এই ম্যাজিকের ভেতরেই।”
এইবার আমি তার ঠোঁটের সিক্ততায় জিভ বোলালাম। আমার থেকে আলাদা হয়ে সে বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়ল। তার উপর নেমে আসার আগে আমি একবার কার্নিশের দিকে তাকালাম। বিড়ালটা যেখানে ছিল, আমার অন্তরও সেখানেই ছিল।
আর ওর অন্তর ওর বন্ধ হতে শুরু করা চোখের ভিতর ছিল।
এর সাত মাস পড়েই সে বিয়ে করে নিল।

সেই রাতে সবকিছু জলদি শেষ হয়ে গেছিল। এর আগে আমার কোনো অনুভব ছিল না। স্ত্রীদেহের সুত্র, তন্ত্র-লয়, আরোহ অবরোহ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছিল না আমার। সে আমাকে সহ্য করেছিল মাত্র। সে যাওয়ার আগে আরও একবার নিজের ভয় থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম আমি।
যতটুকু সময় ছিলাম আমরা এক গুহার ভেতরে ছিলাম। শরীরের ভেতরকার এই গুহা আমাদের সত্য নয়, এর বাইরের দুনিয়া, আলো হাওয়া সত্য।
আমাকে চুপটি করে একবার মাত্র দেখেছিল সে তারপর ঝুঁকে দুটো গ্লাস উঠিয়ে আস্তে করে বলেছিল “এসো” আর আমি চলে এসেছিলাম।
এরপরে আমি ওর সাথে আরও দুবার দেখা করেছিলাম, আমাদের মাঝে সেই রাতের কথা আর ওঠেনি।
এর পরে পরেই সে বিয়ের ফয়সালা করে ফেলে। আমি আশ্চর্য হয়নি। একজন পুরুষের দরকার ছিল তার। তার অসুস্থ মায়েরও। লোকটির সামনে সে শুধুমাত্র একটিই শর্ত রেখেছিল। সে কখনো শরীর দেবে না। সে জানত আমি সারাজীবন এই শহরেই থাকব।
বিয়ের পর সে মাকে নিজের নতুন ঘর নিয়ে চলে যায়। আমি তার নতুন ঘরে কখনো যায়নি। বিয়ের পর অনেকদিন আমাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই।
আমরা দু’জন নিজেদের জীবন আলাদা আলদাভাবে যাপন করছিলাম।

আমি জানি না দুঃখের উৎস কোথায়? কীভাবে জন্মায় আর কীভাবেই বা তিরোহিত হয়। কোথায় তার সাম্রাজ্য। কীই বা তার ব্যাপ্তি, আমি জানি না। কিন্তু এক শীতের দুপুরে এক ছোট্ট রোদের টুকরো আমার মধ্যে দুঃখের জন্ম দিয়েছিল। নিস্তব্ধ, নির্মল। দীপ্তিমান।
আমি ছাদের উপর ছিলাম। আমার হাতের পাশে এক টুকরো রোদ ছিল, কুলোর মতো দেখতে। ছাদের এক কোণায় কাপড় শুকোচ্ছিল। এখানে ওখানে কিছু গাছ ছিল। পাখি ছিল। দানাপানি ছিল। ছিল আটকে থাকা জল। আমার দৃষ্টির পরিধির ভিতর সমস্ত আকাশ ছিল, ঝকঝকে নীল। তার নীচে ছিল কল্পিত সোনালি রোদ, উষ্ণতায় ভরপুর।
আর সেই স্বরনিম বিভার ওই পারে ছিল মিল-এর শীতল চিমনি। চার্চের মিনার, শহরের বড়ো ঘড়ি। পুরোনো দালান। আর দালানের বিশাল ছাদ। একশ-দেড়শ বছরের পুরোনো দেওয়াল, ঝরকা কাটা জানালাও ফলকের উপর লেখা নাম। এবং তার থেকেও পুরোনো গাছ, গাছের ডালপালা ছিল। নৈঃশব্দ্যের অনন্ত বিস্তার ছিল। সৃষ্টির অপরিমেয় সাম্রাজ্যের স্পর্শ ছিল। এই সবকিছুর ভেতর আমার অস্তিত্ব এক ছোটো নৌকার মতো ভাসমান।
এই সমস্ত নির্মিতির ভেতর আমি সম্পূর্ণ একা ছিলাম। নিতান্ত একাকী। আমার চোখ এই সবকিছুই দেখছিল কিন্তু সেরকমভাবে নয় যেভাবে সাধারণত দেখি। আমি শুধুমাত্র একজন দ্রষ্টা ছিলাম আর তখনই সেই দুঃখ জন্ম নিল আমার নিজেরই সাক্ষাতে, নিজেরই অস্তিত্বের স্পন্দনে, আত্মার স্পর্শে। সমাধি, নিষ্ক্রমণ, পরিত্যাগ, নির্লিপ্ততা ও গহন একান্ত দিয়ে গড়া দুঃখ। আমার দৃষ্টি বিশাল হতে শুরু করল। নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। এক পাতলা শুকনো চামড়া, ক্লান্ত চোখ, হতাশ চেহারা, নরম শিরা-উপশিরায় ভরা ঘুমন্ত চেতনার পুরোনো অপ্রাসঙ্গিক জীবন যেন বা। দ্রষ্টা হওয়ার এই দুঃখ আমাকে আক্রান্ত করেনি। কোনো ব্যথা। যাতনা ছিল না সেখানে, এমনকী মুক্তির ছটফটানিও ছিল না বরং দুঃখকে আমার নিজের কাছে আসার নিজেকে ঢেকে ফেলার এক অদ্ভুত সুখ ছিল। সে-সময় ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার তাকে মনে পড়ল, তার অলৌকিক শরীর, এক ভয়ংকর টানের মতো, আমাকে নিংড়ে আগুনের ফুলকির মতো আমাকে জ্বালিয়ে দিয়ে। মনে হল এই সমস্ত সৃষ্টি, প্রকৃতির এই রোদ্দুর, ছাদের একাকিত্ব, আত্মনির্বাসনের অসহায়তার ভেতর তার শরীরকে আমার খুব প্রয়োজন। এবং এর সঙ্গেই আমার এক বোধের জন্ম হল— নারীদেহ এ গভীর দুঃখের এক শরণ। উনুনের আঁচে যেমন কোনো কাঁচা জিনিস পরিপক্ক হতে থাকে ঠিক তেমনি পুরুষের ক্ষতবিক্ষত খণ্ডিত অস্তিত্বকে নারীদেহ ধীরে ধীরে নিজের ওমে উষ্ণতায় পরিপক্ক করে নতুন জীবন দান করে। পুরুষ জানে না সে-সব।
ছাদ থেকে নীচে নেমে এলাম। আমার কাছে তার ফোন নং ছিল। বহুদিন হয়ে গেছে তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া, কথা বলা। রিং করলাম। কিছুক্ষণ পর সে নিজেই ফোন ওঠাল।
কেমন আছ?
আর তুমি?
আমি ঠিক আছি। আসতে চাই।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল—
কী হয়েছে?
কিছু না।
তাহলে?
ব্যস, এমনিই।
কখন?
এখুনি এইমাত্র।
দাঁড়াও একটু দেখে নিই থেমে থেমে বলল সে, এরপর রিসিভার নামিয়ে রাখল পাশে।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল—
তুমি এখানকার ঠিকানা চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। বাকি সকলে কোথায়?
মা পিছনের বারান্দায় শুয়ে আছে।
আর?
ও বাইরে গেছে। রাতে আসবে।
আমি আসছি।
ফোন নামিয়ে রাখলাম।
প্রথমবার আমি তার নতুন ঘরে এলাম। দুটো সিঁড়ি চাপার পর আমার পিছনে দুপুরের নিস্থব্ধতা পড়ে ছিল। এতই নিস্তব্ধ যে হাওয়ায় পাতাদের দৌড়নোর আওয়াজ পাচ্ছিলাম।
দরজা খুলল সেই। একবার আমাকে দেখে সরে দাঁড়াল। আমি ভেতরে এলাম।
ভেতরে অন্ধকার ছিল। উপরে আলো জ্বলছিল, কিন্তু তা শুধু উপরেই ছিল। নীচে অন্ধকার। সে আমাকে আরও ভেতরের এক ঘরে নিয়ে এল। শোয়ার ঘরের আগের ঘর। একটু ছোটো মতো জায়গা। মাটিতে বসার বন্দোবস্ত। গদি, কালীন, কুশন। এক কোণায় ল্যাম্প জ্বলছিল, শুধুমাত্র সেইটুকু আলো।
ইশারায় বসতে বলল। আমি বসলে আমার পাশে বসে বলল—
কিছু নেবে?
না।
কী হয়েছে?
কেন? কী আবার হবে?
তাহলে, এমনি হঠাৎ?
চেহারা দেখলাম একটু ফুলে গেছে। চামড়ার যৌলুশ কমে গেছে আগের থেকে। একটু ভারীও হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে।

জিজ্ঞেস করলাম কেউ আসবে না তো?
না। আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
ওটা নিভিয়ে দাও। ল্যাম্পের দিকে ইশারা করলাম। ল্যাম্প নিভিয়ে আমার পাশে এসে বসল সে। আমি ওর ছোটো হাত নিজের থাবার ভিতর ঢুকিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলাম।
“আরও একবার গুহার ভেতরে যায়?”— ফিসফিস করে বললাম। সে কিছু না বলে মুখ উঠিয়ে আমার দিকে তাকাল। এই অন্ধকারেও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ওর অন্তর সেই প্রথম রাতের মতো ওর চোখের ভেতর ছিল। আর আমার অন্তর চুপচাপ বসেছিল কালীনের কোণায়।

এর ছয়বছর পর তকে আমি বাজারে দেখেলাম আবার। ওর সঙ্গে এক ছোটো বাচ্চা ছিল। আরও শীর্ণ হয়ে গেছে সে। আমাকে জানালো মায়ের মৃত্যুর কথা, এও জানালো তার স্বামী প্রায়ই বাইরে থাকে।
বাচ্চার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম কবে হল?
“দেখতেই পাচ্ছ”— একটু হাসল সে। হাসার সঙ্গে সঙ্গেই মদের তীব্র গন্ধ ছিটকে বেড়িয়ে এল।
বিস্মিত হয়ে বললাম “মদ খেয়েছ?”
হ্যাঁ। একটু। ডাক্তারের পারমিশন নিয়েই। হাঁফাচ্ছিল সে।
রোজ খাও?
হ্যাঁ।
সারাদিন?
না।
কেন খাও?
মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল আসছি।
বাচ্চার হাত ধরে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন আছ?”
আমি জবাব দিলাম না। একাবার আমার দিকে তাকিয়ে বাচ্চার হাত ধরে চলে গেল সে।
তিন বছর পর আবার তার সঙ্গে দেখা হল আমার অন্য শহরের এক বিয়েবাড়িতে।
এই তিন বছরে সে একবার মাত্র আমাকে ফোন করেছিল। ছেলের জন্মদিনে। আমি যায়নি।
আমরা বিয়ে থেকে একসঙ্গে ফিরছিলাম। সেসময় রেলওয়েতে দু-বার্থের ফার্স্ট ক্লাসের কুপ হতো। টিটিকে ঘুস দিয়ে একটি কুপে রিজার্ভ করিয়ে নিয়েছিলাম আমি। স্টেশনেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। বাচ্চাটা একটু বড়ো হয়ে গেছিল। কথা বলতে শুরু করেছিল। খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিল সে বাচ্চার হাত। আমাদের রাতভরের জার্নি ছিল।
কিছু খেয়েছ? জিজ্ঞেস করলাম।
বাচ্চাকে ঢাকতে ঢাকতে জবাব দিল, হ্যাঁ।

অক্টোবরের রাত, হু হু করে হাওয়া আসছিল।
সে নিজের বাচ্চাকে একেবারে ধারে শুয়ে দিল।
কখন ঘুমায় এ? জিজ্ঞেস করলাম।
এইতো এখুনি ঘুমিয়ে পড়বে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ধান খেতের পাড় থেকে চাঁদ বেরোতে শুরু করেছে। একেবারে লাল, গোল থালার মতো। এরকম চাঁদ আমাদের শহরে দেখা যায় না।
আমি ওর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বললাম, “দ্যাখো।”
মাথা ঘুরিয়ে সে চাঁদের দিকে তাকাল। অনেকটা সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল চাঁদের দিকে। আমার শরীর তার শরীরকে ছুঁয়ে রেখেছিল। বুঝতে পারছিলাম খুব দ্রুত তার শরীর গলে যাচ্ছিল। নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল তার শরীরের আলোক।
তুমি ভালো নেই! আমি বললাম।
কেন?
অসুস্থ দেখাচ্ছে তোমাকে।
হ্যাঁ। হতে পারে। প্রচুর দায়িত্ব। মা চলে যাওয়ার পর কেউ নেই। ওতো সবসময় বাইরেই থাকে। বাচ্চাও বড়ো হয়ে যাচ্ছে।
এসবে শরীর নষ্ট হয় না। খুব বেশি মদ খাচ্ছ আজকাল?
হুম। তা বটে। মৃদু হাসল সে।
এক হাতে সে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছিল আর অন্য হাতটা আমার মুঠোর ভেতর ছিল। ছোটো আঙুলগুলোর চামড়া পাতলা হয়ে হাড় বেড়িয়ে এসেছে। আমি খুব ধীরে তার উপর হাত বোলাচ্ছিলাম।
তুমি কেন কর এরকম? আস্তে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর দিল না সে।
আমরা নিজেদের জীবন অন্যভাবে বাঁচতে পারতাম না! কিছুক্ষণ পরে বলল সে—
“অথচ তুমি ভয় পেয়ে গেলে সে রাতে, আর সেই দর্শন তৈরি করলে।”
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। তার চেহারা অস্পষ্ট ছিল। কুপের ভেতর পুরো অন্ধকার। চাঁদ আরও একটু উপরে উঠে এসেছিল সমস্ত লালিত্য নিয়ে। সে আলোতেই তাকে দেখলাম। কপালের ভাঁজ, কানের কুঁচো চুল, উদাস হা-ক্লান্ত চোখ।
“অতটা আর ওভাবে আমি কখনো কাঁদিনি জীবনে। মা চলে যাওয়ার পরও নয়। যতটা সেই রাতে কেঁদেছিলাম। তুমি বেড়িয়ে যাওয়ার পর কাপড় পড়ে আমিও বাইরে বেড়িয়ে এসেছিলাম। শহরের খালি রাস্তায় আমি অনেকক্ষণ বেতাহাসা হেঁটে বেড়িয়েছিলাম। পাগলের মতো কাঁদছিলাম সেদিন। চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেছিল চুল, কাপড়। চাঁদের আলো, শিশিরের ঠান্ডা ও বাড়ি ঘরের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্ধকার। সেদিন যদি কেউ আমাকে দেখত নিশ্চিত আমাকে হয় নষ্ট মেয়েমানুষ মনে করত কিংবা পাগলী। সেই রাতে আমি এ’দুটোই ছিলাম। সেই সময় মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেছিল এরোপ্লেন। তখনই একটি কুকুর মুখ তুলে কাঁদছিল, আমার পা পড়েছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর আর সেই মুহূর্তেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিয়ে করার। এবং তখনই ঠিক করেছিলাম যে, আমার অন্তর আমার আত্মাকে এই সিদ্ধান্তের থেকে আলাদা রাখব, যেমনটি তুমি বলেছিলে। দ্বিধাগ্রস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আগেই অন্তরকে সরিয়ে রাখা ভালো। রাতে যখন আমি ঘর ফেরত এলাম ততক্ষণে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেছিল। গুহার আত্মার সত্য, মায়ের ভবিষ্যৎ সব।” লম্বা একটা শ্বাস ফেলে সে চুপ করল। তার হাতের আঙুল আমার আঙুলের নীচে কাঁপছিল। একটু ঘেমেও গেছিল বোধহয়।
আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। বাইরে সবকিছু সাদায় ডুবে গেছে ঘরদুয়ার, গৃহপালিত জীব, খেতখামাড়, কুয়ো, শুকনো নালা, কাঁচা পুল সব। আমি একটুক বাইরেই তাকিয়ে রইলাম।
জীবন-মৃত্যু, প্রেম, স্বপ্ন, জয়-পরাজয়,সমস্ত সৃষ্টি, সকল ইতিহাস সবকিছুরই নিজস্ব বিস্তার আছে। অর্থ, ব্যাপ্তি আছে। কেউ জীবনে কতটুকু পায় আর কেনই বা পায় এসমস্ত এক রহস্যই বটে। অলিখিত, অবিবেচিত। যা ছিল আমার ভয় তাই তার কাছে ছিল সুখ। তার আত্মা আর আমার শরীরের সত্য দুটোই এক। আমার ভয়, আর তার ভয়ের তর্ক, তার সুখ ও সুখের তর্ক সমস্তই এক ঘেরাটোপের ভেতর ছিল। আমি দোষী, না, সে? এ এমন এক নিরন্তর সনাতন রহস্য যা আমাদের দু’জনের আত্মাকে একে-অন্যের ভেতর সমাহিত হতে দেয় না। কেন এমন হয়? এই ছোটো জীবন কেন এত সহজ সরল হয় না? এক মুহূর্তের এক শতাংশ ভাগও কেন অসংখ্য মানুষ আলাদা আলদা বাঁচে? শরীর ও মননের সূত্রগুলি কেন অঙ্কের নিয়মের মতো সিদ্ধ ও জ্ঞাত হয় না?
সে তার অন্য হাতটি আমার হাতের উপর রাখল। আমি মুখ ফেরালাম তার দিকে। বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো শেষ হয়ে গেছে তার।
“ঘুমিয়ে পড়েছে”— বার্থ থেকে উঠতে উঠতে বলল সে।
বাচ্চাকে বার্থের কোণায় সরিয়ে দেওয়াতে বেশ অনেকটা জায়গা খালি হয়ে এল অথচ সে ওখানে বসল না।
আমার সামনে উঠে এল, দুহাত আমার দু’গালে রেখে চেপে ধরল। আমার মাথা টেনে নিল বুকের ভেতর। আমার কানের পাশে দু’ফোঁটা জল নেমে এল। বুকে থেকে আমার মুখ বের করে আমার চোখের দিকে তাকাল সে।
“সেই গুহার ভেতরে আবার যাবে?” আমাকে শুধালো। তার চেহারায় ব্যাপ্ত ছিল আঁধার। চোখের ভেজা ভাব আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি ওকে নিজের দিকে টেনে নিলাম।
বার্থে যখন সে শুয়ে পড়েছিল তখন সমস্ত চাঁদের আলো ওর মুখশ্রীতে নেমে এসেছিল। আর তার অন্তর ছিল সেখানেই যেখানে বরাবর থাকে। আমি একবার বাইরে তাকালাম।
আমার আত্মা চাঁদে বসে উপভোগ করছিল জীবনের নাটক।

এর দুই বছর পর।

গোরস্থানের পিছনে পুরাতত্ত্ব বিভাগের ছোটো পুরোনো বিল্ডিং ছিল। চেয়ারে বসে আমি সামনের জানালায় লোকেদের যাওয়া আসা দেখছিলাম। বিকেলে রাস্তা খালি ছিল। আমার অ্যাসিসট্যান্ট মেয়েটি ভেতরে কফি বানাতে গিয়েছিল।
তখনই আমি তাকে দেখলাম। রাস্তার চড়াই ধরে উঠে আসছিল। প্রথমে চুল, মাথা, গলা তারপর ধীরে ধীরে ক্লান্ত শরীর। এখন আমি তাকে পুরো দেখতে পাচ্ছিলাম। রাস্তার ধারে এক দেওয়ালে ঠেস দিয়ে হাফাচ্ছিল। শরীর কাঁপছিল হাঁটার ধকলে। হাত খালি। ও গোরস্থানের পিছনে থেকে বেড়িয়েছিল। মনে হয় কারো কবরে এসেছিল। এখন ওর শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
স্তব্ধ, সংজ্ঞাহীন তাকে দেখছিলাম। এইভাবে কিছুক্ষন থাকার পর খুব দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে চলতে শুরু করল সে। ধীরে ধীরে উৎরাই ধরে মিলিয়ে গেল।
একবছর পর আমি জানতে পারি সে দশদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ফোন করাতে সেই ফোন ওঠালো।
কী হয়েছিল?
কিছু না। এমনিই।
এমনি, এমনি কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয় না। এখন ঠিক আছ?
হুম।
কে আছে ঘরে?
কেউ না। ও বাইরে আছে।
আমি আসছি।
কিছু না বলে সে ফোন নামিয়ে রাখল।

দ্বিতীয় বার তার ঘর এলাম আমি। দরজা ভেজানো ছিল। পাল্লায় ধাক্কা দিলাম। আমার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল সে, দেখতেও পেয়েছিল বোধহয়।
“বন্ধ করে এসো”
ভেতরের কোনো এক ঘর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম। দরজা বন্ধে করে সেই কামরার দিকে এগোলাম। সে সেই ঘরের বিছানায় শুয়েছিলাম। জানালার জালির ফাঁক দিয়ে আলো এসে ভরতি করে রেখেছিল ঘর।
বিছানায় শুয়ে ছিল সে। মাথার নীচে বালিশ। চুল খোলা। গলা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। আমি পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। সে হাত নেড়ে পালঙ্কের উপর ইশারা করল। চেয়ার ছেড়ে বিছানায় মাথার কাছে বসে পড়লাম।
কী হয়েছিল?
রক্তে কিছু প্রবলেম ছিল। দশদিন হাসপাতালে থাকতে হল।
কেন?
কোনো উত্তর দিল না।
মদের জন্য?
মুখ ঘুরিয়ে নিল একদিকে।
এবার?
এবার নয় আগেই ছেড়েছি। এখন ওষুধ চলবে। মুখ ঘুরিয়ে দেখে বলল এত জলদি মরব না।
এই অবস্থায় একা কেন?
কাজের দিদি এখুনি গেল। তুমি আসবে বলে ছেড়ে দিলাম। বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে।
অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। সারা শরীর কুঁকড়ে গেছে। কম্বলের নীচ থেকে একটি হাত বের করে আমার হাতের উপর রাখল। হাতের চামড়া কুঁচকে কালো হয়ে গেছে। আঙুলে কেবল হাড়।
কেমন আছো? ওর প্রশ্নের ভেতর, চোখে কেমন যেন মমতা!
ঠিকঠাক।
তোমার চুলে পাক ধরেছে।
হ্যাঁ। মেঘে মেঘে বেলা তো কম হল না।
আমরা মনে হয় অনেকটা জীবন বেঁচে রইলাম না?
হ্যাঁ।
“এই জীবনকে বুঝে, স্বীকার করে, নিজেদের সুখের সঙ্গে একে অপরকে সুখ দিয়ে।”
চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমি সুখ দিয়েছি তো? আচমকা প্রশ্ন করল সে।
হ্যাঁ।
“আমি কখনো পিছু হটিনি। যতক্ষণ, যখন তুমি চেয়েছ। কোনো সংশয় ছাড়ায় নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে। প্রতিবার আমার অন্তর আমার চোখের ভিতর ছিল তোমাকে সুখ দেওয়ার সময়। তুমিও দেখেছ তাকে।”
হ্যাঁ। কেন করলে এরকম?
জানি না। মনে হয় গতজন্মের কিছু ছিল। প্রেম হয়ত এরকমই হয়।
তার হাত আমার হাতের উপর ছিল, আমি দেখছিলাম তাকে।
কী দেখছ?
তোমার হাল।
গায়ের কম্বল সরিয়ে দিয়ে খুব ধীরে বলল সে— ভালো করে দেখো।
কম্বলের নীচে এক পাতলা কাপড় ছিল শরীরের থেকে আলাদা।
সে এখন এক ভয়ংকর বিশ্রী বুড়ি হয়ে গেছে। বুক ধসে গিয়ে একেবারে চিপকে গেছে। জাঙ ও পাছার মাংস লটকে গেছে। ওর মুখ থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল। এই শরীরের অনবদ্য আলো কতবার দেখেছি আমি। শরীরের এই ক্ষয় আমি প্রথমবার দেখলাম।
আমার হাত ধরে টানায় আমি ওর শরীরের দিকে ঝুঁকে গেলাম। সে আমার হাতের উপর হাত বোলাতে শুরু করল। ওর নগ্ন দেহ আমার শরীরের তলায় চাপা পড়ে গেছে। কিছু সময় আমরা এরকমই ছিলাম। নাকের পাটায় শ্বাস নেওয়ার শব্দ হচ্ছিল। ধ্বসে যাওয়া বুক ওঠানামা করছিল। সে নিজের হাত আমার শরীরে বোলাতে শুরু করল।
পুরুষের এই লালসাকে বুঝতে নারীর কখনো ভুল হয় না।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই ঘৃণিত শরীরের জন্যও আমি কামুক হয়ে উঠেছিলাম।

কম্বল টেনে নাও— বলল সে।
কম্বল টেনে নেওয়ার আগে আমি দেখলাম ওর আত্মা ওর নিস্তেজ চোখের উপর জেগে বসে আছে। আর আমার অন্তর জানালার উপর বসে আছে। সাক্ষীস্বরূপ করতালি দিতে দিতে।
কিছুক্ষণ পরেই আমরা আলাদা হলাম। হয়তো ওর শরীরের অপূর্ণতা, বয়সজনিত অবসাদ বা আমার চিরকালীন অকুশলতার জন্য। বিছানা থেকে নেমে এলাম আমি।
নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল ঘরে। ওর হাঁফানোর আওয়াজ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়েছিল সে। ঘৃণা জন্মাচ্ছিল এখন ওকে দেখে। চুপ করে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ।
আজকেও তুমি শুনতে পেয়েছ তাই না?
কী?
প্রতিবার নাটক শেষের করতালি যা তোমার আত্মা দর্শক হয়ে বাজায়?
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
হাঁফাতে হাঁফাতেই বলতে শুরু করলো সে— “প্রতিবার আমি তাকে দেখেছি। শুনেছি তালির আওয়াজ। কার্নিশে, কালীনের চাঁদের উপর আর আজকে জানালায়। প্রতিবার অপেক্ষা করেছি হয়তো এইবার এরকম হবে না। কিন্তু আজও যখন সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে, মরণ হচ্ছে, সমাপ্তি ঘটছে। গোটা জীবন বাঁচা হয়ে গেছে আমাদের, এখনো তোমার অন্তরাত্মা তোমার ভেতরে ছিল না।” রক্তশূন্য হয়ে পড়েছিল তার চেহারা। কিছুই না বলে চুপচাপ কাপড় পড়তে শুরু করলাম আমি। হঠাৎ দড়াম করে চৌকাঠে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আমি। সে আমাকে লাথ মেরেছিল।
মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম সে হাসছে। তার নিস্তেজ চোখে আবার পুরোনো দ্যুতি ফিরে এসেছে। তার অন্তর, আত্মা প্রতিবারের মতো তার চোখে স্থির। সেই অসামান্য দ্যুতির ঝরনায় স্নানরতা।
কয়েক পলক তাকে দেখলাম আমি, তারপর চুপচাপ বাইরে চলে এলাম।

(প্রিয়ম্বদ’র জন্ম- ১৯৫২ সালের ২২ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের কানপুর। ঔপন্যাসিক ও কাহিনিকার। কথাক্রম সম্মান ও বিজয় বর্মা কথা সম্মানে সম্মানিত লেখকের প্রমুখ উপন্যাস হল – পরছাই নাচ, ছুট্টি কে দিন কে কোরস প্রভৃতি। )

Facebook Comments

পছন্দের বই