লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাসের গল্প

মাগুর

সজনে পাড়তে লম্বা বাঁশের ডগায় কাচিয়া দাঁও বেঁধে নিয়েছে শরিফ। রান্নাঘরের ছোটো জানালা দিয়ে এ-সব দৃৃৃশ্য আমি দেখছি। বাঁশের আগালি ফাঁটিয়ে সামান্য ফাঁক করে নিয়েছে ও। ওটা সজনেডাঁটার একই বৃন্তকে ফ্যাঁচাকলে আটকানোর কৌশলগত প্রক্রিয়া। আর ফ্যাঁচাকলের সামান্য নীচে চকচকে ধার দেওয়া কাচিয়া দাঁও। সেটা দিয়ে সজনে পারার পর ডালগুলোকে কেটে মাটিতে ফেলা হবে।

এ-সব আমি দেখছি জানালা দিয়ে। শরিফ মানে আমাদের বাড়ির পার্মানেন্ট লেবার। ও, প্রথমে উঁচু থেকে নীচুতে আসবে সজনেডাঁটা পারতে পাড়তে, আর ডালগুলোকে কাটতে কাটতে। এটা ওর বুদ্ধিগত কৌশল। দেখলাম— বাড়ির সীমানা ঘেঁষা নীচু প্রাচীরে ও তরতর করে উঠে গেল। এরপরই দুই হাতে লগ্গা বাঁশকে ধরে ওর মাথার ওপরে উঠাল। এটা করতে গিয়ে শরিফ গাছের মোটা কাণ্ডের গায়ে এরপরে ওর বুককে ঠেকালো ব্যালান্সের জন্য। আর তক্ষুনি সেই ভয়ংকর কাণ্ডটা ঘটে গেল! হঠাৎই ও লগ্গা বাঁশকে ছেড়েই প্রাচীর থেকে বাগানে লাফ দিয়ে ওর গেঞ্জির তলায় হাত ঢুকিয়ে চুলকোতে শুরু করল। শরিফ এবার লাফাচ্ছে! চুলকোচ্ছে ওর বুক, পিঠ, পাছা, সর্বত্রই জোরে জোরে! একটা গভীর ষড়যন্ত্রের নক্সায় গাছময় সংঘবদ্ধ শুঁয়াপোকাই শরিফের আততায়ী! আমি লক্ষ করছি— বেচারা শরিফের বদলে কখন যেন এক মস্ত শুঁয়াপোকা নিজেকেই নিজে চুলকোচ্ছে! খামচাচ্ছে! নখ দিয়ে নিজের শরীরকে নিজেই রক্তাক্ত করছে।

ছবি: ইন্টারনেট

কিন্তু আমি! আমি তো বাইরে বেরোতে পারব না! আমি তো এই ছোটো পরিসরে, এই ছোটো রান্নাঘরে, এমনকী আমি আমার নিজের শরীরের ভেতরে নিজেই বন্দী! আমার চারিদিকে আমারই এখন কড়া নজরদারি! যেন, কোনোভাবেই আমি আমার এই শরীর থেকে বেড়োতে না পাড়ি।
শরিফ এ-সব জানে না। ও কেবলই জানে, এই বাড়ি ভাঙা হবে। আর এখানে এরপর মস্ত এক বাড়ি তৈরি হবে। তার আগে এইসব গাছভরতি সজনেডাঁটা তাকে পাড়তে হবে। তারপর গাছগুলোকে সমূলে কাটতে হবে। এরপর এ বাড়ির কাঁঠালগুলো পাকবে। সেগুলোকেও সেই-ই পারবে। গাছটাকেও কেটে ফেলবে! তারও আগে আমগাছ থেকে খুবই যত্নে একটা একটা করে ল্যাংড়া আমগুলোকে পাড়তে হবে। অবশ্য নারকেল গাছে এখন ডাবভরতি হয়ে আছে। শরিফ কোমরের সাথে নাইলনের মোটা দঁড়ি দিয়ে তৈরি কাছির সাথে নিজেকে বেঁধে নিয়ে, তারপরে গাছের সাথে বাঁধবে। তখন, শরিফ মানে— একটা দঁড়ির শক্ত বাঁধন। আর শক্ত বাঁধন মানে— ভূমিকে স্পর্শ করে থাকা আর আকাশ ছুঁতে চাওয়া একটা লম্বা রেসের নারকেল গাছ! তাহলে, ব্যাপারটা কী হল? শরিফ-দড়ি-নারকেল গাছ! অথবা, নারকেল গাছ-দড়ি-শরিফ! তাহলে দাঁড়াল এটাই— শরিফ মানে, একটা শক্ত বাঁধনের কাছি— দড়ি থেকে দীর্ঘ পথচলা একটা নারকেল গাছ! এরপর, নারকেল গাছ হয়ে যাওয়া একজন শরিফ মানুষ, সে নিজেই!
ও এরপর নিজেকে, অর্থাৎ নিজের শৈশবের বিমূর্ত রূপের ডাব ফলগুলোকে কাঁদি-সহ কেটে কেটে মাটিতে ফেলবে। অর্থাৎ নিজেকেই বৃন্তচ্যুত করে ভূমিতে ফেলবে।

একাকার হয়ে যাচ্ছে শরিফের সারা শরীর। লাজলজ্জার পতন ঘটে গেছে চুলকোতে চুলকোতে। এমনই পতন, যেন কোনো বড়ো রকমের ডিজাস্টারের পরে শেয়ার বাজারের সূচকের পতন। আর পারছে না ও। এইবার এক্কেবারে উলঙ্গ হয়ে গেল শরিফ। শরিফ মানে গুচ্ছ গুচ্ছ শুঁয়াপোকার একটা মস্ত বড়ো সংস্করণ! সমস্ত শরীরময় অজস্র শুঁয়া! সেগুলো থেকে রেচন পদার্থের রূপকের মতো লালা বেরোচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি— এক দীর্ঘ লালার নদী! এঁকেবেঁকে গড়ানের দিকে এগোচ্ছে। আর কচুরিপানাকে যেভাবে বহন করে, তেমনভাবেই অজানা এক খিদেকে বহন করে নিয়ে বইতে বইতে এগোচ্ছে আমার রান্নাঘরের দিকে সেই লালা রসের নদী। এ-সব দেখে আমিও আমার ছোট্টো পরিসরে পিছোচ্ছি এক পা দু-পা করে! কিন্তু তাতে কী হবে? আমার পরিসর, এই বাড়ির পরিসর তো মাত্র দু-হাজার স্কয়ার ফিট! আহা! কত সখ আমার! এ-পাড়ার অন্যদের মতো আমারও একটা দু-হাজার স্কয়ার ফিটের বড়ো বাড়ি হবে। তার চাইতেও বড়ো কথা— আমার সবচাইতে প্রিয় একটা স্পেসিয়াস রান্নাঘর হবে। সুন্দর সাজানো-গোছানো কিচেন! একটা বিশাল ডাইনিং টেবিল! ও-পাশে হাইরোডের দিকে মুখ করা ড্রয়িংরুমে টেলিভিশন আর বসবার জন্যে মডার্ন, এক্কেবারে পোস্ট-মডার্ন আর্ট ক্যাম্পে আমার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বসবে। কথা বলবে খিদে বিষয়ক! নানারকমের বিশ্বকেন্দ্রিক খিদে বিষয়ক ইনফরমেশন কমিউনিকেট করবে নিজেদের মধ্যে। আর সে-সব ছুঁয়ে যাবে রান্নাঘরের সর্বময় কর্ত্রী হিসেবে আমাকে। এ-সব ভাবতে ভাবতে কখন যেন সেইসব তথ্যের ওপরে ধপাস্ করে বসে পড়লাম আমি। শুনতে পাচ্ছি, চারিদিকে ভাঙনের মতো শব্দে কাঁঠাল গাছটা কাটা হচ্ছে। পাকা কাঁঠালের মাতোয়ারা ভক্ত হয়ে আমাদের পাশের বাড়ির বড়ো ছেলে স্বাধীন ঘোষ এসে হাজির। উনি গাছতলায় এসে দাঁড়াতেই আমার স্বামী ওনাকে একটা চেয়ার দিয়ে বসতে বলে বললেন— বসুন স্বাধীনদা। সবগুলো কাঁঠাল পারা হয়ে গেলে এর মধ্যে থেকে বেছে আপনি বড়ো দেখে একটা কাঁঠাল নিয়ে যাবেন।

এ-সবই আমি বন্ধ রান্নাঘর থেকে দেখতে পাচ্ছি। স্বাধীনদা গল্প করছেন— ‘সার্ভিস বুকে ঊনপঞ্চাশ। কিন্তু আটচল্লিশে জন্ম বলে জেলায় প্রথম মদের লাইসেন্সই দীপক রায়ের প্রতিবেশী সোমশঙ্কর সেন আমার নাম রেখেছিলেন স্বাধীন। একই বছরে ওনার মেয়েও জন্মেছিলো। উনি মেয়ের নাম নিজেই রেখেছিলেন ভারতী। আমরা সোমশঙ্কর বাবুর বাড়ির ভাড়াটে হয়ে দেশভাগের সময় ওনার বাড়িতে ছিলাম। এরপর সরকার থেকে কলোনি তৈরি করলে আমরা কলোনিবাসী হই। তোমাদের এই জায়গাটা একটা জলা ছিল। কত মাছ ধরেছি সেই জলাতে!’
আমি শুনছি সেইসব পুরোনো দিনের খবর। স্বাধীনতার গল্প স্বাধীনদার কাছ থেকে। আর তথ্যসূত্রগুলোর ওপর বসে বসে আমি দেখছি— স্বাধীনদা নিজের হাতে বঁড়শিতে গেঁথে শিঙ্গি-মাগুর মাছ তুলে খালুই-এ রাখছে। আর, দেখতে দেখতেই খালুইভরতি হয়ে যাওয়া পিচ্ছিল কাদাতে স্বাধীনদা কখন যেন একটা মাগুর মাছ হয়ে গেল।
আমার স্বামী চিৎকার করে বলে উঠল— এই দ্যাখো গো! স্বাধীন— পিচ্ছিল একটা মাগুর মাছ কীভাবে যেন প্রাচীরের পেছনে থাকা হাইড্রেন থেকে গাছতলায় লাফিয়ে উঠে পড়েছে! আমি বন্ধ অবস্থায় বলতে চাইলাম— পিচ্ছিল স্বাধীন মাগুরটাকে ধরো! ওটা মেরে আমার রান্নাঘরে স্বাধীন-মাগুরের রসিয়ে কসিয়ে ঝাল রান্না হবে!
কিন্তু কোথায় আমার গলার স্বর ! আমি যে এখন বহুরৈখিক বিভঙ্গে ভেঙে যাওয়া অজানা কোনো আলোর সাথে মিলে যাচ্ছি ক্রমশই!

ওদিকে শরিফের অজস্র শুঁয়া থেকে বেরানো লালার নদীটা ততক্ষণে আমার রান্নাঘরে ঢুকে পরেছে। নদীর জলে কামের মতো অসংখ্য কচুরিপানার দাম। এইবার ওরা আমাকেও বানভাসি করে ছাড়ল।
একটিই পরিধেয় কাপড়ের ব্লকপ্রিন্টের থেকে অজস্র শরীফের শুঁয়া আমার শরীরকে আক্রমণ করল। আর কোনো উপায় নেই এবার আমার! শরীরময় লাল চাকা চাকা কামসূত্র! সাংঘাতিক চুলকানো শুরু হল এইবার আমার শরীরে। এত চুলকানো যে, অবশেষে আমি আমার একমাত্র পরিধেয় কাপড় খুলে ফেলে উড়িয়ে দিলাম বন্ধ রান্নাঘরের ভেতরে।

এখন আমি সম্পূর্ণভাবে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট ফর্মের মতো উলঙ্গ নারী। ওদিকে উলঙ্গ শরিফও! মানে আমি ও শরিফ দু-জনেই চুপচাপ নিজেদের ভেতরে অসম্পূর্ণ বিলাপ করে কেঁদে উঠলাম কাঁঠালগাছের নীচের মাগুর মাছের দিকে তাকিয়ে। দু-জনেই বলে উঠলাম— পিচ্ছিল ওই স্বাধীন মাগুর মাছটাকে কেউ ধরতে পারল না!

আমি আর শরীফ অজস্র শুঁয়ার তাড়নায় জর্জরিত হয়ে দু-জনেই দু-জনকে জড়িয়ে ধরলাম। মানে, আমরা দু-জনে তখন এক হয়ে গেলাম।
শরিফ মানে আমিই! আর আমি মানে শরিফ।

শরীফ— আমি, এই প্রথম আমার নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শুনছি। প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে আকাশ বাতাস আর আম কাঁঠাল, সজনে, নারকেল গাছের মায়াময়ী বসতভিটে এগোচ্ছে ওই হাইড্রেনের নোংরা গন্ধের থিকথিকে কাদার দিকে, যেদিকে অনেকক্ষণ আগে কালো রঙের পিচ্ছিল মোটাসোটা স্বাধীন দেশের জলাভূমির মাগুর মাছটা লাফ দিয়ে মিলিয়ে গেছে কোনো কাদার অতলে।

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাসের গল্প

পছন্দের বই