লেখক নয় , লেখাই মূলধন

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: আপনি যখন অনুবাদ করেন, আপনাকে অন্য লেখকদের কণ্ঠস্বর গ্রহণ করতে হয়। আপনাকে এক অর্থে ফিটসগেরাল্ড, চ্যান্ডলার বা শেভার হতে হয়। আপনি যখন নিজের একটি স্টাইল আয়ত্ত করে ফেলেছেন তখন কি এটি একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

মুরাকামি: হ্যাঁ। আমি স্কট ফিটসগারেল্ডকে ভালোবাসি। তাঁর অনেকগুলি বই অনুবাদ করেছি। তবে তাঁর শৈলী আমার থেকে অনেকটাই আলাদা, সুন্দর এবং জটিল। তবুও আমি তাঁর লেখা থেকে অনেক কিছু শিখেছি— তাঁর মনোভাব, বিশ্বজগতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। রেমন্ড কার্ভারের শৈলী এবং তাঁর লেখার জগৎ আমার থেকে অনেক আলাদা। তবে আমি তাঁর থেকেও শিখেছি।

দেবোরা: জন শেভারের লেখা বর্তমানে আপনি অনুবাদ করছেন। কেন শেভার?

মুরাকামি: কেন শেভার? আমি বহু বছর ধরে তাঁর ছোটোগল্পগুলি আনন্দের সঙ্গে পড়ে আসছি। তবে শেভার জাপানে জনপ্রিয় নন। এখানে খুব কম লোকই তাঁর লেখা পড়েছে। কারণ, তাঁর শৈলী ভীষণ আমেরিকাপন্থী। আমার ধারণা, উনিশশো পঞ্চাশের দশক এবং এর মাঝামাঝি সময় আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিই শুধু তাঁর লেখার উপজীব্য। আমি মনে করি না বেশি জাপানি পাঠক তাঁর লেখা পছন্দ করবে। তবে লেখাগুলো আমি খুবই ভালোবাসি। তাই এটি একধরনের চ্যালেঞ্জ।

দেবোরা: আপনি অন্য লেখকদের থেকে যা যা শেখেন সেগুলি আপনার লেখায় প্রবেশ করলে আপনি বুঝতে পারেন?

মুরাকামি: আমার মনে হয় একটু প্রভাব তো আছেই। আমি যখন লিখতে শুরু করি আমার কোনো পরামর্শদাতা ছিল না। আমার কোনো শিক্ষক ছিল না। আমার কোনো সাহিত্যিক বন্ধু ছিল না। আমার শুধু আমি ছিলাম। তাই আমাকে বই থেকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। ছোটোবেলায় আমি বই পড়তে পছন্দ করতাম। বাড়িতে আমি একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার কোনো ভাই বা বোন ছিল না। অবশ্যই আমার কাছে বই এবং বিড়াল ছিল। সংগীত তো অবশ্যই ছিল। আমি খেলাধুলা পছন্দ করতাম না, পড়তে পছন্দ করতাম। কৈশোর বয়সে আমি রাশিয়ান উপন্যাস পড়ি। দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় আমার প্রিয় ছিল। আর এদের বইগুলি থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এমন অনেক সহপাঠী ছিল যারা লেখক হতে চেয়েছিল। তবে আমি বিশ্বাস করতাম না যে, আমার প্রতিভা আছে। তাই আমি একটি জ্যাজ ক্লাব খুলি আর সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি।

দেবোরা: আপনি নিজে কখনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছিলেন?

মুরাকামি: ছোটোবেলায় আমি পিয়ানো বাজাতাম। তবে এতে আমার বিশেষ প্রতিভা ছিল না। আমার বয়স যখন পনেরো বছর তখন আর্ট ব্লেকি এবং জ্যাজ মাসেঞ্জাররা জাপানে এসেছিলেন। সেই কনসার্টে আমি গিয়েছিলাম। এর আগে আমি জানতাম না, জ্যাজ কী, তবে সেই রাত থেকেই আমি একজন উৎসাহী জ্যাজ ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রেকর্ড সংগ্রহ করে গেছি। আমার স্ত্রী সবসময় অভিযোগ করত। আমার বাড়িতে কত যে জ্যাজ রেকর্ড রয়েছে! তবে আমি লেখার বিষয়ে সংগীত থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। আমি মনে করি এতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, ছন্দ, সাংগীতিক ঐকতান আর তাৎক্ষণিক উন্নতিকরণ। আমি সাহিত্য থেকে নয়, সংগীত থেকে এই জিনিসগুলি শিখেছি। এবং যখন আমি লিখতে শুরু করি তখন ভাবটা এমন থাকে যেন আমি গান বাজনা করি।

দেবোরা: আপনার মা-বাবা দু-জনেই সাহিত্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরা কি আপনার লেখার সিদ্ধান্ত বিষয়ে খুশি হয়েছিলেন? তাঁরা কি আপনাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে বলেছিলেন?

মুরাকামি: তা আমি মনে করি না। আমি জানি না তারা আমার কাছ থেকে কী আশা করেছিল।

দেবোরা: শেষবার আমরা যখন কথা বলেছিলাম আপনি বলেছিলেন, ৯/১১ বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। কেবল আসল পৃথিবীকেই নয়, আপনি যে পৃথিবী নিয়ে লিখতে চান সেখানেও এই সংকটগুলি প্রভাব ফেলেছিল মনে হয়। আপনি কি মনে করেন যে, জাপানের সুনামি এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের মতো ঘটনাগুলি আপনার কল্পকাহিনিগুলোকে বদলে দিয়েছে?

মুরাকামি: হ্যাঁ। ১৯৯৯ সালে কোবে ভূমিকম্পের পর আমি ‘আফটার কোয়েক’ নামে ছোটোগল্পের একটি সংকলন লিখেছিলাম। আমার মা-বাবার ঘর-সহ পুরো কোবে শহরটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ম্যাসাচুসেটসে ছিলাম। তারপর চার বছর কাটিয়েছি যুক্তরাজ্যে। বলতে গেলে তখন আমি একপ্রকার প্রবাসীই হয়ে পড়েছিলাম। তবে টিভিতে দেখেছিলাম দৃশ্যগুলো। ঔপন্যাসিক হিসেবে তখন আমি ভাবছিলাম, এই ভূমিকম্প বিষয়ে আমি কী করতে পারতে পারি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যা করতে পারি তা হল ভূমিকম্পের সময়টায় ঠিক কী হয়েছিল তা শুধু কল্পনা করতে। তাই এটা আমার কাছে কল্পনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যখন কোনো উপন্যাস লিখি তখন গবেষণা করি না। কারণ, কল্পনা আমার সম্পদ, আমার উপহার। আমি এটি পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাই। ওই একই বছর, এর দুই মাস পরে টোকিওর একটি পাতাল রেল ট্রেনে সারিন-গ্যাস দ্বারা আক্রমণ হয়েছিল। আমি তখন জাপানে ছিলাম না। আমি খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনে এই বিষয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি যা পড়তে চেয়েছিলাম তা ওই লেখায় পাইনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম সত্যি কী ঘটেছিল সেদিন ওই ট্রেনে। ভরতি ট্রেনে গ্যাসের গন্ধ নেওয়ার মতো বাস্তব অবস্থাটা আমি জানতে চেয়েছিলাম। তাই আমি নিজের মতো এই জিনিসগুলি খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি সারিন-গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং তাদের প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি আসল ঘটনা। তারা আমাকে বলে আসলে কী ঘটেছিল। আমি এই বিষয়গুলি নিয়ে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামে একটি প্রবন্ধধর্মী বই প্রকাশ করি। অন্য কেউ এটা করেনি বলে আমাকেই এটা করতে হয়েছে। তাছাড়া আমার নিজস্ব জিজ্ঞাস্য আর কৌতূহলও ছিল। এই সাক্ষাৎকারগুলি নিতে আমার একবছর সময় লেগেছিল। আমি মনে করি ওই একবছর আমাকে বদলে দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাটা ছিল দারুণ। সেই একবছর আমি কিছুই লিখিনি। আমি কেবল সেই কণ্ঠস্বরগুলো শুনেছি। সেগুলি এখনও আমার মনের মধ্যে আছে। আমি সেই শুদ্ধ স্বরগুলোকে বিশ্বাস করি। ট্রেনে চড়া মানুষগুলো ছিল সাধারণ মানুষ। তারা টোকিয়োর এক সকালে ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই কেউ সারিন গ্যাসে ভরতি প্লাস্টিকের ড্রাম দ্বারা আক্রমণ করে এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন মারা যায়। পরিস্থিতি ছিল এমনই অতিবাস্তবিক। তবে তাদের কণ্ঠস্বর ছিল সাধারণ। আউম শিনরিকো সম্প্রদায়ের মানুষেরা (যারা আক্রমণ করেছিল) সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁরা হয়তো এর মাধ্যমে একরকম সত্য বা পরম সত্যের সন্ধান করছিলেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা সাধারণ যাত্রী ছিলেন। আমি শিনরিকো সম্প্রদায়ের মানুষদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের কথা আমার মনে ধরেনি।

দেবোরা: গ্যাস আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় আপনি কঠিন সত্যের খোঁজ করেছিলেন, কিন্তু ভূমিকম্পের কথা বলতে গিয়ে আপনি কেন আংশিক কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন?

মুরাকামি: কারণ, কোবে আমার নিজের শহর এবং ঘটনাটা খুবই বেদনার। সেখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। আমি যদি এই লোকগুলির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতাম তবে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু কাহিনিতে আমি আমার নিজস্ব জগৎ তৈরি করতে পারি। তাই এটি আমার পক্ষে সহজতর ছিল। সহিংসতা আপনার মন আর শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছুর বিনাশ হয়ে যেতে পারে এর ফলে। ভূমিকম্পের আগে আমরা ভেবেছিলাম ভূমিস্তর খুব শক্তপোক্ত। কিন্তু এখন আর তা নেই। এটা হয়ে উঠতে পারে অস্থির, অনির্দিষ্ট, নরম। আমি হয়তো এটাই লিখতে চেয়েছিলাম।

এরপর ৯/১১, সুনামি-সহ আরও অনেক বিপর্যয় ঘটেছিল। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিপর্যস্ত মানুষগুলির জন্য আমি কী করতে পারি। উত্তরটা এইরকম যে, আমি শুধু পারি ভালো সাহিত্য রচনা করতে। কারণ, আমি যখন একটি ভালো গল্প লিখি তখন আমরা একে অন্যকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। আপনি যদি পাঠক হন আমি একজন লেখক। আমি আপনাকে চিনি না। তবে সাহিত্যের অন্তর্জগতে আমাদের মধ্যে এক গোপন যোগাযোগের পথ রয়েছে। আমরা অবচেতন পথে একজন অন্যকে বার্তা পাঠাতে পারি। এইভাবে আমি মনে করি অবদান রাখতে পারি।

দেবোরা: আপনি লেখার মাধ্যমে বার্তা পাঠান। কিন্তু আপনি নিজে বার্তা ফিরে পান কী করে?

মুরাকামি: আমি জানি না। একটি উপায় হয়তো আমরা বের করতে পারব।

দেবোরা: ‘কাফকা অন দ্য শোর’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর আপনার ওয়েবসাইটে বইটি সম্পর্কে পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। আপনি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছিলেন। আপনি কেন এটা করলেন? শুধু এই বই নিয়ে কেন?

মুরাকামি: আমি পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানতে উৎসুক ছিলাম (২০১৫ সালেও এইরকম করেছিলাম)। সীমিত সময়ের জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। তবে আমি অনেকগুলো মেইল পেয়েছিলাম। আমার মনে নেই কতগুলো। ত্রিশ হাজার হবে সম্ভবত। তবে আমি সেগুলো পড়েছি এবং চোখের ক্ষতি করেছি। আমি সম্ভবত তিন হাজারের উত্তর দিয়েছি। খুব পরিশ্রমের ছিল ব্যাপারটা। তবে আমার মনে হয় আমি এটা জানতে পেরেছি যে, কী ধরনের পাঠক আমার বই পড়ছে। এবং আমার লেখা সম্পর্কে তারা কী ভাবছে সে সম্পর্কে আমি একটা অস্পষ্ট ধারণা পেয়েছি। তাদের মধ্যে কিছু বোকা বোকা প্রশ্নও ছিল। একজন আমাকে স্কুইডের কর্ষিকা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। স্কুইডের দশটি কর্ষিকা রয়েছে এবং সে জানতে চেয়েছিল তাদের হাত পা আছে কিনা। তিনি কেন সে এইরকম প্রশ্ন করলেন? আমি উত্তর দিয়েছিলাম এইভাবে: স্কুইডের বিছানার পাশে আপনি দশটা গ্লাভ অথবা দশটা মোজা রেখে দিন। সে যখন জেগে উঠবে তখন হয় গ্লাভ নয়তো মোজা বেছে নেবে। এইভাবে আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি অবশ্য জানি না স্কুইড বিছানায় ঘুমায় কিনা। তবে আমি বেশিরভাগ প্রশ্নই উপভোগ করেছিলাম।

দেবোরা: এটা ছিল পাঠকদের সংস্পর্শে থাকার একটা উপায়। আমি জানি যে আপনি জাপানে কোনো অনুষ্ঠান বা সেখানে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন না। কেন এমন?

মুরাকামি: আমি একজন লেখক। এবং আমার কাছে লেখাই একমাত্র কাজ। আমি একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, লেখালেখি ছাড়া আমি আর কিছুই করব না। তবে সম্প্রতি আমি ডিস্ক-জকির কাজ করছি। টোকিয়োর একটি এফএম রেডিয়ো স্টেশন থেকে আমাকে ডিস্ক-জকির কাজ করতে বলা হয়েছিল। আমি এখন ওই কাজটি করছি।

শেষ পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই