লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভংকর গুহ’র গল্প

শেষের তিনি

ওই যে তিনি, মাঠের ওপরে গাছের ডালে। তিনি সর্বেশ্বর, তিনি মায়া। তিনি যাদুকর। আছেন তিনি বর্তমানে। ছিলেন তিনি অতীতে। থাকবেনও তিনি ভবিষ্যতে। তিনি নাকি মানুষের হকের কথা বলেন। না, তিনি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নয়। আবার তিনিই গ্রামবাসীদের স্বপ্ন দেখান। সেই তিনিই প্রতিশ্রুতি প্রদানকারী। অর্ধ শতবর্ষের অবশেষে, এখনও তিনি। বটগাছের ডালে ঝুলে ঝুলে এখন অতি ক্ষুদ্র বট পোকার ছদ্মবেশে এক নিসর্গের সমান সমান।

গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, পুনরায় এসেছে শ্রাবণ, তিনি শ্রাবণ। মধ্য শ্রাবণ। ভরা শ্রাবণে তিনি মেঘ কালো। আশ্বিনে নাকি তিনি ধান। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার আলোতে অবারিত দুয়ার খোলা এক মাঠের আরাম। গ্রামবাসীরা পূর্ণিমার মাঠময় জ্যোৎস্নার আলোতে তাকে দেখতে পায়। কখনো লম্বা লম্বা পা ফেলে তিনি হেঁটে চলে যান। আবার কখনো প্রাচীন কোনো এক মোড়লের মতন ধবধবে সাদা পোশাকে পার হয়ে যান চাঁদের মায়া আলো। তিনিই হামাগুড়ি দিয়ে মাঠের বহু দূরত্ব ভেঙে ভেঙে চলে যান মধ্যরাত্রির আধিভৌতিক ঠাকুরতলা।

তার ক্ষমতা এবং ব্যক্তিত্বের পালিশ চোঁয়ানো এমন যেন সব চারধার চারধারে নয়, মাঠ মাঠে থাকে না, ভাসমান এক ডিঙি, ঘাটে ফেরার বৌঠানের নিশিকান্ত বর। শোনা কথা বা বাউণ্ডুলে গুজব, সত্য বা অর্ধসত্যও হতে পারে অথবা ডাহা মিথ্যাও হতে পারে। কেউ কেউ গ্রামবাসী তাকে দেখেছে, কাঙালদের সামনে তিনি নাকি মুক্তোর দানা ছড়িয়ে দিতেন। যারা কুড়িয়ে নিত তারা নাকি পাখি হয়ে উড়ান দিয়ে চলে যেত গ্রাম গ্রামান্তর ছাড়িয়ে। গ্রামের পোস্টমাস্টার কুড়িয়ে ছিল তার মুক্তো, তারপরে আর পোস্টমাস্টারকে কেউ দেখেনি।

তামাদি বৃদ্ধ অধিকান্ত ভূঁইয়া, তাকে প্রশ্ন করে, গ্রামবাসীরা উত্তরটি যেন সংগৃহীত কোনো বস্তুর মতন যত্নে আগলে রেখেছে,— আহা কী রূপ তার, সোনালি দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। ভুর ভুর করছে আতরের গন্ধ। চোখ দুইটির গভীরে বসে আছে লাঙলের কর্ষণের গভীর দাগ, কণ্ঠ থেকে বুকের ওপরে নেমে এসেছে কাকচক্ষুর মতন উজ্জ্বল সব ধাতুর দানা। খাসা সুপুরুষ। হাতে জাদুদণ্ডের মতো লাঠি, পায়ে হরিণের চামড়ার জুতো। হেঁটে চলে যান, তার পিছনে পিছনে অনুসরণ করে দুয়ারে পাতা পাপোশের মতন কিছু একটা। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মধ্যে তাকে দেখেছি কাপাস ফুলের মতো ভেসে বেড়াতে বহুবার।

গ্রামবাসীদের একজন উৎসাহিত হয়ে তাকে যদি প্রশ্ন করে,— আপনি কতবার দেখেছেন তাকে?

অধিকান্ত ভূঁইয়া নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলবে,— মাঠের মধ্যে পাখির পালক ফেলে যাওয়ার মতন স্পর্শ যেমন। তারপরে অন্ধকার হয়ে এলে মাঠ বাতাসের সাথে লণ্ঠন ভেসে যায়।

সবটাই যে মায়া মহামান্যি?

তা বটে।

***

চিত্র: নন্দলাল বসু

মরিয়মপুরের পঞ্চায়েত সমিতির কাছারিখানার ছাদে গ্রামবাসীদের বাল্যকালের ঘুড়ি ফেঁসে আছে ক্ষমতা প্রদানকারীর প্রতিশ্রুতির মতন। প্রতিশ্রুতিগুলিকে সুতোয় বাঁধা ঢিলের মতন ঝুলতে দেখা যায়। কতশত প্রতিশ্রুতির সমাহার,— তালগাছের ও নারকোল গাছের গুঁড়ি খণ্ড ফেলে বাঁধানো পুকুর ঘাট, টলটলে পুকুরের জল আয়না ঝকঝকে,— জিভে আনবে পোনা পোস্তর স্বাদ, বোরো চাষের জন্য খালভরতি সবুজ পানি, খামারবাড়ি, ধবধবে সাদা চুনকাম করা ঈদগা, সংকীর্তনের জন্য নাম গানতলা, বিনোদন মহল আর অতি বুদ্ধিমান কেন্দ্র।

বছরের পর বছর ধরে গাছের ডালে ঝুলে থাকা প্রতিশ্রুতিগুলিতে এমন সব রঙিন মাথা মুণ্ডুহীন প্রলেপ লাগিয়েছে সেইগুলি রূপকথার মতো ডানা মেলেছে। ঘটনার পরে ঘটনা কল্পনার আড়ালে গ্রামজীবনে গড়িয়ে গেল নবাবী আমল, ভুঁইফোঁড় প্রথা, সামন্ত প্রথা, দখলদারি প্রথা অতিক্রম করে মাটিতান্ত্রিক যুগে এসে,— আশার আশা সব পচা লাউয়ের খোলের দশা।

মান্তু ফড়েকে কে যেন একবার টোকা দিয়ে গেল। মান্তু ফড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ সরিয়ে নিল, চৌবাগা খেয়াঘাটের সামানপত্তর সব স্থির। বেচারা গোবেচারা মাঠকর্মী,— কিছুক্ষণ পরে মান্তু ফড়ে বলল,— গতকাল তুই কী যেন পেলি?

নিতাই খাটুয়া খুব নীচু স্বরে বলল,— আমি ব্যালান্স জানি না, কর্তারা তা জানে না? না জেনেই দেল।

শিখে নিবি।

কে শেখাবে?

এই ভোর বেলায় কীসের জন্য টোকা দিলি?

শোনো গতকাল পূর্ণিমা ছেল না কিন্তু। পূর্ণিমা আগামীকাল হবে। এখন ভরা শুক্লপক্ষ। মধ্যরাত্তিরে গেলাম, হাতমাটি করতে, সেইখান থেকে মাঠ ধূ ধূ। কী দেখলাম জানো… শুনলে তোমার শরীল হিম হয়ে আসবে?

এই তো, সবেমাত্র ভোরবেলা, শীতল শীতল সকালের জীবনে কুড়িয়ে না পাওয়ার মধ্যে দুঃখ, মাটির কুটিরের দেওয়াল থেকে কুয়াশা ভেজা রাজনৈতিক ইস্তাহার গলে যায়… মাঠকর্মী লাঙল ও হ্যান্ড ট্র্যাক্টর নিয়ে মাটি কর্ষণে নেমেছে, চারদিকে মাঠ বানানোর কাজ চলছে, ঘুম আচ্ছন্নতা দুরমুশ করে মান্তু ফড়েকে মহা ব্যস্ততার মধ্যে প্রবেশ করতে হয়, মাঠ থেকে আনাজপাতির সব তুলে ফেলে গুছিয়ে নিতে হয় ভ্যান রিক্সায়, বেগুন মূলো কপি সিম টমাটো প্রস্তুত করে নিয়ে যেতে হয় রহিম দাড়িপাল্লাবাজের তক্তায়। পাইকার আসে, দরদাম করে মান্তু ফড়ের মাল নিয়ে যায় গঞ্জের বাজারে। নিজের মাঠ থেকে যাওয়ার পথটি একটু মোটা দাগের হলেও, এবড়ো-খেবড়ো। ভ্যানরিক্সায় মাল চাপালেই পথের হাওয়া বাতাস ঠিক করে দেয় ফসল সবজির দরদাম। মান্তু ফড়ে বুঝতে পারে, সময় দিনকাল আর আগের মতন নাই। ভ্যানরিক্সা নিয়ে রাস্তা পার হতে গেলে মোড়ে মোড়ে জ্যান্ত মাটির ঠাকুর দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের সবজির দামের অংশ নগদ নগদ অগ্রিম দিতে হয়। না হলে মাটির ঠাকুর যাতায়াতের সব রাস্তা বন্ধ করে দেবে।

রহিম দাড়িপাল্লাবাজ, মান্তু ফড়েকে বলবে,— হ্যাঁ রে মান্তু, তোকে না শিখিয়েছি, পাইকারদের বলবি, ঢ্যাঁড়সের বিচি বড়ো হয়ে গেছে, শক্ত ঢ্যাঁড়স নিলে নাও না হলে, সোজা পথ দেখো তো, মাঠপোকা আর ধসা সর্বস্বান্ত করে ছাড়ল। এতটা পথ ভ্যানগাড়িতে চাপিয়ে, মাল এনে আর কাঙ্গাল ক্ষেতমজুরকে মজুরি দিয়ে আমার কী থাকে? তুই এইসব বলে বস্তার মাল আগে সাফ করে দিবি। তারপরে তো তোর স্পেশাল বস্তার আনাজের সঙ্গে আমার তোর কারবারের ব্যবস্থা হবে। সেইসব মালের দামের জন্য তোর আমার প্রেম। খুশি করে দেব তোকে। যা একবার, আগে পাইকার সামলে তারপরে আমার এখানে পাকাপাকি করতে বসে পড়বি।

মান্তু ফড়ে জানে, রোজকার পাইকার বাজারে এক ভাষা থাকে। যে-ভাষার অভ্যন্তরে বিভিন্ন অর্থ লুকিয়ে থাকে, গরিব হারগিলা পাইকার মান্তুর কঠিন পাষাণ বাক্য শুনে, কণ্ঠ শুকিয়ে ব্যবস্থার কথা বলে,— অ মান্তু, মান্তু রে, তোর আগুন দামের জন্য গ্রামবাসীরা একটু পিচ্ছিল খাবে না? একডু কম করে দে না রে?
মান্তু ফড়ে বলবে,— নে না? না হলে, বস্তা নামানোর জায়গা দে, সরে দাঁড়া, একটু মাটি ছেড়ে দাঁড়া। ঢ্যাঁড়স একটু পচা হলে লোদ লোদ হয়। ভাজা হলে পান্তা ভাতের সাথে জিভে ভালো স্বাদ নেয়। তুলে নে, অল্প দামে নিয়ে নে। ভালো খাবে। লোকসানের দামে নিয়ে নে।

এইভাবে কথা বললে মান্তু বেদনা পাই। আমি কি তোর আজকের পাইকার? ঢ্যাঁড়সের পিচ্ছিল গ্রামবাসীদের স্নেহ দেয়। স্বাস্থ্য দেয়। নুঙ্কুতে সাদা পিচ্ছিল তড়বড়িয়ে…

বাজে কথা বলিস না। লোকসানে দিচ্ছি তাও শুনছিস না? ভ্যানরিক্সার সারাইয়ের পয়সা তো দিবি, না তাও দিবি না? নিয়ে নে। না হলে বল ফেলে দিই।

ছিঃ। আমি কি তাই বললাম মান্তু?

***

মান্তু ফড়ে নিতাই খাটুয়াকে বলল,— সকাল সকাল কত কাজ পড়ে আছে আমার। তা কেমন হল শুনি? দিলি তো সারাদিন পানি পানি করে?

নিতাই খাটুয়া বলল,— বড়োই অপূর্ব দৃশ্য। যেমন চমৎকার জ্যোৎস্না তেমনি তিনি। দুধ সাদা রাত্তিরে শূন্যস্থান পূরণ করছে যেন। একা একা এমন দৃশ্য দেখলে, নিজেকে আরও একা মনে হয়। অত বড়ো মাপের একজন, ঘোড়ার গায়ের রং তো নয়, চিনা বাদামের কচি পাতলা চোকলা। তার ওপরে বসে আছেন তিনি। কাছে গেলাম না। জানি কাছে গেলে আমারও সেই ডাকঘরের মাস্টারের দশা হবে। হবে সেইসব গ্রামবাসীদের মতন অবস্থা, যারা তাঁর দর্শনের পরে’ উড়ান দিয়েছিল পোক্করের মতোন। আমরা ছোটো ছোটো ভাবনার মানুষ। মাঠ জ্যোৎস্নার সামান্য নিয়তি বুঝি না। দেখি না জগৎ-সংসারের মায়া। তোমার কথা মনে হল, ডাকি তোমাকে? কিন্তু আগামীকাল আবার যে হাটবার। সেই কথা ভেবে তোমার গোছানো ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।

ভাজে ভাজে সকাল বড়ো হতে থাকল। রোদ গাঢ়তর। রাত শ্রাবণের বৃষ্টির পরে সকাল। নিংড়ে দিয়েছে পতন। মাঠে মাঠে ভোরের জলপাখি বেলার পাখি হয়ে উঠল। পাখির দল জলভরা মাঠে কিছু ঠুগরোচ্ছে। অদূরে মান্তু ফড়ের ভ্যানরিক্সাটি কাত হয়ে মাটির ঢালু ভাঙছে।

নিতাই খাটুয়া আবার বলল,— গতকাল সন্ধ্যায় ঘটে গেল জানো?

কী ঘটল আবার?

সেকি জানো না?

বলো তো?

মাধবের তেলেভাজার দোকানের ঝাঁপ তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। ভৈরব সর্দারের দল এসেছিল?

আবার এসেছিল?

দেখলাম তরবারি ফেলে গেল।

মান্তু ফড়ে নিতাইকে সাবধান করে দিয়ে বলল,— খবরদার তরবারি ছুঁয়ে দেখিস না। তাহলে থানা পুলিশ হবে। বিপদে পড়ে যাবি।

নিতাই খাটুয়া উদাসভাবে বলল,— এ সবই তেনার মাহাত্ম্য। আগামীকাল পূর্ণিমায় যাবে একবার তার দর্শনে? এখন চাঁদের আলো ধুইয়ে দেওয়া মাঠে কথাটা একবার পাকা করে নিতাম।

গেলাম না হয় তোর পাকা কথা রাখতে। কিন্তু যদি তিনি গাছের ডাল থেকে না নামেন? তালে? বুঝতে পারছিস না? সে যে পোকার খেয়াল?

পোকার খেয়াল মানে?

কেন তুই জানিস না? সব গ্রামবাসীরাই তো জানে তিনি বটগাছের ডালে বটপোকার ছদ্মবেশ ধরে বিরাজ করছেন।

তা জানব না কেন?

সেই জন্যই তোকে পাকা কথা কী করে দিই বল তো? কত কেউ মাতব্বর রয়েছে, শেষ পর্যন্ত আমাকেই তোর পছন্দ হল?

তোমার মতো গ্রামে আর কে আছে? সাহসী, বিপদে আপদে মানুষকে ঋণ দাও। কত উপকার করো তুমি। তোমার মতন যে আর দ্বিতীয়টা নাই? আর তা ছাড়া তুমি আমার কাছের মানুষ।

মনে থাকলে আমার? আগামীকাল যাওয়ার আগে একবার টোকা দিয়ে যাস?

সেকি বলো তুমি? টোকা দিয়ে যাব না? রোজ ন্যাওড়া খাল পার হওয়ার সময় তেনার কথা মনে পড়ে। ন্যাওড়া খালপারের মাঠ থেকে বটগাছটিকে পরিষ্কার দেখা যায়। আগামীকাল যতবার তাকে মনে পড়বে, তোমাকেও ততবারই মনে পড়বে। আমি আসব। মধ্যরাত্রে।

মাঝ শ্রাবণের পূর্ণিমা। মরিয়মপুরের পঞ্চায়েত সমিতির কাছারি কোঠার পাশে ধূ ধূ মাঠের ওপরে চাঁদের আলো ধুয়ে দিচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো চরাচর জুড়ে ফরাশ পেতে রেখেছে। কুটির গঞ্জ রাস্তা আড়াআড়ি, বাঁশে ঝোলানো মাছ ধরার ফাঁদি জাল, নিতাই খাটুয়ার লোহা পিটানোর আস্তানা, ধানী পটুয়াদের ধানমাঠ বিল খালের উঠে থাকা জলছবি, ঈদগা, এই সব কিছু ভাঙা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। প্রাচীন বটগাছটির নীচে ঝিঁ ঝিঁ শব্দের মধ্যে গুবরেপোকা, গোখরো দাঁড়াশ নিশিন্তে চাঁদের আলো চেটে নিচ্ছে।

মান্তু ফড়ে নিতাই খাটুয়াকে বলল,— নিবি নাকি রে এক গাল?

নিতাই খাটুয়া বলল,— মধ্য রাত্তিরেও যে আয়োজন করে রেখেছ?

চাউল ভাজার সাথে বাতাসার এক কোণ কামড় দিলে, জিভের ও দাঁতের ফাঁকে বিস্তর স্বাদ রে নিতাই? এমন তো রোজ হয় না, তাই।

নিতাইয়ের হাতে একটা লগা ছিল। মাঝে মাঝে ঘাস ছাড়া শুকনো মাঠের টাকে ঠগ ঠগ করছিল। কিন্তু নরম মাটিতে শব্দ খুব ক্ষীণ হচ্ছিল। মহাকাশে কিছু একটা শব্দ হল না? চাঁদ একপাশে সরে গেল।

নিতাই খাটুয়া বলল,— রাতে বুঝি তোমার ভোজন হয় নাই?

দেখ কেমন সুন্দর? পক্ষে পক্ষে চাঁদ ফিরে আসে। মানুষের কথা রাখে।

আস্তে কথা বলো, শব্দ কোরো না। দেখ একবার চেয়ে দেখ, কেউ তো বিশ্বাস করে না, গাছের নীচে কেমন উজ্জ্বল বাদামি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে, এই এখন তিনি নামবেন।

আমি দেখতে পাচ্ছি না নিতাই?

ভালো করে দেখো। আমার আঙুলের সোজা দেখো।

না রে। আমার চোখে পড়ছে না।

দেখো না? আমার আঙুলের সোজা দেখো তো? গাছের ডাল থেকে, রাতের পাখি উড়ে যাচ্ছে। মানে বটপোকা আস্তে আস্তে মানুষের রূপ ধারণ করছে। আর কিছুক্ষণ পরে মাঠের মধ্যিখানে তিনি আসবেন,— তিনি গ্রামরক্ষক, মরিয়মপুরের মাতব্বর, আমাদের প্রতিশ্রুতি প্রদানকারী, শত শত বৎসর ধরে মানুষ তাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। কারো কপালে তার দর্শন জোটে আবার কারো কপাল খাঁ খাঁ করে।

মান্তু ফড়ে বলল,— শরীরটার কেমন ওজন ওজন মনে হচ্ছে না? পা-ডা ভারী মনে হচ্ছে, কেমন সব কিছু টাল খাচ্ছে। গড়িয়ে পড়ছে স্থির সব কিছু।

নিতাই খাটুয়া মান্তুর দিকে তাকিয়ে সহমত পোষণ করল,— তিনি এসে গেছেন। এই একটু পরেই দেখতে পাব। এইবার তিনি আসবেন। চরাচর দুইয়ে জ্যোৎস্নার আলোর মধ্যে সাদা চাদর পেতে দেবেন। সেই চাদর গ্রাম পক্ষের জ্যোৎস্নাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে ।

মান্তু ফড়ে নিতাই খাটুয়ার হাত চেপে ধরল। চারদিকে কেমন বিস্ময়কর এক শূন্যতা। শীতল শীতল লাগছে বড়ো। কুদলাই নদীর পাড়ে চোরা বালির কথা মনে পড়ছে খুব। মনে হল বাদামি ঘোড়াটি নড়ে উঠল। পরস্পর পরস্পরকে হাত চেপে ধরল। তারপরে এক আচ্ছন্নতার ঘোর। মধ্যরাত্রির জনচিহ্নহীন এক অচেনা মরিয়মপুর। আকাশের মেঘ ধরে রাতজাগা হাঁস দেশের সীমানা ভাঙছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশ। এক রাষ্ট্রক্ষমতার সীমানা থেকে অন্য এক রাষ্ট্রক্ষমতা। নিশাচর হাঁস বোঝে জমির বিল খাল নদী ঝিলের মায়া…

***

তাই খাটুয়া আর মান্তু ফড়ে গাছের নীচে প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল, কখন রোদ উঠেছে বুঝতে পারেনি, সকাল যে গড়িয়ে গেছে। কিছু গড়াগড়ি, এধার থেকে ওধার। ভগ্যিস বৃষ্টি হয়নি, কেমন চারধার স্তব্ধ হয়ে আছে। মান্তু ফড়ে নিতাই খাটুয়াকে বলল,— এ কেমন রে নিতাই? সত্যি সত্যি?
নিতাই খাটুয়া বলল,— বিশ্বাস হচ্ছে না? ওই দেখ, গাছের ডালে ঝুলছে পুকুর, গোটা দুই দিঘি লাট খাচ্ছে গাছের মাথার ওপরে, বটগাছের মূল কাণ্ড ধরে ওপরে উঠে যাচ্ছে সবুজ পানির কানা খাল। কেমন সুন্দর গ্রামবাসীদের জন্য থাকার আস্তানা। বন্যার জলে ভেসে যাক না এবার মরিয়মপুর, খামারবাড়ি, মন্দিরতলা, নামগানতলা, বিনোদন মহল, বুদ্ধিমানতলা…। আস্তানা এবার খাসা।

চল, এখানে পড়ে থাকলে সবাই সন্দেহ করবে? ভাববে আমরা বুঝি সারা রাত নেশা ভাঙ করে পড়ে আছি।

চলো পা চালিয়ে ফিরে যাই। একটা সত্যি কথা বলবে?

কাল রাতে আমরা কখন এসেছিলাম? আর কেনই-বা এসেছিলাম?

জানি না, পা চালিয়ে চল।

মান্তু ফড়ের পাশে নিতাই খাটুয়া, গ্রামের মাটির পথ। দুই পাশে মাটির দেওয়াল। বৃষ্টিতে ভিজে গলে পড়ে গেছে রাজনৈতিক দেওয়াল লিখনের ‘উন্নয়ন অক্ষরটি’। ওরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এল, মন্দিরতলার চাতালে, সেখান থেকে ভেসে এল দুইজনের কানে পারলৌকিক ক্রিয়ার মন্ত্র…

Facebook Comments

পছন্দের বই