লেখক নয় , লেখাই মূলধন

নির্মাল্য চট্ট্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

অবচেতনের জাদুকর

আমাদের জীবনে, যাপনের যে আপাত-রঙিন বহিরঙ্গ, তার ভেতরে ভেতরে কি কাজ করে চলে না কোনো গভীর, ধূসর বৈপরীত্য? আমার সত্তাকে নিয়ত শাসন করে চলা ‘আমি’-কে যে মাঝে মাঝেই অ-চলতি পথে বেরিয়ে পড়তে উসকানি দেয়? আর অন্তর্গত এই দ্বন্দ্বে উৎপন্ন বোধ বা বোধের আভাসগুলিকে আমরা, নিজেরা কতটা অনুভব করতে পারি? নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, আমাদের ধ্যানের বাইরে কাজ করে চলা এই বোধগুলি কিন্তু মারাত্মকভাবে ক্রিয়াশীল— যদিও কোনো মনোযোগই সে পায় না, বা দাবিও করে না।

কথাগুলি মনে এল নবীন লেখক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু সাহিত্যকাজ হাতে পেয়ে। লেখালেখির দুনিয়াদারি করতে যে-কবজির জোর দরকার, সেটা তাঁর সহজাত— তাঁর জনপ্রিয়তা তার প্রমাণ। কিন্তু ‘জীবন’ নামক যে-চলমান প্রক্রিয়ায় নিয়ত-বদলে-যাওয়া রংগুলিকে নিয়ে রাঙানো হয় সাহিত্যকে, তমাল সেই জীবনের চামড়ার তলা দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই নিঃশব্দ বোধমালার হদিশ পেয়েছেন। তাঁর লেখনিকে চুবিয়ে নিয়েছেন সেই বোধের রসে। তাই তমালের সাহিত্যের অন্তর্গত চেতনাতে ছাপ ফেলতে ফেলতে যায় মানবজীবনের অনন্ত বিরোধাভাস।

সাহিত্য বা লেখক— কাউকেই কোনো নির্দিষ্ট খোপের মধ্যে ভরে ফেলে শ্রেণিকরণ করাটা মোটেই কাজের কথা নয়। কারণ, প্রতিটি সাহিত্যকর্মই একটি বহমান জীবনের কথা বলে, যার অন্তর্লীন ধারা সমস্ত ভেদরেখাগুলোকে কখন যেন মুছে দিয়ে একাকার হয়ে যায়, পাঠকের হাত ধরে তা যেন টেনে নিয়ে আসে মোহনার দিকে, যেখানে পৌঁছে, ফিরে তাকালে, সামনে অনন্ত, অপার ‘জীবন’-কে প্রত্যক্ষ করা ছাড়া, চেতনায় আর কিছু সাড়া ফেলে না।

এই জীবনবৈচিত্রের পাশাপাশি, তমালের লেখার ধরতাইটা হয় না, তাঁর লেখায় ক্রিয়াশীল ‘অবচেতনার’ সুরটাকে ধরতে না পারলে। প্রতিমুহূর্তে মানুষের এই অবচেতনকে নিয়ে খেলা করতে করতে, তমাল যখন ‘সমে’ এসে দাঁড়ান— প্রচণ্ড, কিন্তু নিঃশব্দ অভিঘাতে নাড়িয়ে দেন আমাদের অস্তিত্বকে। শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে আসা হিমেল স্রোতের মতো বোধ আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয় নিজের সামনে। তখন আর নিজের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারি না আমি!

অস্তিত্বের গহন, গভীরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সেই ‘উইশ’, যাকে যথেষ্ট সহজেই ‘অব’ উপসর্গটি লাগিয়ে দিয়ে লোকসমাজের নজর থেকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিই বটে, কিন্তু গোপনে নিভৃতে অভিসারে চলি তার কাছে। নিজের পুঁজ-রক্ত মাখা ক্ষতস্থানকে নির্জন একাকিত্বে যে-নিখাদ আদর আমরা মাখাই— তা বোধকরি একদম ‘সোস্যাল’ নয় বলেই এবং একান্ত নিজস্ব বলেই লোকসমক্ষে আনি না। কিন্তু ক্ষতস্থান আর তার অধিকারীর এই নিঃশব্দ রসায়নটা কিন্তু কাজ করে চলে সর্বদা, সর্বত্র। আর এখান থেকেই নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ হয় আমাদের চেতনার। সেই চেতনা— যা গভীর কুয়াশাচ্ছন্নতায় নিজেকে মাঝে মাঝেই মুড়ে ফেলে— কিন্তু তার অস্পষ্ট অবয়ব হাতছানি দিয়ে যায়। মোড়কটাকে আমরা রেখেই দিতে চাই, যাতে সামাজিক অভিনয় আর আপোষগুলো সুষ্ঠু হয়। কাম্যুর ‘আউটসাইডার’-এর নায়ক কিন্তু পেরেছিল। মায়ের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে ভারহীন, মুক্ত মনে করেছিল। সর্বজয়ার মৃত্যুতে বিভুতিভূষণও অপুর মনে একটি তারে হাত ছুঁইয়ে গেছেন, প্রবল শূন্যতায় আক্রান্ত হওয়ার আগে অপু মুক্তির ভাবনায় দুলে উঠেছিল। সেই ভাবনা বহুমাত্রিক, কিন্তু বৃত্তের বাইরের এই ভাবনা অস্বীকার্য নয়— কোনোভাবেই।

তমালের নবতম উপন্যাস ‘ঘাতক’ পড়তে পড়তেই এই ভাবনাগুলোয় জারিত হলাম। অবচেতন মানুষকে নিয়ে কী অবলীলায় কী নির্মম খেলা খেলে চলে, এ তার জবানি। এক বৃদ্ধের বয়ানে মানবচরিত্রের আলো-আঁধারি, চোরা প্রকোষ্ঠ। নৈর্ব্যক্তিকতাকে যদি মাপকাঠি ধরি, যদিও জটিল মানবমনের প্রেক্ষিতে তা অসম্ভব, কোনো মানবিক বয়ানই নিরপেক্ষ নয়, কারণ, মানুষের চিন্তা ও আচরণের সাফাই তার নিজের কাছেই থাকে, নতুবা সে খুঁজে নেয়। এই উপন্যাসে যেটা আনকোরা নতুন, সেটা হল চরিত্রের নিজের কাছে স্খলনগুলোর প্রতিভাত হওয়া। আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে সে যেন নির্মোহ দৃষ্টিতে নিজেকে দেখেছে। মরমে মরে গেছে, কিন্তু পরমুহূর্তেই বশ হয়েছে সেই অনাদিঅনন্ত অবচেতনার। অত্যন্ত ডিটেলিঙে তমাল এই কাজটা করেছেন। এখানে একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করা দরকার। প্রথম পুরুষে লিখিত উপন্যাসে, স্বনির্মাণকে দূর থেকে দেখলে একটা মোহহীনতা অর্জন করা যায়। অনেকেই বলেন, উত্তম পুরুষে, আত্মবচনে নির্মোহ আঁকা হয়ে ওঠে না কিছুতেই। এখানে তমাল চলতি ধারণাটাকে ভেঙেছেন। তিনি একটা ব্যূহের মধ্যে ঢুকেছেন, তারপর পদে পদে ব্যূহের স্তরগুলোকে চিহ্নিত করেছেন, প্রতিটা ধাপ পাঠকের সামনে মেলে ধরেছেন, তাঁর উপন্যাসের নায়ককে যুঝতে দিয়েছেন সেগুলোর সঙ্গে। আর সেজন্যই উপন্যাসের যা অন্যতম প্রধান চরিত্র বা শক্তি— মানবচরিত্রের বন্ধ দুয়ারগুলোকে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে খুলে ফেলা— সেটা এই উপন্যাসে সার্থকতা লাভ করেছে।

এই উপন্যাসে এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ, নিঃসন্তান জ্যাঠাশ্বশুর এক বিচিত্র অবচেতনার খেলায় তাঁর বিধবা, যুবতী ভ্রাতুষ্পুত্রবধূর প্রতি প্যাশনেট হয়ে পড়েন। যদিও এই প্যাশনের উৎপত্তি তার একাকিত্ব নির্মূল করার নির্ভেজাল কল্যাণকামনার মধ্য থেকেই। এই কল্যাণেচ্ছু দৃষ্টির ফলেই বৃদ্ধ তাকে সঙ্গ দিতে থাকেন, এমনকী তার জন্য সঙ্গী নির্বাচন করে দু-জনকে কাছে আসার সুযোগ করে দেন। কিন্তু অবচেতনার বিচিত্র ও সুতীব্র অভিঘাতে বৃদ্ধের লুকিয়ে থাকা ‘আমি’-টা আকৃষ্ট হয় যুবতীর প্রতি। তার অনুপস্থিতিতে তার ঘরে ঢুকে বৃদ্ধ তার শরীরের গন্ধমাখা বিছানার চাদরে মুখ গুঁজে দেন, স্নানরতা অবস্থায় তার সঙ্গে ইচ্ছাকৃত কথোপকথন চালান। এই অবসেশনের মধ্য দিয়েই তমাল খুব যত্ন নিয়ে জ্যাঠাশ্বশুরের জন্য গড়ে তোলা শিক্ষিত, মেথোডিক্যাল চরিত্রটা ভাঙেন। তাঁর কুশলী হাতে এই বৃদ্ধ যেন সহসা এক বয়ঃসন্ধির কিশোরে পরিণত হন। প্রবল আবেগ তার চেতনাকে অধিকার করে, আর সেই আবেগতাড়িত অধিকারবোধ আর হঠকারিতার বশে তিনি যুবতীর সঙ্গী যুবকটিকে এক সাজানো দুর্ঘটনার সম্মুখীন করবারও নিখুঁত পরিকল্পনা করেন। অপরাধবোধ ক্ষণে ক্ষণে তাকে তাড়া করে বেড়ালেও পরক্ষণেই তিনি যেন মরিয়া হয়ে ওঠেন। এখানে একটু উদ্ধৃতি দেবার লোভ সংবরণ করা যাচ্ছেনা— “এ যে কতটা লজ্জার কী বলব, এ ভাবে মাংসের জেগে ওঠা— খুব বছর ঘুমিয়ে থাকার পর মিথিক দৈত্যের মতো। সে আড়মোড়া ভাঙছে এই রাতের বাতাসে।… মনে হচ্ছে মানুষের মতো দেখতে এই কাঠামোটা শুধু হাড়মাংসের মণ্ড— পচা দুর্গন্ধী মাংস— নৈতিক শুদ্ধ হৃদয়ে দগদগে ঘা।”

এখানেও কিন্তু তমাল এক অনবদ্য কুশলী টানে এর পরের ঘটনাবলীকে চিত্রিত করেন। আর তা যেন এক অনির্বচনীয় মানবিক উত্তরণ। ভালোবাসার প্রতি এক মধুর আত্মোৎসর্গে দুর্ঘটনাগ্রস্ত যুবকটি তার অঙ্গহীনতাকে আশীর্বাদ বলে মনে করে! যে-আশীর্বাদের ফলে সে ওই বিধবাকে বিবাহের জন্য উদ্ভুত সমস্ত সামাজিক জিজ্ঞাসাকে চুপ করিয়ে দিতে পারে। আর বৃদ্ধও যেন এই অমোঘ ভালোবাসার পরিমণ্ডলেই ফিরে পান তার কল্যাণকর রূপ। তার অবসেশন পরিবর্তিত হয়ে ভালোবাসার এক শুভার্থী রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি ওদের আশু মিলনের ব্যবস্থা করেন।

কিছু ক্ষেত্রে, এই উপন্যাসে, বৃদ্ধের সংলাপ একটু ভার-ভার মনে হয়েছে। কিছুক্ষেত্রে এই ভার চরিত্রনির্মাণে সহায়ক হলেও, নাতিদীর্ঘ, প্রগলভ সংলাপও এই ওজন বহন করে চলেছে সর্বদা। তবু মনস্তত্ত্বের যে-টানাপোড়েনের খেলা লেখক ফেঁদেছেন, তার টানেই উপন্যাসটি এগিয়ে চলে তরতর করে।

ঠিক একই গতিতে পড়া গিয়েছিল তমালের ‘মায়াকাচ’ উপন্যাসটি। এখানে অবচেতনের যে-চরিত্রের সঙ্গে তমাল আমাদের পরিচয় করিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যে প্রায় বিরল। অথচ জীবনের প্রেক্ষাপটে তাকে অস্বীকার করা যায় না মোটেই। লুকিয়ে থাকা, লুকিয়ে রাখা ফ্যান্টাসিগুলোকেই টেনে বাইরে এনে দাঁড় করিয়েছেন তমাল।

মফস্সলের ছেলে কৃষ্ণেন্দু কল্পনাপ্রবণ, সাহিত্যকর্মী। বাস্তববাদী হবার জন্য বাবার চাপ সত্ত্বেও সে নাছোড় তার পছন্দের বিষয় নিয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশুনা করার জন্য। এ-ব্যাপারে তার উপরে প্রভাব ফেলেন তার বাবার কাকা, ‘কাকাদাদু’, তার ব্যতিক্রমী জীবন দিয়ে। ভাবালু, নিভৃতি পছন্দ করা কৃষ্ণেন্দু, নিজের কঙ্কালকে নিজের প্রিয়তম বন্ধু বানিয়ে ফেলা কৃষ্ণেন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে সহপাঠীদের বৃহত্তর সঙ্গ আবিষ্কার করে, জুড়ে যায় প্রথাগত নোটভিত্তিক পড়াশুনার বাইরের নানা কাজে। সেখানে তার সঙ্গিনী হয় কুরূপা নন্দিনী, যে তার উদার পারিবারিক প্রেক্ষাপট আর সুন্দর মন নিয়ে কৃষ্ণেন্দুকে সতত প্রশ্রয় দিয় যায়। অন্যকিছুতে উদ্বুদ্ধ হলেও পরীক্ষার পড়াশুনার ক্ষেত্রে নন্দিনীর পরামর্শ শোনে না কৃষ্ণেন্দু, ‘অন্যরকম’ হবার দুর্নিবার বাসনায় সে যেমন পড়াশুনার সাফল্যের রাস্তা থেকে দূরে সরে যায়, সেই একই ইচ্ছের বশে সে যেন জেদ করেই ভালোবাসতে চায় নন্দিনীকে। কিন্তু অবচেতনে সে তার ভালোবাসার মানুষকে পেতে চায় সুন্দররূপে। আর তাতেই বস্তুত ওই কুদর্শনা সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রভূত সময় কাটালেও তার মন সঙ্গিনীর উপর প্রতিস্থাপন করে সুন্দর সব বিগ্রহ— তাদের ঝকমকে সুন্দরী সহপাঠিনী অথবা লাস্যময়ী অভিনেত্রীর রূপে। তার এই ফ্যান্টাসিনির্ভর বেঁচে থাকার পাশে পাশেই চলতে থাকে বস্তুজীবনে তার ব্যর্থতাগুলি— জেদের বশে নোটনির্ভর উত্তর না লিখে পরীক্ষায় খারাপ মার্কস পাওয়া, অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সর্বোপরি তার কাকাদাদুর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁর দেহদান পরিবারের আপত্তিতে করতে না পারা। ফলে, তার চেতনার স্তরে তার ফ্যান্টাসিগুলোই তার জীবনের ‘পজিটিভ নোট’ হয়ে দেখা দেয়। আর সে এই আপাত অবাস্তব চিন্তার মধ্যে ঘোরাফেরাটাকে উপভোগ করতে থাকে। আশ্চর্য দক্ষতায় লেখক এখানে মানসিকতার দু-টি বিপরীতমুখী ধারাকে অলক্ষ্যে উভমুখী দিকে চালিত করেন। যেভাবে কৃষ্ণেন্দু তার শরীরিক অস্তিত্বের গভীরে ডুব দিয়ে তার কঙ্কালকে বন্ধু বানিয়ে কথোপকথন চালাত, তার মধ্যে যে-গভীরতার দ্যোতনা ছিল— সেভাবেই ফ্যান্টাসি-নির্ভর ভাবনায় মোহগ্রস্ত হয়ে সে কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসার গভীরতা থেকে বিচ্যুত হয়। আত্মপ্রবঞ্চনার সাথে সাথেই নন্দিনীর নিখাদ প্রেমকে প্রবল প্রতারণা করে সে। অবচেতনের হাতের পুতুল হয়ে সে নিঃশব্দে ধ্বংস হয়।

‘মায়াকাচ’-এর সার্থকতা এখানেই— কৃষ্ণেন্দু আমাদের অনেকেরই পরিচিত। একে আমরা কখনো-না-কখনো, কোথাও-না-কোথাও দেখেছি। আচ্ছা, আমিই কি কৃষ্ণেন্দু নই? এভাবেই কি ইল্যুশনগুলো, নিরন্তর নির্মাণ করে যাওয়া মিথ্যেগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের বাস্তব থেকে দূরে রাখে না? বাস্তবের উপর বারংবার আমরা স্বপ্নকে স্থাপন করি না? আসলে এই আত্মপ্রবঞ্চনাটা আমরা টের না পেলেও, বা টের পেয়েও স্বীকার না করলেও, আদতে ঠকে যায় জীবন। এই সেদিনই, পথচলতি এক মানুষের ঠোঁট থেকে নির্গত এক স্বগতোক্তি, “এভাবেই উলটোপালটাভাবে কেটে গেল জীবনটা”— ভাবালো অনেকক্ষণ। সত্যিই তো, আমরা, সাজিয়ে নিতে বা গুছিয়ে উঠতে পারি না অনেক কিছুই, পারছি না, সে-উপলব্ধিও হয়তো হয়। কিন্তু সেজন্য যে-ধাক্কাটা নিজেকে দেওয়া দরকার— সেটা পারি না কিছুতেই। কারণ, যাপন জীবনকে আমরা বড্ড ভালোবাসি। তার জন্য মায়ার পাত্র কানায় কানায় পূর্ণ। ব্যর্থতার কোনো দাগ সেখানে স্থায়ী হয় না। হতাশ, অবসন্ন কৃষ্ণেন্দু আত্মহত্যাও করতে পারে না।

প্রবঞ্চিতা নন্দিনী ফিরে আসেনি। বহুদিন বাদে, একান্ত নিজস্ব সময়ে, পুরোনো পরিমণ্ডলে ফিরে কৃষ্ণেন্দু চেয়েছিল— সে যেন অন্তত ছায়ার শরীর নিয়েও ফিরে আসে একটিবার। ব্যতিক্রমী হতে চেয়ে শেষে হাজারো মানুষের ভিড়ে মিলে যাওয়া কৃষ্ণেন্দু, উপন্যাসের অন্তিমভাগে, তার ক্লিশে হয়ে যাওয়া দৈনন্দিনতার মাঝেই ফের ফ্যান্টাসির কাছেই ফিরে যেতে চেয়েছে। কিন্তু নন্দিনী ফেরেনি, নন্দিনীরা ফেরে না।

যে-কথাটা আগে উল্লেখ করেছি— তমাল তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মানবমনের বিভিন্ন ‘ফেজ’ ছুঁতে ছুঁতে যান— যেখানে প্রতিটা ‘ফেজ’–ই জীবনের অমোঘ লক্ষণগুলি ছাপ ফেলতে থাকে। আর এখানে এসেই আমরা নিজেদের ‘আইডেন্টিফাই’ করতে পারি। কারণ, অদ্ভুতভাবেই, জীবন এই চরাচরের সকলের ওপরই সমানভাবে ক্রিয়াশীল। এই বিশাল জীবনপাথারের কোথায় কোন ঢেউ উঠছে, আমরা জানি না। কিন্তু উঠছে তো বটে! সে-তরঙ্গের অভিঘাত এক-একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকমভাবে ক্রিয়া করে। ‘মায়াকাচ’ কৃষ্ণেন্দুর সমস্ত অপারগতার পাশাপাশি লেখক সৌমাভ তার শ্বেতা, দুই সহপাঠীর চরিত্র এনেছেন। তাদের সফল যৌথজীবনের ইঙ্গিত দিয়েছেন— কিন্তু এদের জীবনেও কি কালো ছায়া পড়বে না কোনো মেঘের? তমালের ‘মর্মমেঘ’ উপন্যাসের ডাক্তার নীলাদ্রি আর তার স্ত্রী স্বর্ণালী কিন্তু সম্মান আর বৈভবের জীবনে থেকেও এড়াতে পারে না সমস্যাকে— যে-সমস্যা অতি সঙ্গোপনে তার শিকড় ছড়িয়ে দেয় যাপনে, চারিয়ে যেতে থাকে অনুভবে। পেশাদারি মোড়ক, টাকা রোজগার করার লক্ষ্যমাত্রা, প্রতিদিন মফস্সলের সরকারি হাসপাতালে হাজারো রোগীর হাজারো সমস্যার থেকে সমস্যান্তরে মনকে প্রতিস্থাপন করার মাঝেও, অন্তর্গত বোধের জগতে নীলাদ্রি অসহায়। সে তার অবচেতনের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য। চোখ টানার মতো সুন্দরী স্ত্রী, যা রোজগেরে ডাক্তার হওয়ার ফলে প্রাপ্য, লাভ করেও সে যৌন অক্ষমতার শিকার হয়ে চলে। নামী গাইনিকোলজিস্ট হওয়ার ফলে ছাত্রাবস্থা থেকেস নারীশরীর নাড়াচাড়া— ফলে অবধারিতভাবে তার অবচেতনে সেই নারীশরীর তার সমস্ত পুঁজ, রক্ত, পুরীষ নিয়ে একটা কাঠামো নির্মাণ করে, যে-গভীরতায় গিয়ে নীলাদ্রি ফিরতে পারে না বহিরঙ্গের আকর্ষণে। নীলাদ্রির বয়ানে তমাল লেখেন— “আসলে বোধের জগতে পৃথিবীর সবকিছুই আদতে একটা স্ট্রাকচার। সাপ, ব্যাঙ, নারী, পুরুষ, হাতি, ঘোড়া, ফুল, পাখি সব এক-একটা অবয়ব।… চেতনার তলায় একেবারে প্রাথমিক স্তরে তুমি কিন্তু একটা নারীমূর্তি, নিখুঁত তবু কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্না নারীশরীর। সমস্যার বীজটা পোঁতা ওখানেই।… কাঠামোটাই যত নষ্টের গোড়া।” এই কাঠামো ভাঙতে ভালোবাসার যে জাদুকাঠির দরকার পড়ে— তীব্র কর্মব্যস্ততায় ডাক্তার তার নাগাল পায় না। সে নৈকট্য তাদের কাছে এসে দাঁড়ায় না। অথচ, ঠিক এর উলটোপিঠে, এই পেশাদারি জীবনের প্রবল ট্র্যাজেডিটা তমাল দেখান ভাস্কর সেনগুপ্তকে দিয়ে, বিলেত ফেরত ডাক্তার হয়েও যিনি পেশাদারিত্বের ইঁদুর–দৌড়ে ছোটেন না; সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোর জন্য শুধু জীবনে জায়গা ছেড়ে রাখেন না, নিজের কাজের মধ্যেও তাদের জড়িয়ে নেন। অথচ, নিজের নিকটাত্মীয়ের অবধারিত মৃত্যুর দায় এসে পড়ে তাঁর ঘাড়ে। সামাজিক ও পারিবারিক সম্মানে মুহূর্তমধ্যে থাবা মারে সুতীব্র অপমান। তার ভাগীদার হয় নীলাদ্রিও। এখান থেকেই, এই সংকটের মোড় থেকেই ভালোবাসার পথে উত্তরণের একটা দিশা দেখান তমাল। জীবনযুদ্ধের প্রবল স্রোতের বাইরে তাকে টেনে এনে দাঁড় করাতে, তাকে নিয়ে স্বর্ণেলী ঘুরতে চলে সিকিম পাহাড়ে। আর এখানেই বিধ্বংসী ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটে স্বর্ণালীর ‘কাঠামো’-র ভিতরের ‘নারী’-কে আবিষ্কার করে নীলাদ্রি। সে খুঁজে পায় সেই চোরাস্রোত, সৃষ্টির আদিমুহূর্ত থেকে যে চিরন্তন ভালোবাসা নীরবে, নিঃশব্দে বয়ে চলেছে— বয়ে যাবে আরও কত কাল— যার মধ্যে আত্তীকৃত হয়ে যেতে থাকে সমস্ত শরীরী চাহিদা, অন্তর্বর্তী সমস্ত সংকট। শুধু তাই নয়, পেশাদারি জীবনের বাইরে সেবার প্রকৃত মূল্যায়নও করেন তমাল— উপন্যাসের শেষ ভাগে। একটি উপন্যাসের কাছে মানুষের প্রত্যাশা তো এটাই— বোধ থেকে বোধে উত্তরণের।

তমালের ছোটোগল্পগুলোর কথা এবার বলা দরকার। উপন্যাসের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে যেভাবে মানুষের মনের আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন তমাল— ছোটোগল্পের স্বল্প-পরিসরে তা পরিণত হয় ক্যানভাসের ওপর ছোটো ছোটো ব্রাশস্ট্রোকে। যে ঘায়ের অভিঘাত প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হয়ে ওঠে। এই ধুলো, জল, মরে আসা আলোর দুনিয়ায় প্রবলভাবে থেকেও তমালের ছোটোগল্পগুলো যেন নিজেরাই রচনা করে নেয় এক মায়াবাস্তবের প্রেক্ষাপট, যেখানে জাদুর ঝাঁপির মতো এক-একটা গল্প থেক বের হতে থাকে কুয়াশামাখা অনুভূতি, যাকে শুধুমাত্র বোঝা যায়— হাত দিয়ে ধরতে গেলে মিলিয়ে যায়, নয়তো-বা গলে যাওয়া অস্তিত্বের মতো লেগে যায় হাতেই।

তমালের প্রায় সবক-টি গল্পেরই প্রয়াস গহনে যাওয়ার। লক্ষ্যস্থানে গিয়ে তা যেন একটা হাল্কা ঘা মেরে ফিরে আসে, আর অনুরণনটা স্পন্দিত হয় সারা পথ জুড়ে। এই যাওয়ার রাস্তাটা কখনো কখনো খুব সন্তর্পণে, একদম আটপৌরেভাবে— আপনি জানতেই পারছেন না কোথা দিয়ে লেখক বাঁধছেন আপনাকে— আমাকে। যখন আবিষ্কার করব, তখন আমরা বন্দী। গল্পের চরিত্র, প্রেক্ষাপট— সবকিছু আর পাঠকের মননের মধ্যেকার সূক্ষ্ম পরিসর, সেখানে সহসাই আপনি দেখতে পারেন আপনার ছায়া।

তমালের ‘সংক্রমণ’, ‘মুখ’, ‘অভিযোজন’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’— প্রত্যেকটি গল্প এক-একটি লুকানো বোমা। যখন ফাটল, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বহু যত্নে গড়ে তোলা আমাদের বাহারি অবয়ব। নগ্ন, হতচেতন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। আত্মউন্মোচনের আকস্মিকতার অভিঘাত হয়তো-বা এরকমই। ‘সংক্রমণে’-এর সুনীল বা ‘মুখে’-এর মদন তো আমাদের ভেতরে অতি যত্নে লালিত পালিত হয়। আমাদের সমস্ত চিন্তা, চেতনা, অবচেতনার চারপাশে একটা আয়নার পরিমণ্ডল গড়ে তোলেন লেখক। ‘কালপুরুষ’, ‘গদাই মরেনি’, ‘প্রতারক’, ‘জ্বর’— প্রতিটি গল্পই একটা তীক্ষ্ণ বোধকে আচ্ছন্ন করা রেশ রেখে দিয়ে যায়। ‘কালপুরুষ’ গল্পে তমাল যেমন মানুষের অতি সাধারণ চাহিদা, তা অর্জনের জন্য আমাদের মরিয়া প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটা অভিঘাত হেনেছেন, অভাবনীয়। আবার ‘গদাই মরেনি’ গল্পে জীবনের প্রতি এমন একটা আটপৌরে মমত্ব দেখিয়েছেন, যা সদ্য ছেড়ে যাওয়া ঘুমের মতো আমাদের চোখে লেগে থাকে। ‘বেড়ালবাড়ি’ গল্পেও যেন মনুষ্যজীবন তার আশ্রয় খুঁজে পায় মনুষ্যেতর জীবনের মধ্যে, যেখানে পাড়ার মধ্যে প্রায় একা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, আইবুড়ো মেয়েতে ভরতি বাড়িতে একটা বেড়ালের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অন্তর্লীন মমতার গল্প শুনিয়েছেন তমাল।

‘বাবা’ গল্পটার কথাই ধরা যাক। প্রকৃতির মুচকি হাসির সামনে গল্পের একদম ক্লাইম্যাক্সে এসে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তমাল। ছোটোগল্পের এরকম সার্থক ‘ফিনিশিং’ বহুদিন পরে দেখা গেল। গল্পটাকে যেখানে ছেড়ে রেখে গেলেন তমাল, কী অসাধারণ একটা স্পেস রেখে গেলেন। কত না-বলা কথা যেন আকাশ পর পর লেখা হেয় গেল! সত্যি, গল্পটা পড়ে তৎক্ষণাৎ নারায়ণ গঙ্গাপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্পটির কথা মনে হয়েছিল, এতই তার অভিঘাত।

‘সুপুরিওলা’ গল্পটা যেমন জীবনের সদর্থক লক্ষণগুলোর দিকে আলো ফেলতে ফেলতে একটা পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তেমনি ‘মোটাখোকা’ গল্পে মোটাখোকা সাধারণের পরিমণ্ডলের বাইরে অবস্থান করেও শেষমেশ এক অদ্ভুত স্নেহের সামনে নিজেকে সমর্পণ করতে থাকে, বহিরঙ্গে কিছুটা উন্নাসিকতা বজায় রাখলেও সে জারিত হতে থাকে সেই স্নেহরসে, যার পরিপ্রেক্ষিতে তার হারানো মেয়ের স্মৃতি তার পিতৃত্বের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আলো ফেলে।

‘ঝাঁপ’, ‘শববাহক’, ‘লোকটা’, ‘লজমালিক’— এই গল্পগুলি ঠিক এমনিভাবেই মানুষের মনের গভীরে গিয়ে যেন আলো ফেলে বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে, যেখানে অপমান, দুঃখবোধ, হেরে যাওয়া— সব জড়ামড়ি করে থাকে।

‘প্রেত’ গল্পটাতে একদম অপরিণত বয়সের ‘ক্রাশ’-কে এক ভয়াবহ অবস্থায় তমাল হাজির করেছেন সেই তরুণ প্রেমিকের কাছে, যেখানে সেই নারী ক্যানসারে আক্রান্ত, আর কেমোথেরাপির অবধারিত বিক্রিয়ায় সে প্রেতদর্শনা। এখানে যেন তমাল আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন তীব্র জীবন জিজ্ঞাসার সামনে, আমরা কি আদৌ অন্তরের বা অন্দরের পূজারী? নাকি নিজের মতো করে সাজিয়ে তোলা চিন্তাক্রমকে ক্রমশই একতরফা করে তুলি আমরা?

‘সংক্রমণ’ গল্পটা, আগেই বলেছি, বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসে যেন এক কণা হীরে। ছাইয়ের গাদায় পড়ে থাকলেও, আপন দ্যুতিতে যা সকলের চোখে পড়ে যাবে। কোথা থেকে শুরু করে কোথায় গিয়ে শেষ করলেন তমাল? দৈনিক মজুরিতে নিযুক্ত রোগগ্রস্ত পাখিদের হন্তারক এক বিরামহীন হত্যার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠল এক নেশাগ্রস্ত বিনাশকারী, যে অন্তিমে চূড়ান্ত অট্টহাস্যে আহ্বান করল নিজের শেষটাকে। সে যেন এক অলাতচক্রের মধ্যবিন্দুতে অবস্থানকারী— যার কাছে জীবনের সমস্ত মানে গিয়ে পৌঁছোতে পারে না, হত্যার নিরন্তর ঘোর লাগা চোখে সব পুড়ে যায়, জ্বলে যায়— কেবল শুষ্ক ছাইয়ের মতো অনুভূতির দেহাবশেষ গ্রহণ করে সে। যে-ভয়াল মানসিক প্রেক্ষাপট এই গল্পে তৈরি করেছেন তমাল; এবং সেই প্রেক্ষিতটাকেও চরিত্র করে তুলেছেন গল্পের— টুপিটা লেখকের উদ্দেশ্যে খুলতেই হয়। বহু, বহুদিন বাদে এমন ছোটোগল্প পেল বাংলা সাহিত্যজগৎ।

এই একটা গল্পকে যদি আমরা মূলক হিসেবে ধরি, তবে তমালের গল্প বলার যে-আঙ্গিক, তার একটা সূত্র পাব। তাঁর ন্যারেটিভটা বাইরের প্রকৃতি, আর মনুষ্যপ্রকৃতি নিয়ে গল্প বলার যে-ঢঙটা গড়ে তোলে— তাতে কখন যে কোনটা প্রবলতর হয়ে গল্পে তার কালো ছায়া ফেলে যায়, তা আগে থেকে বোঝা যায় না। তাঁর ‘লোকটা’ গল্পেও এই দুটো ‘ডাইস’ নিয়ে খেলতে থাকেন। তীব্র, জ্বালা ধরানো শহুরে গ্রীষ্ম প্রকৃতি, আর এক উন্মাদের ‘বিধাতার সঙ্গে সাপ লুডো খেলার’ মতো উৎকেন্দ্রিক চেতনা— যেন দাঁতে দাঁত চেপে চাপান উতোর খেলে চলে। আমরা নীরব দর্শক হয়ে দমবন্ধ হয়ে শুধু দেখে যাই।

যে-কথাটা বলবার, তমাল কিন্তু তাঁর গল্প বলার বা উপন্যাসের ভঙ্গিকে দুর্বোধ্যতার মোড়কে মুড়তেই পারতেন। বিশেষত তাঁর ঘোরাফেরা মানুষের মনের যে-সদাজটিল সাদা–কালো খোপগুলোতে— তাকে অনায়াসে ঢাকতে পারতেন কুয়াশার রঙে। কিন্তু তা না করে, তমাল কলমের আঁচড়ে ছিঁড়েছেন সেই আবছায়া জাল; সেখান দিয়ে যেটুকু আলো এসেছে, তা হয়ে উঠেছে মানবমনের হদিশবাতি। সেই হলদেটে, মরে আসা আলোর পথ ধরেই চোখের সামনে খুলে যায় জীবনের নানা অলিগলি, আর বড়ো রাস্তা— যে-রাস্তা নিজেই যেন চলে গিয়েছে এক বড়োসড়ো জিজ্ঞাসাচিহ্নের দিকে।

ছোটোগল্পের আদর্শ নিদর্শন হিসেবে, তমাল খুব হাল্কা চালে দৈনন্দিন যাপনের বয়ন করা মুহূর্তকে বেছে নেন। আর সেখান থেকেই জাল বুনতে বুনতে পৌঁছন একেবারে কেন্দ্রে, যেখানে এসেই মোক্ষম আঘাতটা হানেন তমাল। কিন্তু সে-আঘাত অনেকটাই নিঃশব্দ ঘাতকের মতো অভিঘাত ফেলে পাঠকের মনে। পুলিশের ‘থার্ড ডিগ্রি’-তে যেমন নাকি রবারের লাঠি ব্যবহৃত হয়, কোনো বাহ্যিক দাগ না রেখেও তা মরণযন্ত্রণা দেয়! এই দক্ষতা সকলের থাকে না, কারণ মানুষের মনের গলিঘুঁজিকে হাতের তালুর মতো চিনতে পারা চাই। সেটা, বোধহয়, তমাল অর্জন করেছেন।


এভাবেই তাঁর লেখনিতে জীবনপ্রবাহের আলো-ছায়ার সিল্যুয়েটকে অনবদ্য দক্ষতায় লিপিবদ্ধ করেন তমাল; যে-প্রবাহ চোখের আড়ালে অন্তঃসলিলা, তাকেও হঠাৎ করেই চোখের সামনে এনে ফেলেন তিনি। কিন্তু চোখের আড়ালেই যাকে রাখতে চাই আমরা, সেই অবচেতনকে নিয়ে বেশ নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী খেলা করেন অবচেতনের এই জাদুকর। মানুষের মন খুঁড়ে নিয়া আসা সেইসব হীরেতে হয়তো লেগে থাকে আকরিক ক্লেদ, কিন্তু তার মাঝখান থেকেই ঝিলিক দিয়ে ওঠে সেই আলো— যার তেষ্টাতেই সাহিত্য পাঠ, বা বৃহত্তর অর্থে সাহিত্যকর্ম।

বিশেষ করে, ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে যে-মুন্সীয়ানা তমাল দেখাচ্ছেন, তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। সাহিত্য প্রতিষ্ঠানগুলিও তাঁর কদর করছেন— এটা অবশ্যই আনন্দের কথা। আমাদের, পাঠকদের আশ থাকবে, এই লেখনি নব নব সৃষ্টিতে ক্রিয়াশীল হোক, ঋদ্ধ হই আমরা। মনের জটিল ক্রিয়াবিক্রিয়াকে লিপিবদ্ধ করার যে-সহজাত দক্ষতা তার আয়ত্ত, সেই দক্ষ শিল্পীর চিত্রকর্মের সাক্ষী থাকি আমরা, আরও বহুদিন। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায়, স্বীকার করতে বাধা নেই, বর্তমানে কিছুটা ভাঁটার টান। হয়তো-বা যুগের চরিত্রবৈশিষ্ট্যেই, গভীর চিন্তার উদ্দীপক কোনো কাজের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেকটাই। সেখানে, তমালের এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করবে, অবশ্যই।

Facebook Comments

পছন্দের বই