লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের কবিতা

আষাঢ়লিপি

এক
পায়ের শব্দগুলো ঘুমে নেই, জাগরণে নেই, থেমেছে অনেককাল
বধিরতা অভ্যেস করে কান সরু আর তীক্ষ্ণতা অর্জন করেছে যত
তাকে তুমি জানোনি বলেই নিরাপদ ঘুমের ভিতর ডুবে থাকা বুঝে নাও
সকাল দুপুর রাত চাঁদতারাজলফোঁটা দেওয়ালে সাজাই, গুঁড়ি মেরে বসি
ফেরিওয়ালা এক— লাইনে লাইনে কত বাহারি বেলুন আর রাংতালজেন্স
নেড়েচেড়ে চলে গেলে টকজল জিভে উঠে আসে।
স্পর্শরা অনাহুত, ভারী হলে আচমকা ভেসে উঠি জলের মাথায়

দুই
জাদুকর টুপি থেকে রঙিন পাখিটি ওড়ে হাওয়ায় হাওয়ায়। লক্ষ্মণরেখা ছুঁয়ে ছটফটে পা সেই অলৌকিক পালক স্পর্শের লোভে। কাউকে বলিনি তবু হাওয়ার ফিসফিসে রটে যায় ছুটির খবর! অনেক দূরের স্টেশনের কাছে নির্জনতাপ্রিয় গাছ অপেক্ষায় বসে।
বহুদিন সেই পথে আনাগোনা নেই কারো। ততদূর উড়তে গিয়ে ডানা খুলে পড়ে গিয়ে পাখিটি হঠাৎ খরগোশ, গড়ানো মাঠের ওপর থমকে দাঁড়ায়। মেঘ খুঁজে আকাশের দিকে উন্মুখ শ্রবণ বিস্তারে গতজন্ম ভেদ করে কিছু একটা ডাক… অস্পষ্ট সেই স্বরক্ষেপনের ভিতর ফসল কাটার গান অকস্মাৎ। ধসপ্রবণ এলাকা থেকে কুয়াশার সংকেতধ্বনি নিয়ে যে ট্রেন আসে তার সমস্ত শরীরে খিদে ঝমঝম। এই পা থেকে ওই পায়ে গড়াগড়ি পূর্ণচাঁদ, গায়েগতরে আধপোড়া কাঠকয়লার গন্ধ। ছায়াগুলো শ্বাপদের মতো দেখায় খাঁচার বাইরে।

তিন
প্রতিটি বর্ষামঙ্গলের গা থেকে আমি যত্ন করে মুছে নিই ব্যক্তিগত স্থানুকাল, ওষুধের ঝাঁঝ ও বিলাপ। কতদিন আগেই এসম তামাদি হয়ে যাওয়া দিনলিপির ওপর হেলান দিয়ে থাকা বিস্ময়চিহ্ন তুলে ফেলেছি। জলে ভেজা মাছরাঙার নীল শুধু যমুনার ইঙ্গিত নিয়ে চৌকো ফ্রেমে নিজেকে বাজায়। উপচে ওঠা কদমগন্ধ আজকাল বেঁধে রাখা ঘ্রাণ ডিঙোয় না। রক্তপাতের গোপনীয়তায় নদীর গভীরে শুয়ে থাকি, ঘনঘোর। মা ডাকের ভিতর কপালের ওপর জলেভেজা একলা দোয়েল এসে বসে।

চার
জলফোঁটার ঘুঙুর আর অস্পষ্ট বাতাস নদীতল বেড়ে ওঠার গল্প শোনায়। সীমানা টপকে নদী নিঃসারে এসে দরজায় বসে। ভোর হওয়ার বিস্ময় তার গায়ে দু-একটি করবী পাতায় লেখা, সূচীপত্রের মতো। জলের শব্দ মেপে আধমরা মাছশিশু একোয়ারিয়াম থেকে লাফ দেয় খুব। ফুলে ওঠা পেটের ভিতর সমুদ্র ও চাঁদ পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকে। কাচের দেওয়ালটুকু স্বচ্ছতার গল্প বললেও স্পর্শের আড়াল কোন নৌকো খোঁজে না।
জলের শব্দে নুড়িপাথর শুধুই নদীদের পালটানো নামগুলো কানে কানে বলে যায়।

পাঁচ
ব্যঞ্জনগন্ধ থেকে সমস্ত স্বর খুলে রাখি, বন্ধ হয়ে আসা গলা বোবা হয়ে যায় তারপর। লেবুপাতার আদরে সেজে উঠছে বারান্দার চড়ুইভাতি। নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখি সাপ ও সংসার পাশাপাশি ঘোলা জলে। পিন্ডটি গড়িয়ে গেলে হৃদঘাত ধ্বনি মুছে
লালজবাফুল লুটিয়ে খাঁচার আড়ালে। ব্যথাহীন, স্পন্দনে মৃদু। বেঁচে আছে কি না আছে টের পেতে মাঝেমাঝে মরশুমি ফলওয়ালা হেঁকে যায়। বিশল্যকরণী খুঁজতে গিয়ে ফিরে আসা মৃতদেহটির গায়ে পলিথিন সমুদ্রের মতো নীল— ‘টলমল টলমল করে ময়ূরপঙ্খি নাও’! সকালে যে পাখিঝাঁক দানা খুঁটে কার্নিশে জমে, তাদের ঠোঁটের ফাঁকে হাসি খুব খানখান— স্পষ্ট শুনতে পাই, বিভ্রমহীন!

Facebook Comments

পছন্দের বই