লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

ষষ্ঠ পর্ব



সাতপাক
(Sevenling)

সে ভালোবাসত

সে ভালোবাসত তিনটি জিনিস শুধু
সাদা ময়ূর, সান্ধ্য উপাসনা
আর আমেরিকার একটা ছেঁড়াখোঁড়া ম্যাপ

একদম পছন্দ করত না বাচ্চাদের কান্না
চায়ের সঙ্গে র্যাজবেরি
আর মেয়েলি হিস্টেরিয়া

… সে বিয়ে করেছিল আমাকে

রুশ কবি আনা আখমাতোভা (১৮৮৯ – ১৯৬৬) রচিত এই সাত লাইনের কবিতাটির আঙ্গিক বিশ্লেষণ স্কটিশ কবি রডি লুমসডেন (জন্ম:১৯৬৬) প্রস্তাব করেন কবিতার ফর্ম ‘সেভেনলিং’।
শুধু সাত লাইনের কবিতা বা সপ্তপদী নয়, সেভেনলিং-এর আরও কিছু বৈশিষ্ট আছে।

এর তিনটি স্তবক: প্রথম দুটি স্তবক তিন লাইন করে আর শেষ স্তবকটি এক লাইনের। পঙ্ক্তিগুলির নির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাস নেই।
অন্ত্যমিলহীন।
প্রথম স্তবকে তিনটি সম্পূরক উপাদান (নাম, বিবরণ, চিত্রকল্প, সম্ভাবনা প্রভৃতি) আর দ্বিতীয় স্তবকের তিনটি উপাদান সমান্তরাল। তৃতীয় স্তবকে কবিতাটির সপ্তম লাইনটিতে থাকে জাক্সটাপজিশন বা বর্ণনামূলক সংক্ষিপ্তসার বা পাঞ্চলাইন।
‘সেভেনলিং’ শিরোনামেই সাধারনত লেখা হয়, আবার কখনও মূল কবিতার প্রথম কয়েকটি শব্দ সেভেনলিং-এর পরে জুড়ে দেওয়া হয় শিরোনামে। আবার প্রথম কয়েকটি শব্দই কেবল থাকতে পারে শিরোনামে।

আমেরিকার কবি শারমান অ্যালেক্সি (জন্ম:১৯৬৬) ও রিচার্ড গার্সিয়া (জন্ম:১৯৪১) এই ফর্মটির উল্লেখযোগ্য চর্চা করেছেন।
বাংলায় একে বলতে পারি ‘সাতপাক’।

জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে

জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে আমরা দেখলাম
নৈঃশব্দ্যের ঝরাপাতা, ডোরাকাটা রোদ
আর একটা পেট-ওলটানো মরা ব্যাং
রাত্রে খেলাম বনমোরগের মাংস
রুটির মতো গোলগোল যৌনতা
এক বোতল ভয়-ধরানো লোককাহিনি
সকালে তুমি লাফিয়ে উঠলে চার হাত-পায়ে

চাঁদ
(Lune)

জাপানি পরম্পরাগত কবিতা ‘হাইকু’ সম্পর্কে আমরা জানি। তিনটি পর্বে রচিত এই কবিতা লেখা হয় মোট সতেরো (৫-৭-৫) জাপানি ধ্বনিমাত্রা ‘অন’-এ আর তার অন্তর্লীন সৌন্দর্যের জাদু সারা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে। নানান ভাষায় কবিরা হাইকুচর্চায় আগ্রহী হয়েছেন। কিন্তু জাপানি ছাড়া অন্য ভাষায় হাইকু সম্পূর্ণ বিকশিত হতে পারে না, এমন মনে করেন অনেকে।
এই ভাবনা থেকে আমেরিকান কবি রবার্ট কেলি (জন্ম: ১৯৩৫) আবিষ্কার করেন কবিতার একটি ফর্ম ‘লুন’, যা আমেরিকান হাইকু নামে খ্যাত।

তিন লাইনের কবিতা লুন, প্রথম লাইনে ৫টি দল (Syllable), দ্বিতীয় লাইনে ৩ আর শেষ লাইনে ৫। মোট ১৩ মাত্রা। কবিতাটির মুদ্রিত রূপ অনেকটা চাঁদের মতো, দ্বিতীয় লাইনটি একটু ছোটো, ডানদিকে একটু ঢুকে যেন চাঁদের কাস্তের মতো দেখায়; তাই এর নাম লুন বা চাঁদ।
এই নির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাস ছাড়া আর কোনও নিয়মবিধি নেই।
যে কোন বিষয়েই লেখা হতে পারে এই আঙ্গিকের কবিতা।

কেলির একটি:

thin silver of the
crescent moon
high up the real world

শীর্ণ রুপোলি
কাস্তে চাঁদ
পার্থিবের দূরে

রবার্ট লি ব্রেওয়ার লুন সম্পর্কে লিখতে উদারহণ হিসেবে দিয়েছেন নিজের এই কবিতাটি:

trees never wander
but still spread
across the open field

গাছ তো হাঁটে না
মাঠ জুড়ে
ছড়িয়ে পড়ে

এই ফর্মকে আমরা ‘চাঁদ’ বলতে পারি।

কবিতা জটিল
না তত
যেমন কবিরা

চাঁদ
(Lune)


স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে লুন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একটা ‘ভুল’ করে ফেলে ছিলেন আরেক আমেরিকান কবি জ্যাক কলম (১৯৩১ – ২০১৭)। সিলেবলের বদলে তিনি গ্রহণ করলেন শব্দসংখ্যাকে, বললেন তিনটি লাইন যথাক্রমে ৩, ৫, ৩ টি শব্দে লেখার কথা।
তৈরি হল লুনের আরেকটি আঙ্গিক, কলমের লুন। এখানে দ্বিতীয় লাইনটি অন্য দুটি লাইনের থেকে একটু বড়ো এবং তা চাঁদের কাস্তের উত্তল দিকটিকে বোঝায় যেন।
কেলির লুনের মতোই যে কোনও বিষয়েই লেখা হতে পারে চাঁদকবিতার এই রূপটি আর শব্দসংখ্যা ছাড়া অন্য কোনও নিয়ম নেই।
সিলেবলের চেয়ে শব্দ গণনা সহজতর, এই ফর্মটির জনপ্রিয়তা তাই তুলনামূলকভাবে বেশি।
এক স্কুলছাত্রের লেখা:

when the sun’s
rays hits the shades, it
lights up lines

যখন সূর্যের রশ্মি
ছায়াকে আঘাত করে এসে, রেখারা
উজ্জ্বল হয়ে ওঠে

বাংলায় চাঁদকবিতা লেখার সম্ভাবনা যথেষ্টই।
বিশেষত হ্রস্ব-কবিতাচর্চায় হাইকুর তিন লাইনের কবিতা হিসেবে নিয়মের নিগড়ের বাইরে এই ফর্মটি নিয়ে আগ্রহী হতে পারেন অনেকেই।

এই পৃথিবীর মানুষ
পৃথিবীর কোনও জিনিসের চেয়ে বেশি
চাঁদের কবিতা লিখেছে

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই