রণজিৎ অধিকারীর গদ্য
বাল্যকাল কিংবা এক কাল্পনিক অতিভুজ
কিন্তু হারমোনিয়ামটা গেল কোথায়! মালপত্র নামানোর সময় দেখা গেল বাকি সবই আছে— ডুগি তবলা, খোল, বাঁশির লম্বা ব্যাগ, তার সানাই, আমাদের পোশাক-আশাকের ব্যাগ… শুধু হারমোনিয়াম নেই।
এদিকে গানের আসরের সময় হয়ে এল, এখন উপায়!
গ্রামের নাম মনে নেই, ঝাড়গ্রাম থেকে শিলদা যাওয়ার পথে, শিলদার একটু আগের একটা বাস স্টপে নেমে ডান দিকে জঙ্গল পেরিয়ে কয়েক মাইল ঢুকে এসেছি আমরা। সন্ধ্যের আগে আগে আমাদের মালপত্র আনার জন্য এখান থেকে গোরুর গাড়ি পাঠানো হয়েছিল। সবকিছু গাড়িতে তুলে দিয়ে আমরা ঝাড়া হাত পা পেছনে হেঁটে হেঁটে আসছি। বাবা দলের অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। আমি একটু আগে আগে। দু-দিকে শালের জঙ্গল ঘন হয়ে এসেছে, আধো জ্যোৎস্নায় সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছে বছর পনেরোর চোখ। নুড়িভরা উঁচু নীচু পথে চলতে হোঁচট খেতে হয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর চোখ সয়ে গেলে অসুবিধা হয় না। কথা বলতে বলতে আমরা কখনো গাড়ির চেয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ি, আবার কাছাকাছি হই… বয়স্করা এত কথা বলে কেন?
ওরা দেখে কম, বলে বেশি।
গ্রাম থেকে যে-লোকটি আমাদের আনতে এসেছিলেন, তিনি শোনাচ্ছেন, কেমন ধর্মপ্রাণ তাঁর গ্রাম, কবে কোন কীর্তনীয়া এসে পরপর পনেরো দিন আসর করতে বাধ্য হয়েছিলেন, শ্রোতারা কেমন মুগ্ধ হয়ে রাত জেগে গান শোনে… দেখবেন আসন ছেড়ে কেউ উঠে যায় না… আপনার গান হবে বলে সকাল থেকে মাইকে প্রচার চলছে। টুকরো টুকরো এমন সব কথাই মনে আছে। অন্তত ২৬-২৭ বছর আগের কথা।
কিন্তু এখন উপায়? বাবার খুব সখের চেঞ্জার হারমোনিয়াম। চেঞ্জার হারমোনিয়ামে কীর্তন গাইতে তখন আর কোনো কীর্তনীয়াকে আমি দেখিনি।
সাধারণত কীর্তনে সিঙ্গল বা ডাবল হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হত। শুধু জুড়ি বা জুড়ি হায়ার রিডের প্রচলন ছিল।
অবশ্য হারমোনিয়াম নিয়ে বাবাকে খুব চিন্তা করতে দেখলাম না। বলল— গ্রামে কোনো হারমোনিয়াম নেই? এনে দিন, তাতেই গান হবে।
পাওয়া গেল কেষ্টযাত্রার দলের একটা সিঙ্গল হারমোনিয়াম।
সারা গ্রাম ভেঙে লোক এসেছিল সেদিন পালাকীর্তন শুনতে। বাবা অনেকবার বলেছে আমাকে যে— সেদিন না কি আমি চমৎকার খোল বাজিয়েছিলাম। অবশ্য ওই বয়সে যা-ই বাজাই শ্রোতারা প্রশংসা করত। পরপর তিন দিন সেখানে আসর হল, তারপর আবার চললাম ফুলকুসমার পথে। কিন্তু সেদিনের সে-হারমোনিয়াম রহস্যের উন্মোচন আজও হয়নি।
২
এই মধ্যবয়স থেকে যখনই নিজের লম্বিত জীবনের দিকে তাকাই— অবাক হই। কেমন ছিল সেই বাল্যকালের চোখে দেখা জগৎ? আজকে যা দেখি, যেভাবে চারপাশের জগৎ আমার সামনে প্রতিভাত হয়— তা এতটাই আলাদা যে, বুঝি সেইসব দিনের সঙ্গে একটা বড়োসড়ো ফারাক ঘটে গেছে কীভাবে যেন! আমি, আমার দেখা দৃশ্য আর উপলব্ধির। সেদিনের ‘আমি’ থেকে আজকের ‘আমি’ পর্যন্ত যদি একটা রেখা টানা যায় আর সেদিনের ‘আমি’-র থেকে সেইসব দিনের উপলব্ধ জগৎ পর্যন্ত আরেকটা রেখা আঁকি— দুটো রেখা মিলে একটা কোণ তৈরি করে না কি? যত দিন যায় বাল্যে দেখা জগতের সঙ্গে এই আমি-র দূরত্ব বাড়তেই থাকে, যেন একটা ক্রমপ্রসারমান কাল্পনিক অতিভুজ… হায়, কখনোই যা যুক্ত হবে না, কোনো রেখা দ্বারাই!
কত কিছুই যে বদলে যায়! ধারণাগুলো পালটায়… মনোভঙ্গি, বিশ্বাসের ধরন…।
তবু সেইসব দিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে, হারায় না। আমার… আমাদের মতো সাধারণের তুচ্ছের জীবনেও তারা কত ঝলমলে। কোনটা লাল, কে-বা গাঢ় নীল, মুখ করুণ করে থাকা দিন, বাঁকাচোরা, বেদনার, তুমুল সুখের কিংবা হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করা ভালো লাগার দিন…। এক বালক শালবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একা, বনের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভয় পায়, ছোটে… হয়তো এটুকুই মনে পড়ছে এত দূর থেকে, তার আগের পরের আর কিছুই মনে নেই, অন্ধকার।
তবু সেই ছবিটির কী অসীম মূল্য আমার কাছে!
বাবার এক অল্পবয়সী শিষ্য, তার কথা মনে পড়ছে। তখন সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো, পড়া ছেড়ে দিয়েছে, বাড়িতে থাকে না, টো টো করে ঘুরে বেড়ায় তাই বাবা তাকে সঙ্গে নিয়েছে। কিন্তু আমার তাকে ভালো লাগেনা একটুও, একেবারেই সহ্য করতে পারি না।
সে বাবার আজ্ঞা পালন করে, আমাকে খুশি করার চেষ্টায় থাকে। বাবার কথামতো তার সঙ্গেই ঘুরতে বেরোতে হয়, একা কোথাও যাওয়ার সুখ নেই আর। বিরক্ত হয়ে থাকি তার ওপর। হারমোনিয়ামটা আমি তুলতে পারি না, সে অনায়াসে সেটা তুলে আসরের মাঝখানে রেখে আসে। আমি অল্পবয়সের ঈর্ষায় পুড়তে থাকি। মনে অশান্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াই, খাই, বাজাই।
বাবা অবসরে তাকে তবলা শেখাতে বসে, তার খ্যাংরা কাঠি আঙুলে কোনো বোল ফোটে না দেখে আমার আনন্দ হয়। আড়ালে হাসি। কী বিচিত্র মানুষের মনের রূপ!
মেট্যালা থেকে লাল রাস্তা ঢুকে গেছে গভীর জঙ্গলের ভেতর, আমরা ওই পথেই সেদিন হুমগড়ের কাছাকাছি একটা গ্রামে যাচ্ছি। বড়ো শালগাছগুলো কেটে নেওয়ায় কোথাও কোথাও বেশ ফাঁকা। হয়তো কাছাকাছি কোনো গ্রাম আছে, কিন্তু দেখা যায় না, ছেলেদের চিৎকার ভেসে আসে, মহিষ চরে বেড়াচ্ছে। বিকেল শেষ হয়ে আসছে, তখন এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছই, রাস্তাটা নেমে গেছে, ঝোরামতো, জল পেরিয়ে যেতে হবে।
বাকিরা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে পেরোনোর প্রস্তুতি নেয়।
কিন্তু আমি? বাবা বলল— মনু, তুমি ভাইকে ধরে পার করে দাও। বলা হল ধরতে কিন্তু সে তখন আচমকাই আমাকে ঘাড়ে তুলে নিল, ওই শরীরে কী শক্তি তার!
কিন্তু আমি কেন পারলাম না একাই জল পেরোতে?
এই সুযোগে ও আমাকে কব্জা করতে চায়? কিন্তু কয়েক মিনিট ওর কাঁধে চেপে জল পেরোতে পেরোতেই ওকে ভালোবেসে ফেললাম। বাল্যকালের চোখের জল কী বিশুদ্ধ! তারপর থেকে সে যে কী আপন হয়ে উঠল আমার! যেখানে যাই, সে সঙ্গে যায়, যে-কোনো সমস্যা থেকে সেই উদ্ধার করে। যোগাযোগ ছিল অনেক দিন।
পরে একসময় খবর পাই বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দিকে না কি মাওবাদীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল, পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়েও ছেড়ে দেয়। তারপর কিছুদিন তার খোঁজ কেউই পায় না। বেশ কিছুদিন পর জঙ্গলের ভেতর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। কেন কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল? কে তার উত্তর দেবে?
তার কথা যখনই মনে পড়ে— বাল্যকাল থেকে আজকের এই আমি পর্যন্ত টানা যে-কাল্পনিক রেখা তা আরও টানটান হয়ে ওঠে, ব্যথায় টনটন করে ওঠে।
না, তার জন্য নয়, এই কান্না এক বিশুদ্ধ উপলব্ধির।
৩
ঘটনাটি ঘটেছিল কোথায়— ছাতনা না কি বিষ্ণুপুরে?
ও-সব দিকে তখন রামায়ণ গান বা পালাগান শুনতে লোক হত দেখবার মতো। মাঝে মাঝে আমার ভয়-ভয়ই করত, বুক দুরুদুরু…। পারব তো এতজনের সামনে বাজাতে? অবশ্য গান শুরুর কিছুক্ষণ পরেই বেশ হাত জমে যেত, তখন এত এত দৃষ্টির সামনে বাজাতে ভালোই লাগত।
কিন্তু সেদিন গান শুরুর অল্প কিছু পরেই বিপত্তি ঘটল।
এমন আর কখনো ঘটেনি।
একজন সমীহ করবার মতো বনেদি চেহারার প্রৌঢ় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে বললেন— এভাবে আপনি পালাগান করতে পারেন না।
বাবা থামিয়ে দিলেন গান, ভালো করে বুঝতে চাইল তাঁর বক্তব্য।
যা বুঝলাম, বাবা গানের মধ্যে যে-রাগরাগিণীর আরোপ করছে, তা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। কৃষ্ণবিষয়ক গান বিশুদ্ধ সুরে গাওয়া উচিত ইত্যাদি।
বাবা কীর্তন শিখবার আগে কিছুকাল মার্গ সংগীতের চর্চা করেছে। শুনেছি, বাবার ঠাকুরদার আমল থেকে আমাদের বাড়িতে ধ্রুপদী সংগীতের চর্চা, তার প্রভাব পড়েছিল বাবার মধ্যে। আমি লক্ষ করতাম, একেকদিন বাবা একটু বেশিই রাগ-রাগিণীর ব্যবহার করত। আর সেদিন আমাকে খোল রেখে বেশি তবলা বাজাতে হত।
তবে সেদিনের মতো আর কখনো ঘটেনি। বাবা তৎক্ষনাৎ আসর ত্যাগ করল, একটা গুঞ্জন শুরু হল শ্রোতাদের মধ্যে। অনেকে সেই মানুষটির ওপর বিরক্ত হলেন। কর্তৃপক্ষ এসে বারবার অনুরোধ করলেও বাবা কারো কথাই শুনলেন না।
৪
একটি মতে বাঁকুড়ার ছাতনা শহরে যে-বাশুলী মন্দির আছে, সেখানেই চণ্ডীদাস সাধনা করতেন। সেই মন্দিরের পিছনে একটি লাগোয়া ঘর, আমরা একবার ওই ঘরটিতে টানা পনেরো দিন থেকেছি। মন্দিরের সামনে আটচালা তারপর মাঠ, মাঠ ঘেঁষে পিচ রাস্তা চলে গেছে, রাস্তার ওপারে একটি ছোটো পুকুর। কথিত যে, ওই পুকুরেই রামী রজকিনী কাপড় কাচতে আসত। আমরা দিনের পর দিন ওই পুকুরে স্নান করেছি। কিন্তু সবসময়ই মনে হত, গল্পে শোনা পুকুর কেন এত ছোটো হয়! কল্পনা আমার বাধা পেত।
অবশ্য আমার এই বালকোচিত কল্পনার সঙ্গে ঐতিহাসিক সত্যের কীই-বা সম্পর্ক!
এখানে আসর বসত সন্ধ্যের মুখে মুখে এবং গান শেষ হত রাত দশটার মধ্যেই।
প্রচুর নানা বয়সের মহিলা গান শুনতে আসত।
তারা কখনোই বাজনার মান বিচার করত না।
একটি অল্পবয়সী ছেলে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে কখনো শ্রীখোল কখনো তবলা বাজাচ্ছে— এটাকে তারা বিস্ময়মিশ্রিত মুগ্ধতা দিয়ে দেখত।
পুরুষ শ্রোতারা এই ব্যাপারটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না। বরং তাদের মধ্যে অনেকেই থাকত কীর্তনের প্রকৃত সমঝদার।
তো তখন সাধিকা রাধার চরণ পাবে বলে কৃষ্ণের চূড়া বামে হেলছে…
চূড়া বামে-এ-এ হে-এ-লে-এ বামে হেলে-এ।
কৃষ্ণের চরণ পাবে বলে।
বামে হেলে চূড়া-আ-আ বা-আ-মে-এ হেলে-এ।
কৃষ্ণের চর-অ-অ-ণ পা-আ-বে-এ বলে…
আর গলার মালা তখন?
আপনি দোলে মালা আপনি দোলে
গলার গুণ কি মালার গুণ…
দোলে মালা সে যে
ধীর লয় থেকে পরের গানেই আমার হাত দ্রুত লয়ে বোল তুলত খোলে।
প্রাণ খুলে বাজিয়েছিলাম কি সেদিন? গানের আসর ভাঙতেই প্রৌঢ়া ক-জন মা মাসির মতো আদল তাদের— এসে আমাকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নেয়। আর বল লোফালুফির মতো এ-কোল ও-কোল হতে হতে কখন তুলনায় অল্পবয়সীদের কোলে পৌঁছে গেছি। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল কিন্তু এমন একটা অনুভূতি যা আগে কখনো হয়নি, অজস্র নারীর চুম্বন আর তাদের শরীরের ঘনিষ্ঠ স্পর্শ আমাকে এক নতুন সুখানুভূতির কাছে নিয়ে গিয়েছিল— অনেক পরে যখন স্পষ্ট যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, যৌবনের দিনগুলিতে তা যেন একটা আর্তিই বয়ে এনেছে আমার কাছে কিন্তু সেদিনকার সেই দমবন্ধ হয়ে আসা সুখানুভূতি আমাকে নতুন অপূর্ব একটা জগতের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল। তখন সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি— সেদিনের সেই সমবেত আদরের কথা যখনই মনে পড়ে, আবিষ্ট হয়ে পড়ি। ভাবি যে, আমার এই ছোট্ট সংগীতজীবনের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার হয়তো পেয়েছিলাম সেদিনই।