লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রণজিৎ অধিকারীর প্রবন্ধ

হিরণ্ময় শিল্পজগৎ ও রং তুলি হাতে এক দেবদূত

নাটকের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শিল্পী হিরণ মিত্র বলেছিলেন, ‘যা তাৎক্ষণিক, যা পুনরাবৃত্ত করা যায় না। যা কালেই ভেসে যায়।’ তা-ই হয়তো শ্রেষ্ঠ শিল্প। যা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই, তা-ই আসলে হারাই। এই প্রবন্ধের লেখক হিসেবে আমারই এ-কথাটা আরও একটু স্পষ্ট করা উচিত। শিল্পকে কীভাবে আমরা পাই কিংবা আমরা আবিষ্কার করি? এটা অনেকটা মোকাবিলা করার মতো। আমি একজন সাধারণ পাঠক কবি হিসেবে যখনই কোনো চিত্রের দিকে তাকাই একঝলক কিংবা কোনো নাট্যমুহূর্ত (পুরো নাটকের কথা বলছি না) বিদ্যুচ্চমকের মতো আমার চোখে প্রবেশ করে, আসলে প্রবেশ করে আমার মনে আমার মস্তিষ্কে— তখনই তো একটা স্পার্ক ঘটে; সেটা শুধু মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে না, আমার সারা শরীরে অঙ্গে প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তেই তা সার্থক শিল্প হয়ে ওঠে। আর আমি একজন সাধারণ দর্শক ও ওইসময় অনুপস্থিত সেই শিল্পী দু-জনেই একটা সৃষ্টির অংশীদার হয়ে উঠি। ঐ চিত্রটি হয়তো দেওয়ালে শত বর্ষ আটকানো ছিল, কতজন তাকে অন্যমনস্কভাবে এতদিন দেখেছেন, হয়তো দেখেনইনি— তখন তো সে কোনো শিল্পই নয়।

হিরণ মিত্র

পিকাসোর কথাটা মনে পড়ছে। তাঁর সাইকেলের অংশ নিয়ে বানানো সেই ষাঁড়ের মুখ। ভাস্কর্যের জঞ্জালে পরিত্যক্ত শিল্পটি সম্পর্কে ভাবছেন, এটা পড়ে থাকতে থাকতে একদিন কেউ একে সাইকেলের অংশ বলেই ফের একে চিনে নেবে— আর তখনই ঘটবে যথার্থ মেটামরফোসিস। অর্থাৎ যতক্ষণ না কেউ এটাকে সেই দৃষ্টিতে দেখছে ভাবছে ততক্ষণ তো এই শিল্পকর্মটির রূপান্তর ঘটছে না। মানে, শিল্পের ক্ষেত্রে দর্শক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর যে-মুহূর্তে শিল্পটি তার মস্তিষ্কে ক্রিয়া করছে সেই মুহূর্তেই এই পুরো শিল্প-প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হচ্ছে। একটা বৃত্তের সমাপ্তি— যার উৎপত্তি হয়েছিল শিল্পীর মস্তিষ্কে। আমরা অনুভূতিকে খুঁজে বেড়ালেই সে ধরা দেয়না, আবার না খুঁজলে আসেওনা। যেভাবে সঙ্গম ঘটাতে চাইলেই আমরা সঙ্গম করতে পারি না, বড়োজোর একটা যৌনক্রিয়ায় অংশ নিতে পারি।

যতক্ষণ না দুটো শরীর মন চূড়ান্ত কোনো প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে ততক্ষণ কোনোকিছুই চরিতার্থ হয় না। রূপ, শরীর, ছন্দ, রেখা… সব মিলে একটা হয়ে ওঠা। ভিন্ন ভিন্নভাবে আমাদের চারপাশের জগতে যা ঘটেই চলেছে তা শিল্প নয়। রূপ আর শরীর নিয়ে আমরা অসংখ্য যৌনক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছি অথচ তা যিশু মাগদালেনার সম্ভোগের মতো বিশুদ্ধ উচ্চতায় পৌঁছোচ্ছে না। শিল্প আসলে ঐ চূড়ায় পৌঁছাতে চায়।

আবার একটা শিল্প তা যতই উঁচুমানের বা ইতিহাস প্রসিদ্ধ হোক না কেন— যদি একজন দর্শকের দেখার সময় মস্তিষ্কে ক্ষরণ না হয় তবে সেই শিল্পকর্মটি সার্থক হয় না। এই দেখাটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। চোখ দিয়ে দেখা যায় না, শরীর মন দিয়ে দেখতে হয়— তাতেই শিল্পকর্ম সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে।

হিরণদা-র মঞ্চনির্দেশনায় আমি বহু নাটক দেখেছি। একবার উত্তম মঞ্চে ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ দেখতে গিয়ে এক অভিজ্ঞতা হল। নাটকের শেষে ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ সংলাপের পুনঃপুন উচ্চারণে আবেগমথিত এক পরিবেশ তৈরি করে আলো নিভে যায় মঞ্চে। আর আলো নিভে যাওয়ার পরও আমি স্পষ্ট মঞ্চটা দেখতে পাচ্ছি। একটা মুহূর্ত— মঞ্চে ব্যবহৃত নানা জ্যামিতিক কোণ আমার মধ্যে ক্রিয়া করছে। আমি কাঁপছি, মনে হল যেন আমার মাথার ভিতর মঞ্চের চলমান অংশগুলি চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। ঐ মুহূর্তটাই আসলে সমগ্র মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনাকে সার্থক করে তুলছে। সেটা কিন্তু নাটকের গল্প, অভিনয়, নাট্যালোচনার মধ্যে নেই।

শিল্পকর্মকে দর্শকের মধ্যে ক্রিয়া করতেই হবে। বছর কয়েক আগে একাডেমি-তে গেলাম খবর পেয়ে— আরও অনেকের সঙ্গে হিরণদা-র একটি চিত্র প্রদর্শনীতে আছে। আমি সটান গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। ততদিনে এই শিল্পীর চিত্রকলা, নাট্যসজ্জা বিষয়ে সামান্য ধারণা হয়েছে। হল কী— আমি ছবিটিকে সামনে থেকে উধাও হয়ে যেতে দেখলাম। একটা বিমূর্ত ছবি আমার সামনে তখন মূর্ত হয়ে উঠছে। চারপাশের আর কিছুই আমার কাছে দৃশ্যমান নয়। আমি দেখছি এক মহাজাগতিক কাণ্ড। সেখানে লাল আর কালো মিশিয়ে এমন এক জগৎ, যেন ব্রহ্মাণ্ড!

বেশ কিছু দিন আগে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি বই পড়ে জানলাম— আমাদের চোখ এইজগতের সামান্য অংশই দেখতে সক্ষম। অসংখ্য কোটি অদৃশ্য জীবাণু, অনু-পরমানু পেরিয়ে আমরা দূরের ওই গাছটি দেখতে পাচ্ছি, একজন নারীকে দেখতে পাচ্ছি।
তো রূপ কী? ওই গাছটিই কেবল? নারীটিই কেবল?
তাহলে রূপ হিসেবে যা দেখি তা তো অসম্পূর্ণ দেখা।
অবয়ব কী? কোনটা কেমন দেখতে? তা তো আমাদের প্রায় অন্ধ চোখই ঠিক করে দেয়! তাকে অতখানি গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে?

এইভাবে আমার মধ্যে প্রাথমিক মূর্ত বিমূর্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। সুতরাং যা কিছু মূর্ত, তা অসম্পূর্ণ। অসম্পূর্ণ দেখা থেকে যা কিছু সঞ্জাত যা কিছু সৃষ্টি তা সবই অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। আমি কখনোই যথাযথভাবে আঁকা প্রকৃতি, একটি নারীর মুখ— এতে আকৃষ্ট হইনি। আমার এইসব ছোটো ছোটো ধারণা স্পষ্ট হয় হিরণদা-র সংস্পর্শে এসে। বলা ভালো তাঁর ভাবনার সংস্পর্শে এসে। ভাবনা কথাটা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ — শিল্পকে বুঝতে, হিরণ মিত্রকে বুঝতে।

নাট্যকার অভিনেতা মেঘনাদ ভট্টাচার্য একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটা ভালো অভিনয় একটা নাটক আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। নতুন ভাবনা বা আইডিয়াই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। কথাটা ভীষণ জরুরি শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে। মানে একটা ভালো ছবি, একটা কবিতা আমাদের উদ্ধার করতে পারবে না, যদি না তাতে কোনো নতুন ভাবনার জন্ম হয়। একথাটা হিরণ মিত্র সম্পর্কে খুব খাটে। আমি বলছি না যে সাম্প্রতিক অতীতে আর কোনো প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী বাংলায় আসেনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি আরও কয়েকজনের শিল্পকর্মের প্রতি আকৃষ্ট। কিন্তু এই যে আইডিয়া— নতুনভাবে ক্রমাগত নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে চলা— এই দিক থেকে হিরণদা অন্য সকলকে হাজার মাইল পেছনে ফেলে দেন।

এর কারণটা কী? হিরণ দা-র নিজের বয়ানই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। তিনি সবসময়ই বলেন, চিত্রকলার জগতে তিনি কখনোই ঠাঁই পাননি, আস্থা অর্জন করতে পারেননি এদেশের ক্রিটিকদের কাছে। তিনি একটা অবজ্ঞা দ্বারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। আর এটাই কিন্তু আশীর্বাদ হয়ে আসে তাঁর শিল্পকর্মে। তাঁকে নতুনভাবে গড়ে নেয়। অবজ্ঞেয় হয়ে থাকার, চারপাশের অমনোযোগের সুযোগ নিয়ে হিরণদা স্বতন্ত্রভাবে গড়ে তোলেন তাঁর নিজস্ব স্টাইল। এই নিভৃতি না পেলে তিনি আটকে পড়তেন। একাডেমিশিয়ানরা তাঁকে যেভাবে দেখাতেন, তিনি সেভাবেই নির্মিত হতেন আমাদের কাছে। কিন্তু তা ঘটেনি। তিনি অনেকটা বাইরে থেকে বিভিন্নভাবে নিজেকে গড়ে চললেন, আপন খেয়ালে।

‘পূর্ব’ পত্রিকার ‘(অ)ধর্ম’ সংখ্যায় তিনি লিখেছেন, তিনি নাচছেন, নাচতে নাচতে আঁকছেন, শিল্প রূপ নিচ্ছে, কোনো বাঁধাধরা শিল্পধর্মের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখছেন না।

গানের আসরে, পটুয়ার বাউলের আসরে আজ্ঞা পেয়েছেন বসার। ছুটে বেড়াচ্ছেন এ-জগৎ থেকে ও-জগতে। চিত্রজগতের বাইরে থেকেই তাঁর আঁকার প্রেরণা। এখানে জরুরি দুটো ঘটনার উল্লেখ করি।

কলকাতা শহরে বনেদি বাড়িতে তখন প্রায়ই ধ্রুপদী সংগীতের আসর বসতো। অনাহুত হিরণদা রং তুলি নিয়ে গোপনে সেইসব ডেরায় পৌঁছে যেতেন। ছবি আঁকাকে তিনি এক গোপন ক্রিয়া বলেই ভাবেন। এমন এক আসরে পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর মূর্ত বিমূর্ত প্রচুর ছবি আঁকলেন। ছোট্ট খাতা কোলের ওপর রেখে রেখার আশ্চর্য কাজ, তারপর কাজশেষে ছবি বগলদাবা করে সটকে পড়তেন। এভাবে কত ছবি পোর্ট্রেট যে করেছেন।
হারিয়েও গেছে কত!

আরেকটি ঘটনা। সেবার সচিন তেণ্ডুলকর অবসর নিলেন, সেই নিয়ে আলোচনা আর পিছনে ক্যানভাসে ছবি আঁকছেন একের পর এক। ২৪ ঘন্টা চ্যানেলের ঐ অনুষ্ঠান সম্ভবত কবি রাহুল পুরকায়স্থ-র তত্ত্বাবধানে।
একটা ছবি আঁকলেন, বিমূর্ত, তাতে সচিনের অবয়ব নেই, আবার আছেও। একটা গতি, দেহ সঞ্চালন, সচিন হয়তো পুল করছেন, ব্যাটের দ্রুত গতির ফলো থ্রু— চকিতে যেমন হয়, ছবিটিতে সচিন জীবন্ত হয়ে ওঠে।
আসলে সহজ পথ হিরণদা কখনো বেছে নেননি।

এই যে অবয়বহীনতা বা বিমূর্ততা— এই নিয়ে দু-একটি কথা এখানে বলা দরকার। বিমূর্ত মানে তো আমাদের চোখে দেখা যে মূর্ত সসীম জগৎ তাকে ভেঙে ফেলা, তাতে আরও বিস্তার আনা। এখানে দর্শকের অংশগ্রহণ খুব জরুরি। দর্শক যোগ না দিলে বিমূর্ত চিত্র মূর্ত হয়ে উঠবে না। ‘আপাত অবয়বহীনতার যে অবয়ব, তার অবয়ব বা সাযুজ্যের ভিতর যে বিমূর্ততা তা অনুভবের জগৎ। বারবার তাকিয়ে থাকতে থাকতে রূপ নির্মিত হয়।’
তার মানে দৃশ্য দৃশ্যান্তরে যাচ্ছে, এই অবয়বহীনতারও কিন্তু পুরুষ নারী জেন্ডার ভেদ আছে। এখন এই বিমূর্ততা নিয়েই একটু দর্শনের কথা পাড়ি। ‘অবভাস ও তত্ত্ববস্তুবিচার’ গ্রন্থে ‘প্রকৃতি’ অধ্যায়ে দার্শনিক ফ্রেন্সিস হাবার্ট ব্রেডলি লিখছেন, ‘প্রকৃতির সত্তা দ্বিবিধ: মূর্ত সত্তা ও অমূর্ত সত্তা। প্রকৃতির মূর্ত সত্তা হল প্রত্যক্ষের বিষয়ীভূত এবং অমূর্ত সত্তা হল চিন্তা বা বুদ্ধির বিষয়ীভূত।’ সসীম জীবের প্রত্যক্ষ যে জগৎ তা মূর্ত ছবির বিষয় হতে পারে কিন্তু যে প্রকৃতি চিন্তার বিষয়ীভূত ও অসীম— তাকে কীভাবে প্রকাশ করবে সহজ মূর্ত?
তাকে তো বিমূর্তর দ্বারাই মূর্ত হতে হবে! স্বাভাবিকভাবেই সেই ছবি সাধারণ অভ্যস্ত চোখে অবাস্তব মনে হতে পারে। মনে হবে অর্থহীন রেখার জগৎ। কিন্তু সে যদি আমার মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে তবেই বুঝব— ঐ রেখা, ঐ কালো তুলির আঁচড় কোনো অসীমকে প্রকাশ করছে।

কেউ কেউ মনে করেন যে ব্যবহারিক সত্য বা আপাত সত্য ছাড়া অন্য কোনো সত্তা বা বস্তু নেই। অবচেতনে ছবি দেখার সময় এটা কাজ করে বলেই আমরা ঘোড়ার একটা নিশ্চল অবয়বকেই ঘোড়া হিসেবে চিনি; একটা অনুভূতির লক্ষণহীন নারীমূর্তির মধ্যেই নারীর সৌন্দর্য খুঁজি। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে, অর্থাৎ দেখার এই চোখটাকেই যদি বদলে নিতে পারি? যদি ভাবি চোখে দেখা এই অবভাস মাত্রই একমাত্র সত্য নয়! আরও কোনো গভীর সত্য আছে। কিংবা কোনো অমোঘ গতি— যা মুহূর্তে বস্তুর রূপ বদলে দিচ্ছে, ধরতে পারছি না, মানুষের রূপ বদলে যাচ্ছে… আর সেই কাল, সেই অসীম জগৎ, যা সম্ভাবনাময় হয়ে ব্রহ্মাণ্ডে আছে, আছে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে— তাকেই যখন কোনো শিল্পী ঘনিয়ে তুলতে চাইবেন তখন সেই চিত্র বিমূর্ত হবেই।

প্রত্যক্ষভাবে আমি হিরণদা-র এই চিত্রধারা থেকে প্রভাবিত হয়ে অনেক কবিতা লিখেছি, রেখার সেই বিমূর্ত ভাষাকে ধরবার চেষ্টা করেছি কাব্যের ভাষায়।

বছর তিনেক আগে মৌলালির কাছে জেমস সিনেমা হলের ভেতর হিরণদা-র একটা কাজ দেখতে গিয়েছিলাম। অডিও ভিজুয়াল কাজ। শরীর কীভাবে ভাষা দেয়, ইঙ্গিত করে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম কাজটার সামনে— সেখানে শরীর তার নানা ভঙ্গিমায় কথা বলছে। শরীরের ভাষা কিন্তু মুখের ভাষার মতো মিথ্যে বা কপট হয় না। তার আর্তি চিৎকার অকপট হয়, যদি তা আমরা ধরতে পারি।

বিমূর্ত চিত্র দুটো প্রধান জিনিসের ওপর নির্ভরশীল— বিশুদ্ধ মার্গসংগীত ও নানা জ্যামিতিক আকারের কল্পনা। প্রাচীনকালে যাঁরা জ্যামিতি নিয়ে ভাবছেন, আমার মতে তাঁরাও একেকজন বিমূর্ত শিল্পী। আর সঙ্গীত— যা আসলে এই জগৎ ও তার গভীর সঙ্গতিকেই উন্মোচন করে। এই দুটো বিষয়ই কোনো-না-কোনোভাবে বিমূর্ত শিল্পকলাকে প্রভাবিত করে।

হিরণদা এইক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালের একজন অগ্রগণ্য শিল্পী। তাঁর যাত্রাপথ অনেক দীর্ঘ এবং বিস্তৃত। ধীরে ধীরে কীভাবে তিনি আরও বেশি সাংকেতিক ও প্রতীকী করে তুলছেন তাঁর শিল্পকর্মকে, ধারাবাহিকভাবে যাঁরা তাঁর কাজ দেখে চলেছেন তাঁরা টের পাবেন।

পূর্বাপর তাঁর কাজ লক্ষ করলে বোঝা যাবে, তিনি সাদা আর কালো রং খুব পছন্দ করেন, সেইসঙ্গে লালের বিস্ময়কর ব্যবহার। ছবির মধ্যে ছেড়ে রাখা স্পেস যেন এই অসীম জগৎকেই চিহ্নিত করে। কিন্তু তাঁর লালকে উপেক্ষা করা যায় না। কত কত জনের ছবি দেখেছি কিন্তু হিরণদা-র মতো আর কারো ছবির লালই আমাকে এত গভীরভাবে নাড়া দেয়নি, শুধু নাড়া দেয়নি একেবারে মেরে ফেলে। কামনায় রঞ্জিত করে দেয়। হিরণদা-কে একবার বলেছিলাম, আপনার লাল এত ইরোটিক শরীরী হয় কী করে? একজন নগ্ন নারীও আমাকে তত উত্তেজিত করে না। আমি টানটান হয়ে উঠি, তীব্র প্রণয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ি। কীভাবে হয়? রং কীভাবে ক্রিয়া করে আমাদের মস্তিষ্কে?

কবি প্রবালকুমার বসু হিরণদা-র ছবি নিয়ে একটি গদ্যে লিখেছিলেন,
“হিরণ দা-র ছবির লাল রং কি আসলে ক্ষত অথবা এ এক ক্ষরণ?… এই লাল আমার কাছে যেমন হাহাকার আবার তেমনই এক তীক্ষ্ণ উন্মোচন। এই রেখা ধরে কখনো বা আমি পৌঁছে যাই যোনিপদ্মের গভীরে আবার কখনো এই লাল আমাকে পৌঁছে দেয় সেই অবচেতনে যেখান থেকে পুনরায় শুরু হতে পারে।”
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল প্রবাল বসুর ‘জন্মবীজ’ কাব্যগ্রন্থটির কথা। সেখানে ছবি আর কবিতা পাশাপাশি যে যার ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির। এরকম আরেকটি বলিষ্ঠ উপস্থাপন কবি জয় গোস্বামীর ‘ভালোটিবাসিব’। প্রতি পৃষ্ঠায় মোটা তুলির কালো রঙের আঁচড়। শুধু কালোতেই তুলির নানান প্রক্ষেপণে এত শরীরী আবেদন এমন অর্থময় হয়ে উঠেছে! কোথাও কোথাও মনে হয়েছে ভাষা যেন বাহুল্য এখানে। এত বর্ণনা কেন, এত প্রগলভতা দৃশ্য নিতে পারবে না। একটি রেখা, কালো তুলির পোঁচ অনেকবেশি সংবেদন আনতে সক্ষম। যা আমাদের দীর্ঘ কবিতাতেও সম্ভব নয়।

‘আরবানিয়া’-র কাজগুলি হিরণদা-র জীবনের অত্যন্ত জটিল গভীর সাংকেতিক কাজ। একটা শহর, ধ্বসে পড়া শহর, তার অলিগলি, পলেস্তারা খসা পুরোনো দেওয়াল, জমে থাকা জল, আবছা ছায়া, ভাঙা দরজা… সব মিলে যেন একটা সভ্যতার কথা বলতে চেয়েছেন। যেন কত না-বলা অনুভূতি নষ্ট শসার মতো হৃদয়ে ফলে যাওয়া কত কী— সব যেন উঠে এসেছে ‘আরবানিয়া’-র মধ্যে।

রেলিঙের ছায়া, দেওয়ালের ছায়া, আনন্দ, ঘুলঘুলি, পাখির বাসা খড়কুটো এরা কি বাসা হারিয়েছে? কোথাও লালেরা পরস্পর আলাপ চালাচ্ছে। মনে হবে তাদের কথোপকথন দু-জন নারী পুরুষের চেয়েও আরও সজীব সত্য, আরও স্মৃতিভারে জর্জরিত। এখানে বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুষ্কোণ ইত্যাদি নানা জ্যামিতিক গঠন খুব অর্থময়। তারা যেন একটা ক্ষয়ে যাওয়া বিবর্ণ সময়ের কথা বলতেই হাজির হয়েছে।

‘আরবানিয়া’-কে আমি এক ইতিহাস হিসেবে দেখি, অনাবিষ্কৃত ইতিহাস। যে-সময়ের কথা লেখা হয়নি, যে শহর, সভ্যতা আমাদের অজানা হয়েই ধ্বংস হয়ে গেছে। সেইসব সভ্যতার জীবনযাপন আর হারিয়ে যাওয়া লিপি।

লিপি শব্দেই মনে পড়ল— এই শিল্পী লিপি নিয়ে প্রভূত কাজ করেছেন। মনে হবে অর্থহীন পোকাদের সারি, তাদের চলমানতা। আসলে সেই পোকাদের গভীর জীবনযাপনের রূপ ধরে এসেছে লিপির চলমানতা। কত অজানা অতীত থেকে তারা উঠে আসছে তাদের দাবি নিয়ে এবং তারা সব গ্রাস করে নিতে আসছে আমাদের এই চেনা সভ্যতা। একেবারে প্রত্যক্ষ প্রভাবেই আমি একটি কবিতা লিখে ফেলি প্রায় তিন বছর আগে।

“মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই
অজানা লিপিরা পাতার অর্ধেক খেয়ে নেয়।
তাদের উপনিবেশ ছিল কি কোটিবছরেরও আগে!
বহু বংশলোপের পর এবার তারা সোচ্চার হয়েছে।
বন্য পিঁপড়ের মতো উগ্র মিছিল যে জায়গার
দখল নেয়— সেখানে ছিল পাতার অর্ধেক রাজত্ব।
যার ছিল পূর্ণতা, নতুন আবিষ্কারের ন্যায্যতায়
আজ তার অর্ধেক দখলকারীর— বাকিটুকু তার।
ভয় যে, তাদের ক্ষয় আছে, অগ্রসরও…
পাতা কি বাঁচাতে পারবে নিজেকে?
এই আগ্রাসন কিংবা ইহুদিতুল্য পুনরুত্থান দেখে
মানুষও আশঙ্কায় দিন গুনল— একদিন না লিপিরা…”
(গ্রাস)

এই লিপি নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন হিরণদা। হাজার হাজার বছর আগেকার অর্থোদ্ধার না হওয়া অপঠিত লিপি যেন তাদের অর্থ ছিল কোনোদিন, আমরা হারিয়ে ফেলেছি কিংবা আমরা সেই অর্থ থেকে ইঙ্গিত থেকে দূরে সরে এসেছি! লিপি, সংকেত তাদের অর্থ নিয়ে অটুট, মহাকাল তাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।
এই লিপি তিনি ঝুলিয়ে দিলেন গাছে, নদীর ঘাটে, সমুদ্র সৈকতে বা খোলা এক চত্বরে।
শিল্পের ভাষা তার নতুন অর্থ খুঁজে নিতে চাইল।

হিরণদা-র করা পোর্ট্রেটের প্রসঙ্গ এলেই আমার জ্যোতির্ময় দত্ত-র কথাটি মনে পড়ে। ‘মুখ মুখর’-এর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘হিরণ আমার ছবি আঁকেননি বলে রাগ হচ্ছে।… এরকম পোর্ট্রেট যে আমার যুগের কিংবা আগের যুগেরও কোনো ভারতীয় আঁকতে পারেন, জানা ছিল না।’
এই কথায় এতটুকু অতিশয়োক্তি নেই। আমি এই বইটি একসময় কাছে কাছে রাখতাম। বাসে ট্রেনে যখন ইচ্ছে হত খুলে দেখে নিতাম। কী সব মুখ আর তাদের মুখরতা।
জগদীশচন্দ্র বসুর মুখটা যদি দেখতেন সবাই, বুঝতেন— মুখ আর মুহূর্ত কাকে বলে। মুখের একটা পাশ আঁকেননি, অথচ আপনি সেখানে স্পষ্ট দেখছেন অংশটা।

একটি ছবি ওঁর স্ত্রীর। অনীতা মিত্রের। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের দিন ডাঃ আনোয়ারা খাতুনের নার্সিংহোমে। আস্তে আস্তে প্রসব যন্ত্রণা বাড়ছে। অসহ্য হয়ে উঠছে যন্ত্রণা, একটা তীব্র চিৎকার, শরীরে পাক খেয়ে ওঠা, ছটফটানি, শিল্পী-মন সহ্য করতে পারে না, পাশে বসে প্যাডের কাগজেই শুরু করেন আঁকতে। শারীরিকভাবে যে-কষ্ট অসহ্য তা যেন ফুটে বেরোচ্ছে ওই রেখাগুলো থেকে।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, হিরণ তাঁর প্রকৃত রূপটাকেই এঁকেছেন। তাঁর একটি গদ্যগ্রন্থের প্রচ্ছদে এভাবেই এক নগ্ন সন্দীপন। পেছন থেকে আঁকা। সন্দীপনের চরিত্র এতে সত্যি হয়ে উঠেছে।
এই যে রূপকে মুখর করে দেওয়া, এখানে হিরণ মিত্র অনন্য।

২০১১ সালে হিরণদা লন্ডন গিয়ে বেশকিছু ছবি এঁকেছিলেন। হিরণদা-র অভ্যাসই হল যেখানে সেখানে যেকোনো মুহূর্তেই রং তুলি নিয়ে প্রস্তুত। তো জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ রাস্তার এক পাবের টেবিলে বসে আছেন— এক অচেনা সুন্দরী এসে বসল সামনে। কালো পাহাড়ের মতো চুলের ধারা নেমে এসেছে মাথা থেকে। তাকে আঁকলেন হিরণদা, ওখানে বসেই। আমি ঐ ছবিটি দেখি ‘জারি বোবাযুদ্ধ’-র একটি সংখ্যায়। কয়েকদিন ধরে ঐ রমণীর ছবি আমাকে এমনভাবে পেড়ে ফেলে, কোনো বাস্তব নারীও অতটা পারেনি। আমি রাস্তায় চলাফেরায় স্বপ্নের মধ্যে ঐ নারীকে ফিরে ফিরে পেতাম। কী থাকে একটা ছবির মধ্যে?

এই যে যেখানে সেখানে যখন তখন হিরণদা ছবি আঁকেন— এই নিয়ে এক বিপত্তি এবার। ২০১৯-এ আফ্রিকার জাম্বিয়া গেলেন। কঙ্গো বর্ডারের কাছে চিংগোলা শহরে ডেরা বেঁধেছেন। একদিন আবাসনের বাইরে সামনের বাসস্ট্যান্ডে বসেই ছবি আঁকছেন। প্রায় ৭০-৮০-টির মতো ছবি এঁকে ফেলেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি এক বাচ্চা স্কুলছাত্রীর— তাই নিয়ে ঝামেলা।

স্কুল কর্তৃপক্ষ আর আরও কয়েকজনের হৈচৈতে হিরণদা চার পাঁচটি ছবি তাদের দিয়ে দিতে বাধ্য হন। তারা শিল্পীর চোখের সামনেই ছবিগুলি ছিঁড়ে ফেলে। এই ঘটনা শুনে আমি হিরণদা-কে জিজ্ঞেস করি। একজন শিল্পীর কাছে এটা কতটা কষ্টের? উনি বলেন— সেদিন আর একটিও ছবি আঁকতে পারেননি। এমন একটা বিমূঢ় ভাব এসে মনকে তছনছ করে দিয়েছিল। অবশ্য পরেরদিনই রেলিঙের ভেতরে বসে অজস্র ছবি এঁকেছিলেন।

নাটকের প্রসঙ্গে মনে পড়ে হিরণদা বহুবার একথা লিখেছেন, ‘আমি সেই অর্থে নাটকের লোক নই।’
কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতের নাট্য আলোচনা তাঁকে বাদ দিয়ে করা সম্ভব নয়। আজ তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, ফ্যাতাডু, কিং লিয়র, নিঃসঙ্গ সম্রাট, আলতাফ গোমস… একেকটি তো ইতিহাস। এই নাটকগুলির প্রতিটির মঞ্চনির্দেশনাই একেকটা টেক্সট। শুধু অভিনয় নয়, চরিত্র, আলো, মঞ্চ… সব মিলে একটা রসায়ন, যা উপলব্ধি করতে গেলে দর্শকদের দীক্ষিত হতেই হয়। হয়তো মঞ্চসজ্জার কারণেই আমি কিছু নাটক বারবার দেখেছি!
হিরণদা নাটকের মহড়া চলার সময়, নানা মুহূর্তের স্কেচ করে রাখতেন। এরকম বহু স্কেচ আমি দেখেছি। এই স্কেচগুলো থেকেও নাটকের অনুভব হতে পারে, চোখের সামনে নাটকের অভিনয় হতে পারে। একটু কল্পনাশক্তির প্রয়োজন। হিরণদা-র কাছে বরাবরই ভঙ্গির গুরুত্ব খুব বেশি। তিনি লিখছেন, ‘আমার সামনে বাঁশের লাঠিটা ভর করে ত্রিভঙ্গে যিনি দাঁড়িয়ে, পুরুষ অথবা মহিলা, তিনি কি অভিনয় করছেন?’ এই যে বাস্তব জগতেও নাট্যভঙ্গি খুঁজে ফেরা— তা কিন্তু নাটকের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতে সাহায্য করল শিল্পীকে।

একবার আমেরিকায় লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্টে একটি অল্প বয়সী মেয়েকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি ভাবেন— এ নিশ্চিত স্বজনহারা। পাশেই একটা তিন চারজনের দল। একজন বয়স্কার বুকে সে আছড়ে পড়ল, হিরণদা-র বুকটাও মুচড়ে উঠল। তারপর পুরো দলটা সামনে দিয়ে চেক-ইন লাগেজ কাউন্টারের দিকে চলে গেল। যেন মৃত্যুর সাক্ষীরা এক এক করে মঞ্চ ছাড়ল। এই যে মঞ্চটাকে দেখছেন কল্পনায়— এটা তো প্রচ্ছন্নভাবে হিরণদা-কে নাটকের দিকে প্ররোচিত করেছে। না করলে ফ্যাতাডু, নিঃসঙ্গ সম্রাট-এর মঞ্চ করা যায় না।

একটা খেদ আমার। আমি তো নিবিড়ভাবে এই বহুমুখী শিল্পীর নানা বিষয়ে লেখালেখি পড়ে যাচ্ছি। জানি তিনি একজন অসাধারণ ভাষাশিল্পী। আচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে আর কেউ কি এত এত লেখা লিখেছেন? জানি না। অথচ হিরণদা-র লেখালেখি নিয়ে আলোচনা কোথাও চোখে পড়েনি। অনেকে তো তাঁকে কেবল প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেই দেগে দিয়েছেন। কিন্তু প্রচ্ছদ শিল্প তাঁর প্রধান পরিচয়ের ক্ষেত্র নয়। যদিও এ-ব্যাপারেও তিনি নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। থাক, সে-বিষয়ে পরে কখনো লিখব। আপাতত তাঁর লেখার ভাষা নিয়ে দু-একটা কথা বলি।

হিরণদা যেমন যখন যেখানে খুশি আঁকা শুরু করতে পারেন, তেমনি যে-কোনো বিষয়েই তিনি লেখায় পারদর্শী। শিল্পকলার নানা শাখা নিয়ে তিনি অজস্র লেখা লিখেছেন। ‘আমার ছবি লেখা’ তাঁর একটি আশ্চর্য বই। কীভাবে তাঁর চোখে মনে ছবি ধরা পড়ছে, কীভাবে দৃশ্যের পর দৃশ্য জন্ম হচ্ছে তার আশ্চর্য সব বর্ণনা আছে এই বইতে। গদ্যভাষার ক্ষেত্রেও তিনি ভাঙছেন। গদ্যের চলনটা হল— যেভাবে দেখছেন সেইভাবে। তাতে ব্যাকরণগত বাক্যগঠন বা শব্দব্যবহার নয়, একটা নতুন শৈলী।

সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘ঝরা সময়ের কথকতা’ থেকে একটু উদাহরণ দিই:
“…কিন্তু একটা সময় তো আমরা জানলাম, মূর্ততার মধ্যে বিমূর্ত আর বিমূর্ততার মধ্যে মূর্তের বাস। একে আর আলাদা করা গেল না। যে রেখার সম্পর্ক, রঙের বোলচাল, বর্ণ-লেপনের কারুকার্য আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। একটা ছবিকে গড়ে উঠতে দেখলাম, ধীরে ধীরে সাদা কাগজ খননকার্যের মতো, তুলে আনল অদ্ভুত জাদু-সম্ভার, রত্নখচিত অক্ষর, তার উচ্ছলতার নুয়ে পড়া গাছের ডালের মতো, ভূমি স্পর্শ করা দৃশ্যকল্প, এই কিশোর বয়সে, শুধু আবেগতাড়িত শিল্পী মনে আটকে রইল না। এক ভিত্তিভূমি রচনা করে গেল, তাকে আমি স্পর্শ করি, সন্দেহ করি, কীভাবে তবুও তো সংশয় থাকে, পথ আলাদা হয়, আমিও ধীরে ধীরে বিমূর্ত সংসারে বাসা বাঁধলাম।…”
‘মুখ মুখর’-এ ছবির পাশে ছোটো ছোটো টুকরো লেখাগুলো চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে এক ঝলকে।
তুলি আর কলম সেখানে পরস্পর আলাপ করতে থাকে। একটা গভীর পারস্পরিকতা গড়ে ওঠে।
‘ঝরা সময়ের কথকতা’-য় চিত্তপ্রসাদ, রামকিংকর, গোপাল ঘোষ, বিনোদবিহারী প্রমুখের সম্পর্কে লেখাগুলো তো একেকজনকে আবিষ্কারের, তাঁদের শিল্পীমনকে খোঁজার এক এক জানালা।

আমি জানি না এই অন্যমনস্কতার দেশে, অবজ্ঞা আর বিস্মৃতির দেশে কখনো হিরণ মিত্রের মতো বহুমুখী শিল্পপ্রতিভার মূল্যায়ন হবে কিনা! সে-আক্ষেপ করার সময় এখনও আসেনি। তবে আমরা তো জানি, হিরণদা নিজেও জানেন— যে-দেশে সোমনাথ হোড়, চিত্তপ্রসাদরা হুল্লোড়বাজি বিনোদনের সংস্কৃতিতে হারিয়ে যেতে বসেন, সেখানে বেশি আশা করাও ভালো না।

আমাদের তবু আনন্দ সীমাহীন, কেন-না আমরা এখনও চলমান সজীব হিরণ মিত্রকে পাচ্ছি। সটান তাঁর শিল্পময় পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়তে পারছি। হয়তো এতে তাঁর রসভঙ্গ হচ্ছে, কেটে যাচ্ছে তাল কিন্তু সেই অধিকার তো তিনিই আমাদের দিয়েছেন। তিনি যে উদার আসর পেতেছেন— সেখানে আমাদের মতো অরসিকদের বসবার আজ্ঞাও দিয়েছেন। এই আনন্দ লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমি অর্জন করিনি। চাই— তিনি আমাদের এই পোড়া দেশে আরও অনেকগুলো দিন মাস বছর এভাবেই সচলতায় কাটিয়ে দিন।

Facebook Comments

পছন্দের বই