লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অত্রি ভট্টাচার্য্যের প্রবন্ধ

শূন্যদশক, কারিগরিবিদ্যা, স্বপ্নের কবিতারা…

সে-সব দিন এখন অতীত, যখন বিদ্যা থাকত/ছিল বিদ্যায়তনের নিজস্ব সম্পত্তি। ভাগ্যাকাশ ছিল একটুখানি, মেঘের উপর শুধু ল্যাজঝোলা পাখিদের মূর্ত অধিকার। সেখানে আমি-তুমি-সে-এই-ওই বাতুল! একে দুর্যোগের ঘনঘটা ছাড়া কি বলা যায়? খিলান ফাটিয়ে ফাটিয়ে আকাশকে বড়ো করে নিতে হাতুড়ির প্রয়োজন ছিল— আর পৃথিবীর প্রথম হাতুড়িনির্মাতা একজন আদিবিশ্বকর্মা, প্রথম প্রজন্মের কারিগর! সুতরাং বিদ্যা পেল তার কারিগরকে, আর কারিগরি আয়ত্ত করল প্রথাগত বিদ্যার ক্লক টাওয়ার— তার ক্লোকড সেজে থাকবার দিন তো গেল সন্ধ্যে হল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে আমরা নদীর কাছে এসে পড়েছি। এ নদী এমন নদী যার আসবার বাঁক দেখা যায় না, যাবার বাঁক অন্তহীন! আমরা কেউ চড়ায়, কেউ কেউ পায়ের পাতা ভেজাই কি ভেজাই না, কারো কারো বেণী শুকনো— কেউ আক্ষরিক বিশ বাঁও জলে! এমন এক প্রফেশনাল আনঅর্গানাইজড আনার্কি চলছে জানলা-দরজা খোলা এই ঘরে— যেখানে ঢুকতে আচমকা পাঠক মায়োপিয়াক্রান্ত, নিয়ম ও নিয়ম ভাঙার মুখোমুখি ও পিঠোপিঠি দ্বৈরথে জ্বরপরাহত! তাহলে প্রশ্ন— কোথায় পেনিট্রেশন সূচিমুখ? ওয়েল, বিল্ডিং ব্লক ছাড়া খেলাবাড়ী হয় না— তা সে যতই চকরাবকরা জমকালো আনইম্প্রেসিভ ইম্প্রেসন হোক তার! আমরা যারা লিখতে শুরু করেছি শূন্য দশকে বসে— তাদের কাছে শূন্য দশকের কবিতা ভাগ্যাকাশের চাঁদ— ঝড়ের বুকে প্রদীপ— শিখাটি বাঁচিয়ে রাখাই দায়! আবার জ্বালাও, আবার নিভে যাবে! চঞ্চলা চপলা চমকে বেড়ানো দৃষ্টি এড়ানো সোনার হরিণ— তাকে আইসাইটে বিদ্ধ করা কঠিন!

প্রথমে ইচ্ছা ছিল— কেন্দ্র থেকে স্পাইরালি বাইরের দিকে বুনে চলি এবং এই সূত্রে গত দশকের ক্র্যাফটম্যানশিপকে ক্রমিক ধরতে থাকি বিভিন্ন শক্তির অভিমুখে। যাতে অঙ্ক নেই তা কবিতা নয়— এই অমোঘ গীতিকবিতা প্রায় হাইফেন হয়ে দাড়িয়েছে যে, শূন্য দশক এবং কবিতার মাঝখানে, তাকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এমনভাবে উড়িয়ে দিই— যাতে তার ভাগ্যাকাশ বরাবর রেখাটি ভারি সুনির্দিষ্ট হয়। তবে না— অ্যানার্কিকে অ্যানার্কিস্ট হিসেবে লিপিবদ্ধ করবার থেকে বেশি চ্যালেঞ্জ— এক প্রান্তিকের কপোলউঠানে সাজানো লাঞ্চটেবিল অফার করা একটু কম ভীতিপ্রদ ও সহজ— একটু বেশি খেলাবাড়ি! এই ক্ষুদ্র পরিসর একাধিক ফ্যাক্টারি খুলে দেবে সময়ের মাঝখানে— যা ইদানীং প্রায় অ-দস্তুর! এপার-ওপারের শূন্য দশক কমবেশি একইরকম ক্ষয়ে আক্রান্ত— সেখানে শব্দচর্চার উঁচু-নীচুর থেকে একই প্লেনে আরও আরও হরাইজন্টাল এক্সপ্লোরেশনের জায়গা বেশ। হ্যাঁ— একাধিক নতুন প্লটের মধ্যে এই একটি বৈশিষ্ট্য এই দশকে— কবিতার জগতে উল্লম্ব অক্ষ লোপ পেয়েছে চিরতরে— পরিবর্তে XY প্লেন মনোজগৎ আচ্ছন্ন করছে— তার কোনো কোনো বিন্দু সময়ের নিরিখে নতুন, কোথাও পুরোনো— কিন্তু তথাপি সমসত্ত্ব শব্দটি আর কোথাও প্রয়োগ করা শক্ত।

কমবেশি কয়েকজন কবিকে একটি ছকে ফেলে নানান চার্ট ও গ্রাফ সাজিয়ে নিবিড় হওয়া যেত এই রিয়্যাল এস্টেটগত কালখণ্ডের রুবিক’স কিউবের সঙ্গে। চার্ট ও গ্রাফ হয়তো তাকে নগ্ন করে দেখায়, আসা যাওয়ার পথে কোট ঝোলানোর হুক যে নির্নিমেষে চেয়ে থাকে যার আসাও নেই যাওয়াও নেই অনন্ত চেয়ে থাকা আছে— এই বুভুক্ষু কাল কণিকাগুলি তাই বিশ্লেষণের তোয়াক্কা করে না। আমরা ছড়িয়ে বসি বিল্ডিং ব্লকস— যারা আসে তাদের আসতে দিই র্যা ন্ডম। একটি কোটেশনের বুক-পাছা-থাই-যোনি-শিশ্ন থ্রিসিক্সটি ডিগ্রি প্যানোরমায় দ্যাখানো— এ-ও একপ্রকার দর্শনগৃধ্নু চাবুক বৈকি, গাউটে বেঁকে যাওয়া আঙুল ভিস্যুয়ালি যতটুকু কামাতুর! প্রথম উদ্ধৃতিটি তাই ভূমিকার, কবি স্বপন রায়ের লেখনি থেকে—

“অনুপম স্থির বা জড়-শব্দে এবং দৃশ্যে নেই। পাখি দিয়ে যেমন, রোদ, জল বা আলো নিয়েও তিনি এক সংযত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছেন। বাংলা কবিতায় এই সংযম এবং বিস্ফারের মেলবন্ধনটি জরুরি ছিল। তার আবেগ নিরাবেগের ফিল্টারে শোধিত হয়, খুবই কঠিন এই কাজ।”

বহুচর্চিত অনুপম মুখোপাধ্যায়। পাঁচটি গ্রন্থের জনক এই শূন্য দেশের কবি। শূন্য দশকের শুন্যটি মহাশূন্যের সঙ্গে আকারে-ডায়মেনশনে ও ভার্সেটিলিটিতে সমধর্মী ধরে নেওয়া হলে, অনুপম সেখানে এক মধ্যবয়সী নীহারিকা। তার থেকে একাধিক বহুগামী ডিকশন অপসারী হয়। কয়েকটি বিন্দু একটি ইক্যুয়েশনবীহিন সরলরেখায় প্রাণসঞ্চারী, তেমনই অনুপমের কবিতা মাঝমাঠের নিজস্ব অন্ধকার, পাহাড়ের সংযত স্বতঃবাঁক। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ— “যার নাম অপরাজিতা, সেও কিন্তু নামকরনে হেরে যায়” (কবিতা ক্যাম্পাস/২০০৭)। এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলির একাধিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে—

১. প্রতিটি কবিতাই যেন একই মেলায় এসেছে। তারা একেকটি স্টলের পেছনে আলাদা আলাদা রঙিন নেপথ্য দেওয়াল। শুধু স্টলে স্টলে পসরার হেরফের। তাই ফর্মাল বুননেও সেই মেলার গন্ধ।

২. প্রতিটি কবিতা (প্রতি পাতার কবিতা বলাই ভালো) তিনটি করে ৪/৫ পঙ্ক্তির স্তবকে বিভক্ত, যাদের অন্তর্গত খিলান হল “…”-রূপ কানেক্টার! ভিস্যুয়ালাইজেশনের ক্ষেত্রে এই বিন্যাসের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

৩. পদ্ধতিগতভাবে লক্ষ করলে, কবিতাগুলি “বিষয়ভিত্তিক ন্যারেটিভ”। দৃশ্য সেখানে দৃশ্যের মতো করেই যে এসেছে তা নয়— কখনো বিষয় কখনো আশ্রয় কখনো বিষয়হীনতা কখনো-বা স্রেফ শুষ্ক তত্ত্ব— যাদের নান্দনিকতা অনুপমের নিজস্ব ব্যাতিক্রমী স্ট্রাকচারপ্রদান। যেমন—

“হাত থেকে খসে পড়া তরোয়ালও গেঁথে যায় মাটিতে…
কেউ চুমুর জন্য কপাল এগিয়ে দিল না… হয়তো ভালো ঠোঁট ছিল না…
ঠিকঠাক শুকনো জিভ ছিল না…”

এখানে প্রথম দুটি দৃশ্যখণ্ডের মধ্যে ক্রিয়ার প্রভেদ এদের যুগচিহ্নিত করছে, প্রথমায় “যায়” ও মধ্যমায় “দিল” সহযোগে। এবং সম্ভাবনা এখানে পৌরুষের নিজস্ব ইনফিরিয়র শেপ নিয়েছে জিভ ও ঠোঁটের ঔরসে। প্রশ্ন— এখানে একাধিক সম্ভাবনার প্রান্তে দুলিয়ে দেওয়া পেণ্ডুলাম কি তাৎক্ষণিক অ্যাড্রিনালিনের অনুষঙ্গ? পরের স্তবকে এর উত্তর পাব কি? দোলাচল থাকবে নাকি সংহত হবে স্বপনদা-কথিত “স্থির বা জড়-শব্দ” ক্ষেপে?

“…পাপোশের বাইরে পড়ে পেন ভেঙে যায়…
কবিতাগুলো চিন্তার ক্যামোফ্লেজ ছেড়ে বেরিয়ে আসে…
যে যাই বলুক… ডুবতে চলা সূর্য্যের সাথে ডিমের পোচের কোনো মিল কেউ
দেখতে পায় না…”

টের পাই, পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদ নিছক-ই চিন্তার ক্যামাফ্লেজ, কথান্তরে উৎসমুখ। প্রজাপতির জন্যেও পিউপার প্রয়োজন হয়— এখানে কোন দৃশ্য কোন অদৃশ্যকে দৃশ্যময় করে তুলছে তা এককথায় বোঝানো মুশকিল। তবে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, তিনটি স্তবক তাদের নিজস্ব তলোয়ার কষিতে পড়েছে— শব্দক্ষেপে নিখুঁত ও সংবেদনশীল অনুপম, বোঝা যায়, আছেন অনুপমেই। এই দৃশ্যের সম্পূরক দৃশ্য শূন্য দশকের কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এবং এই-ই প্রকৃত অনুপম নন, তার দিগন্ত আরও বিস্তৃত ও মণিমুক্তাখচিত। সে-প্রসঙ্গে প্রভূত আলোচনা আগেও হয়েছে এবং আরও হবে। আপাতত আমরা এগোব এই দশকের-ই আরেক মাইলস্টোন— রঙ্গীত মিত্রের কবিতায়!

যে-বেসিক আলোচনা অনুপমের কবিতায় ঘাটতি হয়ে থেকে গেল, তাকে রঙ্গীতের কবিতায় বাদ দেওয়া প্যারালাইজ্‌ড লেখায় দাঁড়াবে। কারণ, রঙ্গীতের কবিতাগুলি তাৎক্ষণিকের ছায়াপাতে বিমূর্ত বৃহত্তর বর্তমান। এ এক এমন কবি, যার কাব্যভাষা রচনা শুরুর মূহূর্ত থেকে অল্পবিস্তর আয়াসহীনভাবেই নিরন্তর সরলরৈখিক। এবং প্রচণ্ড পুরুষ কবি মাঝেমধ্যে তার অজান্তেই হাত করে ফ্যালেন অলমাইটি প্রকৃতিকে, তার কবিতা পড়ে কখনো কখনো স্পষ্ট দেখতে পাই সত্যজিত দাড়িয়ে রয়েছেন ক্যামেরা হাতে। সত্যজিতের স্টাইলের সঙ্গে রঙ্গীতের রচনার বেমিলপ্রসূত মিলগুলির একটি— এরা জেনে বা না জেনে ভিস্যুয়াল ডিটেল্‌সকে আত্মগত করে নেয় ফ্রি-ফ্লোয়িং আবেগের মোড়কে। উদাহরনস্বরূপ রঙ্গীতের একটি চটি কাব্যগ্রন্থের প্রসঙ্গে আসি। “আতরের বাক্স থেকে যেসব নাম হারিয়ে গেছে”। রঙ্গীত লিখছেন—

“ছাইএর মাঠ হয়ে আছে
আমাদের আর একটা দিক
আমাদের পোল্ট্রীকারখানা
আমার চারদিকে ভাইব্রেশন
যাকে তুমি ভূমিকম্প বলো
আমাদের ঘামে মিশে উপত্যকার রস হয়েছে
এছাড়া আর কিছু নেই; এইবার আলোর গর্ত কোথায় রেখেছো?”

ইদানীং যে সোয়াট উপত্যকা বিতর্কের (পড়ুন প্রতিবাদের) শিয়রে, তাকে এড়িয়ে গিয়েই বলি— শূন্য দশকের চৌকাঠে চিরকাল-ই ভয় দাঁড়িয়ে রয়েছে, অথবা জন্মলগ্ন থেকেই আমরা, ডুয়েলার্স অফ দ্য ভ্যালি অফ ফিয়ার। তাকে আত্মস্থ করা, উপলপদ্ধি করা এবং ক্রমশ তাকে সেন্ট্রিফিউজে ফেলে রং-গন্ধ-কাঠামো-দৌর্বাল্য ছিন্ন ভিন্ন করে আনা খুব কম কবির কলমে সম্ভব! রঙ্গীত, দেখুন পাঠক, সেই কাজটি করেছেন। কারখানা— সর্বনির্বাপিত দগ্ধতাজনিত ছাইএর; এমনকী ভূমিকম্পও আমাদের চেতনার প্রকম্পে ক্ষীয়মান। এখানে রবীন্দ্রনাথ আসেন তাঁর মানববিশ্ব ও বিশ্বমানবতত্ত্ব নিয়ে— চমস্কি-অমর্ত্য সেন এসে দাঁড়ান পরিচয় ও আতঙ্কের পরস্পরবিরোধী কানাকানির সাম্রাজ্যে! ফাঁকি যা পড়ে— তা ওই আলোর গর্তটুকু! হ্যাঁ, রঙ্গীতের কবিতা ইঙ্গিতময় তবু সে মিনিয়েচারাইজ্‌ড চিড়িয়াখানার কাজ করে আমাদের মস্তিষ্কে হ্যামারিং-এর মাধ্যমে। অথচ তার সবটুকুই সমসাময়িককে অন্ধকার ঝাজরিথালার পেছন থেকে দ্যাখে কি? পরের কবিতা বলছে—

“যেদিন থেকে শুধু গিলে গেছি নিজেকে
আমাদের কোন মানে নেই
কেবল পকেটের থেকে টাকা উঁকি মারে
তোমায় বরং উল্কি কিনে দেবো
আমাকে ভাবাবে আর একদিন; আজকে নয় কেন?
আমার পায়ে ধুলোর পরাগ
মায়ার আলোতে সকাল ঘড়িতে শেষ হয়ে আবার আসবে কি?”

পাঠক ক্রমশ পরিচিত হচ্ছেন ভয়ের আড়ালে থাকে হতাশা, হতাশার মোড়কে নিষ্ফলা প্রেম এবং ইভেঞ্চুয়ালি এক আশার অপেক্ষায় বসে থাকা আলোর কবিকে। প্রসঙ্গত, কবি রঙ্গীত মিত্রের লেখার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য— কবিতায় সান্ধ্যভাষামুখর এক দিকনির্দেশ, যা কিনা সমগ্র কবিতাদেহ থেকে একটু তফাতে দাড়িয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্যকে জড়িয়ে থাকে ময়ালের মতো! আর এই যে আচমকা “তোমাকে” কিনে দেওয়া উল্কি— এ নিছক আশাবাদমাত্র নয় কিছুটা পুরুষ কিছুটা মধ্যবিত্ত যার “পায়ে ধুলোর পরাগ”! এবং এই যে আলোর সন্ধান, এ কবিতার-ই আপন এক চিরন্তন!

আমরা শূন্য দশকে ছড়িয়ে যাইনি, যদিও বেছে নিয়েছে কয়েকজন প্রচলনকে, যারা নিষ্ঠার সঙ্গে লাইন ছাড়ছেন— না হয় নতুন কিউ জমাচ্ছেন— তাও সে এক এক অনিশ্চয়তার উদ্দেশে। আর এই অকিঞ্চিৎকর আসেসমেন্ট যা হওয়া উচিত ছিল এক আদ্যন্ত ফ্রি-বডি ডায়গ্রাম তা ক্রমশ মুগ্ধতার আলেখ্য তৈরি করছে অন্ত্রতন্ত্রে। আমরা নিরুপায়, প্রি-অকুপায়েড। সাঁতরে যাচ্ছি পরের দ্বীপের দিকে। দোলনচাঁপা চক্রবর্তী!


দোলনদি, প্রায় আত্মীয়তার সূত্রকে কবিতায় বেঁধে নিয়েছেন অবলীলাক্রমে! শূন্যের অন্তর যে জেনারেটরে প্রাণ সঁপেছে শব্দার্থে, দোলনদি-র সেলফ তাকে রুমালে জড়িয়ে মাঝারি মাপের পার্সে রাখছে— কিন্তু পার্সসর্বস্ব হয়ে ওঠার পথটি তার কাছে বহু বৎসরের। অনেকের মতেই দোলনদি “কৌরব”-এর কবি (পাশের ঘরে ঠান্ডা কাতর একটি কাশি উঠল ঘুরপাক খেতে খেতে; ঠিক ধোঁয়া যেন অথবা ধোঁয়া-ও নয়।), অনেকের মতে বৈখরী-র! আমার মতে, শূন্যকে একটি রুপোলি পেন্ড্যাণ্টের মতো বুকের উপরে রেখেছেন দোলনদি। এক শান্ত কিন্তু মৌনতায় মুখর অ্যাঙ্গেল তার লেখার ছত্র ছত্র থেকে আমাদের উপহার হয়ে আসে। যেমন দোলনদি-র কবিতার একটি আপাত-অদৃশ্য ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক উপস্থিত, যা কখনো কখনো ধরা পড়ছে উঁচু বা নীচু পর্দায়— যেন এক এলিয়েন সংগীত—

টেরাকোটার জাদুকর -১

দোতারায় শীত উঠছে খুব
তোমার হাতে আমার জানলা বদল হল
মিটসে সংসার;
প্রতি পংক্তিতে একেকটি আলো ও আড়াল
মজ্জায় শিরশিরে তাপ;
শিশুদের মুখে এই তাপটুকু ধরলাম
অর্ধ চিবানো শব্দেরা উঠে এলো ভারা বেয়ে
নতুন কি নত হতে জানে
রুটি ও মাংসের কাছে, পুরনো থালায়?

দৈনন্দিনের যে-অনিয়ত স্রোতধারা প্রতিটি চেতনাকে গড়ে, আবার অথচ তাদের মধ্যে দ্বিচারিতার এবং হেন্স, ম্যাজিকরিয়্যালে বাঁচবার বীজ পোঁতে— সেই সুমধুর বর্তমান-ই এখানে কুণ্ডলিত নয় কি? শীত, জানলা, তুমি-আমি, মিটসেফ এবং এই পথে শিশুদের মুখের তাপ, শব্দদের উঠে আসা মিলিয়ে টিপিকাল সংসারেচ্ছা! তবে, বিষয়ের মধ্যে কোথায় গোলা পড়ছে, এই শীতে? পড়ছে— একটি আজীবনপ্রসূত সম্ভাবনার সীমানায়। “নতুন কী নত হতে জানে/রুটি ও মাংসের কাছে,/পুরনো থালায়?” প্রশ্নের মধ্যে আশা থাকে, আশার মধ্যেও আবার চিরকালীন প্রশ্ন গুটি পাকায়! এই হয়ে ওঠারা আমাদেরকে সাজায়— এই হয়ে ওঠাদের সহ্য করে আমরা বিষম মানুষ, আমাদের বিমর্ষ মানুষেরা। অথচ এই দোলনচাঁপা-ই আবার ছুপিয়েছেন রং, গজিয়েছে কাজল তার চোখের দু-পাশে। রং এসে ঢেকে গ্যাছে রংবীহিনতার বুক-পেট-অন্তর্দাহ। শব্দের গতি থামিয়ে গতিকে স্থিতির মধ্যে জীবন্ত করবার শূন্যচিহ্নিত পথ ধরেছেন, সহাস্যে, সুকৌশলে। যেমন—

যুদ্ধোত্তর

ঘাসদুপুরের পেট ছিড়ে নিলো সাপবেজী
বেরিয়ে পড়ছে ভিজে টকঝালকথা
উড়ন্ত ঘুরপাক রাস্তায় গলিতে
যে নক্ষত্রমন্ডলের বিবিধ ছায়ায়,
তারা কি আদপেই জানে,
এ ভাবেই দিন চলে যায় !
আমিই সেই শত্র তবু
গ্ল্যাডিওলী ঝাড়েবংশে তোমার কবরে হামাগুড়ি
হেমন্ত বলে গেছে স্ট্রেঞ্জ মিটিংয়ের আগে কি ভাবে কে মারলো আমায়?
দুপুর জ্বালানো ঘাস উঠে গেলো, পড়ে আছে কৌতূহলী ঘর
সন্ধানী জলপালক অনর্থক শৈত্য নিরন্তর

এই লেখাটির নির্মাণে যে-সমস্ত রহস্য প্রথমেই দিগ্বিদিকে সৌন্দর্য্য উপচে দিচ্ছে তাদের, এবং তাদের পোশাকে-আশাকে আমরা কৌশল দেখি। এখানে ন্যারেটিভ প্রথমে কয়েকটি শব্দসমষ্টিতে ভেঙে গিয়ে, তারপর নিজেদের আত্মপর গোপন করেছে পরস্পরের ছদ্মবেশে! “ঘাসদুপুরের পেট ছিঁড়ে নিলো সাপবেজী/বেরিয়ে পড়েছে ভিজে টকঝালকথা”— দৃশ্যের এই রহস্যায়ন ক্রমশ গভীরতায় যাচ্ছে অন্দরমহলের পথে, নাকি বাইরের দিকে— প্রান্তরসীমার উদ্দেশ্যে? “তারা কি আদপেই জানে,/এ ভাবেই দিন চলে যায়!” এর পরে বিস্ময়বোধকটি একটি খুঁটি, যেখানে আরেক স্টেপ বা আরেক জায়েন্ট লিপ এগিয়ে গেল বিস্ময়, এবং বোধহীনতা! এবং পৃথিবীর যাবতীয় মনুষ্যোচিত অকালধর্ষিতা প্রশ্নের উত্তরেরা যে কোথাও-না-কোথাও ক্লিপবোর্ড খুঁজে নেয়, নিজেদের ঝুলিয়ে রাখে অলক্ষ্যে— তা পরিস্ফুট— দেখুন পাঠক— “হেমন্ত বলে গেছে স্ট্রেঞ্জ মিটিংয়ের আগে কি ভাবে কে মারলো আমায়?” এখানে, দৃষ্টিকটুভাবেই কিছুটা, প্রশ্নচিহ্ন এসেছে— যা হয়তো না এলেই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত আরও! এহ বাহ্য, সীমানার একটি দখল রয়ে গিয়েছে কবির নিজস্ব সংহারে, যেন শেষদৃশ্যের সেট আঁকাই পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ! পড়ুন— “দুপুর জ্বালানো ঘাস উঠে গেলো, পড়ে আছে কৌতূহলী ঘর/সন্ধানী জলপালক অনর্থক শৈত্য নিরন্তর”— মাঝের স্পেসটি ইন্টারেস্টিং যে, এবং আমাদের সন্ধানের কিছুটা পালকের মতো হালকাত্ব তথা অনর্থকতা, উষ্ণতার অনুপস্থিতি— কিছুই নজর এড়ায় না প্রকৃতিসর্বস্ব কোনো কিছুর। আর ঘাসদুপুর ও সাপবেজী থেকে উৎসারিত এক নিসর্গগাঁথা প্রশ্নের মুখোমুখি শেষ হয়; প্রশ্ন, যা কিনা মানুষের চালিকাশক্তি, প্রকৃতিদত্ত প্রশ্রয়!

এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো, দোলনদি-র কবিতায় একটি ফিনফিনে কিন্তু স্পষ্ট সীমারেখা টানা সম্ভব বয়স ও বয়ঃসন্ধি, নারী ও পুরুষযোজকের মাঝখানে! কবি এক নারী, এবং তা গোপনের কোন প্রচেষ্টা পাওয়া যায় না কবিতায়। বরং কোনো একপেশে বন্ধনী রাখেন না উনি কবিতায়, শব্দগুলিকে বাঁচতে দ্যান এবং সেই সূত্রে নিজে বেঁচে ন্যান ফুল ভলিউমে— আরামে-আপোষে-আপত্তিতে-আশ্লেষে-আদর ও আঁতান্তরে, কিন্তু বেদনানামক কালোভ্রমর একটি প্রাণ লুকিয়ে রেখেছে কিছুটা সর্বসমক্ষে কিছুটা পুকুরের ভেতর! সেই বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম লেবু ও খেলনা পেনিনসুলা কেমন ব্যথাগাঁথা কুঁড়েঘরটি সূচিত করে, দেখতে পাই—

মান অধ্যুষিত দূর্গ প্রাকারে দাঁড়িয়েছি
অভিমানী ভাবছি নিজেকে;
ভাবলেই সাতশো হ্যালোজেন টিউবের নিচে তোমার অকির্ডে
রোদ পড়ছে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলে বৃষ্টিও
বাটার ফ্রাই খায়।

এই ধংসবিদ্যা তুমি জানো না
অথচ তুমি জানতে এই টিলারই নিচে
প্রকৃত ইভের ঘরবাড়ি,
যেখানে স্নেহবশত: কোন সন্তান নয়
কেবল একটি হাইব্রিড টিউলিপ জায়গা পেতে পারে

টবের নম্রতায় অন্তিম লকেটটি বেড়ে উঠছে
যা আমার দেহের সাথে অবিচ্ছেদ্য হবে
আর দেয়ালে একটি অর্কিড
পাহাড় আঁকিতে এসে একতারা হয়ে গেল
(লেবু ও পেনিনসুলা)

আমরা, যাদের ধারণা আমরা শূন্য দশকের সূচিমুখের সন্ধান পেয়েছি শূন্য দশকেই লেখালেখির সূত্রে— তারা ভাষার, নির্মাণের এক গূঢ় কেমিস্ট্রিকে খানিকটা প্রবৃত্তিবশে আত্মস্থ ও শিরদাঁড়ার অধীনে নিতে পারি। আমরা জানি আমাদের আশেপাশের অসহায়তা আমাদের নিজেদের অসহায়তাগুলিকে একটি আপাত-খোলস দেয় বটে, কিন্তু তার পাশাপাশি একাকিত্বকেও মহিয়ান করে রাখে ব্যক্তিস্বাধীনতানামক ছদ্মবেশ দিয়ে। আমাদের মাথায় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী উইগ বড়ো মৌমাছি করে ফ্যালে আমাদের, কমতে কমতে নিজেতে এসে ঠ্যাকা প্রতিটি সন্ধ্যায়, পৃষ্ঠায়। আমরা তাই যখন পড়ছি— “অভিমানী ভাবছি নিজেকে; ভাবলেই…” শুধু চেনা নয়, জানা নির্মাণভঙ্গি! কিন্তু তারপরেই ইনফিরিয়রিটি ছড়িয়ে যাচ্ছে কালো আকাশে— “সাতশো হ্যালোজেন টিউবের নীচে তোমার অর্কিডে/রোদ পড়ছে।” এ এক জার্নি। তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, তার-ও দূরে থাকা আমাদের এ এক গোপন সাংকেতিক ল্যাঙুয়েজ যার একটিই প্রাপক, একটিই সাইকেল, একটিই যোজক! এই মনোলগের মতো আর্তি শূন্যের কবিতায় এক বিপরীতধর্মী ইন্টার্যাাকশনের সূচনা করেছে, মূলত চেতনার স্তরে— ভাষা যেখানে আঁতুড়আশ্রয়ী। শব্দ যেখানে স্বরমাত্র, চিত্র যেখানে নামজন্মের ঊর্ধ্বে! আবার শুধু কমিউনিকেশন কেন— কবিতায় বিষয় বড়ো সহজ করে মেলেছে ইতিহাসকে, কিছুটা যেন বাতাসিয়া লুপের চারিদিকে ঘুরেছে সময়— “টবের নম্রতায় অন্তিম লকেটটি বেড়ে উঠছে/যা আমার দেহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হবে।” আমরা যে বিন্দুবৎ বাঁচছি— তার চড়াই-উৎড়াইটি কেমন পরস্পরের ছদ্মবেশ নিয়েছে দেখুন পাঠক! যে-লকেটটি অবিচ্ছেদ্য শরীর ছেড়ে একদিন টবের মাটিতে স্থান পাবে, তার জীবনচক্রটিই আপসাইড ডাউন হয়ে কবিতা হল! এই ধীর-স্থির বিন্যস্ত উন্মাদনা-ই শূন্য দশকের অতিক্রম, সুচিন্তায় গড়ে ওঠা ধাপগুলির এক-একটি! চলে আসি ‘৫’ ক্রমিকচিহ্নিত এই কবিতাটিতে।

(৫)
অতটা উচ্ছ্বাস ভাবো।
ছুঁতে গেলে ঢেউ এসে যায়
অথচ পায়েহাতে দুরন্ত বালি

অভিযান লেগে থেমে গেছে শীর্ষদেশ

প্রদীপ নিভবে বলে দরজা খুলিনা
জানলায় চোরকাঁটা
বেজে বেজে থেমে যায় ফোন

অসহযোগ থেকে সহজ যৌগিক
দুলে উঠছে ভীষণ ঝাপটায়
ইতিহাস ভেঙে দিয়ে বেড়ে উঠছে দুপুরের রোদে
যাদের চিনিনা, তারা আরো কাছে এলো

এখানে শরীর এসে কুণ্ডলী হয়ে আছে, সুতরাং সাপকে শীত চেনাও! হ্যাঁ, কবিতা যখন অসম্ভবকে জপতে শুরু করে তখন চরম রাত্রের মাইলস্টোনগুলিও শ্লেষ ও ব্যাঙ্গোক্তিসহযোগরকমের বিনিদ্র হয়ে যায়! যে-দু-টি দোলনচাঁপা ধরা পড়লেন, তৃতীয়টি এইখানে গভীরে গিয়েছেন, হালকা খই-এর সাথে গুড়-এর জারণপ্রক্রিয়ার মতো! যেখানে সূচনা আসছে “অতটা উচ্ছ্বাস ভাবো”— এখানে বিস্ময়টুকু যে, উত্তেজনাটুকু যে শরবিদ্ধ হবে কোথাও না-কোথাও তা আমরা, কবিতাবিদ্ধ মূর্খেরা জানি! এবং শুরুর তিনটি পঙ্‌ক্তি যেন নিছক আদর্শ হাইকু— “অতটা উচ্ছ্বাস ভাবো/ছুঁতে গেলে ঢেউ এসে যায়/অথচ হাতেপায়ে দুরন্ত বালি”। আর চতুর্থতে চৌকাঠ-ও বিনীত হয়, আমি এক অত্যদ্ভুত ভালোলাগায় ঋদ্ধ হয়ে উঠি— “অভিযান লেগে থেমে আছে শীর্ষদেশ”! শূন্যের কাল্ট! শূন্যের বর্তমান! শূন্যের চিহ্ন! কবিতা কেমন ডানা মেলছে আপনার-আমার দরজায়, অগাধে নির্ভরযোগ্য ও ডিটেল্‌ড— “অসহযোগ থেকে সহজ যৌগিক/দুলে উঠছে ভীষণ ঝাপটায়”— এবং পরবর্তীতে কিছুটা সরাসরি, ফর্ম ভেঙে চিরায়তে যাওয়ার পথে— “ইতিহাস ভেঙে দিয়ে বেড়ে উঠছে দুপুরের রোদ/যাদের চিনি না,/তারা আরো কাছে এলো”। এইখানে এসে সত্যিই আমরা পয়েন্টলেস, ক্লুলেস! এক অন্ধকার যা উচ্ছ্বাসের ছদ্মবেশে ঢুকেছিল— এতক্ষণে আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। তার গভীর থেকে উঠে আসছে মদের গন্ধ, বিভীষণ তোতলামি, ট্র্যাফিক গিজগিজ রাস্তার মধ্যিখানসম্পৃক্ত অব্যক্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা!

দোলনদি-র প্রথম কাব্যগ্রন্থ এখনও পরিকল্পনার অতীত! খুব বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করেন কবি, তাঁর লেখালেখি এখনও মুদ্রণসঞ্জাত ছায়াপাত করেনি ভিতরে! কিছুটা হলেও আমি উষ্মা দ্যাখাই, মুখের আড়ালে বিদ্রূপ নিয়ে তাঁকে ছদ্মে উৎসাহ দিই! আমাদের এই মুখোশসর্বস্বতাও হয়তো লেখাদের মুদ্রিত আকাশ চেনবার পথে মস্ত বড়ো বাধা! বিদুষী এই কবির প্রতিটি কবিতায় কিন্তু, গ্রন্থিতে অগ্রন্থিতে এক ব্যাতিক্রমী মুক্তি খাতাকলম ছাড়াই পঠিত হচ্ছে চেতনায়! আমি অন্তত, তাঁর একনিষ্ঠ পাঠক! ইদানীং কবি লেখেন কম। পত্রপত্রিকার জন্য লেখা চাইতে যাওয়া এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ! তবু, লেখামাত্র ইচ্ছারা তরতর করে ধাবিত হয় সর্বত্রে, একত্রে! শুভকামনায় একমুঠো জল রেখে আমরা এক বিস্ফোরণের ভেতর আত্মপ্রকাশ করতে তৈরি হই! অমিতাভ প্রহরাজ!


কোনো কোনো ঘটনা যে কেন কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠে ভিতরে ভিতরে, প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা দিয়ে তার ব্যাখা পাওয়া যায় না— এ এক আজব প্যারাডক্স! যেমন চুরুট হাতে অমিতাভ প্রহরাজ, স্থির গঙ্গার বুকে বসে আলোড়ন তোলা একের পর এক কবিতা লিখছেন। শূন্য দশক আমাদের বড়ো আদরের চমকদশক! আর শূন্য দশকের পায়ের কাছে লেজ গুটিয়ে শুয়ে থাকে যে-ব্রেজিলের কালো বাঘ, আমরা তার মাথায় পোষা মুকুট পরাই। কিন্তু ওই গাম্ভীর্য্য নিউক্লিয়, ক্লাউডেড— সন্ধ্যে হলে দেখা যায় পাগলের বিছানাটি ফাঁকা! সমস্ত প্রকৃতিস্থ যা যা তা তা তুচ্ছ করে সে বন্ধু খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। খুঁজছি খুঁজছি কী খুঁজছি তা বর্তমানের সিকিওরে থাক! অমিতাভ প্রহরাজের কুণ্ডলী খুলেছে, (খুলেছিল) জীবনের প্রথম বেশ্যার মতন রসালো রুক্ষঘেরা আত্ম-অপহরন ও স্ব-নিযুক্ত র্যা নসম অন্ধকারে। “চলো সিঙ্গলহ্যাণ্ড” অতি বিচক্ষণ এক উন্মাদের ধুন্ধুমার একলা চলো কথা। “সালটার নাম ছিল দু’হাজার প্যাঁচা”— শূন্য দশকের এই জনপ্রিয়তম ডায়লগটি আসলে এই খননের অপর অংশ! প্যাঁচার আগমনবার্তা প্যাঁচা ঘোষণা করছে রাত্রিভাবনাকেই ট্যুইস্ট কোরে— এই সময় তার-ই হাতযশের অন্তর্গত কিনা! এবং উৎসর্গপত্র বিন্দাস রকমের সাদামাঠা, কিন্তু সেটাই কি জটিলতার মুখোশ নয়? “যাকে বলে ইন্দ্রনীল, তাকে…”। ইন্দ্রনীল ঘোষ কি? তা বিশেষ করে দেওয়া নেই, সেজন্যই অ-ইন্দ্রনীল নামের প্রতিটি অসৌজন্য-ও এসে যায় ইন্দ্রনীলেদের পরিচিতির মধ্যে। আকাশের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো, প্রথম লেখাটি ফেটে ছড়িয়ে গেল— শিমূলের মতো নয়, জাপানী ফায়ারওয়ার্কসের মতো। তার আগে, খুব মোটা দাগের আনালিসিসে এই কাব্যগ্রন্থের কিছু বৈশিষ্ট্য—

১. বিশটি কবিতার প্রত্যেক বিজোড়তমটি জোড়তমে-র আয়নাছায়া (মিরর ইমেজ)। অতি দুর্লভ এই শৈলী যে বাংলাভাষার মতো বহতা নদীতেও সাকার হতে পারে, তা একমাত্র পড়েই বোঝা সম্ভব! কবির মতে—
“নিছক উল্টে দেওয়ার গিমিক নয়। প্রতিটি কবিতা খুব সচেতনভাবে ক্রিয়েটেড উল্টোপথে এক প্যারালাল কবিতার কথা ভেবে”

২. শুরুর আগে কবির আর্তিটি ফেনিয়ে ফেনিয়ে গিয়েছে প্রায় দু-পাতায়, সেটুকুই আস্তে আস্তে জমে এসে শেষ পৃষ্ঠার কেন্দ্র একটি নিটোল স্তনের আকার নিয়েছে, একটি ছয় পঙ্ক্তির মুখবন্ধ সহ, মুখখোলার সাফাই হিসেবে। আবার কবিতাগুলির বৈশিষ্ট্য মেনে এদের শেষ থেকে পড়তে থাকুন, দেখবেন ঐ স্তনবৃন্তটি ক্রমশ রূপান্তরিত হয়েছে প্রচ্ছদে— এক গর্ভবতী নারীর নাভিতে। বলা বাহুল্য, এই জটিল মা-টি সিঙ্গল মাদার।

৩. ক্রমিকের খাতাটি বড়ো সহজ, (১/ক), (১/খ)-এই ভঙ্গিতে সেজে উঠেছে ‘চলো সিঙ্গলহ্যাণ্ড’, চৌকাঠ পেরোই আমরা এভাবে—
“গাছের চেন টেনে নেমেছিলে, তুমি সেই কবেকার নির্জন জরিমানা
রূপোলী কামিনা আর আঁটছেনা চাঁদের বনেটে
ফলতঃ বডি পড়ে ঝাঁকড়া সীমানার
কোঁকড়ানো শুনশান, শীত ঘেঁটে”

যথারীতি এই কবিতাগুলির প্রাথমিক স্বাধীনতা দু-টি— এক, অসমাপ্য বাক্যনির্মাণ এবং দুই, ছন্দ ও শব্দের এক নিখুঁত সাযুজ্য! কিন্তু সে তো বিস্ময় নয়। কবিতা বাক্রুদ্ধ করে যখন সে নিজেকে খুলে দেখায় রোজ রোজ নতুন আঙ্গিকে। আমি, ব্যক্তিগতভাবে তাই, প্রথমটিকে (১/ক) এড়িয়ে দ্বিতীয় সংখ্যক কবিতাটি পছন্দ করেছি (১/খ)।
“কোঁকড়ানো শুনশান, শীত ঘেঁটে
ফলতঃ বডি পড়ে ঝাঁকড়া সীমানার
রূপোলী কামিনা আর আঁটছেনা চাঁদের বনেটে
গাছের চেন টেনে নেমেছিলে, তুমি সেই কবেকার নির্জন জরিমানা”

কেন? বলতে হয় যে, তৃতীয় পঙ্ক্তিটি দ্বিতীয় বা প্রথম বা চতুর্থ পঙ্ক্তি হবার থেকে বেশি সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে! এবং এটি একটি ইন্টারপোলেটেড কারণ— একটি সমষ্টিজাতীয় (Cumulative) গবেষণা করলে এর পাশাপাশি আর-ও অনেকগুলি কারণ শৈবালিত হয় যে, মিরর ইমেজ কবিতাগুলি প্রণিধাণযোগ্য, পাঠে সঞ্চরণশীল এবং একমেরুদণ্ডের বিকল্প এক বহুমেরু (দণ্ডের) বিশ্বকে উপায় করেছে চলিত হাওয়ায়! এ ছাড়া আর-ও বড়ো গল্প সম্ভাবনার। যেমন আবার, (২/ক) বরফে চাপা পড়া এক মাইক্রোচিপের সন্ধান দিয়েছে যা ক্রমশ অমিতাভ প্রহরাজের অন্যতম সিগনেচারের রূপ নিয়েছে।
“হাওয়ায় কোমরকুচি ওড়ে
কুয়াশা কুয়াশা ক’রে কোমায় ময়লা
তিনদিক ঘোলা চুল থেকে তুমি শুরু চলে মোড়ে
তন্দ্রা ফলো করি, না বলা গলিতে জাত্‌ হিম টলে একা, হোঁচটে ছয়লাপ”

“…হাওয়ায় কোমরকুচি ওড়ে”— দ্যাখার এ এক নবনাট্য পদ্ধতি, যা তাকে সেক্সিয়ার করে, সুচারু ও হোমোজিনিয়াস করে ক্লান্তিকে ডাইলুট করে দ্যায়! এই ইন্দ্রিয়গামীতার অন্যান্য ডায়মেনশন-ও ভিজিব্‌ল, যেমন—

১. “কোনো ব্রণতলে এসো জিভ, বোসো জিভ, দানা দানা বেদানা বেদানা জিভ” (৪/খ)
২. “উরুতলা থেকে দূরে, ফাইভ হার্টস শীত ঘোরে, একচুল দহ-র বরজে” (৫/ক)

আবার এই বাংলাভাষার উৎকর্ষে বি-শার্প ছুঁয়েছে কিছু কিছু শব্দবোল্ট, যেমন—

৩. “এই ঘাগরা তুলে চলা সমাস, কার প্রাণে? এই রোহিনীবাক্যের অট্টরেপ?” (৬/খ)
৪. “আসলে চেনা ফুঁ-এর সাথে ডাহা রাত জেগে” (৮/ক)

যত পরিণতি পেয়েছে লেখাগুলি, প্রতিটি পঙ্ক্তি আরও শব্দনির্ভর হয়ে উঠেছে— ফলস্বরূপ আরও বেশি শব্দ পেয়েছি আমরা, পাঠকেরা। কিন্তু এই সংশ্লেষ ও বিশ্লেষ এক ধারাবাহিক পদ্ধতি, এবং এর মধ্যে মুখোমুখি লেখক-পাঠকের পরিচিত দৃশ্যটি নেই। বরং অমিতাভ-র লেখার ধারায় কোন লেখা সম্পূর্ণ কবির, কোনোটি একান্ত-ই পাঠকের। একসাথে পাঠকের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, সেখানে কবির উপস্থিতি কম। যেন আছোলা মণ্ড হাতে দিয়ে বলা হচ্ছে যাও— ইচ্ছামতো মেজেঘষে নাও গে। এদিকে আবার কবিই গোপন পুষছেন সাবেকী ভঙ্গিতে পাঠকের ডিকোডিং-রিস্ট্রাকচারিং মেথডগুলির উপর কর্তৃত্ব করতে। সব মিলিয়ে পাঠকপদ্ধতিতেও, অনেকটা চৌহদ্দি জুড়ে কবি বিরাজ করছেন। উদাহরণ—
“ভাঙা ঘড়গাজমে বাদুর বিয়োনো
কুয়ো বাজে, মৃদু, রুলটানা, কোলে থই-এর ছাল
গলির ডাঁটায় রটে রোদ, ছোট ছোট ডুকরে শুকোয়, শোনো
সরকাইলো টিয়া, দাওয়ায় কচি লাগে, হাওয়ায় টালু ডলে টালটামালির চাল”

পড়তে পড়তে মনে হতে পারে, এ এক অলৌকিক কোলোকিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ! বাস্তবিক— হ্যাঁ তাই। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবির অবচেতনে ক্রমশ জমতে থাকে যে পাঠকের ভালো লাগা না-লাগার এক নিঃশব্দ পুটিংপ্রলেপ— অমিতাভ-র কবিতাপ্রসেসের গ্রাফে তেমন কোনো ট্রেন্ড নেই। আজ সাতবছর পরেও তার লেখায় এই পুরোনো প্রস্তর যুগের মতো পাঠককে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া উল্কাবৃষ্টি সমানভাবে অব্যাহত। উঁকি দেওয়া যাক তাঁর শেষতম গ্রন্থ (?), “লাজুক লটারিদের ডায়রী”-র একটি পাতায়। এখানে কবি অনেকটাই স্ব-নিযুক্ত, স্বপরাগী, খোলামেলা এবং লেখার মধ্যগগণে হিডেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

“১. যদি তোমাকে দেখে হাততালি দেয়, ভ্রুণকে ধমকাও আগে। পরে তামাক দিও।
২. আঙুলের কথা জড়িয়ে আঙুরের পর আঙুর উড়ছে
৩. রাত হলে বালি থেকে বেওয়াফা অভ্র উড়ে যায়
৪. যেকোনো ভাইস ভার্সা আসলে জঙ্গল থেকে আসে
৫. অর্গাজমের পর ডাকব্যবস্থার ঘাম জমে চোখে
৬. অবচেতনের থেকে প্রচুর বাবুসোনা ঝরে পড়ে খাতার পাতায়, দম দেওয়া সাদা…
৭. চা বাগান কখনোই সুপারি দেবে না। তুমিও দিও না।
৮. জাদুর অসংলগ্নে রূপসীহুমড়ি পেয়েছি আমি”

প্রণিধাণযোগ্য যে— আদ্যন্ত মৌলিকত্বের পাশাপাশি কিছুটা সময় জমে পাথর হয়েছে তার ঝুলিতে। এমন এক পথ, যেখানে পদে পদে সন্ত্রস্ত না হলে সমূহ বিপদ লঘুত্বের, আক্রমণের— সেখানে এই স্বচ্ছন্দচলন এক বাড়তি ভরসা বৈকি। এবং কবিতা লেখার প্রসেস ইটসেলফ কবিকে কীভাবে প্রভাবিত করে বা করেছে, তা নিয়ে কবি নিজে কী বলেন?

“যে-কোনো লেখার সময়, বিশেষ করে কবিতা, আমাকে একটা জটিল প্রসেস চালাতে হয়। আমি নিজে এই ফিলিংসটা আনতে পারি না যে, এই লাইন বা এই ইউজটা খুব ভালো হয়েছে। এই বোধটা আনার জন্য আমাকে ইমাজিন করতে হয় যে অন্য কেউ, দেবা বা ইন্দ্রনীল এই লেখাটাকে ভালো বলছে।” (ঘ., লাজুক লটারীদের ডায়রী)।

অমিতাভ প্রহরাজের অলৌকিক ভাষা ও অভিজাত সঞ্চরণভঙ্গি এক খোলাদরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে সর্বদা, যেন এখুনি আমাদের টা-টা করে চলে যাবে ওই জগৎবিচ্ছিন্ন নার্নিয়ায়। কিন্তু প্রতিটি পশুপাখির মতো এ-রাজ্যেও লেখার ও লেখাদের কিছু কিছু কাউণ্টারপার্ট পড়ে থাকে। বিভ্রান্তি আসতেই পারে যে, ওইটুকুই প্রাপ্তি। অথবা ওই প্রাপ্তির এপিঠ-ওপিঠে কিছু বেকার সিগারেট ফিল্টার পড়ে রয়েছে, আসল মানুষটি হাওয়া! কতটুকু ব্যক্ত তাই সত্য আর কতটুকু অব্যক্ত তাই পথচারীর করুণার উপরে নির্ভরশীল— তা নিরূপণ করা নিতান্ত দুরূহ! এখানেই অমিতাভ প্রহরাজের প্রকৃত রাজপাট!


কেউ কেউ বেরোন না বিকেলে, কেউ কেউ সূর্যাস্তের তলায় ভিজতে ভিজতে চোখের কোল থেকে বৃষ্টির ফোঁটা দুই আঙুলে তুলে উড়িয়ে দ্যান বাতাসে। কেউ কেউ আবার জনমদুখিনী, টিভির সামনে থেকে কোথাও যান না, কেবল শীত পড়লে এক-আধটা মেঠো কম্বলকে সঙ্গে ন্যান। এইপ্রকার বিপুল কার্মকাণ্ডের আধার বলে কল্পনা করা যায় যে বৃদ্ধাবাস— ঋপণ আর্য্যের কবিতা, তাঁর গদ্য এবং তার রুদ্রপুর তার কন্দরে কন্দরে-র গোলাপায়রা! বহু পুরোনো এক বাড়ির গন্ধ-ও যেমন এক কিশোরের কাছে নতুন— তেমন এক আরাম ছড়িয়ে যায় ভোরের সাইকেলধর্মী পটচিত্রে, যখন ঋপণ লেখে—
“ছেলেবেলায় বাবা একটা কাগজের জাহাজ তৈরী করে
দিয়েছিলেন…আজ সেটা মোমের আলোয় ভাসালাম”

ভারি মিষ্টি এক প্রচ্ছদাকীর্ণ কবিতাবই, “মোমবাতি ও স্বপ্নের কবিতারা”। মূলত দু-টি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের কবিতাগুলি এক থেকে এগারো এই ক্রমিক সংখ্যায় সজ্জিত। এবং পরবর্তী কবিতাগুলি শিরোনাম-সহ। উৎসর্গপত্রটি রুদ্রপুর ও প্রকৃতির নিজস্ব ঋপণের উচ্চারণ—
“হলুদফুল
পাশবালিশ
ধুলোবালি
ফিসফিস”

ঋপণের ভাষাকে কোনো এক দাগের সরলরেখায় আনা যে যায় না— এ তথ্য তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু, যেটুকু যায়— তা, আগেই বলেছি, প্রকৃতিকে ঋপণের রেখায় দাগিয়ে দেওয়া। এবং প্রকৃতি মানে কী? একটি আটপৌরে ঘর, তার ভিতরে মেঘলা সারাদিনের ঠান্ডায় থরথর গুটিশুটি এক মোমবাতি। ঋপণের বাড়ির দাওয়ায় রোদ পড়েছে, গরুকে আদর করছে ঋপণের বোন। হয়তো লাগোয়া মেটে রাস্তায় প্রচুর ছায়ার তলা দিয়ে চেনা অচেনা সাইকেল চলে গেল— বসে আছে সম্বিত, রোহণ, পার্থপ্রতিম। এইভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লোভীর মতো দেখি শিশুসরল ঋপণের লেখাকে, যতটুকু চোখ কার্পন্য না করে মেলে রাখে। ঋপণের ভাষা সুবৃহৎ এক আই-লিডের মতো। উঠছে নামছে আর সামান্য স্পন্দনে মাঝসমুদ্রে জাহাজ বিপদে পড়ছে।
“কিছু সত্যের ভূমিকায়, কিছু মিথ্যের আশ্রয়ে
প্রতিশ্রুতিরা দেওয়াল লিখন হয়ে যায় ।
যার সাশ্রয় মূল্য নেই, তার অধিকার মূল্য
আমাদের গ্রাস করে…”

এক দীর্ঘ স্কেলের মাপে এই অংশটুকু আমাদের অনেকখানিকে ধরেছে, স্বভাবত প্রাজ্ঞ এক অর্থনীতিবিদের চশমার মতো। যেখানে শুধু ফিগার-ফ্যাক্ট ছাড়াও খাতার পাশে রাখা শিরাবহুল আঙুলের ছায়াও পড়েছে। নইলে, একে নিছক রাজনৈতীক কেচ্ছার দেওয়াললিখিত রূপ হিসেবে ভাবতে পারছি না কেন? কারণ, কবিতায় মোমের উৎসের মতো আশাবাদ আছে, শান্তি-স্মৃতি-কাম ও সত্য-মিথ্যার চিরকালীন গার্হ্যস্থ্য-ও রয়েছে। নৌকোটি এসে ঠেকছে এমন এক চড়ায়, সেখানে—
“কিছু কিছু সত্য ভূমিকায়–
দাহ-র ওজন বেশি হলে
রাতের আঙুল মোমের মত জ্বলে।।”

সুতরাং, ক্রমশ প্রকাশ্য যে, “মোমবাতি ও স্বপ্নের কবিতারা” এক নির্বাক মোমের পরাস্বপর আত্মকথন, যে কিনা নিজে জ্বলে। আর কে না জানে, নিজে নিজে জ্বলে আলো দেওয়া বড়ো কষ্টের, বড়ো প্রতিভার। পাঁচ নং কবিতা—
“ঠায় দাড়িয়ে থাকতে থাকতে বৃক্ষের প্রসারিত বাহুও
ভালোবাসার বিরুদ্ধাচরণ শেখায় ।
যার জন্য অস্তিত্ব, তার জন্য টিউশানি ফেরত
শিমুল বোঝে— ‘নিজস্ব ক্ষমতা আপেক্ষিক…’
চুম্বক দণ্ডের বিপরীত ক্রিয়ার মতোই
আকর্ষণ আত্মহত্যা করে অথবা পাগল হয়ে যায়।”

না, ঋপণের কোনো লেখাই ন্যারেটিভ নয়। বরং উলটো! ক্রমশ বাহির থেকে ঘর, ঘর থেকে অন্তর— এই ক্রোনোলজি ফলো করে কবিতা আত্মগত হয়ে ওঠে। এই দর্শনকে যদি অ-বিনির্মাণ বলা যায়, তবে হয়তো আমরা টের পাব যে— ঋপণের কবিতায় এই অন্তর ও উপলগ্ধির পসরা আসলে বাহিরেরই ছদ্মবেশ। সূর্যোদয়ের কোমরে জ্যান্ত বিছাহারের মত এক বৃদ্ধাশ্রম।

পরবর্তী অংশে ঋপণ উদ্বায়ী, কিয়ৎ অধরা এবং অবশ্য অবশ্য ইলাবরেটিভ, এক্সপেরিমেন্টেটিভ। কবিতার স্বচ্ছন্দ চারণ কখনো নিয়মিত কখনো অনিয়ত চলনে উজ্জ্বলে এসেছে। বিষয়ের গভীরতা ওকে আজব করেছে অভিজ্ঞতায়, তার এখানে ওখানে শুকিয়ে থাকছে চারণের ফুল। এভাবে বরফ জমে, এইভাবেই মন্দাক্রান্তা সগর্ভ হয় গতির সন্ন্যাসী আত্মায়। ঋপণ লেখে—
“কখন কিভাবে চেনা চোখ ভিজে গেছে
সম্পর্ক-ই খুঁজে ফেরে তার মানে
ঝড় তুমি এসো, হিসাবকে মেনে নিও
ভাঙা কিছু কথা রেখে যাও কানে কানে”
(“আছি” সংক্রান্ত)

খুব সূক্ষ্ম দাঁড়া আমাদের, সময়ের মতো বিপুল কড়াই-এর মাঝখানে নির্জীব চিংড়ী আমরা সামান্য সামান্য নাড়ি। এই নড়াচড়া বড়ো কল্পনাতীত, ক্ষুদ্র— তবুও, প্রতিটি নড়াচড়াই এক একটি আলোকোজ্জ্বল মোমবাতি। আমাদের ক্ষুদ্রের ধারণা তাই এই আয়নাতেই লুব্ধ, লালিত। ঋপণ স্থায়িত্বকে মেখে ফেলছে ক্ষুদ্রতা দিয়ে, চেতনাকে বিদ্ধ করছে জড় দিয়ে! মহাসময়কে ছোটো করে আনছে আঁজলায়। আমরা পড়ছি—
“পাঁচিল ভাঙতে চায়নি যারা,
তারাও ভাঙে…
দেওয়ালের সেই পেরেকটি
সব ভুলেও ভাঙে না অহংকার–
গতবারের জায়গায়
ঝুলে এবারের ক্যালেণ্ডার”

আবার কখনো কবিতা অন্তর্গতভাবে স্পেসিফিক হয়েছে, ফর্ম নিয়েছে মাইক্রোলেভেলে কিছু নির্দিষ্ট সাহিত্যমাধ্যমকে আত্তীকৃত করে। এখানে ঋপণের একটি কৃতিত্ব বড়ো বেশি করে চোখে পড়ে। যে-ধারাই হোক, যে-পরিবেশই বুদ্বুদ কাটুক তাৎক্ষণিকের চারিপাশে, কুশলী শিল্পী ঋপণ তাকে ছোটো ও বাক্সবন্দী করতে পারে অনায়াসে। “মিনিয়েচারাইজ্‌ড” বা “বনসাঁই” শব্দগুলি এক্ষেত্রে খাটে না, কারণ, সামান্য তিন কি চার পঙ্ক্তি জুড়ে যে-কোনো রসের আবহ এবং খুঁটিনাটি বড়ো স্পষ্টাস্পষ্টি বজায় থাকে— যেন কি হোল দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বিরাট নাচঘর!

প্রথম দৃশ্য— মলাটহীন একজোড়া দেহ

দ্বিতীয় দৃশ্য— পরজন্মের গাঢ় অসুখ

তৃতীয় দৃশ্য— মাঝে মাঝে চাদের নেমে এসে
মাটি খোঁড়া
প্রদত্ত দৃশ্য-স্বরূপ সূত্রগুলো জড়ো করলেই
সম্পর্কের মাঝে মেদ-মাংসহীন দুজোড়া চোখ
গড়াগড়ি খায়

(কেলাসিত সূত্র)

এই কবিতাটির শিরোনাম রসায়নের ছাত্রদের কাছে টেকনিকালি ভুল। সূত্রের কেলাসন হয় না, বরং কেলাসনের সূত্র রয়েছে। কিন্তু যে-বাঁকে রসায়ন বৃহত্তর সংজ্ঞা ধারণ করেছে, সেই বাঁকে একচক্ষু সাইক্লপ্‌সের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে এক স্তম্ভ। এখানে কবিতার আশ্রয়দাতা মাধ্যমটি নাটক, শিরোনাম আদর্শ রসায়ন। আর দৃশ্যগুলি কী? অঙ্কগুলি কী? পরস্পরের অঙ্কশায়িত দু-টি নগ্ন— দীর্ঘ বাসি রতিকাল— চাঁদের আচমকা ইনট্রুশনে ঘামার্ত স্তন-নিতম্ব-থাইসর্বস্ব একটি উভলিঙ্গ ফুল ঝলসালো! এই তো মর্মরমূর্তি! এবং সূত্রগুলি কেলাসিত হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে— “সম্পর্কের মাঝে/মেদ-মাংসহীন দু’জোড়া চোখ/গড়াগড়ি খায়”! এক-একটি স্ফটিকের দ্যুতি তার নিজস্ব শক্তির স্তর। তারা অন্য রূপে এলে স্বভাবতঃই আলো পড়ে অন্য কোণ থেকে। এই আপাত নিরীহ বাক্যটির ভিতরে এক জ্বলজ্বলে প্যান্থার ঠোঁট ও থাবা চাটছে! অন্ধকার আঁকা হয়ে গ্যাছে তার চারকোলকাঁধে, চকচকে কণ্ঠায়! এক সম্পর্কের নাট্য-অধ্যুষিত ছেদন ঘটল শিয়ার কাম থেকে সম্পর্কের কমকথায়! এখানেই ঠা-ঠা শব্দে হেসে উঠে ফেটে পড়ছে কবিতা! দুষ্মন্ত-শকুন্তলাকে, মালবিকা-অগ্নিমিত্রকে ছাপিয়ে তাদের শরীর, মন ও সচলের নির্যাসটুকু উপজীব্য হয়ে উঠছে উপভোগের। শব্দ নয়, ছবি নয়, নাটক নয়, এমনকী রসায়ন-ও নয়— কবিতার ঐকান্তিক পরিচয় সে বানিয়ে নিচ্ছে এই মিশেলে এই ক্ষুদ্রান্ত্রে! সে কবিতা!


এতক্ষণ যাদের কথা হচ্ছিল, তারা প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর নিবন্ধকারের পূর্বপরিচিত। কেউ কেউ, যেমন রঙ্গীত মিত্র দীর্ঘদিনের পরিচয়ে আত্মীয়তায় কবিতায় প্রায় শিকড়লাঞ্ছিত পাঁচিল ও গাছের মতো-ই ওতপ্রোত! রমিত দে কি তার ব্যাতিক্রম? নাকি অনেক অনেক বেশি অন্তরঙ্গ? কে জানে? তবে একটি প্রবাসী রমিতদা-র সঙ্গে এক আন্তর্জালিক রমিতদা-র, এবং আন্তর্জালিক রমিতদা-র সঙ্গে “বাক্‌” ব্লগজিনের অন্যতম আকর্ষণ রমিতদা-র পরিচয়গুলি, তাঁর কবিতার মতো-ই। একে-অপরের থেকে ডিসক্রিট, যেন ইমালসন! কিন্তু প্রবল আলোড়নের মধ্যে কিছুই পৃথক হয় না বদান্য হয় না। ধারাবাহিক রমিত দে বিচ্ছিন্নতার রমিত দে-র থেকে অনেকাংশে ভিন্ন, প্রশস্ত, কোথাও অসুস্থ! কোথাও কোথাও বিপুল ভিয়েনের মধ্যে ফুটছে দু-টি-একটি নির্ভরযোগ্য মুক্তকণা! রমিতদা-র একটি কাব্যগ্রন্থের নাম— “মারাসিম”! উর্দু শব্দটির অর্থ সম্পর্কেরা! উৎসর্গপত্রে— আমার মা-কে!

পরের পাতায় প্রণিধাণযোগ্য উদ্ধৃতি ড. রফি হাবিব (M.A.R. Habib) প্রণিত একটি কবিতা থেকে। জানা-কে এক অখ্যাত মিথ্যের আঘাত বলে বিদ্ধ করছেন বিদগ্ধ স্কলার। প্রতিটি চেনামুখ, প্রতিটি পরিচিত শব্দ এখন “স্ট্রেঞ্জ”, অদ্ভূত! অসাধারণ এই কবিতাটির সঙ্গে কীভাবে সিনক্রোনাইজ সম্পর্কেরা, পৃথিবীর আদিমতম সম্পর্কের প্রতি উৎসর্গিকৃত বইটির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রমিত তা আবিষ্কার করতে আহবান করছেন, আমাদের! প্রতিটি রমিতের সঙ্গে নিবন্ধকারের (পড়ুন পাঠকের) সম্পর্কগুলি ক্রমশ পুনর্মূল্যায়িত হবে এক পাঠসাইকেলে!

প্রথম কবিতাটি এক আদ্যন্ত পেন্টিং-এর বঙ্গানুবাদ— এই-ই মনে হয়েছে! কারণ, বিমূর্ততা নয়, পরাবাস্তবতা জড়িয়ে ধরেছে যে-সব ছবিকে— তারা যেন শব্দে এসে মুক্তি খুঁজছে! কবি লিখছেন—

সারাদিন কেটে গেল
স্নান করতে এসে দেখি আমার গিটারের তার ছেড়া,
এখন, পাঁচতলা বাড়িটার নিচে দাঁড়িয়ে
ফুলিয়ে নিচ্ছি ফুসফুসের লেস
তিনটে সাদা আর একটা কালো মৌটুসী পাখিকে
বলছি হ্যালো, হ্যালো, তোমরা কি শুনতে পাচ্ছো?

পাঠক ধরে ধরে চলুন সরু পাঁচিলটাকে, ড্রেনের কানাটি বড়ই অপরিসর— যে-কোনো মুহূর্তে পা হড়কাতে পারে। ড্রেন মানে তো সিউয়েজ, নিকাশ! শব্দটির সারাগায়েই আবর্জনা মাখা! দেখবেন, আমরা এখনও প্রোমোটার-আক্রান্ত একটি বাড়ির আশেপাশেই ঘুরছি। আমাদের গোড়া থেকে-র যে-বাণ-পালটা বাণক্ষেপ, তার প্রাণবায়ু কিন্তু একটিই। শূন্যের কবিতা পাঠককে প্রভাবিত করে। কীভাবে, কী পদ্ধতিতে করবে এবং তার ফল শরীরে কী দাঁড়াবে তা কবি টু কবি, মোর প্রিসাইজলি, কবিতা টু কবিতা বিভিন্ন হবে। দেখুন যে, পালক নাকি ছুরি, বুলডোজার নাকি হাতপাখা— কী নিয়ে আসছে প্রভাব মানুষের আশেপাশে— যা নিয়েই আসুক, সে সামাজিক। অসামাজিকতা-ও সমাজ থেকে উদ্ভুত ও সমাজলালিত! তাই কবিতা তাকে ন্যায় ও অঙ্গীভূত করে। এক্ষেত্রে— আমরা বাড়িটির সঙ্গে ধ্রুবকের মতো লেপ্টে আছি এবং অনেকে বোকার মতো ফুসফুস হাতড়াচ্ছি একটুকরো লেস পাবার আশায়! সত্যিই কি সেই ব্যারিয়ার আমরা পেরিয়ে আসিনি? নেভারদিলেস, “সারাদিন কেটে গেল” বলার মধ্যে কবি প্রথমেই সারাদিন কাটিয়ে ফিরছেন কবিতায়— পাঠক তাকে অবসরে পাচ্ছে। প্রতিটি লাইনে ছবিটি তার এক এক রহস্যকে মুক্ত করছে— সারাদিনকেই ধরছে— তবে আপামরে, আশিরপদনখরে— একের সঙ্গে অন্যকে প্রাসঙ্গিক করে ফেলে! এবং এই তালগোলপাকানো আর্তি-ও শব্দ হয়ে ফুটে উঠছে— হ্যালো/হ্যালো, তোমরা কি/শুনতে পাচ্ছো?

প্রসঙ্গত, এই বই-এ কবিতাগুলি সংখ্যায় দু-টি করে প্রতিটি পাতার উপরে বাম ও নীচে ডান দিকে বিন্যস্ত। এক বিপুল ও বিচিত্র ক্ষণিকাসম্ভারেরর স্বাদ একমাত্র পাঠযোগেই নেওয়া সম্ভব! আমরা ছড়িয়ে পড়ব এইসব লেখার আশেপাশে, মেঝেতেই, যেমন লেখাগুলি ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের মধ্যে। কবিকে ধন্যবাদ, পরবর্তীতেই আকাশ ছোঁয়ার মত দুরূহ তিনি ঘটিয়ে ফেলেছেন— এক বন্ধনীতে এনে ফেলেছেন একাধিক সম্পর্ককে; তার অবচেতনের চাতুর্য্য কিছুটা গোপন করেছে একে, শব্দ দিয়েই। আমরা কনফিউজ্‌ড!

অনেকটা দূর থেকে কথা হয়েছিল আমাদের।
অনেকটা দূর— এই ধরো, যেখান থেকে
একটা ব্যাঙ অর্ধেক জলে পা ধুতে ধুতে
ধুতে ধুতে বৃষ্টি হয়ে গেল।
আমি ঠিকানা দিইনি জলবন্দী গেরস্তের,
এখন দশমাস, ফুসফুসের ভেতর সব পা হারানো দিন
এখন দশমাস অনেক দূর থেকে কথা হবে আমাদের।

গোটা গোটা শব্দে বললে— মা সন্তান(দের)-কে, পিতা সন্তান(দের)-কে, প্রেমিক তার প্রসবা প্রেমিকাকে, নাকি সন্তান(রা)-ই তাদের পিতা বা মাতাকে এই মেসেজ ছুঁড়ে দিচ্ছেন— এই খাদে (পড়ুন ফাঁদে) আমরা প্রথমেই পতিত হই! আক্ষরিক, কারণ সম্পর্কেরা যে নিছক শব্দমাত্র নয়— গভীরতার রূপভেদ হলেও তার ট্রেজার বদলায় না— মারাসিমকে এই মর্মে গেঁথে দিলেন কবি। পাঠক লজ্জায় পড়ছে। সে আয়নাটি রেখে এবার মুখ দেখতে শুরু করল জলে, নিদেন পথিকের চাহনিতে, ধৃষ্টতায়, সৌজন্যে!

এ ক্ষেত্রে অবশ্য পাওয়া যাবে একটি নিশানা, মোড অফ কন্টিন্যুইটি যাকে আশ্রয় করেছে, সেই “ফুসফুস”-এর উল্লেখ। প্রতিটি শিশুর প্রথম কান্নায় ফুসফুস ফুলে ওঠে! অর্থাৎ কান্না থেকে জীবনের শুরু! কিন্তু এখানে কান্নার থেকে বেশি অস্পষ্ট একটি একক ক্রিয়াশীল-তা দুরত্ব। মায়ের ভিতরে থেকেও নির্বাক শিশুর সঙ্গে মায়ের যে-দুরত্ব, তার সঙ্গে পার্থক্য রয়েছে স্পষ্ট— অচেতন শিশুর সঙ্গে তার ধারিনী মায়ের মধ্যেকার দুরত্বের। সম্পর্কের দুই মেরুতে দুরত্বের সংজ্ঞা ভিন্ন!

দুরত্ব-ই আবার পাখনা ঠুকরোচ্ছে একটু চড়া রদে, দেখুন পাঠক—

ফিরে যাওয়ার শব্দগুলো
চুরি করে রেখে আসি ফোটার আগেই।
ভাবি, এই বেশ ভালো, আলো জ্বেলে
শাড়ি পরিয়ে দেব ডাগর বিষগ্নতাকে
শুধু, থাকা এবং না-থাকা
বাকিটুকু ফিরে গেছে জলের দিকে
ঘাসে-জলে থেমে যাওয়া বাসি গন্ধের দিকে।

জল এবং ফিরে যাওয়া, ফিরে যায়— এই দুই অমোঘের উল্লেখ আমরা আগেও দেখেছি। হয়তো এ প্রবাসী কবির শিয়র, হয়তো আহত পাখির দৃষ্টি! কিন্তু যাই-ই হোক, সম্পর্ককে গ্রন্থিবদ্ধ করতে এরাও! এরাই! শব্দ এখানে ফোটার আগেই চুরি হয়ে গিয়েছে স্বয়ং কবির দ্বারা! তবে আর কবিতার জন্য কী পড়ে রইল? তিনি এবার বুনছেন কবিতাকে শব্দের মনোপলিবীহিন এক রমিত-রাজপাটে, বিষণ্ণতাকে পড়াচ্ছেন শাড়ি। আলো জ্বালছেন, যেন স্বভাবসুলভ সলজ্জ লুকোতে না পারে যে বিষন্নতানাম্নী তারও দুটি ডাগর বুক রয়েছে, দু-টি কালো পাখির ঠোঁট রয়েছে আদর খাবার জন্য! “থাকা এবং না-থাকা”-র আগে অবশ্য “শুধু” আসতেই পারে। এ-ব্যাতিত আর কী? কিন্তু “,” কেন? ওয়েল, শুধুটিও রয়েছে বাকিটুকুর আওতার বাইরে। বিষণ্ণতা-আচ্ছন্ন কবির কাছে শুধুটুকু অন্যতর সম্পদ। চুরির প্রথমতর শব্দধন হয়তো! এবং বাসি গন্ধের এক আবহ পুরো কবিতায় জড়িয়ে আছে তাকে জীবন্ত করে এখানে বর্ণনা— “ঘাসে-জলে থেমে যাওয়া বাসি গন্ধের দিকে।” সব মিলিয়ে, (বা, সব কি মেলে কখনো?) অন্যতম বললে সারাবই-এর প্রত্যেক অন্যতম ধেয়ে আসবে এদিকে। বলি, সিগনিফিক্যান্ট। ইক্যুয়ালি উদ্ধৃতিযোগ্য!

পুরো বইটিই অজস্র উদ্ধৃতিযোগ্য অস্ত্রে সজ্জিত। বস্তুত, একটি কনটুর ম্যাপ যেন আগাগড়া ছেয়ে এক দীর্ঘজীবী বালিয়াড়ি-অধ্যুষিতকে প্রাণের আশ্রয় করেছে। এখানে লজিক বা অ্যান্টি-লজিক জাতীয় চোখ-ফোটানো মন-ভরানো তত্ত্ব বিস্তৃত হতে পারে না। বা হয়তো পারে, কিন্তু এ-কথা অবশ্যস্বীকার্য্য যে, রমিতের কবিতা শূন্যের বাকি অধিবাসীদের থেকে স্বাতন্ত্রে-স্বচ্ছ্বে-বিকিরণে পৃথক! এবং সম্পর্কাবলী কখনো স্বাকার প্রতিপ্রশ্নে, নিজেকে জর্জরিত করতে—

কি চাও? যৌনত।
দেখো, কেমন বেঁচে থাকি শুধু অনিমেষ সান্নিধ্যে।
আসলে জাগরণ মনে আছে,
সেই যে তোমায় ছুঁলাম ভোর বলে
তারপর তো কত মুহূর্ত— নির্মাণ বিনির্মাণ
তবু, সমান্তরালে আঁকতে পারলাম না—
সাদা রংএর আরও একটা বাড়ি।

খুব সরল ও অসহায়ে গিয়েছেন কবি, ফর আ চেঞ্জ! গুটি খুলেছেন বসন্তের, কারণ বসন্তের আশেপাশেই সবচেয়ে অসহায় জ্যোৎস্নাগুলি থাকে। ক্যাম্পফায়ার শুরু হলেই দাঁড়া বার করে গুটি গুটি এসে জড়ো হয়। ওদের কণ্ঠে বিকার ও সত্যি লুকোবার আভাস স্পষ্ট! ওরা প্রেমকে প্রতিবন্ধী করে! সম্পর্কের একক কবির আঙুলের ফাঁক গলে একটি প্রশ্ন নির্গত— কী চাও? যৌনতা? হ্যাঁ— প্রতিটি সম্পর্ক প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে যৌনতানির্মিত, তাই না? কিন্তু এই তথ্য জানতে কি কবি হতে হয়? অথবা, অন দ্য কন্ট্রারি, প্রতিটি কবি কি এই তথ্য জানে? পূর্বরাগের একটি স্পর্শ আরও পরিণত থালায় সাজিয়েছেন কবি— “সেই যে তোমায় ছুঁলাম ভোর বলে”। এবং চির-অপ্রাপ্তিটুকু ব্যক্ত করতে তাকে আর কান্নায় যেতে হয়না, বিষাদ নিজেই মূর্ত হয়— “তবু, সমান্তরালে আঁকতে পারলাম না—/সাদা রং-এর আরও একটা বাড়ি।”

এই পদ্ধতিতে আবার-ও “মারাসিম” তৈরি হতে থাকে একের পর এক! যেমন হাবিব বলেছেন,

All around are strange people, strange words : Some slide over the heart, others pierce it.

শূন্যে উন্নিত কারিগরী

ও পর্যন্ত ধেয়ে আসা যাবতীয় শরসন্ধান মুক্তিমূলক— এই দশকের ছটফটানি থেকে তাদের মহাপ্রস্থান এক মহাজাগতিক লিবার্টির দিকে, যা অবশ্যই রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক শ্রেণি-অবস্থানপ্রসূত ব্যাখ্যাপ্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু শূন্যের এক সাধারণ পাঠক হিসেবে, স্বল্প রিসোর্সের এ প্রান্তে বসে থাকা কবিযশোঃপ্রার্থীর মরাল থেকে, বলাই বাহুল্য, ব্যাখ্যার গল্প কয়েক পোঁচ বর্ণব্যাতিত উপস্থাপিত হয় না। এখানে লেগে থাকে মায়াকাজল— অস্তিত্বরক্ষার্থপদবীসম্ভূত এক ডিসেন্ডিং ইল্যুশনের, অথবা উল্টোটির! কিন্তু এই দশকীয় সেনসেক্স যেমন থামতে দেয় না, মতকে থিতু হতে দেয় না কোনো ডিকশনে! গতি আর বড়ো বেশি সত্যি সবার কোচড়ে। আমি এক প্রত্নবাস্তুচেহারার কাঙাল বারবার রোমন্থন করি রুপোলির সোনালিসময়কে। “অযান্ত্রিক”-এর দ্বন্দ্বটি কবিতা বিষয়ের ঊর্ধ্ব আঙ্গিকে আত্মস্থ করে নিয়েছে। আমরা কেউ কেউ, ঋপণের দেওয়া মোমবাতি হাতে সেই আঙ্গিককে অবসরলাঞ্ছিত করছি সিঁড়ি ভেঙে, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে!

সবশেষের হিপোক্রেসি-টি একটি আফশোষের, একটি ব্যাঙ ও প্যাঁচার আন্তঃপ্রজাতীয় অন্তঃক্রিয়ার জীবন্ত সাইকো অ্যানালিসিস। তার আগে ক্ষমাপ্রার্থনা রইল শূন্য দশকের অযুত নিযুত নিভৃত সেইসব বন্দীদের যারা নিজেদের ছাল ছাড়িয়ে কারাগার ভাঙবার চেষ্টা করছেন। এই একটি দশক দীর্ঘায়িত হচ্ছে ক্রমশ— সময়সীমা তাকে ওয়ার্ড অফ অনার দিয়েছে। শূন্য দশকের কবিরা স্বভাবএকা, দুর্নামে দুঃশাসন, জন্মধর্ষিত-ধর্ষিতার দল যারা ট্রমাকে পাশে বসিয়ে কফির পেয়ালা ও কবিতা অফার করছেন। তাদের উদ্দেশে সেই অনুপম মুখোপাধ্যায়সঞ্জাত একটিকেই এপিটাফ করে ইতি দিয়ে যাচ্ছি এই লেখায়, পরের অংশ আরও তৃপ্তিবিরচিত অর্গাজমসমেত ফিরে আসবার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি চকোলেটের ভিতরে পুরে।

প্লাটফর্মকে পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন।
চেঁচিয়ে বলার কেউ নেই যে মিথ্যে।

টুপি ঘুরিয়ে কেউ বলল – হ্যাঁ।
টুপি ঘুরিয়ে কেউ বলল – না।

লোকটার চেয়ে হয়তো লোকটা অনেক বড়ো! ছবিতে
কোনোরকমে আছে।।
সিগারেটের ধোঁয়ায় ওর সিগারেটটাই দেখা যাচ্ছে না।

সূত্র:
১. অনুপম মুখোপাধ্যায়। “যার নাম অপরাজিতা, সেও কিন্তু নামকরনে হেরে যায়” । ২০০৭। কবিতা ক্যাম্পাস।
২. রঙ্গীত মিত্র। “আতরের বাক্স থেকে যে সব নাম হারিয়ে গেছে…”। ২০০৯।
৩. অমিতাভ প্রহরাজ। “চলো সিঙ্গলহ্যাণ্ড” । ২০০৫।
৪. অমিতাভ প্রহরাজ। “লাজুক লটারীদের ডায়রী”। ২০১২।
৫. ঋপণ আর্য। “মোমবাতি ও স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন”। ২০০৭। অভিযান পাবলিশার্স।
৬। রমিত দে। “মারাসিম”। ২০১১। পত্রলেখা।
৭। বৈখরী ভাষ্য
8। জার্নিনাইন্টিজ, কৌরব অনলাইন, সৃষ্টি।

Facebook Comments

পছন্দের বই