লেখক নয় , লেখাই মূলধন

স্নেহা সেনের গল্প

পুড়তে চায় যারা

রুদ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অম্বরিশ। ছোটোবেলা থেকে একই পাড়ায় বড়ো হওয়া। এক স্কুল। এক কলেজ। দু-জনেই সমান তুখোড় পড়াশোনায়। স্কুলের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান দুজনের মধ্যে নির্দিষ্ট ছিল। শুধু পড়াশোনায় নয় খেলাধুলোয়ও মারাত্মক। সকালে উঠে ডন বৈঠক, বিকালে ফুটবল। চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু। চমৎকার কথা বলে। দুই জমজ ভাইয়ের স্বভাবে এত মিল হয় না যতটা এদের। সরস্বতী পুজোয় পাঞ্জাবী পরে বেরোলে মেয়েরা কাত। এদেরই আরেক বন্ধু অরণ্য। স্বভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত। শ্যামবর্ণ, লাজুক, মুখচোরা, আপনভোলা। নিজের মধ্যে সবসময় গুটিয়ে থাকে। ভালো ফল করার আশায় পড়াশোনা করে না, ভালোবেসে করে। অরণ্য বড়ো আবেগপ্রবণ ও অনুভূতিশীল। অদ্ভুত মায়াবী গানের গলা। এই জায়গায় দুই বন্ধুকে ও টেক্কা দিয়েছে। অম্বরিশ অরণ্যকে ভালোবাসলেও রুদ্র খানিক অনুকম্পার দৃষ্টিতে দেখে। তিনজনের এক জায়গায় বড়ো মিল। কিছুতেই কোনো মেয়েকে তাদের পছন্দ হয় না। রূপে তাদের মোহ নাই, গুণে নাই আকর্ষণ। কিন্তু কেনো? তার ব্যাখ্যা তারাও দিতে পারে না। জানে না। এক জাদু, এক রহস্যের অপেক্ষা করে তারা। সংজ্ঞাহীন এক রহস্য।

সময় এগোলো। রুদ্র ডাক্তার, অম্বরিশ অধ্যাপক, অরণ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বসে। বন্ধুত্ব একইরকম আছে। বহুদিন পরে মুখোমুখি বসে তারা চায়ের কাপ হাতে অরণ্যের বাড়িতে। আজ সাত বছর পরেও তারা পুরনো প্রশ্নটির উত্তর পায়নি। নারীর প্রতি আজও শীতল তারা।
কথার পিঠে কথায় রুদ্র অসহিষ্ণু হয়ে বলে ওঠে, ‘এক চরমকে পাবার আকাঙ্ক্ষায় আমরা নিত্যকে অগ্রাহ্য করে কোনো অন্যায় করছি না তো?’
অম্বরিশ বলে, ‘কীসের অন্যায়?’
রুদ্র, ‘চরমকে পাবার পরে সব আকাঙ্ক্ষার যে নিষ্পত্তি ঘটে। পাবার আকাঙ্ক্ষাই তো মানুষকে শক্তি দেয় কাজের।’
অম্বরিশ, ‘নিত্যতা ক্লান্ত করে।’
অরণ্য, ‘স্থিরতার শক্তি অনেক তীব্র। যা খুঁজে চলেছি তা পেলে আকাঙ্ক্ষা মুক্তি হবে। তখন সমস্ত রক্তবিন্দু একত্রিত হয়ে ছুটে যাবে নতুন কাজের প্রতি। তখন সেই কাজ সহজে সফল হবে। কারণ মনের তখন অন্য চাহিদা নাই।’
অম্বরিশ কথা থামিয়ে বলে, ‘আজ রাত হয়েছে। উঠি। বাড়ি যাই। কাল দেখা হবে।’
রুদ্র, ‘আমার ছুটি নাই। কাল সকালে কলকাতা ফিরব। রুগীরা অপেক্ষা করছে। শালা অধ্যাপকগুলোর জীবন। আজ এই ছুটি, কাল সেই ছুটি। আর অরণ্যের তো সারা জীবনটাই ছুটি। কোনো কাজেই ও এল না।’
অম্বরিশ হেসে উঠল। ‘বেশ কাল তবে শুধু আমি আর অরণ্য। আর অমাবস্যার অন্ধকার রাত। তুমি কলকাতা যাও। রুগী দেখো। মুঠো মুঠো টাকা কামাও।’
রুদ্র হেসে বলে, ‘তোর জন্য টাকা জমাচ্ছি তো আমি। সংসার পাতব তোর সাথে।’
একসাথে সবাই হেসে ওঠে।
রুদ্র, ‘যাকগে চল আমিও যাই তোর সাথে। কাল ভোরে ট্রেন।’
অম্বরিশ, ‘চল। কাল আসব অরণ্য। কেমন? দু-জনে অনেক গপ্পো হবে।’
অরণ্য, ‘আসিস।’
অম্বরিশ বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘অরণ্যকে অন্যরকম লাগছিল না? খুব চুপচাপ গম্ভীর।’
রুদ্র, ‘ও তো অমনিই বরাবর।’
অম্বরিশ, ‘আজ কিছু অস্থির মনে হচ্ছিল ওকে।’
রুদ্র, ‘কই আমার তো কিছু মনে হল না। ওকে নিয়ে অত ভাবিস না। বাড়ি যা।’
অম্বরিশ হেসে বলল, ‘ঠিক বলেছিস। আমিই হয়তো বেশি ভাবছি। চল পরে দেখা হবে।’
রুদ্র ইতস্তত করে বলল, ‘আচ্ছা অম্বরিশ আমি কাল থাকব না, তোর মনখারাপ করবে না?’
অম্বরিশ, ‘তা করবে বটে। তবে কী আর করা যাবে। কাজ তো আগে বল।’
রুদ্র, ‘তোর এতদিন ছুটি আছে শুনে চেষ্টা করেছিলাম ছুটির অনেক, পেলাম না। দিল না।’
অম্বরিশ, ‘আরে ঠিক আছে। আবার দেখা হবে তো। আমি কি পালাচ্ছি কোথাও?’
রুদ্র হেসে বলে, ‘যদি পালাস?’
অম্বরিশ, ‘তাহলে অপেক্ষা করবি আমার ফেরার।’

চিত্র: অনুপম বিশ্বাস

অম্বরিশ পরের দিন অরণ্যের বাড়ি এসে জানল ও নাই! আগের দিন গভীর রাতে কোথায় চলে গেছে। কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে। মোবাইল বাড়িতে রেখে গেছে।’
রুদ্রকে ফোন করে অম্বরিশ। রুদ্র বলে, ‘আধপাগলা ছেলে। দেখ কোথাও গেছে। চিন্তা করিস না ঠিক ফিরে আসবে।’
অম্বরিশ বলে, ‘চিন্তা করব না মানেটা কী? কাল যখন আমি বললাম আসব তখনও কিছু বলল না। দিয়ে রাতে উধাও। একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ উধাও!’
রুদ্র, ‘ওর কোন কাজটার মানে পেয়েছিস এতদিন? বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডেলিস্ট ও। তবু গবেষণা করল না। দু-বছর অকারণ বাড়িতে বসে রইল। এত ভালো গান গায় সেটা নিয়েও সিরিয়াসলি কিছু করল না। মোটামুটি কবিতা লিখত সেটাও লেখা ছেড়ে দিল। শেষের দিকে যখনই দেখা হত উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। জীবনটাকে অপচয় করল। নষ্ট করল। হোপলেস।’
অম্বরিশ, ‘ওর মনের মধ্যে কিছু একটা চলছিল। আমি তোকে আগেও বলেছিলাম। তুই পাত্তা দিসনি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাইনি।’
রুদ্র, ‘তুই জিজ্ঞেস করে যখন উত্তর পাসনি, আমি তো পেতামই না। তোর যা করার করেছিস, অতএব এখন চুপচাপ বসে থাক। অকারণ চিন্তা করিস না।’
অম্বরিশ, ‘চিন্তা আমার হবেই। কিছুই করিনি আমি। ও যদি নাই বলে, আমি কেনও আরও জোর করলাম না। ওকে আমি বড়ো ভালোবাসি। ওর সব মিলিয়ে ভালোবাসি। হাতে হাত রেখে বসে আমি থাকব না। খুঁজব ওকে। পাই বা না পাই।’
রুদ্র, ‘বেশ। কিন্তু আমার অনেক কাজ আছে। স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া মানুষকে এই মানুষের ভিড়ে খোঁজার থেকে যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাখলাম ফোনটা।’

রুদ্র সেই দিনের পরে আর কোনো ফোন করেনি। খবর নেয়নি। অম্বরিশকে ও ছোটো থেকে খুব ভালোবাসে। কিন্ত অম্বরিশের সম্পূর্ণ ভালোবাসা রুদ্রের জন্য নয়। কখনো মনে হয় ও অরণ্যকে বেশি ভালোবাসে। ঈর্ষা কুরেকুরে খায় ওকে। অরণ্যকে খুঁজতে গিয়ে অম্বরিশ রুদ্রকে যে সাত মাসে একবারও ফোন করবে না এতটা ও কোনোদিন ভাবেনি। রুদ্র কিন্তু প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত অম্বরিশের একটা ফোনের অপেক্ষা করেছে। বাড়িতে ফোন করে জেনেছে অম্বরিশ অরণ্যকে পাগলের মতো খুঁজছে। পুলিশে খবর দিয়েছিল। কিন্তু কেউ কোথাও ওকে খুঁজে পায়নি। অম্বরিশ যত খুঁজেছে শুনেছে, ততই রুদ্র ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। মায়ের কাছে জেনেছিল যে, দুই অমাবস্যার পরের দিন সকালে নিজেই ফিরেছিল অরণ্য। কিন্তু কোথায় গিয়েছিল কেন গিয়েছিল তা কাউকে কিছু বলেনি। এদিকে অরণ্যের মধ্যে নাকি এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে। শান্ত তো ও বরাবরই, কিন্তু এখন ভীষণ স্থিরও। গবেষণা শুরু করেছে। গান গাইছে। রীতিমতো রেওয়াজ করছে। বেশ ভালো কবিতা লিখছে। হীরেকে যেন কেউ পালিশ করে দিয়েছে। ঝকঝক করছে। আর… আর অম্বরিশ এখন অরণ্যের বাড়িতেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায়। মুগ্ধ করেছে ও অম্বরিশকে? এই খবর মায়ের জানবার নয়। তাই জিজ্ঞেস করেনি কিছু রুদ্র এ-বিষয়ে। অম্বরিশ কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে! কেনো? এর উত্তরও মায়ের কাছে নাই। অম্বরিশ কারুর সঙ্গেই এখন কোনো কথা বলে না। চুপ থাকে। কী যেন ভাবে। গম্ভীর অস্থির। অম্বরিশের মা বিশেষ চিন্তিত ওকে নিয়ে। কিন্তু কিছুরই থই পাচ্ছে না। রুদ্রকে ফোন করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু জানতে পেরেছেন ওদের আর যোগাযোগ নাই। এতে কাকিমা আরও বেশি বিস্মিত হয়েছেন। অরণ্যকে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পাননি।
সব শুনেছে রুদ্র। আর অপেক্ষা করেছে অম্বরিশের একটা ফোনের। সে ফোন আসেনি। রুদ্র কি ফোন করতে পারত না? নিশ্চয়ই পারত। হাতে ফোন তুলে নিয়েও থেমে গেছে। যদি অম্বরিশ অরণ্যের কাছেই থাকতে চায়, শান্তি পায়, তবে কেন ওকে ডাকা? যে মুখ ফিরিয়েছে, কেন ভিখারির মতো রিক্ত হস্তে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো? যে যেতে চায়, তাকে আটকানো কি সম্ভব। রুদ্রের গাল দিয়ে কিছু মুক্ত গড়িয়েছে। মাসের পর মাস বাড়ি যায়নি রুদ্র। কলকাতায় থেকেছে। অম্বরিশের কাছে অবাঞ্ছিতের মতো দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।

অমাবস্যার আগের দিন গভীর রাতে অম্বরিশ কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়! মোবাইল ফোন বাড়িতে রেখে। অম্বরিশ হারিয়ে যায়। পুলিশ এসে অরণ্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কোনো হদিস পায় না। রুদ্র এসে দাঁড়ায় অরণ্যের কাছে। এ কোন অরণ্য! একী পরিবর্তন। এত দিনে সবই শুনেছিল সে। কিন্ত তবুও এতটা ভাবেনি। এ তো যেন শাণিত তরোয়াল। অরণ্য যেন রুদ্রেরই অপেক্ষা করছিল। হেসে বলল, ‘আয়, বস।’
রুদ্র, ‘অম্বরিশ কোথায়?’
অরণ্য, ‘আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’
রুদ্র, ‘মানে তুই জানিস ও কোথায়।’
অরণ্য, ‘হ্যাঁ।’
রুদ্র, ‘তবু বলবি না আমাকে!’
অরণ্য, ‘না।’
রুদ্র, ‘তুই জানতে পারিস ও কোথায়। কিন্তু আমি নয়। এতটাই কি আমি দূরে চলে গেছি ওর।’
অরণ্য, ‘ঠিক উলটো। ও চায় ও নিজে এসে বলবে তোকে।’
রুদ্র, ‘কবে ফিরবে ও।’
অরণ্য, ‘দুই অমাবস্যার পরের দিন সকালে।’

রুদ্র অপেক্ষা করেছিল। বাড়িতে থাকতে পারেনি। অরণ্যকে দেখলে ভিতরটা জ্বলত ওর। কলকাতা ফিরে এসে কাজে ডুব দিতে চেয়েছিল। পারেনি। উদ্ভ্রান্তের মতো ঘোরে সারা দিন, আর অপেক্ষা করে। ঠিক দুই অমাবস্যার পরের দিন সকালে অম্বরিশের ফোন আসে। ‘রুদ্র আমি এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরেছি। আয়।’
সন্ধ্যাবেলায় রুদ্র অম্বরিশ আর অরণ্য মুখোমুখি বসে। অরণ্যদের ছাদে। অম্বরিশ এক অবিশ্বাস্য গল্প শোনায়।

পাগলাটে অরণ্য খুঁজে বেড়াতো তার প্রিয়াকে। খুঁজে পেত না। অস্থিরতা বাড়ত। শীতকালে পুরুলিয়া বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ সে এক লোককথা শোনে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের সেই লোককথা বুকে নিয়ে কাটায় দু-বছর। কাউকে কিছু বলে না। অভিসারের আগে এ-কথা বললে অভিসার ব্যর্থ হয়। সফল হয়ে ফিরে এসে জানায় অম্বরিশকে। অম্বরিশ প্রথমে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু বদলে যাওয়া অরণ্যকে দেখে ধীরে ধীরে তার বিশ্বাস জন্মায়। সেও সিদ্ধান্ত নেয় অভিসারের। অমাবস্যার আগের গভীর রাতে অম্বরিশ নিঃশব্দে সবকিছু ত্যাগ করে। ট্রেন ধরে। দুপুরবেলায় পৌঁছায় গন্তব্যে। এই স্টেশনে সারা দিনে একটিই ট্রেন থামে। স্টেশনমাস্টার ছাড়া কাউকে দেখতে পায় না অম্বরিশ। এবারে পথ হাঁটতে হবে দৃঢ়তার সাথে। নির্ভয় হয়ে। মরুভূমির মতো রুক্ষ তৃষ্ণার্ত হয়ে। তবেই সমুদ্রের শেষবিন্দু পর্যন্ত শুষে নেওয়া যাবে। পাত্রের ধারণ ক্ষমতার সৃষ্টি না হলে দানী মহাদান করবে না। মুখ ফিরিয়ে থাকবে। ফিরে আসতে হবে অম্বরিশকে। আবার যেতে হবে পরের অমাবস্যায়। যদি আকণ্ঠ তৃষ্ণা না থাকে সে দেখা পাবে না নারীর। আর যদি কখনো একাধিক ব্যক্তি একই দিনে আসে অভিসারে? তবে? উদ্দেশ্য যদি হয় অভিসারের তবে তারা একে-অপরকে দেখতে পাবে না। নারী দেখা দেবে শুধু যোগ্যতম পুরুষ অথবা নারীকে। তুলে নেবে তার নৌকায়। বাকিরা দেখতেও পাবে না সেই নৌকা। একা দাঁড়িয়ে থাকবে পাড়ে। ফিরে আসবে হতাশ হয়ে।
অম্বরিশ বলতে থাকে। স্টেশনে নেমে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। হাঁটা ছেড়ে ছুটলাম। ঘামছি রীতিমতো। তবুও ক্লান্তি নাই। আমাকে পৌঁছাতেই হবে তার কাছে। নির্জন প্রান্তরে আমি ছুটছি, ছুটছি। এই প্রান্তরের কী কোথাও শেষ নাই? কোথায় সেই নদী? আর কতদূর? দূর থেকে চোখে পড়ল এক চওড়া উত্তাল নদী। আনন্দে উত্তেজনায় আমি শিউরে উঠলাম। কাছে আসতেই চোখে পড়ল এক নৌকা। তাতে পিছন ফিরে বসে এক অবগুণ্ঠিতা নারী। বুকের রক্ত চলকে উঠল। নৌকায় পা দিতেই নৌকা খানিক দুলে উঠল। এই নৌকায় বসা মানেই বাস্তব জগৎ ও সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। এবারে চারপাশে যে দৃশ্য দেখব তা আসলে মায়া। অরণ্যের দেখা ও আমার দেখা এক হবে না। স্টেশন থেকে নদী অব্দি পথটা সত্যি। অন্য যে-কোনো দিন গেলে এই পথটা দেখা যাবে। নদীও দেখা যাবে। অন্য মাঝির নৌকায় চাপলে কোথাও একটা পৌঁছানোও যাবে। কিন্তু আজ যেখানে যাচ্ছি সেখানে এই জীবনে আর দ্বিতীয়বার যাওয়া যাবে না। আমাদের চেতনায় থাকবে একটা অমাবস্যার স্মৃতি। কিন্তু বাস্তব জগতের সময় অনুযায়ী তা দুটি অমাবস্যার স্মৃতি।
নৌকা চলতে লাগল। অবগুণ্ঠিতা নারীর পেশীবহুল চওড়া কাঁধ। সাদা মসৃণ দুই হাত। কাঁচুলিবিহীন সাদা শাড়ি লাল পাড় হাঁটুর উপর অব্দি জড়িয়ে পরা। আভরণহীন নারী। দু-পাশের প্রকৃতি ধূ ধূ ফাঁকা। সেই জগতের বিকালের রোদ ফুরাবার আগেই পাড়ে এসে থামল নৌকা। নামলাম। নৌকা নিয়ে অবগুণ্ঠিতা নারী চলে গেল। আবার আসবে কাল ভোরের প্রথম আলোর সঙ্গে। পাড়ের এই প্রকৃতি আবার সবার কাছে একই থাকে। অরণ্য যা দেখেছে আমিও তাই দেখলাম। নদীর দিকে পিছন করে দাঁড়ালে ডান পাশে গভীর জঙ্গল। উঁচু উঁচু গাছের ঠাসবুনুনি সারি। বাম দিকে ধূ ধূ প্রান্তর। শ্মশানের ছাই পড়ে চারপাশে। কত যুগ ধরে কারা পুড়েছে এখানে? সামনে তাকালে দেখি জঙ্গল ও শ্মশান অর্ধবৃত্তাকারে মিলিত হয়ছে। বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি। অপেক্ষা এখন শুধু অপেক্ষা। রাত গভীর হবার। নারী এখন শৃঙ্গার করবে।
রাত কত তা জানা নাই। দ্রুত হাওয়া বইতে শুরু করল। গাছগুলো উসখুস করে উঠল। উদগ্রীব হলাম আমি। সে আসছে। দূরে অন্ধকারকে শরীরে জড়িয়ে গাছপালার ভিড় ঠেলে সরিয়ে বেরিয়ে আসে এক নারী। আচমকা তীক্ষ্ণ উলুধ্বনি ওঠে। আমার সারা শরীরে এক শিহরন ছড়িয়ে যায়। চারপাশের গাছগুলো উন্মত্ত হয়ে ওঠে তাকে দেখে। ঝড় ওঠে। নদী ছটফটিয়ে উঠে মাথা কোটে পাশের নরম মাটিতে। নিকষ অন্ধকারে দূরের সেই নারীকে স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু বাতাসে বয়ে আসে উগ্র এক আদিম বনফুলের গন্ধ। চোখ বন্ধ করে সেই বাতাসকে বুক ভরে টেনে শিরায় শিরায় ছড়িয়ে দিই মাদকতা। খানিক পরে আবার চোখ খুলি। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি কিছু দূরের সেই স্থির অবয়বের দিকে। অবয়বের প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে আমার কয়েক হাত তফাতে জ্বলে ওঠে এক বিশাল চিতা। শিউরে উঠি আমি। আলোকিত হয়ে ওঠে দূরদূরান্ত। সেই আলোয় দেখি ঈষৎ স্থূলাঙ্গী নারীর গোঁড়ালি অব্দি কোঁকড়ানো অবাধ্য চুল তার নিকষ কালো খসখসে উলঙ্গ শরীরকে ঢেকে রাখতে চাইছে প্রাণপণে। নাকে বড় নথ। গলায় রুপোর হাঁসুলি। দুই হাতে মোটা রুপোর বালা। বাম হাতে কুনুইয়ের উপরে বাহুর পুরো অংশে রুপোর সাপ পেঁচিয়ে ফণা তুলে আছে। পাথরের কালো মণি তার, লাল টকটকে চেরা জিভ। পায়ে মোটা রুপোর মল। লাল আলতা। নুপূরধ্বনি তুলে নারী দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসে। কয়েক হাত দূরে এসে দাঁড়িয়ে প্রথম চোখ তোলে। খয়েরি মণি। নারীর চোখের প্রথম তীব্রস্পর্শে বিদ্যুৎ খেলে যায় আমার শরীরে। নাচের মুদ্রায় দাঁড়ায় ভৈরবী। মুহূর্তের স্তব্ধতার পরে শুরু হয় নাচ। অকল্পনীয় অবর্ণনীয় অলৌকিক এক নাচ। সেই নাচের তালে আমাকে স্পর্শ করে শুরু হয় আদর। এ সেই শিল্পীত নন্দিত আদর যার হদিশ জানত আমাদের পূর্বপুরুষেরা। শিক্ষিত শহুরে মস্তিষ্কে তার কোনো রেখাও বর্তমানে নাই। কিন্ত শিরা উপাশিরায় বয়ে যাওয়া রক্তেরা সব মনে রেখেছে। ভৈরবী আমার বিস্মৃতির অতল গহ্বরে ঝাঁকুনি দিয়ে স্মৃতিদের জাগিয়ে তোলে। অম্বরিশ মুখার্জির খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে সে, যে সভ্যতার সূচনালগ্নে প্রথম কাঠকয়লা হাতে নিয়ে গুহায় ছবি এঁকেছিল। অপার কৌতূহলে যে-রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে তারার রেখাচিত্রে নৃত্য দেখত। অব্যক্ত ধ্বনি থেকে যে প্রথম সুর করেছিল। গুহার পাথুরে শীতল ঘরে যে একটি ফুল এনে রেখেছিল। ভৈরবীর দোসর হই আমি। রক্তেরা জ্বলে ওঠে। আমার স্পর্শেরা হয়ে ওঠে হিংস্র। ভৈরবীর ডান বাহুতে থাকে আমার দেওয়া ক্ষত, ঠোঁটে থাকে হাসি, মুখে থাকে সুখ। তার শরীর হয়ে ওঠে কোমল। সময়ের কোনো হদিস থাকে না। কত জন্মের আকাঙ্ক্ষা আমার, কত জন্মের তৃষ্ণা। মনে পরে প্রথম যেদিন অস্ত্র তৈরি করেছিলাম। পাথরে দিয়েছিলাম অবিশ্রান্ত শান। সেই অস্ত্র গেঁথে গেছিল চিতাবাঘিনীর অন্তরে। চওড়া কাঁধে ফেলে নিয়ে এসেছিলাম তাকে। তার উষ্ণ রক্ত আমার শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছিল। দলের সবাই খুশি হয়েছিল শিকারে। আমি ছিলাম দলপতি। চিতাবাঘিনীর ছাল হয়েছিল আমার পরিধান। দেবতার মতো হিংস্র হয়ে পীড়ন করি আমি। পৃথিবীর মাটি হয়ে ধারণ করে নারী। চূড়ান্তে পৌঁছানোর আগে নরম হই আমি মুহূর্তকাল। মনে পরে, এই মুহূর্ত শেষ হলে নারী আর আসবে না কোনোদিন। সে চলে যাবে, যেমন গেছে প্রতিবার। কান্না পায় আমার। আলতো করে তার গালে হাত রাখি। চোখে চোখ রাখে নারী। খিলখিল করে হেসে ওঠে। আমাকে মাটিতে ফেলে উপরে আসে সে। মুহূর্তকে বন্দী করা যায় না পুরুষ। আমাদের আসলে কোনো অতীত নাই, ভবিষ্যৎ নাই, আছে এই মুহূর্ত। একে অনুভবে নাও। স্মৃতিতে নয়। হিংস্র হয় নারী। আমাকে উজার করে নেয় সে। কিচ্ছু নিজের কাছে রাখতে দেয় না। ভোররাতে ক্লান্ত আমাকে ভেজা মাটিতে শুয়ে সে গাছের ভিড়ে হারিয়ে যায়। পিছু ফিরে তাকায় না পর্যন্ত। চিতার আগুন নিভে আসে। ভোরের প্রথম আলো ফুটলে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি নৌকা নিয়ে এসেছে অবগুণ্ঠিতা নারী। ঘোরের মধ্যে এসে বসি। কোনোদিকে তাকাই না। আবিষ্ট আমি। সে নৌকা চালায়। পাড়ে এসে থামে। নামি। একবার ফিরি তার দিকে। সে নৌকা ঘোরায় চলে যাবে বলে। দেখি তার ডান বাহুতে ক্ষত! সে চলে যায়। আমি ফিরে আসি। কথিত আছে, পুরুষেরা পূর্ণতা পেতে প্রতি অমাবস্যায় নিজেকে সঁপে দেয় এক বনদেবীর কাছে। এটা জেনেও যে এরপরে তারা আর কখনো উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারবে না। শীতলতা তাদের ঘিরে রাখবে আমৃত্যু। তবুও তারা যায়, উজার করে দেয়। জীবনে একবার তারা সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে, সেই ছাই থেকে নতুনভাবে জন্মাতে চায়।

সবাই চুপ করে ছাদে বসে থাকে।
রুদ্র খানিক পরে উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘তুই পেলি শীতলতার শান্তি। আর আমি অভিশাপ।’
ধীরে ধীরে সে চলে যায়।

Facebook Comments

পছন্দের বই