লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রুদ্র কিংশুকের প্রবন্ধ

র‍্যাচেল কারসন ও নীরব বসন্ত

পৃথিবীর পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাসে র‍্যাচেল কারসন (Rachel Carson, 1907-1964) ও তাঁর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ (Silent Spring, 1962) বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। এই গ্রন্থ আধুনিক কৃষির রাসায়নিক নির্ভরতার বিপলগুলিকে চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত থাকে না চিহ্নিত করে ক্ষান্ত থাকে না, বিকল্প পথ ও বিকল্প জীবনচর্চার দিশা উদ্‌ঘাটন করে।

আমেরিকার ব্যুরো অব ফিসারিজ অফিসে একজন সামুদ্রিক জীববিদ (marine biologist) হিসেবে র‍্য‍্যাচেেল ল্যুভই কারসন পেশাগত জীবন আরম্ভ করেন। কিন্তু ১৯৫০-এর দশকেই তিনি হয়ে ওঠেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রকৃতি-চিন্তক এবং প্রকৃতি লেখক। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘দ্যৃ সি অ্যারাউন্ড আস’ (The Sea around Us) এবং ১৯৫৫-তে প্রকাশিত ‘দি এজ অব দ্য সি’ (The Edge of the Sea) তাঁকে একজন অগ্রগণ্য পরিবেশ-ভাবুক লেখক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। প্রথম বইটি পরবর্তীকালে নতুনভাবে ‘আন্ডার দ্যs সি-উইন্ড’ (Under the Sea-Wind) নামে প্রকাশিত হয়। এই বইগুলির জনপ্রিয়তা তাঁকে লেখক হিসেবে আরও বিকশিত করে। তাঁর লেখক সত্তায় যুক্ত হয় একজন সংগ্রামী ও সংবেদনশীল সামাজিক কর্মীর আবেগ ও সুদূরপ্রসারী চেতনা।

তাঁর মনে হয় আমেরিকার একবগ্গা উন্নয়নভাবনা এবং সিন্থেটিক সংস্কৃতি প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সংস্কৃতির ধ্বংস সম্পাদনের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতাকেই সুনিশ্চিত বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ভাবনা ও অনুভবই কথারূপ পেল ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ (Silent Spring)। গ্রন্থের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক উৎপাদী বহুজাতিক সংস্থা ও পুঁজিপতিরা এই বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য উঠে পড়ে লাগল। কারণ, তিনি সিন্থেটিক সংস্কৃতির ভেতর সৃষ্টিনাশী সম্ভাবনাকে এমনভাবে উন্মোচন করলেন যে আমেরিকা-সহ পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানুষ কিছুটা সচেতন হয়ে উঠল। আধুনিক উন্নয়ন ধারণার রঙিন মুখোশও অপসারিত হল। আমেরিকাতে ডিডিটি (DDT) ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষিত হল এবং ইউ এস এনভারমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি গঠিত হল। এটা থেকে প্রমাণিত যে কারসনের প্রভাবে জনমতের তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যা আমেরিকার সরকারি নীতি নির্ধারকদের গভীরভাবে ভাবিত করে।

কীটনাশকের নির্বিচার ব্যাবহার কেবলমাত্র ক্ষতিকর পোকামাকড়দের ধ্বংস করছে না, সমগ্র জীবনকূলের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনছে। ধ্বংস হচ্ছে সবরকমের পোকামাকড় এবং পাখি-সহ অন্যান্য জীব। কারসনের কল্পনায় একদিন এমন বসন্ত আসবে যাকে মুখর করার কোন পাখি থাকবে না। এই বোবা বসন্তকেই দেখতে হবে মানুষকে। মানুষের লোভ, অপরিণামদর্শী উন্নয়ন ভাবনা এবং কৃষিক্ষেত্রে বাধাহীন বিষপ্রয়োগ একদিন অনিবার্য ধ্বংসকে আহ্বান করছে। সেই অপরিণামদর্শী আধুনিকতা ও তার উন্নয়ন-প্রতিশ্রুতির কাউন্টার ডিসকোর্স বা প্রতিবাচন কারসনের বই।

র‍্যাচেল কারসনের বইটির মূল প্রতিপাদ্যকে এইভাবে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যায়:


কৃষিক্ষেত্রে যে-কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে তা কেবল ক্ষতিকারক পোকামাকড়কে ধ্বংস করছে না, ধ্বংস করছে প্রকৃতির অন্যান্য পোকামাকড়দেরও যারা মানুষের কৃষিকাজ ছাড়াও বহু উপকারে লাগে। তাই কীটনাশক (pesticide) আসলে ব্যাপক অর্থে বায়োটিক বা বায়োসাইড (biocide)।


কৃষিতে ব্যবহৃত ডিডিটি খুব সহজেই খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ে। মানুষ-সহ বহু প্রাণী এই অদৃশ্য বিষক্রিয়ার শিকার হয় পৃথিবীর সমগ্র জীবন ও স্বাভাবিকতা অনিবার্যভাবে ভেঙে পড়তে থাকে।


কারসনের অভিমত ডিডিটি-র মতো ক্ষতিকারক কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। সিন্থেটিক বা রাসায়নিক বিষ সমগ্র পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই কোনো বায়োলজিক্যাল বিক্রির কথা ভাবতে হবে আমাদের।

ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা। কার্ল মার্কস-এর ‘দাস ক্যাপিটাল’ চার্লস ডারউইন-এর ‘অরিজিন অব স্পিসিস’, হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’-সহ আরও কয়েকটি। এই তালিকায় অবশ্যই সংযোজিত হবে কারসন-এর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। আধুনিক উন্নয়ন ধারণার গভীরে মানব সভ্যতার ধ্বংস বীজের অবস্থানকে কারসন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে রেখেছেন এবং জীবনচর্যার একটি বিকল্প মডেলের কথা বলেছেন। লিন্ডা লিয়ার (Linda Lear) লিখছেন: Silent Spring translated the central truth of ecology: that everything in nature is related to everything else.

রেনেসাঁ ও আধুনিকতা সবার উপরে দেখেছে মানুষ আর তার অপরিমেয় লোভকে। প্রকৃতির যাবতীয় সম্পদ যেন-বা মানুষের ভোগের জন্যই নির্দিষ্ট। এই এককেন্দ্রিক মানব-কেন্দ্রিকতা পৃথিবীতে প্রতিদিন বিনাশের কিনারে ঠেলে দিচ্ছে। মানবকেন্দ্রিক আধুনিকতার ডিসকোর্স-এ প্রকৃতি ‘অপর’ (other) বা ‘উপনিবেশ-শাসিত’ (colonised) যা ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের ক্ষুধা ও শখের অগ্নিগহ্বরে সম্পদের যোগানদার। মানুষের এই আধুনিক মনোভঙ্গি কেবলমাত্র প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে না, মানুষের ধ্বংসের পথও প্রস্তুত করছে। কতিপয় মানুষের কৃতকর্মের শিকার হচ্ছে সমগ্র মানব সভ্যতা।

প্রকৃতিকে নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে। আত্মবিনাশী আধুনিক প্রযুক্তি মানুষের সাময়িক স্বস্তি-সুখের কারণ হলেও তার ভবিষ্যৎ পরিণতি ভয়ংকর। সাইলেন্ট স্প্রিং-এর শেষ অধ্যায়ে কারসন লিখেছেন: The control of nature is a phase conceived in arrogance, born of the Neanderthal age that nature exits for the convenience of man.

কারসনের এই বই আমাদের ভোগবাদী, আধিপত্যবাদী মনোভঙ্গির বিপদ এবং তার বিকল্প কৃষি ও জীবনচর্যার দিশা দেখিয়েছে।

বিকল্প পথেই আছে মানব সভ্যতার মুক্তি। পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ এবং পৃথিবী জুড়ে ভোগবাদের মহা আয়োজনের ভিতর যে চোখ ধাঁধানো আলো তার আগ্রাসী প্রচারকে উপেক্ষা করে মানুষকে শুভবোধে জেগে উঠতে হবে। লিন্ডা লিয়ার লিখেছেন: In Silent Spring Carson gave these cultural qualities a historical context, protested their effects, warned against complacency, and offered a new ethic and a practical sort of hope. Hers is a message that we in the twenty-first century must find the courage to head.

র‍্যাচেল কারসন প্রকৃত অর্থেই একজন অগ্রগণ্য ভাবুক। তা়ঁর নতুন চিন্তা-চেতনার বইগুলি মানুষকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় ভাবনায় চালিত করে। সাইলেন্ট স্প্রিং ও আন্ডার দ্য সি- উইন্ড— এই বই দুটিতে মেলবন্ধন ঘটেছে প্রকৃতি-ভাবনা, দার্শনিকতা এবং সংবেদনশীল কবিত্ব। ২০০৭ ছিল তাঁর জন্ম-শতবার্ষিকী। কিন্তু র‍্যাচেল-এর বইগুলো পড়লে মনে হয় তাঁর ভাবনাগুলি তীব্রভাবে সাম্প্রতিক। তাঁর রচনা এখনও আমাদের আধুনিকতা বিভ্রান্ত ভোগবাদী পৃথিবীর কাছে আলোকবর্তিকা স্বরূপ।

Facebook Comments

পছন্দের বই