লেখক নয় , লেখাই মূলধন

নন্দন সাহার প্রবন্ধ

কাশ্মীর: গণতন্ত্রের উপেক্ষিতা কন্যা

বিগত ৭৩ বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক পরিস্থিতিকে ইস্যুটি সবচেয়ে প্রভাবিত করে এসেছে ‘কাশ্মীর’ ইস্যু। দীর্ঘ সময় ধরে কাশ্মীর উপমহাদেশের এক অমীমাংসিত শব্দ যার জন্য ভারত বা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নীতি তো ছাড়ুন সার্কের মতো আঞ্চলিক সংঘও সফল হতে পারল না। সম্প্রতি সেই কাশ্মীর বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত দু’টি সাংবিধানিক অংশ সংশোধন করা নিয়ে পুনরায় কাশ্মীরের উপর বিশ্ববাসীর নজর পড়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এহেন কাশ্মীর এমন একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড যেখানে তিন রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত রয়েছে এবং তিনটি পক্ষের পৃথক পৃথক দাবি রয়েছে। সামগ্রিকভাবে কাশ্মীর সমস্যাকে জানতে ও বুঝতে হলে অন্তত এক শতাব্দী পিছিয়ে যেতে হয়। আসলে সমস্যার শিকড় তার ইতিহাসেই সাধারণত লুকিয়ে থাকে, কাশ্মীরও তার ব্যতিক্রম নয়।
কাশ্মীর সম্পর্কে প্রথম নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় দ্বাদশ শতকে রচিত কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী স্থানীয় শাসকেরা স্বাধীনভাবে কাশ্মীর শাসন করত। কিন্তু মুঘল আমল থেকে কাশ্মীর বাকি ভারতের সাথে একীভূত হয়। যদিও কাশ্মীরীরা একে বিদেশি শাসন বলেই মনে করতেন। এই সময় থেকে একাদিক্রমে মোঘল, শিখ ও ডোগরাদের অধীনে কাশ্মীর শাসিত হতে থাকে। উনিশ শতকে সাক্ষরিত অমৃতসর চুক্তি (১৮৪৬)-র শর্ত হিসেবে কাশ্মীর ডোগরা শাসকদের অধীনে চলে যায়। বস্তুত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সহযোগী হিসেবে ডোগরা শাসকরা ব্রিটিশের ভারত ত্যাগ পর্যাপ্ত সময়কাল কাশ্মীরে নিরঙ্কুশ রাজত্ব করে। এই ডোগরা বংশের শাসনে জায়গিরদার, জমিদার সম্প্রদায়ের হাতে সমস্ত জমি কুক্ষিগত ছিল এবং মুসলমান প্রজাসকল ছিল সাধারণ ভূমিহীন মজুর, যাদের উপর করের বোঝা ছিল তীব্র। জি.এন কাউল লিখেছেন— গণিকাবৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, ব্যধি, নিরক্ষরতা ও বেকারত্ব কাশ্মীরকে গ্রাস করেছিল। অধিকাংশ কৃষকের জমিই মহাজনদের কাছে বন্ধক পড়েছিল। ডোগরা বংশের গুলাব সিংয়ের আমলে যে অত্যাচার উপত্যকাকে তটস্থ করে রাখত পরবর্তী শাসক হরি সিংয়ের আমলেও তার ছেদ হয়নি। কাশ্মীরের রাজশাসনের সাথে নিরীহ অশিক্ষিত ধর্মাশ্রিত প্রজাদের সম্পর্ক ছিল শুধুমাত্র খাজনা ও ঋণের। ধনবান হরি সিংয়ের বোম্বাইয়ের রেসের মাঠে জুয়া খেলে ও রাজ্যের বন্যপ্রাণ সমৃদ্ধ জঙ্গলে শিকার করে দিন চলে যাচ্ছিল। বলরাজ পুরী সহ একাধিক কাশ্মীর বিশেষজ্ঞদের মতো ডোগরা শাসনে সাধারণ কাশ্মীরি জনতা দরিদ্রতর হয়।
এই পরিস্থিতিতেই প্রজাদের মধ্যে থেকে উঠে আসে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক শিক্ষিত, উজ্জ্বল যুবা শেখ আবদুল্লা। অসাধারণ বাগ্মী, পেশায় শিক্ষক আবদুল্লা কাশ্মীদের বঞ্চনা, সমস্যা, কর্মহীনতা ও সরকারী ব্যবস্থায় সাধারণ কাশ্মীরি মুসলিম জনতার অনুপস্থিতির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আবদুল্লার নেতৃত্বে কাশ্মীরের স্থানে স্থানে প্রজাবিক্ষোভ সংগঠিত আন্দোলনের রূপ নেয়। ধীরে ধীরে আবদুল্লা কাশ্মীরে গণআন্দোলনে ও গণতান্ত্রিক অধিকারের মুখ হয়ে ওঠেন, রাজবংশের পক্ষে ক্রমেই আবদুল্লা বিপদজনক প্রতিপন্ন হতে থাকেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আস্থাশীল আবদুল্লা মানুষের দাবি সংগঠিতভাবে তুলে ধরতে ১৯৩২ সালে ‘All Jammu and Kashmir Muslim Conference’ নামক রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেন। আবদুল্লা প্রথম থেকে সংগঠনকে ধর্মীয় স্বার্থমুক্ত উপত্যকার হিন্দু-মুসলিম জনতার প্রতিনিধি রূপে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং সংগঠনে থাকা মৌলবাদী নেতৃত্বের বিরোধিতায় তাঁর উদ্যোগ সফল হয়নি। অতঃপর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি খারিজ করে ‘জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স’ রাখেন। নেহেরু ও কবি ইকবালের ভক্ত আবদুল্লা পরবর্তীকালে পাকিস্তানে যোগ দিতে অস্বীকার করার পিছনে এই উদার ধর্মীয় চেতনাকে কারণ মনে করা হয়।
কাশ্মীরকে ঔপনিবেশিক ও রাজতান্ত্রিক কুশাসন থেকে মুক্তি দিতে আবদুল্লা ১৯৪৪ সংগঠনের বার্ষিক সভায় ন্যায়-নীতি, সমানাধিকার ও রাজনৈতিক পরিবর্তন চেয়ে ‘নয়া কাশ্মীর’ নামক একটি ইস্তেহার প্রকাশ করেন এবং রাজবংশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন। জাতীয় কংগ্রেসের ধাঁচে ১৯৪৬ সালে তারা রাজবংশের উচ্ছেদের দাবিতে ‘Quit Kashmir’ বা কাশ্মীর ছাড়ো নামক আন্দোলন সূত্রপাত করেন। আন্দোলন ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে এবং প্রজাবিক্ষোভে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠলে রাজা হরি সিং কৃষকদের অবস্থা অনুধাবনে একটি কমিশন নিয়োগ করেন। আবদুল্লা তাঁর সংগঠনের সাহায্যে রাজশাসন উৎখাতের চেষ্টা করতে পারেন এই আশঙ্কায় হরি সিং রাজ্যে সামরিক আইন জারি করেন এবং ১৯৪৬-র ২০ই মে আবদুল্লাকে গ্রেফতার করে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। আবদুল্লার অনুপস্থিতিতে আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায়। ওদিকে ক্রিপস মিশন ভারতে আসলে এবং ভারতের স্বাধীনতা লাভ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। অতঃপর নেহেরু ও অরুণা আসফ আলি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এগোতে আবদুল্লাকে অনুরোধ করলে আবদুল্লা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। তবে জিন্না সাহেব কখনই আবদুল্লা ও তার সংগঠনের আন্দোলনকে ভালো চোখে দেখেননি। যার প্রধান কারণ ছিল আবদুল্লার নেহেরু ভক্তি এবং লিগের দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রতি সহানুভূতিশীলতা।
এই পরিস্থিতিতে মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭-র ২৩শে মার্চ ভাইসরয় হয়ে এসে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করে দেন। মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব অনুযায়ী হিন্দু গরিষ্ঠ প্রদেশগুলি নিয়ে ভারত ইউনিয়ন এবং মুসলিম গরিষ্ঠ প্রদেশগুলি নিয়ে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত প্রদেশগুলিকে নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী কোনো একটি ইউনিয়ন বা স্বাধীন থাকার অধিকার দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে কংগ্রেস দেশভাগ মানতে না চাইলেও লিগের হিংসাত্বক ভূমিকা এবং দেশজুড়ে ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাধ্য হয়ে দেশভাগ মেনে নেয়। এই অবস্থায় দুই রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে অবস্থিত হিন্দুরাজা শাসিত, মুসলিম গরিষ্ঠ প্রদেশ কাশ্মীর স্বতন্ত্র থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। আসলে হরি সিং কাশ্মীরকে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক চরিত্রের একটি রাষ্ট্র বা সহজভাবে বললে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বানাতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের তরফে জিন্না আর ভারতের তরফে প্যাটেল এবং মাউন্টব্যাটেনের একাধিকবার বোঝানোর চেষ্টা হলেও হরি সিং অনড় থাকেন এবং কাশ্মীর ছাড়াই দুই রাষ্ট্রের জন্ম হয়। রাজ্যের স্থায়ীত্ব ও অখণ্ডতার জন্য হরি সিং চেয়েছিলেন দুই রাষ্ট্রের সাথে একটা স্থিতাবস্থা চুক্তির প্রস্তাব দেন। পাকিস্তান এই চুক্তি সাক্ষর করলেও ভারত জল মাপতে আরেকটু অপেক্ষার নীতি নিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় মহারাজা হরি সিং, জম্মুর হিন্দু রাজনৈতিক সংগঠন সমূহ এবং মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি পৃথক জম্মু-কাশ্মীরের রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের সমর্থন জানায় এবং কাশ্মীরের জন্য আলাদা গণপরিষদ গঠনের দাবি তোলে। লক্ষনীয় এই সময় আবদুল্লা সহ ন্যাশনাল কনফারেন্সের সমস্ত শীর্ষ নেতৃত্ব মহারাজার জেলে সিডিশনের চার্জে বন্দী ছিল ফলে তাদের মতামত গুরুত্ব পায়নি। অনুমান করা হয়, স্বায়ত্বশাসনের অধিকার নিয়ে ভারতপন্থী আবদুল্লা ভারত ইউনিয়নের যোগদান করার পক্ষপাতী ছিলেন। ঐ বছরই আবদুল্লা মুক্তি পেয়ে স্বাধীন কাশ্মীরের পক্ষে মতপ্রকাশ করেন, পাকিস্তান দু’বার আবদুল্লাকে পাকিস্তানে যোগদানের বিষয়ে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষুদ্ধ হয়।
এদিকে ১৯৪৭-র সেপ্টেম্বর মাস থেকেই কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। বিভিন্ন গোয়েন্দা ও স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া রিপোর্ট থেকে কাশ্মীরে উপজাতি বিদ্রোহ বা পাকিস্তানের সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের সম্ভাবনা জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেলকে নেহেরুর দীর্ঘ চিঠি লেখে। পরিস্থিতি সামলাতে নেহেরুর উদ্যোগে আবদুল্লা মুক্তি পায়। তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে হজরতবাল মসজিদ চত্বরে এক বিশাল জনসভা আয়োজন করে কাশ্মীরের ভবিষ্যত নির্ধারণের অধিকার কাশ্মীরীদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানান। রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে মহারাজা সিং প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র কাককে বরখাস্ত করে কাশ্মীর রাজ প্যাটেল ঘনিষ্ঠ মেহের চাঁদকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ কর। নেহেরু ও প্যাটেল ঘনিষ্ঠ ভারত সরকারের প্রাক্তন আধিকারিক মেহেরচাঁদের নিয়োগে পাকিস্তান প্রমাদ গোনে। এক্ষণে কাশ্মীর ভারতে যোগদান করতে পারে আশঙ্কায় পাকিস্তান স্থানীয় উপজাতিদের মহারাজার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে আক্রমণ করে বসে। সামনে উপজাতি বিদ্রোহ বলা হলেও আদতে এই বাহিনীতে সাদা পোশাকের পাক সৈন্যরাই মুখ্য ভূমিকায় ছিল। ১৯৪৭র ২২শে অক্টোবর পাকসেনা পরিচালিত উপজাতি বাহিনী উত্তর পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে। প্রায় বিনা বাঁধায় উপজাতিদের সাহায্যে ঝিলম নদীর তীরে মুজফফরাবাদ দখল করে নেওয়া হয়, অনতিবিলম্বে তারা শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর হয়। বিপদ বুঝে রাজ সেনার প্রধান ব্রিগেডিয়ার রাজিন্দর সিং উরি শহরে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। অনতিবিলম্বেই উরির পতন হয়, পাক হানাদার বাহিনীর সংগঠিত আক্রমণে খুব সহজেই তারা শ্রীনগরের নিকটে উপস্থিত হয় এবং মহারাজের গদিচ্যুত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় হরি সিং ২৪শে অক্টোবর ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করলে দেশের প্রতিরক্ষা কমিটি জরুরি বৈঠকে আহূত হয়। ক্মিতির সভায় সিদ্ধান্ত হয় ভি পি মেনন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে কাশ্মীর যাবেন। কিন্তু গর্ভনর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন হরি সিংকে জানান কাশ্মীরে ভারতের হস্তক্ষেপ করার জন্য ‘ভারতভুক্তির দলিল’-এ সই করা জরুরি, অন্যথায় আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করা হবে। নিরন্যপায় মহারাজ ২৬শে অক্টোবর ১৯৪৭ ভারতভুক্তির দলিল সাক্ষর করলে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতীয় রাজ্যসঙ্ঘের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ভারতের সামরিক কার্যকলাপের রাস্তা পরিষ্কার হয়। পরদিন ২৭শে অক্টোবর প্রচুর সামরিক ও অসামরিক সম্ভার নিয়ে ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছয়। সত্ত্বর ভারতীয় বাহিনী পাক হানাদের বিতাড়িত করে এবং কাশ্মীরের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েমের দিকে অগ্রসর হয়। যুদ্ধে ভারতের জয় এবং সম্পূর্ণ কাশ্মীর মুক্ত করার আগেই কোনো এক অজ্ঞাত কারণবশত ১৯৪৮ সালের ১লা জানুয়ারি নেহেরু কাশ্মীর সংক্রান্ত বিবাদটি রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে উত্থাপন করেন। বিশ্বশান্তির রক্ষার স্বার্থে পরিষদ বিবাদমান দুইপক্ষকেই যুদ্ধ বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট স্থানে স্থিতাবস্থা রক্ষার নির্দেশ দেয়। বিভিন্ন মহল থেকে অনুমান করা হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির রীতিনীতি ও আইনকানুনের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধাশীল নেহেরু নবগঠিত ভারত রাষ্ট্রকে আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি বলেই হয়তো বিষয়টিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হন আবার একই সঙ্গে এও মনে করা হয় নেহেরু কাশ্মীরের আইনসম্মত উপায়ে ভারতভুক্তিতে নিশ্চিত ছিলেন বলেই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কারণ যাই হোক ইতিহাস প্রমাণ করেছে নেহেরুর এই পদক্ষেপ একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল যার পরিণাম সমগ্র উপমহাদেশ আজও ভুগছে।

বিপদ বুঝে রাজ সেনার প্রধান ব্রিগেডিয়ার রাজিন্দর সিং উরি শহরে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। অনতিবিলম্বেই উরির পতন হয়, পাক হানাদার বাহিনীর সংগঠিত আক্রমণে খুব সহজেই তারা শ্রীনগরের নিকটে উপস্থিত হয় এবং মহারাজের গদিচ্যুত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় হরি সিং ২৪শে অক্টোবর ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করলে দেশের প্রতিরক্ষা কমিটি জরুরি বৈঠকে আহূত হয়।

পরিণাম যাই হোক ইতিহাস খুঁড়লে দেখা যায় পরিষদ কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গণভোটের নিদান দিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যে পরিষদ দুই রাষ্ট্রকেই বিবাদ পরিহার করে কাশ্মীরের ভবিষ্যতে নির্ধারণে উদ্যোগী হতে আহ্বান করে। এ’জন্য পাকিস্তানকে কাশ্মীর থেকে পাক নাগরিক ও অন্যান্য স্থাপনাসমূহ প্রত্যাহার করা এবং ভারতকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেয়। দুই রাষ্ট্রই একে-অপরকে সন্দেহের চোখে দেখত ফলে বাহিনী প্রত্যাহারে রাজি হয়নি। অপরদিকে পাকিস্তান জাতিপুঞ্জের গণভোটের পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না ফলে অসম্মত হয়। তথাপি বিশেষ কিছু পরিবর্তনের পর এই সংক্রান্ত সহমতি তৈরি হলেও গণভোটের বিষয়ে কোনো রাষ্ট্রই আগ্রহ দেখায়নি। পাকিস্তানের কাছে ভয় ছিল আবদুল্লার ভারতপন্থী ভাবমূর্তি এবং জম্মুর হিন্দু জনতা। অঙ্কের হিসেবে কাশ্মীরের পাকিস্তানভুক্তি তাই প্রায় অসম্ভব ছিল। অন্যদিকে ভারত ইতিমধ্যেই ‘Instrument of Accession’ সই করা কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে তাই এই অপ্রয়োজনীয় গণভোট তার কাছে রাজনৈতিক হারাকিরি। এছাড়াও গণভোট জাতীয় উদ্যোগের মাধ্যমে কাশ্মীরের স্বতন্ত্র হওয়ার চেষ্টা আবারও সামনে আসুক ভারত কখনই চায়নি তাই ১৯৫৭ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ নিযুক্ত কমিশন আটবার গণভোটের প্রস্তাব পাশ করলেও একবারও তা বাস্তবায়নের পথে এগোয়নি। অন্যদিকে পরিষদের যুদ্ধ বিরতির আহ্বানের পর থেকে দখলকৃত অংশ পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত হতে শুরু করে, এপারে আবদুল্লার নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়ে ভারত নিয়ন্ত্রিত শাসন চালু হয়। বস্তুত পৃথক পৃথকভাবে নেহেরু ও জিন্না দু’জনেই মেনে নিয়েছিলেন এই মুহূর্তে অবাধ ও প্রভাবমুক্ত গণভোট হওয়া কখনই সম্ভব নয় তাই প্রাপ্য অংশ হাতছাড়া হওয়া আটকাতে কেউই গণভোটের পথ মাড়াননি। তৃতীয় আরেকটি পক্ষ ছিল আবদুল্লার নেতৃত্বাধীন সচেতন কাশ্মীরী জনতা। সিদ্ধার্থ গুহরায় দেখিয়েছেন, ১৯৫০-র দশকের গোড়ার দিকে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত শেখ আবদুল্লার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তিনি মার্কিন সরকারকে পাঠানো প্রতিবেদনে লিখেছিলেন— শেখ আবদুল্লার প্রাথমিক লক্ষ ছিল স্বাধীন কাশ্মীর। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বুঝতে পেরেই তিনি উদার ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভারতবর্ষে কাশ্মীরকে রাখতে চেয়েছিলেন।
নেহেরুর উদ্যোগে কাশ্মীর প্রশ্ন নিরাপত্তা পরিষদে পৌঁছনোর পর কার্যত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পূর্ণ কাশ্মীরের প্রশ্নকে জিইয়ে রেখে দু’পক্ষই কাশ্মীরে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা প্রণয়নে জোর দেয়। নেহেরুকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেহেরচাঁদের মেয়াদ শেষ হলে হরি সিং কাশ্মীরী জনতার প্রকৃত প্রতিনিধি শেখ আবদুল্লাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে আবদুল্লা কাশ্মীরী জনতার সমস্যা সমাধানে প্রথমেই ভূমিসংস্কার শুরু করেন, এতে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। প্রশাসনিক সংস্কার, রাজতন্ত্রের সমর্থক অভিজাতদের ক্ষমতা ও সম্পত্তি খর্ব করা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্কারকে কেন্দ্র করে আবদুল্লার সাথে হরি সিংয়ের বিবাদ চরমে ওঠে। এই অবস্থায় ভারত সরকারের পরোক্ষ মধ্যস্থতায় হরি সিং ইস্তফা দিলে তাঁর আষ্টাদশ বর্ষীয় পুত্র করণ সিং পরবর্তী রাজা হন। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় আইনসভা (তৎকালীন গণপরিষদ) সংবিধানে ৩০৬ক ধারা যুক্ত করে জম্মু-কাশ্মীরের জন্য আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্বশাসনের অধিকার মেনে নেয়। ১০০ সদস্য বিশিষ্ট জম্মু-কাশ্মীর আইনসভা গঠনের সিদ্ধান্ত হয় (২৫টি পাক অধিকৃত কাশ্মীরে পড়বে)। ‘ভারতভুক্তির দলিল’-এ সই করার পূর্ব মুহূর্তে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ ব্যতীত বাকি বিষয় সংশ্লিষ্ট রাজ্যের আইনসভার হাতে অর্পণ করা হয়। কাশ্মীরের জন্য বিশেষাধিকার ও স্বায়ত্বশাসন মেনে নেওয়া হয়। অতঃপর ১৯৫০ সালে নতুন সংবিধান প্রবর্তিত হলে উল্লিখিত ৩০৬(ক) ধারাটি ৩৭০ ধারা হিসেবে ভারতের সংবিধানে অঙ্গীভূত হয়।
৩৭০ ধারা এবং কাশ্মীরের বিশেষাধিকার— ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি যখন ভারত ইউনিয়নের সংবিধান চালু হয় সেখানে ৩৭০ ধারায় জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের পৃথক মর্যাদা স্বীকার করা হয়। এরই সাথে:
১। অর্থ, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ভারতরাষ্ট্রের এক্তিয়ার ভুক্ত হয়;
২। জম্মু-কাশ্মীরের জন্য পৃথক দ্বিকক্ষ আইনসভা, পতাকা ও রাজনৈতিক সত্ত্বা স্বীকার করা হয়;
৩। জম্মু-কাশ্মীরের পৃথক সাংবিধান, নাগরিক স্বত্বা স্বীকৃত হয়;
এছাড়া
৪। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেয় রায়গুলি সেখানে প্রযুক্ত হবে না;
৫। ভারতীয় সংসদে পাশ হওয়া আইনসমূহ এখানে সরাসরি কার্যকর নয়, পৃথকভাবে জম্মু-কাশ্মীর আইনসভায় পাশ করাতে হবে;
৬। সংসদ রাজ্যতালিকাভুক্ত বিষয়ে যে-আইনসমূহ তৈরি করে তা জম্মু-কাশ্মীরের জন্য বিরত থাকবে;
৭। জম্মু-কাশ্মীর রাজের প্রশাসনিক পদটি ‘সদর-ই-রিয়াসত’ নাম হবে। পরে অবশ্য এটিকেও রাজ্যপাল পদে পরিবর্তন করা হয়;
৮। এরই সাথে রাজ্যের বাসিন্দাদের স্বার্থ রক্ষা করে পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতির এক বিশেষ নির্দেশে সংবিধানে ৩৫ক নামক একটি ধারা যোগ হয়। এই ধারায় অ-কাশ্মীরিদের রাজ্যের বাসিন্দা হওয়া, বিবাহ করা ও চাকুরির নেওয়ার উপর পাবন্ধি বা বিধিনিষেধ লাগানো হয়।
পরবর্তীকালে এই ৩৫-র ক ধারাটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় গৃহীত বেশ কিছু অধিকারের সরসারি বিরোধীতামূলক এই ধারাটি ভারতীয় সংবিধানের অশেষ বিতর্ক উদ্রেককারী একটি অংশ। এই ৩৫(ক) ধারাটিকে যদি আমরা এক নজরে দেখি, তবে দেখব সেখানে বলা হয়েছে—
১। ১৯৫৪ সালের ১৪ই মে’র আগে যারা জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দা ছিল কেবল তারাই নাগরিক গণ্য হবেন;
২। উল্লিখিত তারিখের অন্তত দশ বছর আগে থেকে যারা জম্মু ও কাশ্মীরে বসবাস করছে যারা নাগরিকত্ব পাবেন;
৩। উল্লিখিত তারিখের আগে যারা আইনানুসারে রাজ্যে সম্পত্তি খরিদ করেছেন তারা নাগরিক হওয়ার সুযোগ পাবেন;
৪। ১/৩/১৯৪৭-র পর যারা জম্মু ও কাশ্মীরের ভূখণ্ড থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন এবং পুনরায় বসতির অনুমোদন পেয়েছেন তারা নাগরিক গণ্য হবেন;
৫। ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে কোনো ব্যক্তি কাশ্মীরে স্থাবর সম্পত্তি খরিদ করতে পারবেন না এবং স্থায়ী বসতির অধিকার পাবেন না;
৬। জম্মু ও কাশ্মীরের কোনো মহিলা রাজ্যের বাইরের কোনো নাগরিককে বিবাহ করলে তিনি সম্পত্তির অধিকার ও নাগরিকত্ব হারাবেন। কিন্তু কোনো পুরুষ রাজ্যের বহিঃস্থ কোনো নারীকে বিবাহ করলে এরকম বৈষম্যের শিকার হবেন না। অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক এই আইনটির বিরুদ্ধে মামলা হলে জম্মু হাইকোর্ট আইনটি সামান্য পরিবর্তন করে বাইরে বিবাহিত মহিলার জীবনকালে আদালত তাঁর সম্পত্তির অধিকার ও নাগরিকত্ব স্বীকার করে নেয়। কিন্তু এই অধিকার তার সন্তানদের প্রসারিত করা যাবে না (২০০২)।

বিভিন্ন মহল থেকে অনুমান করা হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির রীতিনীতি ও আইনকানুনের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধাশীল নেহেরু নবগঠিত ভারত রাষ্ট্রকে আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি বলেই হয়তো বিষয়টিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হন আবার একই সঙ্গে এও মনে করা হয় নেহেরু কাশ্মীরের আইনসম্মত উপায়ে ভারতভুক্তিতে নিশ্চিত ছিলেন বলেই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

—অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক উপায়ে গৃহীত এবং সংবিধানের অঙ্গীভূত ৩৫(ক) কাশ্মীরকে ভারত রাষ্ট্রের মধ্যেই একটি পৃথক রাষ্ট্রের তূল্য মর্যাদা দিয়েছিল। লক্ষ্য করার বিষয় সংশ্লিষ্ট ধারা দুটি ভারতের সংবিধান কাঠামোর মধ্যেই বিশেষ অধিকার দিলেও জম্মু কাশ্মীরের রাজনৈতিক সংকট বোধহয় সমাধান করতে পারেনি বরং উলটোটাই হয়েছে। মূল ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে বিছিন্নতার সুযোগে সেখানে মৌলবাদী ও উগ্রপন্থী কার্যকলাপ নিবিড়ভাবে গড়ে উঠতে পেরেছিল। পরিস্থিতির দখল পেতে রাষ্ট্র দমননীতি প্রয়োগ করায় জনমত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। এছাড়াও স্থানীয় কাশ্মীরী নেতৃত্বের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ আর ভারত সরকারের পেয়াদামুখী রাজনৈতিক শাসনে কাশ্মীর আম জনতার সঙ্গে রাষ্ট্রের যোগাযোগ আরও শীথিল হয়েছে। নয়ের দশক থেকে কাশ্মীরে ভারতবিরোধী কার্যকলাপ ও স্বাধীনতার দাবি বাড়তে থাকে। নতুন শাসকদের কেউই আবদুল্লার মতো জনপ্রিয় ও ক্যারিশ্মাটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন না। ফলে পাকিস্থানের মদতে ভারতবিরোধী কার্যকলাপ সহজেই উপত্যকাকে অশান্ত করে তুলতে শুরু করে।

১৯৪৭-র সীমান্ত সংঘর্ষের পর ৬৫ ও ৭১-এর যুদ্ধ এবং ১৯৯৮-এর অঘোষিত সীমান্ত সংঘর্ষ কাশ্মীর সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। ৭১-এর যুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ মদতে পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদ পাকিস্তানকে মরিয়া ও জিঘাংসু করে তোলে। এর সরাসরি ফল উপত্যকার মানুষকে চোকাতে হয়। দুই রাষ্ট্রের পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, তিক্ততা ও রেষারেষির বিষফল কাশ্মীর উপত্যকায় অসংখ্য জেহাদি চারাগাছের জন্ম দেয়। উপত্যকা জুড়ে স্বাধীনতার নামে জঙ্গিবাদের চাষ শুরু হয়। পাকিস্তান ও আরব অঞ্চলের ধনীদের আর্থিক সাহায্যে কাশ্মীরে বিছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ নয়ের দশক থেকেই তীব্র আকার নেয়। সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ক ধারার মাধ্যমে যে-অতিরিক্ত অধিকার কাশ্মীরকে দেওয়া হয় তা ভারতবিরোধী রাজনৈতিক বীজের বিকাশে ব্যায়িত হতে শুরু করে। পাঁচের দশকে জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি যে ‘একদেশ, একবিধান, একনিশান’-এর স্লোগান তুলে দেশ প্রতিবাদের ঢেউ তুলে ছিলেন তাঁর প্রতি দেশজুড়ে সমর্থন বাড়তে থাকে। এই সময় থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কংগ্রেসের দখল কমতে থাকে, মণ্ডলায়ন ও জনসংঘের নবতম রূপ বিজেপির চমকপ্রদ উত্থানে পরিস্থিতি বদলে যায়। কাশ্মীরের বিশেষাধিকার রদ একটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দাবিকে পরিণত হয় যার প্রতি দেশ জুড়ে সমর্থন বাড়তে থাকে। বস্তুত নেহেরুর আপোষকামী চরিত্র, আবদুল্লার স্বাধীনতাকামী ভারতপন্থী বাস্তবমুখী মনোভাব ইত্যাদির পরিণতি ছিল সংবিধানে দেশের একমাত্র মুসলিম গরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীরের বিশেষাধিকার ও ভারত ইউনিয়নে সংযোজন। বিজেপি ও জাতীয়তাবাদীদের সক্রিয় প্রচারে তা কার্যত জাতীয় অস্মিতা, ভারতীয়ত্ব, সংবিধানের সর্বোচ্চতা ও ভারতের অখণ্ডতার প্রশ্ন হয়ে উঠে। এছাড়াও এই দু’টি ধারার ব্যবহারিক প্রয়োগ মোটেই সফল হয়নি। কাশ্মীরে দেশের সমস্ত আইন কার্যকর হতো না, পার্লামেন্টের নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর হতো না, সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ারও সীমিত ছিল… সবচেয়ে সমস্যাজনক ছিল বিনিয়োগ ও উন্নয়ন। বাইরের কারো প্রবেশ, স্থায়ী বসবাস ও জমির মালিক হওয়ার প্রতিবন্ধকতার জন্য কেউ কাশ্মীরে বিনিয়োগ ও চাকরি করতে রাজি হতো না। এমনকী কাশ্মীরে নবনির্মিত আইআইটি-তে যোগ্য শিক্ষকের অভাব দেখা যায়। কারণ, বাছাই হওয়া শিক্ষকরা অনেকেই বাসস্থান ক্রয় বা সন্তানদের স্কুলে ভর্তি হওয়ায় বাধা— ইত্যাদি অসুবিধার জন্য চাকুরিতে যোগদান করেনি। দেশের অন্যান্য অংশের সাথে কাশ্মীর কে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সামিল করার ক্ষেত্রে এই বিশেষাধিকার কার্যত একটি  দেওয়ালের মতো আচরণ করতে থাকে।
অতিজাতীয়তাবাদী বিজেপি ১৯৯৮-তেই সরকার দখল করতে সফল হলেও তারা কখনই কাশ্মীরের পরিস্থিতিতে বলপ্রয়োগের পথে হাঁটেনি। বরং উদার মনোভাবাপন্ন অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে ‘বাতচিত ইনসানিয়াৎ কে দায়রে মে হোগি’-র মতো দার্শনিক মন্তব্য কাশ্মীরিদের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু এও সত্য পাকিস্তানের সাথে সমঝোতাকামী বাজপেয়ীর একাধিক উদ্যোগ পাকিস্তান সরকার ও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির উদ্যোগে ব্যর্থ হয়ে যায়। পরবর্তী মনমোহন সিং জমানায় পরিস্থিতি মোটের উপর টালমাটাল থাকলেও সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয় জারি থাকে। পরিস্থিতির সঠিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব বিজেপি পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর। সরকারে থাকা বিজেপি  উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশটি বলপ্রয়োগ করে কাশ্মীর শান্ত করার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হয়। ২০০১-এর সংসদ হামলায় সাজাপ্রাপ্ত আফজল গুরুর ফাঁসি কার্যকর হলে এবং ঘটনা পরম্পরায় পাক মদতপুষ্ট স্থানীয় সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল মুজাহিদিন কম্যান্ডার বুরহান ওয়ানি ভারতীয় সেনা বাহিনীর অপারেশনে সংঘর্ষে মারা পড়তেই উপত্যকায় বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। উল্লেখ করার বিষয় এই পর্বেই বিজেপি অদ্ভুত রাজনৈতিক সমীকরণ সাজিয়ে কাশ্মীরের স্বাতন্ত্র্যের সমর্থক পিডিপির সাথে জোট সরকার তৈরি করে। ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এই দুই বিপরীত আদর্শনিক্ত রাজনৈতিক পক্ষের সহবাস এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি ছিল। তবে যে লক্ষ্যে বিজেপি সরকারে যোগদান করেছিল তা সফল হয়নি। বস্তুত উপত্যকায় রাজনৈতিক ও সামরিক উপায়ে বিবাদ নিরসনের চেষ্টার ব্যর্থতা বিজেপিকে প্রচণ্ড হতাশ করে। অবশেষে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা জারি করে রাষ্ট্রপতি শাসন বলবৎ করা হয়।

কাশ্মীরে দেশের সমস্ত আইন কার্যকর হতো না, পার্লামেন্টের নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর হতো না, সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ারও সীমিত ছিল… সবচেয়ে সমস্যাজনক ছিল বিনিয়োগ ও উন্নয়ন। বাইরের কারো প্রবেশ, স্থায়ী বসবাস ও জমির মালিক হওয়ার প্রতিবন্ধকতার জন্য কেউ কাশ্মীরে বিনিয়োগ ও চাকরি করতে রাজি হতো না।

২০১৯-এর ২৩শে মে বিপুল রাজনৈতিক সমর্থন ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী পুনরায় সরকারে ফিরেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও বিছিন্নতাবাদী সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। এই উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিশেষ আস্থাভাজন অমিত শাহ্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করে। বস্তুত কাশ্মীর নিয়ে তিক্ত-রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা, রাজ্যে সরকার চালানোর ব্যর্থতা এবং বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা এবং সংঘের রাজনৈতিক চাপে থাকা মোদি সরকার অবশেষে বহু প্রতিশ্রুত ৩৭০ ধারা নিয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে পা বাড়ায়। আসলে কাশ্মীর সমস্যা ক্রমশ ডেড এন্ডে চলে যাচ্ছিল এবং ৩৭০ ধারা ও ৩৫ক’র রক্ষাকবচ নিয়ে কাশ্মীর ক্রমশ দেশের বাকি অংশের চেয়ে বিছিন্ন, অনুন্নত একটি প্রান্তে পরিণত হচ্ছিল যার নেতিবাচক পরিণতিগুলো তির হয়ে ঘুরে ভারতকেই বিদ্ধ করছিল। এই অবস্থায় অত্যন্ত সন্তর্পণে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কাশ্মীরে সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। অমিত শাহ্ কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুবিধা নিয়ে বৃহত্তর পরিবর্তনের ছক কষতে থাকেন। এই উদ্দেশ্য জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকেই কাশ্মীরে সেনা মোতায়েন শুরু হয়, আগস্টের শুরু থেকে কাশ্মীরে স্থানীয় প্রশাসন সরাসরি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। প্রাক্তন বিজেপি নেতা সত্যপাল সিংহ রাজ্যপাল হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে রাজ্য পুলিশকে কার্যত ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করে আধা সামরিক বাহিনীর হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেন। অতঃপর ৪ঠা আগষ্ট কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলির প্রতিনিধিদের সরকার গৃহবন্দী করে নেয় এবং ৫ই আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শ মতো রাষ্ট্রপতি এক নির্দেশ জারি করে সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫-র ‘ক’ ধারায় লিখিত জম্মু-কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন সংক্রান্ত এক্তিয়ারগুলি বাতিল ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ সংসদে এই ঘোষণাটি পড়ে শোনান এবং একই সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে বিভক্ত করে দুটো কেন্দ্র শাসিত রাজ্য সৃষ্টির প্রস্তাব পেশ করেন। সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্বতন জম্মু কাশ্মীর রাজ্যটি একটি কেন্দ্র শাসিত রাজ্য হবে যার বিধানসভা থাকবে এবং নিজস্ব সরকার থাকবে, এ’ক্ষেত্রে দিল্লির মডেল অনুসরণ করা হবে। অপরপক্ষে জম্মু কাশ্মীরের লাদাখ অংশটি বিছিন্ন করে ‘লাদাখ’ নামক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল সৃষ্টি করা হবে যেখানে কোনো বিধানসভা বা সরকার থাকবে না, কেন্দ্র সরকার প্রেরিত একজন লেফটেন্যান্ট গর্ভনর অঞ্চলটি শাসন করবেন; এক্ষেত্রে চন্ডীগড় মডেলটি অনুসরণ করা হবে। অতঃপর সংসদের উভয় কক্ষে বিলটি পাশ হওয়ার পর, রাষ্ট্রপতি ‘জম্মু কাশ্মীর পুর্নগঠন’ বিলে সাক্ষর করলে এই প্রস্তাব আইনে পরিণত হয়। ভারতের একীকরণের ক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে স্মরণ করে তাঁর অর্বিভাব তিথি ৩১শে অক্টোবর এই রাজ্য পুর্নগঠনের দিন স্থির হয়।
পরিশেষে বলা যায় স্বাধীনতার সময় থেকে আজ এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ভবিষ্যতে টালমাটাল থেকেছে। তিনটি সার্বভৌম, পরমাণু শক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্র এই অঞ্চলটি শাসন করে। কার শাসন বৈধ বা অবৈধ এই নিয়ে আমার বক্তব্যের ভিত্তিতে বিস্তৃত বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু তাতে স্থানীয় মানুষের মৌল সমস্যাটি সমাধান হয় না। এযাবৎকাল কখনও জম্মু ও কাশ্মীরের জনতার মতামত নিয়ে তার ভবিষ্যতে নির্ধারণ করা হয়নি। আদতে জম্মু ও কাশ্মীরের এই দুর্ভাগ্যের পিছনে তার অপার সৌন্দর্য ও ভৌগলিক অবস্থান দায়ী। দক্ষিণ এশিয়ার অত্যন্ত কৌশলগত স্থানে কাশ্মীরের অবস্থান। যে-স্থানটি হাত ছাড়া হওয়ার অর্থ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ে অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যাওয়া। তাই যথার্থ দাবিদার না হওয়া সত্ত্বেও চীনও কাশ্মীরের এক দখলদার সেজে বসে আছে। এই মুহূর্তে চীনের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ ও পাকিস্তানের বিকাশ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত প্রকল্প ‘সিপেক’ কাশ্মীরের গিলগিট-বাল্টিস্থান অঞ্চল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে কাশ্মীরের একীকারণ ও এবং ভারতীয়করণের পথে চীনের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ বিরাট বাধাসূচক। তাই ভারতীয় জনতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চাইলেও অখণ্ড কাশ্মীর কখনই তাদের অধীনে আসবে না। আবার উলটোদিকে স্বাধীন কাশ্মীরের প্রশ্ন প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার মুখে। নবকৃত প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে জম্মু-কাশ্মীর একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ভারতের মধ্যে ক্রমশ সমাহিত হবে এবং অনতিবিলম্বে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির মতো ছাইচাপা আগুন বুকে নিয়ে একদিন শান্ত হয়ে যাবে। তবে বিগত ৪৫ দিন যাবৎ অবরুদ্ধ কাশ্মীর কী বলতে চায় তা কারো আর শোনা হল না।

বস্তুত গণতন্ত্র কখন যে নিজেই নিজের শত্রু হয়ে উঠে তা বোধহয় সে নিজেও জানে না।

Facebook Comments

পছন্দের বই