দেবাশিস সাহা’র গুচ্ছকবিতা
চোতক্ষ্যাপা
দারুচিনির দেশে
কেউ কেউ নেমেছে দারুর খোঁজে
চিনি নিয়ে আগ্রহ নেই মধুমেহ প্রেমিকের
স্লেট থেকে ভাগ্যরেখা মুছে
দারিদ্র্যরেখা এঁকে দিল অমাবস্যা
উড়ালপুল ধরে হেঁটে যায় ভাত
পিছু পিছু ভাই ও আমরা
সিঁড়ি কাকে কী শেখায় জানি না
সেই একই পড়া প্রতিদিন
ফুটপাত টকভাত বমি আর
অন্ধকার ঘরে ভ্যপসা গন্ধ
নিজের বুকে ভর করে
ব্রিজের নীচে ফিরেছে কামিজ
লতিয়ে লতিয়ে
এ বাড়ি সে বাড়ি
চলে যায় আলো রঙের আনন্দ
সাবান জলে হাত ধুয়ে রাত ঘুমাতে যায়
সাবান জলে ধোয়া ভোর
দিদিমণির চাল আলুর দিকে বাড়িয়ে দেয় হাত
মাস্ক গ্লাভসের কাছে
আরও কিছুটা সময় চেয়ে নেয় জীবন
পুলিশের ইশারার অপেক্ষায়
নরম নরম আলোগুলো বসে থাকে
পাতার আড়ালে
চোতক্ষ্যাপার দল কাদা করছে রেশন দোকান
মানুষ আজ সংখ্যা
পরিসংখ্যানের আড়ালে চলছে অন্য এক খেলা
লাঠির তাড়া খেয়ে
গরম ভাত খুঁজে চলেছে
এক নিরুপদ্রব ঠেক
***
পা-হীন পথ
স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে চলে যাব
পা-হীন পথকে সঙ্গী করে
ল্যম্পপোস্টে বাঁধা পতাকার চিৎকার
ইনকিলাব জিন্দাবাদ
গোটাকয়েক ভেড়া হয়ে গেল বোবা
সাড়ে তিন হাত দূরত্বে হাসি ও কান্না
মধ্যিখানে শুয়ে থাকা আমি
পেরোতে পারি না চোখের গন্ডি
পর পর থেমে আছে আমার দুঃখ
খুলে যাচ্ছে হাফ প্যান্টের দড়ি
দড়ির এক প্রান্তে নোঙর
অন্য প্রান্তে
ঝুলে আছ তুমি
সবাই দূরত্ব বোঝে না
সরাইখানা জানে
সহিসেরা ফিরে এলে
সূর্যাস্ত সাজতে সাজতে নেমে যাবে তোমার গুহায়
আমি ছোঁবার লোভ সামলাতে না পেরে
নেমে যাব রক্তাক্ত মাঠে
বৃহৎ লড়াই হবে
টক্কর শেষে টুপি খুলে চলে যাব
পা-হীন পথের হাত ধরে
কোনো এক অন্ধ নাবিকের পাঠশালায়।
***
গোল্লা
গোল্লার ভিতরে
নিরন্ন মানুষের পা
সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রেখে
পর পর গোল্লা
নিরন্ন মানুষের আশ্রয়
এই গোল্লার গভীরে
দূরত্ব রেখে
তুমি গোল্লার ভিতরে
ঢেলে দিচ্ছ টাকা, রেশন আর নীরবতা।
***
চাবি
কমে এসেছে আঠা
জোড় লাগেনি
তোমার অব্যবহিত রাত
আমাকে নিয়ে খেলে বেড়ায়
ভেসে যায় বন্যায় কবলিত
মাঠের পর মাঠ
দৃষ্টি কমে আসে
দেখতে পাই না গোলপোস্ট
একটি হলদে জড়ুল
ঘুমাতে দেয় না আমাকে
বাতিল ঘোড়ার আস্তাবলে
আমাকে রেখে এসে
কার হাতে তুলে দিলে
ব্রহ্মাণ্ডের চাবি
***
ক্রীড়নক
মৃত্যুর কাছে
আমাকে মানত রাখে অসুখ
এই অস্থির সময়ে
অসুখের মধ্যেও
আনন্দ পেলে লাফিয়ে ওঠে জল
আমাকে পাঁঠা ভেবে
বলির দিকে
এগিয়ে দেয় সময়
মৃতদেহের অভিনয় করে যাই
দিনের পর দিন
বেঁচে থাকি এক খেলনাপুতুল হয়ে
কে পরে যাবে
এই প্রতিযোগিতায়
গো-হারা হেরে গিয়ে
অসুখ আজ নিজেকেই ধরেছে বাজি
এই খেলায়
নতুন বাজিগর আমি
তোমার ক্রীড়নক হয়ে
কাটিয়ে দেবো হাফ টাইম
পরের হাফ খেলে দেবে সেই পাখিটা
যে সারারাত মৃত্যু মুখে ডেকে বেড়ায় আমাকে।
***
বেসুরো বাজনা
ফিরিয়ে দিয়েছে
যে সমস্ত কঠিন মুখ
স্তন চটকে চটকে
ছুটিয়ে নিয়ে গেছে রাত
দুধের বদলে মেঘ রেখে গেছে
আলো কমে এলে
ভুগোলে ভুগোলে অপরিচিত হাত
কেন জেনে নিতে চায় তাপমাত্রা
শুকিয়ে যাবার পরেও
ফুলে গন্ধ খোঁজো কেনো
তারাদের মধ্যে খুঁজি
পুর্বপুরুষের মুখোশের রং
বেসুরো বাজনা
আজ শরীরে
নানা রঙের মেঘেদের ভিড়ে দেখি
পুরানো প্রেমিকার ব্যর্থ তলপেট
তাল গাছের আড়াল থেকে শুনি
শ্মশানবন্ধুদের নির্মল অনাবিল অট্টহাসি
***
উৎখাত
রাত হলেই
মাঠের ধারে ভাত খেতে আসে নদী
জল খাবার সময় জলে ফিরে যায়
কখনো কখনো তোমাদের হাসপাতাল
আসে ফুলেদের শোবারঘরে
তুমি পাড়ে এসে
গর্ভবতী পাখিদের শেখাও ডানা সেলাইয়ের কৌশল
গাছেদের খিদে পেলে
খুলে দাও স্তন
গমক্ষেত থেকে ট্রাক্টর ভর্তি হাসি
পাঠিয়ে দাও চাষিভাইদের এবড়ো-খেবড়ো মুখে
বোমারু বিমান
রক্তের বিনিময়ে নিয়ে যায় আহ্লাদ
কাকতাড়ুয়ার জীবনকথায় জানা যায়
মঙ্গল গ্রহ তার জমি থেকে উৎখাত করেছে
মানুষ নামের পাখি সম্প্রদায়কে।
***
পাশুপত
ফল থেকে রস সরিয়ে রাখে
প্রিয় বোলতা মহোদয়
বোলতার মধুমেহ হলে
আমরা কার কাছে যাব
কার কাছে চেয়ে নেব বিশল্যকরণী
সাঁকোর অসুখ হলে
সাঁতার ভুলে
উড়ে যায় নদী
কেউ কোনো রাস্তা বলতে পারে না
হয়তো রাস্তাগুলোর মৃত্যু হয়েছে
নয়তো রাস্তাগুলো সঙ্গে করে
চলে গেছে আমাদের আদিম মা
আমাকে হাতকড়া পরিয়ে
মুখের সামনে
পায়চারি করে মৃত্যু
স্মৃতি হারিয়ে প্রকৃতি আজ অসহায়
আমাদের বুকের ভেতর
যৌনকামড় খেয়ে কেঁদে যায় বেড়াল
একটানা ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে
চলে যায় কে বা কারা
মৃত্যু থেকে পক্ষপাতীত্ব
সরিয়ে রাখে মেঘ
প্রকৃতির কান্না
দিনের পর দিন জমে জমে
একদিন মেঘ হয়ে যায়
মেঘের অসুখ হলে
অসহায় অরণ্য হাউমাউ করে
কেঁদে ফেলে নিজেই।
আজ অসুখের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
কার কাছে চাইব পাশুপত?