লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

এই ২০২০ খৃস্টাব্দে বাংলা উপন্যাস লেখার ব্যাপারে দু-চারটে কথা

এই গদ্যে আমি উপন্যাস নিয়েই কথা বলব। প্রথমেই যে-প্রশ্নটা ওঠে, আপনি কি সন্তানের বাবা অথবা মা? যদি সেটা হয়ে থাকেন, আপনি নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করেছেন, না কি ইংলিশ মিডিয়ামে? দ্বিতীয় প্রশ্নটা হতে পারে, ধরে নেওয়া যাক আপনার সন্তানের বয়স এখন ষোলো, আপনি তাকে কোন উপন্যাস পড়তে দেবেন? যদি আপনার সন্তান ইংলিশ মিডিয়ামের হয়, আপনি হয়তো তাকে ডিকেন্সের ‘পিকউইক পেপারস’ বা ‘অলিভার টুইস্ট’ পড়তে দেবেন, বা আর এল স্টিভেনসনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ বা মার্ক টয়েনের ‘অ্যাডভেঞ্চার্স অফ টম সয়্যার’। অথবা আপনি ন্যাজা থেকে শুরু করবেন— হ্যারি পটারই হাতে তুলে দেবেন তার। যদি সে বাংলা মিডিয়ামের হয়, আপনি কি তাকে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বা ‘কপালকুণ্ডলা’ পড়তে দেবেন? সে হয়তো পড়তেই পারবে না।

এটা অনস্বীকার্য, বঙ্কিমের ভাষা আজকের একজন কিশোর/কিশোরী কিছু বুঝতেই পারবে না। এমনকী তাঁর শেষ পর্যায়ের ‘রাধারাণী’ বা ‘রজনী’-তেও সে অসুবিধা অনুভব করবে প্রতি পদক্ষেপে। এখানে আরেকটা প্রশ্নও হতে পারে, আপনি কেন তাকে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পড়তে দেবেন না? বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত প্রথম উপন্যাস থেকেই কি তার যাত্রাটা শুরু হওয়া ভালো নয়? কিন্তু, তার যাত্রা ফেলুদা বা ঘনাদা থেকেই কেন শুরু হবে না, যদিও ওগুলো শিশুপাঠ্য একেবারেই নয়, ষোলো বছর বয়সীরাই ওগুলোর প্রকৃত রসাস্বাদন করতে পারে, তাই নয় কি? যদিও ২০২০-এর ষোলো বছর আর ১৯৬০-এর ষোলো বছর দুস্তর আলাদা, এখনকার এই বয়সীরা আলাদা প্রজন্ম নয়, প্রায় এক আলাদা প্রজাতি। ভাষার মধ্যে যে-স্বস্তি আর যে-অস্বস্তি, তাদের একটা ব্যালান্স থাকে, সেটা বজায় রেখেই মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগের ব্যাপারটা অনাদিকাল চলছে, অনন্তকাল চলেও যাবে। যতদিন না হোমো স্যাপিয়েন্স মুছে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে, বাঁচার বেসিক প্যাটার্নটাও যে একই থাকবে।

আপনি বঙ্কিম থেকে বাংলা উপন্যাস পাঠ শুরু করতেই পারেন। কিন্তু, সেই যাত্রার শেষটা কোথায় হবে? কেউ যদি কালানুক্রমিকভাবে বাংলা উপন্যাস পড়বে ভেবে থাকে, বটতলা ছাড়বে না রথতলাও ছাড়বে না, বিটুইন দ্য লাইনস পড়বে, বিটুইন দ্য ওয়ার্ডস পড়বে এই সাব্যস্ত করে, সমরেশ বসু অবধি এসে পৌঁছোতেই এবং অসমাপ্ত ‘দেখি নাই ফিরে’ সমাপ্ত করতেই তার জীবনের প্রথম তিন বা সাড়ে তিন দশক কেটে যাবে। যদি সে প্রতিদিন গোগ্রাসে পড়ে, তাহলেও এটা হবে। লেখাপড়া করে, চাকরি জোগাড় করে, প্রেমিক এবং প্রেমিকাকে পটিয়ে এবং বজায় রেখে, বিয়ে করে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে, খবরের কাগজ ও নিউজ চ্যানেল ঘেঁটে, ফেসবুক টুইটার ইউটিউবকে প্রাপ্য সময় দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ও কালোত্তীর্ণ লেখকের সকল কাজ যদি একজন পড়বে ঠিক করে, বাংলা উপন্যাসের ভাণ্ডার তার এ জীবনে শেষ তো দূরের কথা, ঠিকভাবে শুরুই হবে না। সে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পেরিয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় অবধি জীবনের শেষ দিনগুলোতে, যদি সে দীর্ঘজীবীও হয়, এসে পৌঁছোতে পারবে না। ‘ঈশ্বরের বাগান’ বা ‘শাহজাদা দারাশুকো’ না পড়েই তাকে পটল তুলতে হবে, সেই পটলের স্বাদ, বলা বাহুল্য, আভাঁ গার্দ ও সমকালীন একেবারেই নয়।

উট থেকে নামার পরে আপনার পশ্চাদ্দেশে কতটা ব্যথা হবে, সেটা মরুভূমির উপরে নির্ভর করে না, সেটা আপনার অনুশীলনের ব্যাপার। সাহিত্যের ইতিহাসটা লেখকের অতটা নয়, যতটা পাঠকের ক্রমবিবর্তনের। কেন জগদীশ গুপ্ত তাঁর প্রাপ্য আসন পেলেন না, সেই আসন শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হয়ে গেল, তার উত্তর ওই দুই লেখকের কাছে ততটা নয়, যতটা ১৯৩০-৫০ পর্বের পাঠকের অবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে। ‘পরিণীতা’ বা ‘বামুনের মেয়ে’-র পাঠকের পক্ষে ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ বা ‘নিষেধের পটভূমিকায়’ হজম করা অসম্ভব ছিল, এবং তৎকালীন বাংলা বাজার পাঠককে হজমিগুলি দেওয়ার কোনো কারণ দ্যাখেনি, তার হোটেল রমরমিয়ে চলছিল। শরৎবাবুর উপন্যাসের নাট্যরূপ যে আসলে শিবরাম চক্রবর্তীর দেওয়া, এই তথ্যটাও চাপা দিলে সে-সময় নাটক অনেক বেশি হিট হত।

যাক, যা বলছিলাম, সামগ্রিক বাংলা উপন্যাসের পুরো ভাণ্ডারটা কারো পক্ষেই আজ পড়ে ওঠা অসম্ভব, সে যতই সিরিয়াস পাঠক হোক, অনেক মহৎ লেখক ও অনেক মহৎ উপন্যাস একজনকে আজ না পড়ে নিজের বিবেচনা অনুসারে বই বেছে নিতেই হবে, ঐতিহাসিকভাবে পাঠক হয়ে ওঠা কার্যত অসম্ভব। আর, আমরা হয়তো এটাও মেনে নিতে পারি, লেখকের চেয়ে পাঠকের মেধা ও রুচির উপরেই একটি ভাষার সাহিত্য অধিক নির্ভর করে থাকে, যেমন রাঁধুনির দক্ষতার চেয়ে একটি হোটেলের খদ্দেরের সংখ্যাই সেই হোটেলকে টিকিয়ে রাখে, না হলে সে হোটেল উঠে যায়। পাঠকই ভগবান। যদিও, ভগবানের কথা সর্বদা ভেবে এই ধরাধামে কেউ বাঁচে না, বাঁচতে পারে না, সে গুহাবাসী সন্ন্যাসী হোক আর যাই হোক, শুধুমাত্র ঈশ্বরচিন্তা ঈশ্বর থেকে মানুষকে দূরেই নিয়ে যায়। শুধুমাত্র পাঠকের কথাও, একইভাবে, লেখককে ভাবতে নেই, যে-লেখক সেটা ভাবে সে লেখক নয়, সে বিকারগ্রস্ত, যেমন ঈশ্বরের নামও কিছু কিছু উন্মাদের জীবনে বিকার মাত্র, তারা জানেই না তারা কোন আরাধনা কেন করছে।

বিকারের অন্যরকম সুযোগও আছে। ধরুন, আপনি বাংলা উপন্যাস মুড়ো থেকে পড়বেন, না কি ন্যাজা থেকে? আপনি যদি এখনকার উপন্যাস থেকে পড়া শুরু করেন, আপনার কপালে দুঃখ আছে। এখন চাইলেই যে-উপন্যাসগুলো আপনার সামনে লাফিয়ে উঠবে, সেগুলোর মধ্যে ক্ল্যাসিক হওয়ার কোনো সুযোগই রাখা হয় না। এই ‘ক্ল্যাসিক’ অবশ্যই একটি বিদেশি ধারণা, সেটার সূত্রপাত আমাদের এখানে করা হয় ফিল্ডিং, রিচার্ডসন, ডিকেন্স, থ্যাকারে, জেন অস্টেন, থমাস হার্ডি, বা ব্রন্টি সিস্টারদের লেখাই যে অবশ্য পঠনীয় উপন্যাস, এই ধারণাকে উপনিবেশের বুকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করতে, যাতে আমাদের দেশীয় উপন্যাসগুলো, যদিও সেগুলোর জন্য কোনো জঁর বরাদ্দ করাই হয়নি আবহমান পাঠকের সামনে, নিষ্প্রভ হয় আর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। উপন্যাস শব্দটাও একটা চাপিয়ে দেওয়া ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’ উপন্যাসই ছিল, বায়রনের ‘ডন জুয়ান’-ও উপন্যাস। উপন্যাসের ভাষা যে গদ্যই হবে, গদ্যের পালোয়ানি তার মধ্যে ভরপুর থাকতে হবে, এটাও আজকাল কেমন যেন ধরেই নেওয়া হচ্ছে। অথচ প্রায় এই সময়েই লেখা হয়ে গেল বিক্রম শেঠের ‘গোল্ডেন গেট’।

চসার বা বায়রনের কথা কেন তুলছি! আমাদের বাংলাভাষায় যে-মধ্যযুগীয় সাহিত্য, তার সামনে ১৯২০-র দশকের প্যারিস তুচ্ছ হয়ে যাবে। যেভাবে আমাদের এখানে ‘মনসামঙ্গল’ কালোত্তীর্ণ হয়েছে, ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কালোত্তীর্ণ হয়েছে, সেরকম উপন্যাস এই মুহূর্তে লেখা হচ্ছে না। এখানে, বলা বাহুল্য, আমি এই মতই প্রকাশ করলাম যে, ‘মনসামঙ্গল’ ও ‘চণ্ডীমঙ্গল’ তাদের সময়ের এক-একটি উপন্যাস ছিল, ভারতচন্দ্র প্রণীত ‘বিদ্যাসুন্দর’-ও। আজ সেগুলোকে কেউ উপন্যাস হিসেবে চেনে না। কিন্তু, গোটা সমাজ তখন যেমন সেগুলো নিয়ে মেতেছিল, আজও কিছুটা হলেও মেতে আছে। সমাজ যে তাদের এতটা গ্রহণ করেছে, তার কারণ কবিতার দাবি তাদের প্রতি যতটা, উপন্যাসের দাবি তার চেয়ে বেশিই। সমাজে কবিতা টেকে কম, গল্প টেকে বেশি।

আজও যে-কোনো উপন্যাস নিয়ে শোরগোল বা উন্মাদনা গোছের কিছু দেখা যায় না, এমন তো নয়। বাঙালি মহাপুরুষদের যৌনজীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস তো বেস্টসেলার হচ্ছেই। বইমেলায় যে-বইগুলো খুব বিক্রি হচ্ছে, বেশিরভাগই থ্রিলার। সেগুলোর বিজ্ঞাপন করা হচ্ছে অতি সুকৌশলে। অতীশ দীপঙ্করের জীবনী অবলম্বলে লেখা একটি উপন্যাসের নাম কিছুদিন খুবই ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকের মুখে। এগুলো জনপ্রিয়তা অবশ্যই, কিন্তু এই জনপ্রিয়তা স্থায়ী হবে বলে আমার মনে হয় না। প্রচারের কৌশল এই বইগুলোকে একটা হাইপ দিয়েছে। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি। একসময়, এই ধরুন ১৯৪৮-৪৯ নাগাদ, যখন উত্তম-সুচিত্রা নামক ফেনোমেনন এই বাংলায় নেই, রঞ্জন মজুমদার লিখিত ‘শীতে উপেক্ষিতা’ নামক একটি উপন্যাস এভাবেই তুমুল প্রচারিত হয়েছিল, যদিও দ্বিতীয় সংস্করণ হতে দেরি লেগেছিল ঢের। আজ ক-জন ‘শীতে উপেক্ষিতা’ পড়েছেন সন্দেহ আছে। তার চেয়ে ঢের বেশি লোক কিন্তু এখন কমলকুমার মজুমদারের ‘সুহাসিনীর পমেটম’ পড়েন, অথবা অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখণ্ড’। যদিও, বলতেই হবে, সেই সংখ্যা খুব উৎসাহবর্ধক নয় একজন তরুণ লেখকের সামনে। বাঙালির সংখ্যা এখন কত কোটি, এই প্রশ্নের সামনে এই দু-টি বইয়ের পাঠকসংখ্যা নিস্তেজ হয়ে যায়।

এখানেই জানতে ইচ্ছে করে, আজ ক-জন পড়েন প্রবোধকুমার সান্ন্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’? যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’? নিমাই ভট্টাচার্যর ‘মেমসাহেব’? কোনোদিনই কি এই উপন্যাসগুলো মহাকালের লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বা জগদীশ গুপ্তর বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের পাশে গিয়ে বসতে পেরেছিল? আজ যাঁরা জরাসন্ধের ‘লৌহকপাট’ পড়েন, তাঁরা কারা? আমার এই প্রশ্নে অনেকেই রেগে যেতে পারেন। এই বইগুলোর প্রতি অনেকের অনেক রকম সেন্টিমেন্ট আছে। এই বাজারসফল উপন্যাসগুলো লেখা হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যাঁদের জন্ম, এবং যাঁরা সাহিত্যের খুব একটা গুরুপাক রস নিতে পারেন না, সেই পাঠকদের যাতে পেট ছেড়ে না যায় এমন সাহিত্য লিখে বাজারে ছাড়ার জন্য। সেইসব উজ্জ্বল পাঠকরা ‘শেষের কবিতা’-র স্টাইল বা ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র কূটিল আবর্তের প্রতি বিমুখতা দেখাতেন, শরৎ চন্দ্রকে এঁরা পড়ে ফুরিয়ে ফেলেছিলেন, তারাশংকর এঁদের বোরড্ করে দিতেন, যদিও তারাশংকর উপন্যাস লিখে গাড়ি কিনেছিলেন, এমপি হয়েছিলেন, অথচ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘চিতা বহ্নিমান’-এর প্রতিও এই পাঠকদের সন্তোষ মোটেই ফ্যাশনেবল হত না, আফটার অল, বই পড়ার একটা স্ট্যাটাস ছিল তো, আজ যেমন স্মার্টফোন দেখানো হয়, তখন বইয়ের মলাট দেখাতে হত। এই পাঠকদের লেখক ছিলেন এই বইগুলোর রচয়িতারা।

পরের পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই