লেখক নয় , লেখাই মূলধন

হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখরের গল্প

নভেম্বর ইজ দ্য মান্থ অফ মাইগ্রেশনস

ভাষান্তর: রমিত দে

(জন্মসূত্রে হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখর সাঁওতাল এবং সাঁওতালী জীবনের অস্তিত্বের প্রশ্নগুলিই বারবার তার গল্পে অনুরণিত হয়েছে। বারেবারে একজন গল্পকার তার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে পাঠককে মুখোমুখি করিয়েছেন প্রান্তিক মানুষের নির্বাসিত জীবনের। এমনকি তার প্রথম উপন্যাস-‘রুপি বাস্কের অদ্ভুত অসুখ”এর মুখবন্ধে হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখর যখন লেখেন –‘ এটি ইংরেজিতে লিখিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাঁওতাল উপন্যাস’ তখন বোঝা যায় কিভাবে তার যাপনে জড়িয়ে রয়েছে নিজস্ব জাতিসত্ত্বার ভাষ্যগুলো। এই উপন্যাসের জন্যই হাঁসদা শৌভেন্দু শেখর ২০১৫ সালের যুব সাহিত্য আকাদেমী পুরষ্কারে ভূষিত হন এবং ২০১৪ সালের ‘ক্রশওয়ার্ড বুক এওয়ার্ড ও হিন্দু লিটেরারি এওয়ার্ডের জন্য তালিকাভুক্ত হন। )

বছরের পর বছর তাই তো চলছে! নভেম্বর পড়তে না পড়তেই ঢ্যামনা সাপের লেজের মতো এঁকেবেঁকে ওরা নেমে আসবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। বাঁশ, ঝুড়ি, কোদাল-এ ক’দিন এটুকুই তাদের ফাঁদানো সংসার আর তাই নিয়েই সাঁওতাল ছেলে মেয়ে বাচ্চাগুলো জীবন্ত শিখার মতো পাহাড়ের ছোটো ছোটো গাঁও থেকে ছিটকে পড়বে ঠান্ডা নিষ্কলুষ নতুন তল্লাটে।

সাঁওতাল পরগনা থেকে জেলা সদরের স্টেশন অনেকটা পথ, আরও অনেকটা নাবালে পৌঁছতে। চারপাশের পাহাড় শালফুল সার সার লাল ডেঁয়ো ছেড়ে তারা বর্ধমানে আসে। ধান রোয়। ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে গানের কলির মতো সব্জি সাজায়। এসবই স্থানীয় জোতদারের জমি। মহাজনের জমিতে সবসময়ই তো একটা গণ্ডী থাকে, এই গণ্ডীর ভেতরেই পাহাড়ের গয়না খুলে আসা সাঁওতাল মানুষগুলো এই একটা মাস ঘুরঘুর করে, একটু ঘুমোয়, অনেকটা জাগে। শীত পড়তেই চারপাশের পাহাড় হঠাৎ শেষ হয়ে তারা এভাবেই ঢুকে পড়ে শহরে। হয়তো অন্ধকারে, হয়তো আলোতে। তবে এ অন্ধকারের গন্ধ নেই তবু অনুসরণ আছে। ঠিক যেমন এ আলোর পুরোটাই আগুন। তবে যেটা সত্যি তা হল নভেম্বর মানেই তাদের কাছে অভিবাসনের মাস। বেরিয়ে পড়ার মাস। কাজে যাওয়ার মাস। আর এই অভিবাসনটা তাদের কাছে ভীষণ জরুরি।

বছর কুড়ির তালামাই, তালামাই কিসকু তেতাল্লিশ জনের যে দলটা আজ পাহাড় ছাড়ল তাদের একজন। এর মধ্যেই ওর তিন ভাই আর এক জামাইবাবু বর্ধমানের উদ্দেশে বেরিয়ে গেছে, হয়তো পৌঁছেও গেছে। আজকের দলে তালামাইয়ের বাবা মা আর দু’বোনের একজনা আছে।

তিন ছেলে তিন মেয়ের সংসারে তালামাই দ্বিতীয় মেয়ে। ওর নামের মধ্যে কিন্তু তেমন আহামরি কিছুই নেই, বলা যেতে পারে একেবারেই কল্পনাহীন একটা নাম। তালা মানে মাঝের জন আর মাই মানে মেয়ে-সোজা সাপটা, নামের ভেতর কোনো ফাঁকি আছে বলতে পারবে না কেউ। তালামাইরা খ্রিস্টান। সেদিক থেকে দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না যে, তালামাইয়ের পরিবারের  কারুর শিক্ষা নেই কল্পনা নেই  রহস্যবোধ নেই যে, মেয়ের একটা গুছিয়ে নাম রাখতে পারবে না। অথচ এটাই সত্যি মিশনারির হাজার একটা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তালামাই বা ওর বাবা মা কেউই আজ অবধি স্কুলের মুখ দেখেনি। হয় কয়লা কুড়িয়েছে নয়তো বর্ধমানে জ়োতদারের জমিতে ধান রুয়েছে।

নিজের দল থেকে ছিটকে কিছুটা এগিয়ে যায় তালামাই। অল্পবয়সী একটি ছেলে তাকে ইশারা করে। ডিকু, আর পি এফের জওয়ান, দেখতে শুনতে বেশ, এদিক ওদিক কিছুটা তাকিয়ে তালামাইকে ডেকে নেয় এক কোণে। হাতে ব্রেড পাকোড়া, নেড়ি কুত্তার মতো গুটিয়ে ঠান্ডা হয়ে মুঠোয় শুয়ে আছে। এমন একটা ইশারার জন্য তালামাই অপেক্ষা করছিল কিনা সে নিজেও জানে না, কিন্তু তার খিদে পেয়েছে, ভয়ংকর ঠান্ডা একধরনের খিদে, ফিসফিস করে সে কথা বললেই এই খিদের কাছে তালামাই হেরে যায়। আর এখন তো সবে রাত ১০.৩০। এখনো প্রায় দু’ঘন্টা দেরি তাদের ট্রেন আসতে। বাইরে আস্ত এক অন্ধকার, অন্ধকারের গায়ে ঠেস দেওয়া কালো লম্বা পাহাড় আর পাহাড়ের সামনে ন্যাংটো পোঁদে দাঁড়িয়ে থাকা খিদে— কে কার প্রতিদ্বন্দ্বী এতসত তালামাইয়ের জানার কথা নয়; হেঁটে যাওয়ার পথে কেউ যদি অর্তকিতে এ মূহূর্তে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় আর সেই হাত কাঁধে রেখে বলে—‘খিদে পেয়েছে’?— তবে সে থেমে যেতে পারে। এ মূহূর্তেই।

পুলিশ কোয়ার্টারের সামনেই ডিকু দাঁড়িয়ে।

—‘কিছু খাবি’?

‘হ্যাঁ’— আধো অন্ধকারে শান্তভাবে বলল তালামাই।

—‘টাকা চাই?’—

—‘হ্যাঁ’।

—‘আমার জন্য কিছু করবি?’

তালামাই জানে কী করতে হবে। কোয়েলা রোডের ধারে যেখানে সাঁওতাল মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক থেকে কয়লা চুরি করে সেখানে সে এমন কাজ আগেও করেছে। কালো পাথরে খোদা সাঁওতাল মেয়েগুলো অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ট্রাক ড্রাইভারদের সাথে এ কাজ হামেশাই করে থাকে; শুধু ট্রাক ড্রাইভার কেন, অন্য অনেকের ইশারাতেই তারা সাড়া দেয়, অর্ধাঙ্গ অসাড় হয়ে গেলেও করতে থাকে। টাকা পায়, রুটি পায়, সময়কে চাপা দিয়ে চলে যায় কয়লা আর পাথর আর খিদে। ওরা করতেই থাকে। নাবালে পৌঁছনোর পথে স্টেশন চত্বরেও এটা নতুন কিছু নয়।

—‘হ্যাঁ’— তালামাই মাথা নাড়ে। ডিকুকে অনুসরণ করে কোয়ার্টারের পেছনে ফাঁকা মতো একটা জায়গায় চলে আসে।

পুরো কাজটা শেষ করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। ডিকু তো আগে থেকেই তৈরি। গামছা পেতে নেয় মাটিতে আর নিজের প্যান্ট খুলে ফেলে। কনডোম পরে নিতেও ভোলে না। তালামাইও পুরোপুরি বিবস্ত্র হয় না, স্রেফ সায়া আর লুঙ্গিটা খুলে রাখে— সে জানে কী কী করতে হয়। যেমন এরপর দু’পা ফাঁক করে চিৎ হয়ে শুতে হয়। তালামাইয়ের ঢলে পড়া পাছায় চাঁটি মেরে দু’হাতে নিজের দিকে তুলে নেয় পুলিশটা। তারপর ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। গলার কাছে কামড়ে ধরে জোরে জোরে করতে থাকে। শান্তভাবে শুয়ে থাকে তালামাই। নির্বিকার নিরুত্তর। মজাকিয়া অন্ধকার আঁছড়ে কিছুটা আলোমরা আলো এসে পড়েছে পুলিশের মুখে আর তালামাই ওর বুকের তলায় শুয়ে লক্ষ করতে থাকে প্রতিটা ধাক্কার সাথে সাথে কীভাবে বদলে যাচ্ছে প্রতিটা বলিরেখা।

একসময় আলতো হেসে ওঠে ডিকু— তালামাইয়ের কোমরের পেটি নিজের দিকে আরও জোরে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলে— “শালী, তোরা সাঁওতাল মেয়েগুলো লাগাবার জন্যই তৈরি হয়েছিস”। প্রত্যুত্তরে, কিছু বলে না তালামাই। কিছু করে না। একটা সময়, ব্লাউজ়ের ভেতর থেকে মাইদুটোকে বের করে ডলতে থাকে পুলিশটা, ওর ক্ষুধার্ত উন্মুখ দাঁতে নিয়ে কামড়াতে থাকে। লাগে, খুব লাগে তালামাইয়ের।

‘চেঁচাস না’— হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে থাকে লোকটা।

‘একটাও কথা বলিস না, লাগবে না বেশি’—

তালামাই একটাও শব্দ করে না, এমনকী গুটিয়েও নেয় না নিজেকে। সে জানে মাংস গলে গেলেও কীভাবে চুপ করে পড়ে থাকতে হবে। খালি দু’পা ছড়িয়ে চুপ করে পড়ে থাকা। এতটুকুই তো কাজ, আর এটুকু তার জানা। যা করবে তা কেবল লোকটা। তার কাজ শুয়ে থাকা, কিছু না ভেবে চোখের পাতা না ফেলে এককুচি নিষ্ক্রিয় শূন্যের মতো আস্ত একটা শরীর নিয়ে শুয়ে থাকা। ঠান্ডা হয়ে শুয়ে থাকা খালি— পিঠের তলায় গামছার ফাঁক দিয়ে যেমন মাটির ঠান্ডা এসে লাগছে এখন, ঠিক তেমন ঠান্ডা হয়ে শুয়ে থাকা। যেভাবে কালো মেঘ এসে চুপটি করে ঢুকে পড়ে নীরব মাটির কুঁজোয় আর নিজেকে নিঃশেষ করে একটা নির্জীব মুখ করে বসে থাকে।

দশ মিনিটেরও কম সময়ে পুরো কাজটা শেষ হয়ে গেল।

তালামাইয়ের দু’হাত ধরে টেনে তাকে উঠে পড়তে সাহায্য করল পুলিশটা। ব্যবহৃত কনডোমটা ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশের ঝোপে আর প্যান্ট পড়ে নিল। তারপর পঞ্চাশটা টাকা আর দুটো ঠান্ডা পকোড়া তালামাইয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে সামনের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

নিজের সায়া আর লুঙ্গিটা বেশ শক্ত করে বেঁধে নিল তালামাই, ব্লাউজের খাঁজে গুঁজে নিল পঞ্চাশ টাকা। আর ঠান্ডা পকোড়া দুটো খেয়ে নিয়ে নিজের দলের দিকে ফিরে গেল।

Facebook Comments

পছন্দের বই