লেখক নয় , লেখাই মূলধন

করোনার দিনগুলিতে: সুস্নাত চৌধুরী

গ্রহে ও গৃহে ইতস্তত ঘুরে

অভিজ্ঞতা হল সেই জিনিস, যা আমাকে শেখায় আত্মোপলব্ধির পাঠ। ভুল ভেঙে মনে করিয়ে দেয় আমার অদক্ষতার কথা, অপারগতার কথা, অজ্ঞানতার কথা। মানুষের জীবন কোনোদিনই বেঁচে থাকার অনুকূল কিছু ছিল না। বলা ভালো, তার বেঁচে থাকাটাই এই মহাজগতের এক ব্যতিক্রম, ম্যাজিক। হয়তো অতিরিক্তও। তবু অতিমারির প্রকোপ যখন তার উপরে প্রত্যক্ষ প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল, নতুন করে, আর বারবার বিজ্ঞাপিত হতে থাকল আসন্ন মৃত্যুর প্রতিবেদন ও কল্পভাষ্য; সেই অবকাশে আমি খুলে বসেছিলাম পাটিগণিতের খাতা।

নিজেকে নিয়ে ভাবার মতো স্বার্থপর আমি অনেক দিনই। তাই লকডাউন আমাকে একেবারে নতুন করে এ-সব ভাবতে শেখায়নি। জ্ঞান শূন্য, যোগ্যতা শূন্য, আজও কিছুই পারি না এবং এতদিনে কিছুই পারিনি— কয়েক বছর এই গ্রহে ও গৃহে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানোর পর এ-সব ভাবনাকে মাত্র পূর্ণতা দিয়েছে এই লকডাউন। সন্দেহকে সিদ্ধান্ত করে নিয়েছে। আত্মোপলব্ধিকে স্বীকারোক্তি।

অক্ষমতাকে আড়াল করতে আত্মগ্লানি এক চিরাচরিত আশ্রয়। আয়না ও বিয়ারের কাছে এলে সেই চাতুরী কি অবচেতনকেও অধিকার করে নেয়? এ ক্ষেত্রে যদি তা করেও থাকে তবু তাতে সেই অক্ষমতা মিথ্যে হয়ে যায় না। তা ছাড়া আমি তো নিজ ব্যর্থতার পাঁচালি লিখতে বসিনি। সফল মানুষের খুচরো ব্যর্থতার কিছু ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকতে পারে, একজন আনখশির ব্যর্থ মানুষের একাকী ব্যর্থতা যাপন মাঝসমুদ্রে মূত্রত্যাগের মতোই। পরম স্বস্তিকর হয়েও চিহ্ননিরূপকহীন অক্রিয়া।

আমায় তো লিখতে হবে লকডাউন যাপন। লিখতে হবে আগামী দিনের কথা। ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পন। কার থেকে ঘুরে? কার দিকে ঘুরে? ঘুরে দাঁড়ানো বলে কিছু হয়, এ-কথাই আমি আর বিশ্বাস করি না। অন্তত আমার কাছে সময়ের গতি বক্র নয়, সরলরৈখিক। আমার করা ও না-করা— সবই সেই সরলরেখার অংশ মাত্র। ঘুরে দাঁড়ানোও চতুর্থ পাদ সম্পূর্ণ করে, তিন-শো ষাট ডিগ্রি হলে সর্বাধিক। অভিমুখ অপরিবর্তিত। কাজেই, ‘শো মাস্ট গো অন’ মানুষের কয়েন করা নিছক এক অতিকথন হয়ে পড়ে না কি? জগতের এই মহাআয়োজনই তো নিরবচ্ছিন্ন। একক ও অনন্ত।

মানুষ কি তাহলে বাঁচতে চাইবে না? অবশ্যই চাইবে। সে আমৃত্যু বাঁচতে চেষ্টা করবে। চেষ্টা করবে তার পরিবার, গোষ্ঠী ও সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু এক ব্যর্থ মানুষ, যে বুঝে গিয়েছে ব্যর্থতার দৌড়, তার আর এসবে অধিকার নেই। আগ্রহও নেই। সে বরং ভাববে, মৃত্যুর কথা। মৃত্যু। যা সুন্দর ও পবিত্র। যা বিশ্রামের উদ্‌যাপন। যা নাটকের মতো ঘটনাবহুল। যা কবিতার মতো শান্ত।

বন্ধু সৌম্য লিখেছিল, ‘অস্তিত্ব’ শিরোনামে, আত্মহত্যার বেশ কিছুদিন আগে:
এখানে কোথাও নেই আমি,
বাকি সব যেমন তেমনই।
আকাশের চাঁদ-তারা,
আঙিনায় উনুনের আঁচ,
সকালের ঘুম ভাঙা,
চায়ের রেওয়াজ!
একই আছে সবকিছু,
একই থেকে যায়,
আমার না-থাকা শুধু
আমাকে ভাবায়।
(‘কবির জীবন’, সৌম্য চক্রবর্তী)

কিন্তু যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের নয়— এমনকী কবিরও নয়— তাকে আর ভাবায় না এই না-থাকার কথামালা। তার কোনো অমরত্বের প্রত্যাশা নেই। তাই করোনার দিনগুলিতে তার শেষমেশ পাওয়ার কিছু থাকে না, খোয়ানোরও না। সে কেবল মাঝেমধ্যে খুলে বসতে পারে পাটিগণিতের খাতা। সে জানেও না সেই খাতার উপরে যে-কোনো সময়েই আছড়ে পড়বে এক বিধ্বংসী ঝড়। যে-ঝড়ের নামের উচ্চারণ আসলে কী ছিল, সে-বিতর্কের অবসান কোনোদিনই করে উঠতে পারবে না তার প্রিয় শহর।

Facebook Comments

পছন্দের বই