লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অভিষেক মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

জতুস্মৃতি

এক ডজন গ্যাসবেলুন, থ্রি নট্‌ থ্রি কোল্ট ব্যারেল বুড়ির কপালে ঠেকিয়ে,
শাদা থান খুলে তুমি উড়িয়ে দিয়ো নভতলে! জতুস্মৃতি মনে থাকে না যেন।
যেন একটি দাঁড়কাক উত্তল মাংসের গন্ধে গোটা থান জুড়ে ধান খায়।

ব্ল্যাক শার্ট, কালপুরুষ সত্তা— বাইপোলার, লাল নীল ক্যাপ্সুল, বাম রগে
ঠাটানো লিঙ্গের জাতক জাগতিক ঘোড়া তুমি ফুটিয়ে দিচ্ছ ফেটামিন সিরিঞ্জ
সঙ্কেতহীন। অধিশ্রাব্য জুড়ে একটানা চিঁহিগান। ট্যাঁর তাস নাচছে শিলাদানে
মেধার খোঁচানো অংশ বেয়োনেট থেকে রগড়ে, চামচে অস্তিত্ব দিল সন্ধ্যেবেলা মা।

এখন কফিন লুটব। হামা দেব। টেট্‌রাগ্রাম স্পর্শ করে, চুমু খাব কুণ্ডের শিখায়
যদি বা পাথরখণ্ড উল্টে পরে তোমার শরীরে— অগ্নি মুখে ব্রত করছি, খুবলে নিয়ো চোখ
দুঘণ্টা বাঁচাতে পারবে আমার শবরমুখী ফুসফুস, মাথাখারাপ আমি কি হরিণ?

আনুবিস প্রভার পথে পথে

এখন রাত্রি টোপাকুলের খোসার মতো নরম। তাপমাত্রা বাইশ দশমিক এক ডিগ্রি
প্রতিবেশী অন্ধকার। নতুন বউ এসময়টা শাড়ি পাল্টায়, ব্রণ খোঁটে, খাতায় নম্বর বসায়;
বটগাছ দেখেনা অবশ্য। বটগাছ মানুষের সঙ্গে সেই কবে বাজী ধরেছিল―
বটগাছ ইতিহাস লেখে, নতুন বউ কেবল জ্যামিতি
আজ ব্রহ্মও তালকানা। হুক ভাঙা জানলাটা আটকে ফেলা ছাড়া আর গতি নেই।

সন্তগুরু ছিলেন ওলন্দাজ। তার কবরের ওপর এই বাস্তুজমি বসল।
যেখানে এখন লাগাম কাটা জলের পাইপ নাচ করছে,
সুভাতি কে বুদ্ধদেব জিজ্ঞেস করছেন কেন রক্ত টেনে নামাবার উলম্ব রেচন পদ্ধতি, অস্তিত্বমানস থেকে বাহ্যবোধ আলাদা করেনা?
কেন মানুষ মদ ছাড়বে মনে করলে, ছাদের ওপরে দুপাক হেঁটে আসে?

হাওয়া-ঝড় কর্গেটের চামড়া গুটিয়ে দিয়েছে। হাওয়া যেন ক্লাসিক মাস্তান―
ছাদ যেহেতু গৃহস্থের, ঐশ্বরিক যোগাযোগ মাধ্যম; তাকে ঢাকলে, ধ্বংস তো হবেই।
এখন কামানের কথা ভাবলে খুব হাসি পায়, জল জমা রাস্তাঘাটে ডলফিন ভেসে ওঠে হারানো জুতোর মতো।

ও দেওয়াল, রাজনৈতিক, লেখাপত্র ঘেঁটে ফেলা বৃষ্টিভেজা সর্বদলীয় দেওয়াল―
তুমিই তো আর্যাবর্ত্যে― অন্তেবাসী বালকের মনে আগে ঢুকিয়েছিলে আনন্দধারণা
পরে তাকে দুর্নিবার সিয়েরা মায়েস্ত্রো অবধি ছুটিয়ে নিয়ে গেছ,
ও দেওয়াল, শ্রাবগন্ধ, ঘিনঘিনে তোমার ভেতরে
এইমাত্র জন্ম হল যে দুটি পোড়া ইটের থাবার,
থাবার ভেতরে ভাত, ভাতের ভেতরে আবার সেদ্ধ পোড়া ইট
ইটের ভেতরে আগুন

সেই আগুনের ওপর শুয়ে শুয়ে যখন আমি মাংস ছুঁয়ে ভালোবাসছি,
ভাবছি শহরের সব ইটভাটার মালিকানা লিখে দেব ডুরে শাড়ির পাড়ে
জঙ্গলের দিকে তখন জিপসি ভ্যান বিকল হচ্ছে
নেকড়েমুখী দেবী নাকি সরু করছে দাঁত নখ!

তোমার বনসাই আমার

বেতারনদীর জলে, রাধাচূড়া ফুল ভিজে ভিজে
পাঁশুটে থমথমে বহ্নি-আগুন শুকিয়ে আয়ু ধায়
যে শব্দ ধারণাতীত, পুড়ে যাওয়া বাংলা কবিতায়
তেমন খরমর শব্দে, শাঁখা পলা ভেঙেছে বীজের

সবুজ জাতকশক্তি। নিরাকার জাহান্নাম খোঁপা
প্রথমে আয়াম মুচড়ে, পরে চক্রে লাথি মেরে মেরে
উপলচেতনা খুললো, আর্তনাদ এক লালপেড়ে
ডামরের নাচভঙ্গি, মাথার ভেতরে মুগ্ধপোকা—

পাগল আচমন রক্ত! মিহি কোরে হরিদ্রা লবণ
একটি রাধাচূড়া গাছ গুঁড়ি থেকে কেটে নিয়ে তুমি
বসালে বনসাই টবে-বজ্রযোগে খাঁড়িভর্তি কুমির
শরীরের কিমাবাটা খেতে এল… অরূপচন্দন

দারুব্রহ্ম ভীমাদেব, সম্মোহনে অভয় দিলেন
সকাম ফলার করো, চোখ বন্ধ করে মা কে ভাবো।

মহড়া

ছটান অগ্নির পর, বাইকশ্যাফ্ট কাঁপে কাঁপে, হিরন্যলোকের
জংধরা যোনিমুখ থিরথির করে।

মাংসনাদের দিকে, এগিয়ে গেছি আনন্দ
ছ’রকম ফাটিয়েছি কার্তুজের মাথা

আদিত্য ছড়িয়ে গেল, পাতাময়, রোমরাস্তাময়!
নামতে নামতে খ্যলোকের হুরীধর্ষণের কাল কল্পনা করেছি
ভেবেছি মাইরি শালা মরা শুকনো ক্রৌঞ্চের শরীর,
যদি আমাকে পুরে নিত আজ্ঞা-সহস্রারে
‘আরো ক্ষুদ্রতর করো কাঠের প্যাণ্ডেল-ঘাটকর্মে সাদারং
যেহেতু সমস্ত যুদ্ধ, নদীমাতৃক…’ এই বলে, লাফাতাম
উত্তুঙ্গ শঙ্কুর মধ্যে, ধ্বনি বিস্ফোরন হত… শরশর ব্রহ্মাস্থ যেমন
ঘিরে ফেলেছিল, নোংরা, দুর্ভাগ্যজনক পাণ্ডুলিপি অনাবিল
হাড় ভাঙতে ভাঙতে, শিলাঘাম প্রসব করলো দেবলিঙ্গ।
স্রোত ঠেলে দিল নীল টাইবেরিয়াস।
আয়ু ঠেলে দিল নীরবতা
বায়ু ঠেলে দিল, ছ’টি মভ রঙের উইজ্যা বোর্ড…

আজ আমাদের ত্রাটকে পেয়েছে, মাথা খারাপ করে দিয়েছে, ভট্টিকাব্য
আর পরিত্রাণ নেই। সমুদ্রের নির্দেশ মতন,
শব্দেরা একরোখা, ভেবেছিল মার না খেয়েই, পেট্রাপোল পার করবে
নিভিয়ে দেবে সপ্তর্ষিমণ্ডল!

‘সারাজীবন ঋষভ হয়ে মড়বি, একটুও খুঁদ জুটবে না তোর পেটে
থুতু ফেলি অমন গর্ভে’— বুড়ি মরুভূমি বলতো, মর! মর!
কান করতাম না আমরা। কাঁটাগুল্ম, কপালে মাখতাম
স্নান করতাম না তিনদিন।

আর উপবাস কাটিয়ে, ব্রীজভাঙা গড়ের মাঠে দৌড়ে যেত আমাদের দুলদুল অশ্বেরা।

Facebook Comments

পছন্দের বই