লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অভীক দত্তের গল্প

পাহাড়বাড়ির রহস্য

চিত্র: রেনে ম্যাগরিত


বাগডোগরায় পৌঁছেছিলাম বিকেল পাঁচটা নাগাদ।
ইচ্ছে করলে শিলিগুড়িতে থাকাই যেত কিন্তু পাহাড়ের অমোঘ আকর্ষণে বিকেল বিকেলই রওনা দিয়ে দিলাম।
সেবক রেলগেট, তিস্তা বাজারের জ্যাম পেরিয়ে যখন কালিম্পং পৌঁছলাম তখন রাত ন’টা বেজে গেছে। পাহাড়ের রাতের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা আছে।
হলুম্বায় বুকিং ছিল। পাইন উড কটেজ। হলুম্বাতে এমনিতেই ভূতুড়ে পরিবেশ করেই রাখা হয় যেন। দেরি করলাম না, আগে ডিনার সেরে নিজের রুমে পৌঁছে ব্যাগ ট্যাগ রেখে গরম জলে গা হাত পা মুছে কম্বলের তলায় ঢুকলাম।
শিরশিরে শীত, বাইরের পাইন, ফার গাছগুলো জলে ভিজে আছে।
বৃষ্টি হয়েছে শুনলাম বিকেলে।
অফিসের কাজে নর্থ বেঙ্গলে আমাকে আর অমিতকে পাঠায়। কোম্পানির কাজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। ঘুরতে আমার কোনো কালেই আপত্তি নেই, তাই এসব ট্যুরে আসতে আপত্তি করি না। কলিগ অমিত প্রতিবারই আসে আমার সঙ্গে, এবারে অমিতের বাড়িতে একটা সমস্যা হয়ে যাওয়ায় শেষ মুহূর্তে আসতে পারল না।
কালিম্পংকে কেন্দ্র করে নর্থ বেঙ্গলের বেশ কয়েকটা জায়গা যেতে হবে এবারে। সাত দিনের প্রোগ্রাম। মূলত সকালের দিকেই কাজ থাকবে। বিকেলটা ঘুরে নেওয়া যাবে।
ঠিক করেছি বিকেলের দিকটা বাজার ঘুরব। প্রতিটা জায়গার একটা গন্ধ থাকে। সেটাকে প্রাণভরে নিতে না পারলে জায়গাটার প্রতি ভালোবাসা জন্মায় না। থাকাটাও বোরিং হয়ে যায়।


পথশ্রমে ক্লান্ত ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। ঘুম থেকে উঠে কোনো মতে ব্রেকফাস্ট সেরে ছুটলাম অফিসের কাজে। লাভাতে কাজ ছিল। কাজ সেরে ফিরলাম যখন তখন দুপুর তিনটে। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
দুপুরে ঘুম পায় না।
কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লাম।
বাজারের দিকে রওনা দিলাম।
কালিম্পং প্রাণবন্ত জায়গা। দার্জিলিং-এর ভিড়টা এখানে হয় না। স্থানীয় মানুষজন বেশি। শীতও বেশি না। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকক্ষণ পরে বাজারে পৌঁছনো গেল।
বাজারের এক পাশে থানা। বাঁ দিকের রাস্তা নীচের বাজারের দিকে নেমে গেছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে সে পথেই নামতে থাকলাম। বাজারে গিজগিজে ভিড়। স্থানীয় মানুষেরা বাজার করছেন। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের ঢল বেশি। কলেজ ছুটি হয় বোধহয় এই সময়টা।
নামতে নামতে বাস স্ট্যান্ডে চলে এলাম। দেখতেও ভালো লাগে। একগাদা গাড়ি। আর কত সব অজানা জায়গার নাম। সুমো টাইপ গাড়িগুলোতে লোকে উঠে বসেছে। বিভিন্ন জায়গায় গাড়িগুলো রওনা দেবে খানিকক্ষণ পরেই। আমারও একটা গাড়িতে উঠে যেতে ইচ্ছা করল।
নাম না জানা জায়গা যাওয়ার মজাই আলাদা। সমস্যা হল সকালে আবার দার্জিলিং যেতে হবে। ঠিক করলাম সব কাজ শেষ হলে ছুটি দু’দিন এক্সটেন্ড করব। কয়েকটা জায়গা ঘুরে নেব। নর্থ বেঙ্গল সুন্দরী। এর টান উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
চায়ের দোকান পেলাম একটা। চা খেতে বসে পড়লাম। গরম লাগছিল অনেকখানি হেঁটে।
বিশ্রামের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খানিকটা চাঙ্গাও করা যাবে।
গাড়ি ড্রাইভার আর যাত্রীদের ব্যস্ততা দেখতে ভালই লাগছিল।
চায়ের স্বাদ ভালো। চুমুক দিয়ে বাড়িতে ফোন করব নাকি ভাবছিলাম, এমন সময় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
পাহাড়ের এই সমস্যা। কখন যে বিনা নোটিশে ঝরতে শুরু করে দেবে কেউ বলতে পারবে না।
স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে অবশ্য তেমন কোনো চাপ দেখতে পারলাম না। প্রায় প্রত্যেকের কাছেই রেইন কোট বা ছাতা থাকে। মুহূর্তের মধ্যে সে-সব বাইরে চলে এল। জনজীবনে তেমন কোনো প্রভাব পড়ল না।
আমি ছাতা নিয়ে আসিনি বলে একটু চিন্তায় পড়ে গেছিলাম বটে, কিন্তু সামনেই একটা ছাতার দোকান দেখে স্বস্তি ফিরে এল।
মন দিয়ে চা খেতে লাগলাম।
“ধরতে পারবেন না।”
আমি বাংলা শুনে চমকে পাশের দিকে তাকালাম। একজন মাঝারি উচ্চতার মাঝ বয়েসী লোক, গাল ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি, ভিঞ্চিদার মতো ডায়লগ দিয়ে দিল। আমি বললাম, ‘আমাকে বলছেন?’
লোকটা বাইরের দিকে তাকিয়ে রুদ্রনীলের মতই বলল, ‘পাহাড়ে যে কখন বৃষ্টি হয় আর কখন মেঘ হয়, ধরতে পারবেন না। আমি দাঁতের ডাক্তার। গত তেরো বছর কালিম্পং-এ আছি। আমিই ধরতে পারলাম না, তো আপনি।’
আমি বললাম, ‘ওহ্‌, আচ্ছা। তা ঠিক বলেছেন। আপনার নাম?’
লোকটা বলল, ‘অরণ্যদেব। মাঝে একটা স্পেস আছে অবশ্য। তবে নিজেকে বেশি স্পেস দিই না আরকী। বুঝলেন?’
আমি বুঝলাম অরণ্যবাবু কথা বলার লোক পান না বলে ক্রমাগত ভাট বকে চলেছেন। তবু ভদ্রতার খাতিরে বললাম, ‘বুঝলাম। আচ্ছা, আপনি বাঙালি হয়ে এখানে টিকে আছেন কী করে? গুরুং বাহিনী তাড়া দেয়নি?’
অরণ্য বললেন, ‘এদের নেতার দাঁতও আমি তুলি বুঝলেন? আমাকে তাড়ানোর সাহস এদের নেই। বরং নিজেদের মধ্যে মারপিট করে আমার কাছেই আসে সব। পসার মন্দ হয়নি।’
আমি বললাম, ‘এখানে পসার করতে হল কেন?’
অরণ্য বললেন, ‘আরে সে অনেক গল্প। আমি জাতে বাগদী। ব্রাহ্মণ মেয়ে নিয়ে পালিয়েছিলাম। ধরতে পারলে ছাল ছাড়িয়ে দিত।’
অরণ্য চুপ করে গেলেন।
আমি আগ্রহী হলাম। কিন্তু লোকের ব্যাপারে বেশি জানার ইচ্ছাটাও ঠিক না। ঠিক করলাম নিজে থেকে কিছু বলব না। উনি বলতে চাইলে বলুন।
অরণ্য কাঁচাপাকা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘পাহাড়ে থাকতে ভালোই লাগে। শুধু ভূমিকম্প হলে জলের বড়ো কষ্ট। বুঝলেন?’
আমি বললাম, ‘ভূমিকম্প তো রোজ রোজ হচ্ছে না।’
অরণ্য আমার চোখের দিকে ছোটো ছোটো চোখ করে তাকিয়ে বললেন, ‘হয়, রোজ হয়। বুঝতে পারে না বাকি লোকেরা। গাছ কেটে, পাহাড় ভেঙে রাস্তা হচ্ছে, হোটেল হচ্ছে। অতই সহজ বাওয়া খোদার ওপর খোদকারি করা? অতই? প্রকৃতি রাগে একটু একটু করে কাঁপে ঠিকই। সবাই বুঝতে পারে না। আমি পারি।’
আমার কেন জানি না অরণ্যবাবুকে মানসিকভাবে সুস্থ বলে মনে হল না। চুপ করে গেলাম। অরণ্য ঠান্ডা হয়ে সিগারেট ধরালেন। বললেন, ‘কোথায় উঠেছেন?’
আমি বললাম।

আচ্ছা, আপনি বাঙালি হয়ে এখানে টিকে আছেন কী করে? গুরুং বাহিনী তাড়া দেয়নি?

বললেন, ‘ভালো জায়গা। তবে টাকা বেশি। আমি মাঝখানে ভেবেছিলাম হোম স্টে শুরু করব, দিব্যি টু পাইস হবে। পরে পিছিয়ে গেলাম। মানুষ বড়ো নোংরা। সোফায় নাক খুঁটে রেখে দেবে।’
অরণ্য চোখ মুখ কুঁচকালেন।
আমি বললাম, ‘তা বটে। তা ছাড়া যিনি নিজের লোকজন ছেড়ে এত বছর বাইরে আছেন, তার আবার সেই ভাষাভাষীর লোকজন ভালো লাগবেই বা কেন?’
অরণ্য আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনি বুদ্ধিমান। আমার বাড়ি ঘুরে যান। ভালো লাগবে। বেশি দূর না, ডেলোর পথে পড়বে। শহর ছেড়ে খানিকটা গিয়ে যে-কাউকে পাহাড়বাড়ি বললে দেখিয়ে দেবে। আপনি আজকে কী করছেন? আজকেই চলুন। ভালো স্কচ খাওয়াব।’
আমি অকস্মাৎ এই আমন্ত্রণে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম। আবার স্কচের লোভ সংবরণ করাও সম্ভব না। কোনো মতে সামলে উঠে বললাম, ‘আজ তেমন কিছু কাজ নেই। যাওয়াই যায়। কিন্তু ফিরব কী করে?’
অরণ্য বললেন, ‘আমার গাড়ি আছে তো। পৌঁছে দেব। চলুন। ওঠা যাক।’
অরণ্য উঠে দাঁড়ালেন। আমার চা খানিকটা বাকি ছিল।
কেন জানি না, লোকটার সঙ্গে যেতে ইচ্ছা করছিল। মনে হচ্ছিল, অনেক গল্প জমে আছে লোকটার মধ্যে। গেলে একেবারে নিরাশ হতে হবে না।


আমি নিশ্চিত অমিত থাকলে অরণ্যবাবুকে ঠিক কাটিয়ে দিত। আমি পারি না। কেউ আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলে তাকে একবারে কাটিয়ে দেওয়া যদি শিখে ফেলতে পারতাম তবে অনেক দিনই অনেক ঝঞ্জাট থেকে বাঁচতাম, কিন্তু আমি পারি না।
মারুতি এইট হান্ড্রেডে বসিয়ে অরণ্যবাবু আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
ভদ্রলোকের যে পসার ভালোই, তা বাড়িটা না দেখলে বোঝা সম্ভব ছিল না। বাড়ির চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া, ঝকঝকে লন, আর বিরাট এক কাঠের বাড়ি। সিনেমায় যেমন দেখায়। গেট খুলতে নিজেই গাড়ি থেকে নেমে গেট খুললেন ভদ্রলোক। গাড়িটা বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে ঢুকিয়ে গেট বন্ধ করলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেউ থাকে না এ বাড়িতে?’
অরণ্যবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ক্রীতদাস পোষা আমার স্বভাবে নেই। আমি আর আমার স্ত্রী সব কাজ নিজেরাই করি। আসুন।’
ভদ্রলোক চাবি দিয়ে তালা খুলে বাড়ির দরজা খুললেন। আমি বললাম, ‘আপনার স্ত্রী নেই?’
অরণ্যবাবু বললেন, ‘আছে তো। ঘরের ভেতরে আছে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তাহলে আপনি বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছিলেন কেন?’
অরণ্যবাবু উত্তর দিলেন না। আলো জ্বেলে ইশারা করলেন ঘরের ভেতরে গিয়ে বসতে।

অরণ্যবাবুর বাড়ির দেওয়ালে একগাদা মুখোশ। এরকম মুখোশ আমি হলুম্বাতেও দেখেছি। ঘরে কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। কোত্থেকে একটা স্কচের বোতল নিয়ে এসে পেগ বানাতে বানাতে অরণ্য বললেন, ‘বাঙালির মতো হারামি জাত আমি দেখিনি মশাই।’
আমার একটু রাগ হল। বললাম, ‘আপনি নিজেও বাঙালি তো।’
অরণ্য গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নিন, চিয়ার্স বলুন।’
আমি চিয়ার্স বললাম।
অরণ্য বললেন, ‘আত্মসমালোচনা করছি। একমাত্র বাঙালিই সেই জাতি যে, উৎপল দত্তর আগন্তুকের ডায়লগ শেয়ার করে বিজেপিকে ভোট দিয়ে আসে।’
আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, ‘আগন্তুকের সঙ্গে বিজেপির রিলেশন কী?’
অরণ্য বললেন, ‘ইন্টেলেকচুয়াল বোঝানো নিজেকে। এই এক জাত, ফেসবুকে একরকম, ইভি এমে আরেকরকম।’
আমি বললাম, ‘সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তো গোটা দেশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। আপনার এই পাহাড়ে লোক দিয়েছে সব থেকে বেশি। এদের সঙ্গে বাঙালির পার্থক্য কোথায়?’
অরণ্য স্কচের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ভণ্ডামিতে। বাঙালি ভণ্ড। মুখে ইন্টেলেকচুয়ালের ভড়ং দেখিয়ে এরা এখনও পণপ্রথা মানে, জাতপাত মানে। বাঙালি পরশ্রীকাতরও বটে। পরের ভালো সহ্য করতে পারে না। এর কারণ হল বাঙালিকে পরিশ্রম করতে হয়নি। সব হাতের কাছে পেয়ে গেছে। মিষ্টি জল, উর্বর শস্যক্ষেত্র। স্ট্রাগল যেটুকু করতে হয়েছিল দেশভাগের সময়। বেসিক্যালি রাজনৈতিক এবং কালচারালভাবে এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাঙালির থেকে ভয়েড জাত খুব কম আছে।’
আমার কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছিল না, নেহাত স্কচের দামটা জানি বলে চুপ করে শোনার ভান করলাম।
কথা ঘোরাতে চেষ্টা করলাম, ‘পাহাড়ের লোকেরা আলাদা রাজ্য চাইছে, এ সম্পর্কে আপনার কী মত?’
অরণ্য মুখ বাঁকালেন, ‘বাদ দিন। ওদিকের জানলাটা খুলুন। ভিউটা নিন। ভালো লাগবে।’
আমি উঠে জানলা খুললাম। চমৎকার দৃশ্য। রাত হয়েছে। কালিম্পং শহরটা আলোয় ঝকঝক করছে।
বললাম, ‘আপনার বাড়ির লোকেশনটা খুব ভালো।’

কোত্থেকে একটা স্কচের বোতল নিয়ে এসে পেগ বানাতে বানাতে অরণ্য বললেন, ‘বাঙালির মতো হারামি জাত আমি দেখিনি মশাই।’

অরণ্য বললেন, ‘প্রথমে এই বাড়িতে থাকতাম না। পালিয়ে যখন এসেছিলাম, কষ্টে থাকতে হতো। পসারও সেরকম নেই। তবে কেন জানি না, আমাদের চলে যেত ঠিক। আমার বউয়ের বাড়ির লোক খুব ডেঞ্জারাস। খুঁজে পেলে বাঁচিয়ে রাখত না। ভয়ও পেতাম সেই সময়টা।’
অরণ্য দুলে দুলে হাসলেন। বললেন, ‘চিপস খাবেন?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, খাওয়া যেতে পারে।’
অরণ্য উঠে একটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে এলেন।
আমি বললাম, ‘আপনার স্ত্রী…’
অরণ্য চিপসের প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খেলা ঘুরল হঠাৎ করেই। ঘিসিং সেবার বিরাট ঝামেলা করছে। রাস্তা ফাস্তা আটকে ভয়াবহ অবস্থা। আমি বাজারের পাশে একটা ছোটো বাড়িতে ভাড়া থাকি তখন। হঠাৎ দেখি এক লোক রাস্তায় পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। তাকে তুলে নিয়ে এলাম। আমি আর আমার বউ সেবা শুশ্রূসা করলাম। সুস্থ করার পর জানা গেল সে এলাকার বেশ ক্ষমতাশালী নেতা রাম চুগাই। তারপর আর আমাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’
রাতের দিকে ঠান্ডা পড়ে। স্কচের নেশাটা মজাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি মানে?’
অরণ্য হেসে বললেন, ‘স্কচটা ভালো?’
আমি বললাম, ‘খুব।’
অরণ্য বললেন, ‘দামী স্কচ। বেশ দামী। প্রতি রাতে একজন কমিউনিস্ট নেতা খেতেন নাকি নিয়ম করে। জীবন দৈর্ঘ্য বাড়ে, হৃদযন্ত্র ভালো থাকে। গৌরকিশোর ঘোষের নাম শুনেছেন?’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘হ্যাঁ সাংবাদিক ছিলেন।’
অরণ্য বললেন, ‘গৌরকিশোর ঘোষ একজন ডানপন্থী সাংবাদিক ছিলেন। ওর লেখাতে মজার ছলেতেই বলেছিলেন, ক্যাপিটালিস্ট মানে নিজের টাকায় যে গাড়ি চড়ে। আর কমিউনিস্ট মানে পাবলিকের টাকায় যে গাড়ি চড়ে।’
আমি বললাম, ‘হবে হয়তো। আমি কমিউনিস্ট নই, বিজেপি, তৃনমূল কিছুই নই। আমার সঙ্গে অন্য গল্প করলে ভালো হয়।’
অরণ্য হাসলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট ছিলাম। নেতার পা চেটে চাকরি চাওয়ার মতো ধান্দাবাজ কমিউনিস্ট না, আদর্শবাদী কমিউনিস্ট। যুক্তিবাদে বিশ্বাস করতাম, ঈশ্বর মানতাম না, প্রেতাত্মা ইত্যাদির তো প্রশ্নই আসে না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তো এখন আপনি কি এসবে বিশ্বাস করেন? মানে ঈশ্বর কিংবা প্রেতাত্মা?’
অরণ্য আমার দিকে তাকিয়ে স্কচের গ্লাস এক চুমুকে শেষ করে দিলেন। বোতল থেকে স্কচ ঢেলে আবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘পসার যখন জমে না, তখন জমে না। কিন্তু একবার জমতে শুরু করলে তখন আর আপনাকে পায় কে। এ এলাকার শুধু নয়, কোন জাদুমন্ত্রবলে দূর দূরান্ত থেকে আমার কাছে রুগী আসতে শুরু করল। আপনি কখনও দাঁত তুলিয়েছেন?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, একবার, মানে আক্কেল দাঁতটা…’
অরণ্য বললেন, ‘বুঝতে পারছেন আশা করি একজন দাঁতের ডাক্তারকে পেশেন্ট প্রতি কত সময় দিতে হয়।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, তা বটে।’
অরণ্য বললেন, ‘প্রথম দিকে নার্ভাস ছিলাম, পরের দিকে সাবলীল হলাম। সবটাই প্র্যাকটিস। মানুষজন বিশ্বাস করতে শুরু করল। তখন এদিকে এত দাম ছিল না জমির। জমি কিনে বাড়ি করা হল। এবং একদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম বউ নেই। পাগলের মতো এদিক সেদিক গিয়ে অবশেষে জানতে পারলাম আমি ছাড়া সবাই জানে, আমার অবর্তমানে লেপচা নেতা রাম চুগাই, আমার বউয়ের বিছানা গরম করত এবং শেষমেশ তাকে নিয়ে ভেগেছে।’
আমি চমকে উঠলাম।
অরণ্য নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলে আবার একচুমুকে হাতের গ্লাসের স্কচ শেষ করলেন।
অরণ্য বললেন, ‘আপনার গ্লাস খালি যাচ্ছে। নিন।’
আমি জোরে জোরে মাথা নাড়লাম, ‘না না, থাক। আপনি খান।’
অরণ্য হেসে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। চিন্তাও করবেন না। শুনে যান না। মন্দ লাগবে না শুনতে। যাই হোক, যেটা বলছিলাম। আমার বউ নিয়ে ভাগবে আর আমি চুপ করে থাকব? বেশ কিছুদিন গুমরে থাকতাম। চেম্বারে যেতাম না। কিছুই খেতাম না। শুধু মনে পড়ে যেত, এই মেয়েটা আমাকে কত ভালোবাসত। কীভাবে আমার সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল। সে এক অসহায় হাহাকার, মনে হতো আমি মরে যাব। একা একা ডিপ্রেশনে গিয়ে মদের মধ্যে ডুবে ছিলাম, এমন সময় খবর এল রাম চুগাই আমার বউকে নিয়ে লোলেগাওয়ের দিকে আছে। কোনো দিকে তাকালাম না। একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি কিনেছিলাম, সোজা চলে গেলাম লোলেগাওয়ের দিকে। এদিক সেদিক খোঁজ নিয়ে একটা গ্রামে গিয়ে দেখি আমার বউ পরম যত্নে চুগাইয়ের কাপড় মেলছে বাড়ির বাইরের দড়িতে। সেই বউ, যার জন্য সব ছেড়ে আমি চলে এসেছিলাম। সে বাড়ি চুগাইয়ের আদি বাড়ি। ঠিক করে গেছিলাম সে মেয়েছেলেকে খুন করে ফিরব, পারলাম না। ফেরার পথ ধরলাম। পরের দিন থেকে আবার চেম্বারে যাওয়া শুরু করলাম। যথারীতি রুগী আসাও শুরু হল। মাথা থেকে বউয়ের সমস্ত স্মৃতি মুছতে আমার ঠিক তিরিশ সেকেন্ড লেগেছিল।’
অরণ্য চুপ করলেন।
ঘরে এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল।
হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় আমি নড়ে চড়ে বসে বললাম, ‘আপনি যে বলেছিলেন, আপনার স্ত্রী ঘরের ভিতরে আছে?’
অরণ্য ধীর গলায় বললেন, ‘বছর তিনেক আগে এক সন্ধ্যেবেলা হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আমি বাড়ি ফিরে এসেছি প্র্যাকটিস থেকে রাত দশটা নাগাদ। তালা খুলে ঘরে ঢুকে দেখি আপনি যেখানটা বসেছেন, ঠিক সেখানে চুপ করে বসে আছে। চোখে আর্তি, যেন ক্ষমা চাইছে। আমি চেঁচিয়ে উঠে ওকে ছুঁতে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার অবস্থা বুঝুন, এমনিতেই বাড়িতে একা থাকতাম, তার ওপর এরকম দৃশ্য। আমার কাছে তো তখনও কোনো খবর আসেনি সে মারা গেছে। কিন্তু সে জিনিস দেখার পরে আর কি মাথা ঠিক রাখা যায়? কোনো রকমে সে রাতটা এক লোকাল লেপচার বাড়িতে কাটালাম, সকালে খবর এসে গেল। ততক্ষণে আমি বুঝে গেছিলাম অবশ্য। মনে মনে তাকে ক্ষমা তো সেদিনই করে দিয়েছিলাম। তবু সে সমস্যা গেল না। যখনই এ বাড়িতে ঢুকতাম, কোথাও না কোথাও বসে থাকতে দেখতাম। চোখে মুখে ক্ষমা চাইবার ভঙ্গি। ঘুম শিকেয় উঠল, আলসার ধরা পড়ল, পসার গেল চলে। তাকে না দেখলেও দেখতে পাওয়া শুরু করলাম।’
স্কচের নেশা সত্ত্বেও আমার গা শিরশির করতে লাগল। আমি চারদিকে তাকালাম। আধো অন্ধকারে সবকিছু দেখেই ভয় লাগতে লাগল।
অরণ্য বললেন, ‘একটা মজার ব্যাপার কী হল জানেন? সেটা সত্যিই মজার। আমি একদিন লনের মধ্যে রোদে চুপ করে বসে আছি, রাতে ঘুমাইনি, চোখের তলায় কালি, এমন সময় দেখি রাম চুগাই এসে বাড়ির সামনে ঘুর ঘুর করছে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে ব্যাটা গেট খুলেই আমার পায়ে ধরে কান্নাকাটি জুড়ল। আমার অবস্থা বর্ণনাতীত, যে লোক আমার বউ নিয়ে পালিয়েছে, সে আমার পা ধরে কান্নাকাটি করছে, এরকম অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স কে কল্পনা করতে পারে! ভাববেই বা কেউ কী করে? যাই হোক, অনেক কষ্টে সে ব্যাটাকে শান্ত করে যা জানা গেল আমার বউকে সে বড়ো জ্বালাতন করত। বউ পালাতে চেষ্টা করেছিল ওর ওখান থেকে, কিন্তু পারেনি। শেষ মেশ এক প্রকার না খেয়েই মারা যায়। কিন্তু মারা যাবার পরে চুগাইকে নিয়মিত আমার বউ দেখা দেওয়া শুরু করেছে। চুগাইয়ের জিনা হারাম হয়ে গেছে।’
অরণ্য অপ্রকৃতিস্থের মতো জোরে জোরে হেসে উঠলেন।
আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। মনে হচ্ছিল, চোখ বন্ধ হলেই অরণ্যদেবের বউ আমার চোখের সামনে প্রতীয়মান হবেন।
অরণ্য বোতল থেকে সরাসরি নিজের গলায় মদ ঢেলে বললেন, ‘বাঙালি ঈশ্বর অবিশ্বাসী যুক্তিবাদী কমিউনিস্টের বাচ্চা, আমি, এসব শুনে হাসব না কাঁদব কিছুই বুঝতে পারলাম না। রাম চুগাইকে বিদায় করে ঠিক করলাম কালিম্পং-এর বাসা এবার ছাড়তে হবে। শেষ জীবনটা অন্য কোনো খানে কাটিয়ে দি। সমতলে আর পারব না, শরীর নেবে না। মংপু গুরুদেবের জায়গা, ওখানেই একটা বাড়ি দেখাশুনা করতে যাব ঠিক করেছি এমন সময় বেরোতে গিয়ে দেখি বাড়ির দরজায় এক তিব্বতি সন্ন্যাসী চুপ করে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম কী চাই? আমাকে একগাদা মুখোশ ধরিয়ে দিয়ে উঠে বেরিয়ে গেলেন। আমি হাঁ করে মুখোশগুলোর দিকে তাকালাম। কিছুই বুঝলাম না। তবে সিক্সথ সেন্স কিছু একটা বলছিল। ঘরে এসে পেরেক মেরে মেরে মুখোশগুলো টাঙিয়ে দিলাম। মংপু যাওয়াও ক্যান্সেল করলাম। অবাক ব্যাপার হল, সেদিনের পর থেকে যেখানে সেখানে ওকে আর দেখতে পাইনি।’
কথাগুলো বলে অরণ্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলুন, আপনাকে দিয়ে আসি। মদে মদে নইলে বারোটা বেজে যাবে।’
আমি উঠলাম। মুখোশগুলোর দিকে না চাইতেই চোখ চলে গেল। অজানা ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম হঠাৎই। কোট পরতে পরতে অরণ্য বললেন, ‘ওহ্‌, আরেকটা কথা বলা হয়নি, যেদিন রাম এ বাড়ি এসেছিল, তার পরের দিন রাম চুগাইয়ের বডি রহস্যজনকভাবে খাদের জঙ্গলে খুঁজে পাওয়া যায়। চোখে মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। কেউ কিছুই বুঝতে পারেনি। ওর মৃত্যু রহস্য অমীমাংসীতই থেকে গেল। আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন, আমি গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের করি।’
অরণ্য পা চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমি এই আধো অন্ধকার ঘরে মুখোশগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।
কিছু একটা অস্বস্তি হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম কিন্তু ঠিক কী হচ্ছে ধরতে পারলাম না। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে অরণ্য আমাকে গাড়িতে বসিয়ে বাড়িতে তালা দিলেন।
গাড়িতে উঠে বললেন, ‘মদ খেয়েছি বলে ভাববেন না, মদ খেলে আমার ড্রাইভিং এর হাত ভালো হয়ে যায়।’
আমি সামান্য ভয় পেলেও প্রত্যুত্তরে হাসলাম। এই ভুতুড়ে বাড়িতে কে থাকতে যাবে রাতে? তার থেকে কোন মোদো মাতাল যেদিকেই নিয়ে যাক, যাওয়া যাবে।
বাস্তবিকই দেখা গেল অরণ্যদেব মত্ত অবস্থাতেই ভালো গাড়ি চালান। আধঘন্টার মধ্যে হলুম্বার গেটের সামনে পৌঁছে গেলাম আমরা।
গাড়ি থেকে নামতে যাব, অরণ্য বললেন, ‘কাল আমি মাঙ্গান যাচ্ছি, পরশু ফিরব। আপনি থাকলে দেখা হবে।’
আমি হাসার চেষ্টা করলাম, বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’
ভেতরে ভেতরে বললাম পাগল কুকুরে কামড়েছে আমায় যে আপনার বাড়ি যাব?
হোটেলের ভেতরের জঙ্গুলে রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছি এমন সময় অরণ্য গাড়ির হর্ন বাজালেন। আমি অবাক হয়ে ফিরে এসে বললাম, ‘কিছু বলবেন?’
অরণ্য হাসলেন, ‘আপনাকে কিছুক্ষণ মুখোশগুলোর সাথে ছেড়েছিলাম। কিছু পার্থক্য বুঝেছিলেন?’
আমি বললাম, ‘না তো, কী পার্থক্য?’

গাড়িতে উঠে বললেন, ‘মদ খেয়েছি বলে ভাববেন না, মদ খেলে আমার ড্রাইভিং এর হাত ভালো হয়ে যায়।’

অরণ্য বললেন, ‘আপনি যখন আমার বাড়ি ঢুকেছিলেন, মুখোশগুলোর চোখ বন্ধ ছিল। বেরোনোর সময় চোখগুলো খোলা ছিল। রাতে ও জেগে ওঠে। সন্ন্যাসী আত্মাবন্ধন করেছিলেন আসলে। আপনি লক্ষ করেননি, বেঁচে গেছেন। ওখানে থেকে লক্ষ করলে ভয় পেয়ে যেতেন। সকালে সবক’টা মুখোশের চোখ বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম যেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু ভেবে দেখলাম, এ মহিলা আমাকে ছাড়বে না। যেখানেই যাব, তার অপরাধবোধ নিয়ে ক্ষমা করে দাও মুখ নিয়ে পেছন পেছন যাবে। তার থেকে যা কারুকাজ করার মুখোশের ভেতর থেকেই করুক। চোখের ওপর দিয়ে যাবে অন্তত। টিকে গেলাম তার পর থেকে। কাল সকালে এলে দেখতে পাবেন মুখোশগুলোর চোখগুলো সব বন্ধ। কোথাও গেলে ওকে আর ফেলে রেখেও যাই না। সঙ্গে করেই নিয়ে যাই। কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে ওর ওপর। ছাড়তে পারি না। মনে হয় থাকুক বাকি জীবনটা। কী আর হবে বলুন?’
অরণ্য ম্লান হাসলেন। তারপর আর কোন কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন। আমার প্রবল শীত করছিল। কী কুক্ষণে যে এর বাড়ি গেছিলাম কে জানে! মুখোশগুলো সত্যিই চোখ খুলে তাকায়! কী সাংঘাতিক! এও হয় নাকি?
চড়াই ভাঙতে শুরু করলাম। ডিনার টাইম হয়ে গেছে হলুম্বায়।
ডিনার রুমে পৌঁছে খেয়াল হল সর্বত্র সেই তিব্বতি মুখোশগুলো। চোখ খুলে হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে…

Facebook Comments

পছন্দের বই