হাফিজ়ের কবিতা: শাসনের বিরোধাভাস
ভাষান্তর: রূপায়ণ ঘোষ
[হাফিজ় শিরাজী। ১৩১৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পারস্যের শিরাজ শহরে তাঁর জন্ম। হাফিজ় মূলত একজন সুফি কবি, তথাপি যে-কোনো প্রকার অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের কট্টর সমালোচক ছিলেন তিনি। তাঁর গজ়লগুলিই সর্বাধিক বিখ্যাত। প্রেম, সুরা এবং ক্ষমতার উন্মত্ততার কথা হাফিজ়ের কবিতায় বারবার ফুটে উঠেছে। এক প্রকারভাবে তাঁর কবিতাকে বলা যায় শাসনের বিরোধাভাস— যা জীবনকে শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন পরমানন্দ চেতনার সন্ধান দেয়। ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভূমি শিরাজ শহরেই ৭৫ বছর বয়সে তাঁর দেহাবসান হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘দিওয়ান-এ-হাফিজ়’।
এ প্রণয় সহজ নয়
চলে এসো শুঁড়ি, রেখো না বসিয়ে
হাতে হাতে দাও পূর্ণ পেয়ালা;
আগে ভেবেছি প্রেম কী সহজ—
আজ দেখি তাতে দহন জ্বালা!
চিকুরগুচ্ছে কস্তুরীঘ্রাণ
এসেছিল ভেসে ভোরের হাওয়ায়
চমকানো তার বিজোড় অলক
হৃদয়ে তুফান নৌকো ছোটায়।
হে প্রিয়তমা, পান্থশালায়
সুখের দিবানিশি ক-দিন বলো;
নিয়ত উঠছে অপসৃত নাদ
এ-স্থান তবে ত্যাগ করি চলো।
কী ঘোর রাত্রি, কী বিপুল ঢেউ
পাতালগামী ঘূর্ণি এমন—
শুষ্ক তীরের অনঘ মানুষ
কী করে জানবে অতল কেমন!
বৃদ্ধ মাজি* বলে, বিধির আসনে
মদের ফোয়ারা উঠুক;
প্রাজ্ঞ নয় সে, তবুও জানে
এ-পৃথ্বী প্রেমে শৃঙ্খল ভাঙুক।
পরিণামে জোটে নিন্দা যত
যা গড়েছি কেবল নিজের জন্য;
গোপন রাখিনি প্রেম, এ-কারণে
ক্রুদ্ধ হয়েছে জনারণ্য।
হাফিজ়, যদি একবার তার দেখা পেতে চাও
নিজেকে করো না আড়াল তবে,
দেখা দিলে প্রিয়া সবার অলক্ষে
এ জগৎ ছেড়ে চলে যেতে হবে।।
—
টীকা:
*মাজি— ইংরেজি ‘ম্যাজি’। যাজক সম্প্রদায়, পারসিক বিশ্বাসে আবার জাদুকর। প্রাচীন ফারসিতে এর উচ্চারণ— ‘মগুস’। ইরানিতে— ‘মগু’, যার অর্থ অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি।
সাদা ও কালো
দ্যাখো সাদা হয়ে গেল আঁখিতারা
দু-চোখে এমন অশ্রু-জোয়ার;
বলো প্রিয়তম কতদিন আর
সরিয়ে রাখবে দু-জনের ছায়া!
আমরা এসো পরস্পরের
হাত ধরে আরও কাছাকাছি আসি,
জেনো পুরোনো স্মৃতি মনে রাখা বৃথা
বিস্মৃত হও দীর্ঘ অতীত; যে-রাত্রি গেছে— তার যাওয়াই প্রথা।
তার চোখের পাতায়, হে ঈশ্বর
শাণিত করেছ তীক্ষ্ণ ধার—
আমি ভুলেছি সংযম-সার
তবু কৌশল তার দিব্য প্রখর!
লাবণ্য মুখে, কৃষ্ণ অলকে
যে-ছায়া ফেলো চোখের ভিতর,
তাতেই আমার অক্ষিশিরায়
সাদা-কালো রং— তীক্ষ্ণ জাগর।
শোনো হে হাফিজ়, গজ়লের গানে
মেলে না বর্ণ অবিরত
আশা রাখি, ঠিক একদিন তুমি
পেয়ে যাবে মন মেলাবার মতো।।
পানশালা
একজন কাল শরাবখানায়
হঠাৎ এক কোণ থেকে হুঙ্কার দেয়;
অপরাধ যার যত সব
হয়ে যাবে মাপ, পান করো এই দিব্য শরাব।
কাজ করে যাই নিজের গরজে
বিধাতার দেওয়া অপারকরুণা—
সুখবর এসে পৌঁছোয় যেই
ফেরেশতা আনে অক্রূরতা!
অপক্ক এই মেধার মগজ
নিয়ে চলো ঠেলে শরাবখানায়
গনগনে তাপে লাল মদ এই,
রক্ত-রসের মণ্ড বানায়!
তুমিও পাবে না দেখা তার
যেতে পারো নিয়ে অসীম সাহস;
হৃদয়, তবু প্রতীক্ষা করো
রেখো না দু-চোখ শান্ত নিরস।
সমস্ত পাপ ছাড়িয়ে আমার
মহীয়ান হয় বিধাতার ক্ষমা—
ফাঁস করো কেন রহস্য সব
ঠোঁট মেখে নেয় স্তব্ধ কথা!
একবার দ্যাখো এ-কান আমার
একবার দ্যাখো চূর্ণ অলক;
নেশাবাহী মুখ লাস্যে যেন
উঁচিয়ে রেখেছে সুরার ফলক!
হাফিজ়, তোমার এই মধুপান*
অশ্লীল কোনো অপরাধ নয়—
বিধাতা বড়ো কৃপাশীলকারী
সকল ত্রুটি নিজেই সরায়।।
—
টীকা:
*মধুপান— প্রাচীন পারস্যে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষদের মধু জাতীয় বৈভবশালী দ্রব্য, প্রকাশ্যে পান করা নিষিদ্ধ ছিল। কোনো কোনো সুফি সম্প্রদায়ের কবিরা এই অপশাসন প্রকাশ্যেই ভাঙতেন। এই কারণে হাফিজ়ের কারাদণ্ডও হয়।
যে-প্রাণ মুক্ত
গত রাত্রির পান্থশালায়
গুহাবাসী যে-সাধক এলেন,
ভেঙে ফেললেন তাপসচর্য
দু-হাতে সুরা দিব্য নিলেন!
সহসা স্বপ্নে খুঁজে পাওয়া যায়
যৌবনভেজা প্রিয়তমা-মুখ,
ফলে সে বৃদ্ধ বিভোর নেশায়
বাঁধিয়ে বসে প্রেমের অসুখ!
সন্ন্যাসে গড়া সংযমী প্রাণ
পথ দিয়ে যায় ক্রম অবিরল
তাঁকে দেখে যত বিশ্বাসীগণ
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ধুলা-পদতল।
গোলাপের এই অগ্নিকোরকে
ছাই হয়ে যায় বুলবুল-বাসা
কৌতুকে ঢলা প্রদীপ শিখা
ধ্বংস করেছে পতঙ্গ নেশা।
রম্য আসরে যে-সুফি
ভেঙেছে সুরার পাত্র;
এক ফোঁটা মদ পেটে পড়তেই
উন্মাদ অহোরাত্র!
বিস্মিত আমি নিয়ত দেখি
মন্ত্র পড়ছে শুঁড়ির দু-চোখ
পানপাত্রের গতিবিভঙ্গ,
সেই তো আমার সপথ্য শোক।
যে প্রাণ মুক্ত ব্রহ্মাকাশে
তেমনই মোক্ষ চেয়েছে হাফিজ়;
হৃদয় ছুঁলেও দরদী-চিত্ত
প্রেম তো আসলে ত্যাগের জিনিস।।
প্রমোদ হরিণ
হে উদভ্রান্ত প্রমোদ হরিণ
কোথায় আছ, তুমি কোন বনে?
আমাদের এই প্রেমের যাত্রা
মনে পড়ে নাকি সেই কবে থেকে!
অনুপায় খামখেয়ালি আমরা
দু-জনেই বাছি নিজস্ব পথ
একটি পিছনে, একটি সামনে
সাজানো রয়েছে চক্ররথ!
যেখানেই থাকো, শোনো ফিরে এসো
ঘনিষ্ঠ হই পরস্পরের—
কেমন রয়েছি আমরা পৃথক
যাচাই করি কষ্টিপাথরে।
তোমার আমার দূরত্ব এই
বেদনা রয়েছে অপরিমেয়
তবুও কার অভিলাষ কত
আলতো ছোঁয়ায় জানতে দিয়ো।
আমাদের এই নিরুদ্ধ পথে
অগণন মাথা দেখাচ্ছে ভয়;
কোথাও পাইনি চারণভূমি
যেখানে গড়ায় মুক্ত হৃদয়।
বলো গো প্রিয় এমন দ্বন্দ্বে
বাঁচার জন্য কী উপায় করি?
খিজ়ির১ দেখালে পথের নিশানা
অতি সহজেই খাদ লঙ্ঘাতে পারি।
২
হয়তো এসেছে দৃপ্ত সময়
বিধাতা নামান বরাতের খাতা;
বন্ধ চোখে উলটেছি বই
নজরে পড়েছে আয়াতের২ পাতা।
‘মনে রেখো সেই যাকারিয়ার৩ কথা
প্রার্থনা তার খোদার কাছে;
তুমিই তো হে পালক সবার
আমার কোল তবে কেন শূন্য মিছে’?
বিস্মিত এক যাত্রী দ্যাখে
চলছে যেন কেউ সে পথ ধরে;
আরও কাছে তাকে ডেকে মুসাফির
বলল কথা হাস্যরবে—
‘এখানে আসুন, বসুন আয়েশে
কী আছে ঝুলির ভিতরে
যদি থেকে থাকে সামান্য দানা
মাটিতে রাখুন ছড়িয়ে।’
শুনে সে-পথিক অমায়িক হাসে
‘সর্বদা দানা কাছেই রাখি।
তবুও জানেন, ছোট ছোট নয়—
ধরব কেবল অজর পাখি।’
‘এত শ্রম তবে চিরজীবী সেই পাখির জন্য’?
প্রশ্ন করে সেই মুসাফির:
‘আপনি জানেন সন্ধান তার?
বলতে পারেন, কোথায় সে-নীড়’?
এখনও কেউ জানতে পারেনি
কোথায় রয়েছে বিহঙ্গ-বাসা,
ব্যর্থ হলেই বীতরাগ জাগে
ভাঙবে, তবু ঝুঁকতে শেখেনি মানবাকাঙ্ক্ষা।
৩
বহু পুরাতন সহযাত্রী
ভারি বেয়াদব ব্যবহার তার;
ঈর্ষার ক্রূর তলোয়ার দিয়ে
হানছে আঘাত বারংবার!
সমস্ত সুখে বিষাদ গড়িয়ে
বিভূষণ যত রেখে গেল সেও;
কখনও এমন অন্যায্য লড়াই
ভাইয়েরা করে কী পরস্পরেরও!
হিংসার নদী পেরিয়ে যেদিন
খুঁজে পাবে পথ কাফেলার৪ ভিড়ে,
দেখবে ঝাউয়ের তলায় তলায়
ধূসর চোখেরা অপেক্ষা করে।
তুমি রেখো ভাই নিয়ত মাথায়
মধুমাস আর সুরার পেয়ালা
প্রমত্ত এই জ্যোতিশ্চক্রে
বিস্মৃত নয় প্রেমের ছায়ারা।
বসন্তে এই আকাশ দ্যাখো ধূম ঘনঘোর
ভিড়ে যাও আজ ভীষণ মল্লে,
অশ্রু-প্রপাতে মেঘ কাছে এলে
হাত ধরো তার নয়নের জলে।
৪
বুদ্ধি এবং মর্ম আমার
একাকার হয় আজ নিজে নিজে;
ভূমিতে ফুটবে অভিলাষ-কলি
সমাগমময় তাদের বীজে।
সৌরভ যত সংগ্রহ করো
নিঃসঙ্গ এই স্পৃহা থেকে—
চিরনির্মেদ সুগন্ধ যেন
মানসচেতনা ভিজিয়ে রাখে।
বিচূর্ণ এক চিকুর থেকে
মৃগনাভিঘ্রাণ ছড়ায় মায়াবী,
অরণ্যে সে-হরিণ কোথায়?
বিক্ষত সব অশ্রু ঝরায় ঘাই-হরিণী।।
—
টীকা:
১. খিজ়ির— এর অর্থ অগ্রদূত। কোরআন শরীফের অষ্টাদশ অধ্যায়ে অল-খিজ়িরের উল্লেখ রয়েছে। কোরানের আয়াত অনুসারে তিনি প্রফেট আদমের পুত্র।
২. আয়াত— কোরানের শ্লোক।
৩. যাকারিয়া— এর অর্থ ঈশ্বর যাকে স্মরণ করেন। জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের পিতা, ইসলাম ধর্মে এই জনই হলেন প্রফেট ইয়াহিয়া।
৪. কাফেলা— মরুভূমির যাযাবর অভিবাসীদের স্থানান্তরের দীর্ঘ যাত্রা।
আগুন অথবা আগুনের মতো
গত রাতে দেখি ফেরেশতা একদল
কড়া নেড়ে গেল দরোজার;
তৈরি করল সুরার পাত্র
ছেনে আদমের মাটি বারবার।
স্বর্গপুরীর গহীন কক্ষে
মহলের সব ঐশীধারা,
রাস্তার এই বিবাগী প্রাণকে
স্বল্প দিয়েছে মত্ত মদিরা।
শুধু একদানা গমের জন্য
ধ্বংস হচ্ছে মাটির আদম—
আমরা যাব না তেমন যুদ্ধে?
যাদের গোলায় সহস্র অহং!
আগুন সে নয়, মোমবাতি যার
শিখার উপর গড়িয়ে পড়ে,
প্রকৃত অনল জ্বলছে জেনো
পতঙ্গবাহী অন্তরে!
জাতিনাশ আর ধ্বংস লড়াইয়ে
লোহিত হচ্ছে সাগরজল
আজও সত্যি বোঝে না কেন,
পুরাণই করেছে হত্যা সবল!
তাঁরই অসীম করুণা মেখে
সন্ধি করি আমরা সকলে;
মন্ত্র বলে পরীরা নামে
পেয়ালা বিনাশে, মহোৎসবে…
তারপর শোনো হঠাৎ একদিন
কবিতা থেকে সরেছে মুখোশ—
হাফিজ় তোমার ভাবের আড়াল, আগুন-পিয়াসে
ভাঙছে জীবন উদ্যত নির্ঘোষ।।
