লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অমিতাভ মৈত্রর প্রবন্ধ

আত্মপ্রতিকৃতি: পরাবাস্তববাদী নারী শিল্পীদের চোখে

চিত্র: দালি

পরাবাস্তববাদই সম্ভবত প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন যেখানে নারীকে দূরতম কোনো নক্ষত্রের আলোর মতো, প্রেরণা ও পরিত্রাণের মতো, কল্পনার দেবী প্রতিমার মতো পবিত্র এক অবস্থান দেওয়া হয়েছিল। নারী তাদের চোখে একই সাথে পবিত্র কুমারী, দেবদূত আবার একই সাথে মোহিনী জাদুকরী, ইন্দ্রিয় উদ্দীপক ও নিয়তির মতো অপ্রতিরোধ্য। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টোয় আজেঁব্রে নারীকে এরকম একটি অপার্থিব অসীম স্বপ্নিল চোখে দেখা ও দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। পুরুষ শিল্পীদের প্রেরণা, উদ্দীপনা ও কল্পনার সুদীর্ঘ সাম্পান হয়ে এগিয়ে আসবেন নারীরা। হয়ে উঠবেন পুরুষদের আরাধ্য ‘মিউজ’ আর একই সাথে femme fatale. সুদৃশ্য উঁচু পূজার বেদি উদ্ভাসিত করে যেখানে বসে থাকবেন। নারীরা। তাদের স্বর্গীয় প্রসাদে আরও সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে পুরুষ। ব্রের্ত ছিলেন সেই সময়ের কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। তাঁর সম্মোহক ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন হননি তাঁর সান্নিধ্যে এসেও— এরকম কোনো দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। উজ্জ্বল, সাবলীল, মেধাবী, স্বতস্ফূর্ত এবং নায়কসুলভ ব্রের্ত একই সাথে ছিলেন উদ্ধত, আক্রমণাত্মক এবং অহমিকাপূর্ণ। নিজের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে মাঝে মাঝেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতেন। কিন্তু যদি তাঁর একবার মনে হতো যে, কেউ তাঁর প্রভুত্বকে অগ্রাহ্য করছে, সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করতেন। নেতৃত্ব দেবার সব গুণ প্রকৃতিগতভাবেই ছিল তাঁর মধ্যে। মহিলাদের সাথে তাঁর ব্যবহার ছিল তরুণ প্রেমিকের মতো সম্ভ্রমপূর্ণ। তাঁর আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, অভিজাত ভাষা— এসবের সাথে মাঝে মাঝেই মেজাজ হারিয়ে সম্পূর্ণ লাগামহীন হয়ে পড়া আর দুর্বোধ্য জটিল মানসিকতার জন্য পারতপক্ষে অনেকেই ঘাঁটাতে চাইতেন না তাঁকে। নারীদের নিয়ে পরাবাস্তববাদীদের এই স্বপ্নিল কাব্যময় উচ্ছ্বাস জোরালো একটা ধাক্কা খেল যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিম ইউরোপে দ্রুত বদলাতে থাকা পরিস্থিতির ভস্ম ও শোণিত স্নাত শোণিত আত্মশক্তি সম্পন্ন নারীরা তাদের ভারী বাস্তবতা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে। স্বপ্নে দেখা নারীর আয়না-শরীর ভেঙে পড়ল ঝুরঝুর করে, আর বেরিয়ে এল মেরুদণ্ড সম্পন্ন রক্তমাংসের মানবী। সুররিয়ালিজম চেয়েছিল পুরুষের নিয়ন্ত্রণে নারীদের মুক্তি। কিন্তু যে-গভীর অতলশায়ী মুক্তি দরজা খুলে দিল নারীদের জন্য, সুররিয়ালিজম তার জন্য তৈরি ছিল না। মৃত অ্যালবাট্রসের মতো এই বিমূর্ত আদর্শায়িত ধারণা নারী শিল্পীদের গলায় ঝুলে থেকেছে যাকে ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব শিল্পসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা দুঃসাধ্য ছিল। সময় লেগেছে সাফল্য পেতে। কিন্তু দিনের শেষে হেসেছিলেন তাঁরাই। এমন নয় যে, পরাবাস্তবতার প্রধান মশালবাহক ব্রের্ত চাইছিলেন যে, পুরুষরাই হবেন এই আন্দোলনের ঋত্বিক আর দ্যুতিময় নারী শিল্পী এবং সাহিত্যিকদের কাজ হবে মুগ্ধ সাদা পালক ঘাসের ওপরে ফেলে যাওয়া এবং আকর্ষণীয় ‘গুজব’ হিসেবে সুখী থাকা। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশের পরবর্তী প্রদর্শনীগুলিতে নারী শিল্পীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু পুরুষ উদ্ভাবিত পরাবাস্তবতা থেকে তাঁদের ভাষা স্বর ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র। নিজেদের ভারী অস্তিত্ব, শরীরী উপস্থিতি জোরালোভাবে জায়গা পেল তাঁদের ছবিতে। শিল্পী তাঁর অনেক ভেতরে ডুবে থাকা তৃষ্ণা, ভয় ও অদ্ভুত কল্পনাদের জাগিয়ে তুলবেন নিজের মধ্যে— সুররিয়ালিজমের লক্ষ্য ছিল এটাই। এখানে মৃত্যু জন্মের বিপরীত নয়। বাস্তব ও কল্পনা, অতীত ও ভবিষ্যৎ, তীব্র আনন্দ আর বিদ— এদের মধ্যেও কোনো সংঘর্ষ নেই। একজন শিল্পী কেবল তাঁর ভেতর থেকে উঠে আসা আলো অন্ধকারের কাছে বিশ্বস্ত ও দায়বদ্ধ থাকবেন। শিল্পে তাকে আনবেন। এই অর্থে সমস্ত সুররিয়ালিস্ট ছবিই শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি। পার্থক্য এটাই যে, বাইরের সাদৃশ্যের বদলে সেই প্রতিকৃতি শিল্পীর অন্তর্জগতের। সব প্রতীক, ইমেজ, মোটিফ যেখানে শিল্পীর নিজস্ব। কিন্তু সালভাদোর দালিই সম্ভবত একমাত্র পুরুষ শিল্পী যাঁর ছবিতে নিজের প্রতিকৃতি এসেছে। বারবার। নানাভাবে। নার্সিসিজম দালির কাছে ছিল একটি সচেতন চেষ্টা যার সাহায্যে তিনি বিপথগামী করতে পারতেন নিজের মানসিক অবস্থাকে এবং উদ্ভট কল্পনায় জগতে পৌঁছে যেতেন।
কিন্তু নারী শিল্পীদের কাছে আত্মপ্রতিকৃতি হয়ে উঠল একটি সশস্ত্র ভাষার মতো। নিজস্ব গোপন একটি সন্ত্রাসের মতো। এই আন্দোলনের মধ্যে নারীরা এমন এক পৃথিবীর ঝলক দেখলেন যেখানে আরোপিত বিধিনিষেধ না মেনে সৃজনশীল থাকা যায়, দম চাপা প্রতিবাদের ইচ্ছেগুলোর উৎস থেকে পাথরের বাধ সরিয়ে দেওয়া যায়। নগ্ন ও উদ্দাম করা যায় কল্পনাকে। নোঙর নামানো জাহাজের মতো অনড় ও ঠাসবুনোট একটি উপস্থিতি হয়ে ছবিতে নিজের মুখ তাঁদের কাছে হয়ে উঠল অন্যতম প্রধান আইকন। যে-ছবি আত্মপ্রতিকৃতি নয় সেখানেও বারবার আসতে থাকল শিল্পীর শরীরী প্রতিমা। ফ্রিদা কাহলোর (১৯১০-১৯৫৪) ক্যানভাস তাঁর যন্ত্রণাবিদ্ধ শান্ত মুখশ্রী ধরে রাখল। মুখের বিশেষ কিছু চিহ্ন যা তাঁকে চেনায়— যেমন পাখির ডানার মতো ভুরু, আমন্ড আকারের চোখ ছবিতেও আনলেন তিনি। রিমেদিওস ভারোর (১৯০৮-১৯৬৩) ছবিতে পানপাতার মতো মুখ, তীক্ষ্ণ নাক দীর্ঘ মাথাভরতি চুলের নারীর মধ্যে নির্ভুল চেনা গেল শিল্পীকে। আবার লিওনর ফিনির (১৯১৮-১৯৯৬) আঁকা নারীরা তাঁদের বেড়ালের মতো কালো চোখ আর ইন্দ্রিয়াসক্ত মুখ নিয়ে হয়ে উঠল ফিনিরই চেনা মুখচ্ছবি। ১৯৩৯ সালের ‘The Alcove: An inturior with three women’ ছবিতে ভারী পর্দা টাঙানো ঘরে দু’জন অর্ধশায়িত মহিলা পরস্পরকে ছুঁয়ে আছেন। আর একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। তিনজনেই যেন কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করছেন চাপা উদ্বিগ্ন মুখে। যে-তিনজন নারীর ছবি, তাঁরা যে লিওনর ফিনি, লিওনারা ক্যারিংটন এবং ইলীন অগার, এটা ছবিটিকে একঝলক দেখেই চেনা যায়।
এমনকী যখন অন্য কোনো নারীর প্রতিকৃতি আঁকছেন তাঁরা সেখানেও তাঁদের বিদ্রোহের অস্বীকারের জোরালো পাঞ্জার ছাপ এই শিল্পীরা সেই সব নারীর মুখে ঘন লাল নিম্নরেখা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন।

স্বপ্নে দেখা নারীর আয়না-শরীর ভেঙে পড়ল ঝুরঝুর করে, আর বেরিয়ে এল মেরুদণ্ড সম্পন্ন রক্তমাংসের মানবী। সুররিয়ালিজম চেয়েছিল পুরুষের নিয়ন্ত্রণে নারীদের মুক্তি। কিন্তু যে-গভীর অতলশায়ী মুক্তি দরজা খুলে দিল নারীদের জন্য, সুররিয়ালিজম তার জন্য তৈরি ছিল না।

ইতালিয়ান রেনেসাঁ শিল্পীদের ছবি অসাধারণ দক্ষতায় আঁকতেন ক্যারিংটন (১৯১৭)। ক্রমাগত উলটোভাবে লেখার অভ্যেস করতে করতে এত দ্রুত লিখতে পারতেন এভাবে যে, আয়নার সাহায্যে পড়তে হতো সেই লেখা। তাঁর অদম্য উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির জন্য একের পর এক স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ১৪ বছর বয়সে গীর্জায় ফাদারের উপদেশ দানের পর তিনি সোজা সেই যাজকের সামনে দাঁড়িয়ে কোমর পর্যন্ত অন্তর্বাসহীন স্কার্ট তুলে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো উপদেশ নেই, ফাদার?’ কিছুদিন পরে মাঝে মাঝেই তাঁকে দেখা যেত ভিড়ের রাস্তায় বিকেলবেলায় চায়ের খোঁজে বেরোনো সুন্দর পোশাকের সম্ভ্রান্ত নারী পুরুষদের ভেতর দিয়ে কয়েকজন বন্ধুর সাথে তিনি উঁচু গলায় তাঁর নিজের শরীর কল্পিত সিফিলিস নিয়ে কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন। গর্ভপাতের কল্পিত অভিজ্ঞতার কথাও আসত। এই সময়েই তিনি আঁকলেন— ‘Portrait of Joan Powell’. জোয়ান পাওয়েল ছিলেন ক্যারিংটনের বন্ধু এবং ১৯৩৬ সালে যখন ছবিটি ক্যারিংটন আঁকেন তার এক বছর পর তাঁর প্রথম যোগাযোগ হবে সুররিয়ালিজমের সাথে। ছবিটিতে একসপ্রেসনিজমের ধরনে দ্রুত এবং দগদগে করে চাপানো রং জোয়ান পাওয়েলের ছটফটে অস্থির অভিব্যক্তির সাথে মিলে যায়। ইটের দেওয়ালের সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। তার ডান গালে, নাকে, চিবুকে তেরছাভাবে আলো পড়েছে। টুপির নীচ দিয়ে কানের ওপর ঝুলছে সোনালি চুলের গুচ্ছ। গলা পর্যন্ত ঢাকা প্রিন্টেড জামা। ঠোঁটের কোণে অবহেলায় চেপে রাখা জ্বলন্ত সিগারেট। হাতে একটা খোলা বই— জাঁ ককতোর ‘লে আঁফ তেরিব’। ১৯৩০ সালে যখন ককতের এই উপন্যাসিটি বেরিয়েছিল বিচ্ছিন্নতা শিকার সব কিশোর কিশোরীদের হাতবই হয়ে ওঠে উপন্যাসটি অচিরেই। ছবিটির ধূসর রং, খসখসে তল আর মুখোশ-শক্ত মুখ নারীদের অন্তস্থ দানবিক রূপকে তুলে ধরেছে।
১৯৩৯ সালে আঁকা আত্মপ্রতিকৃতিতে যে-ক্যারিংটনকে পাওয়া যাবে ১৯৩৬ সালে বন্ধুর প্রতিকৃতি আঁকা শিল্পীর সাথে তাঁর মহাসাগরীয় দূরত্ব এসে গেছে। ১৯৩৭ সালে সুররিয়ালিজম আন্দোলনের সাথে যোগাযোগের একটা আপাত প্রভাব ফুটে উঠেছে সেখানে। পুরুষ অশ্বারোহীর পোশাক পরা ক্যারিংটন টানটান ভঙ্গিতে একটা সরু গদিমোড়া চেয়ারে বসে। শূন্যে তুলে রাখা ডানহাতের তর্জনী অস্বাভাবিক স্ফীত। তার পেছনে শূন্যে ভাসমান একটা দোলনা ঘোড়া যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছে ক্রমশ আর জানলার ওপারে অনেক দূরে মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে সেই ঘোড়াটিই যেন উজ্জ্বল, আনন্দবিহ্বল ছুটে যাচ্ছে মুক্তির আনন্দে। বাতাসে ক্যারিংটনের চুলের ভারী গোছা তার মাথা ছেড়ে যেন লাফিয়ে উঠছে ঘোড়ার মতো। চোখ যেন জ্বলে উঠছে তাঁর। মেঝের এক অংশ অস্পষ্ট ধোঁয়ায়। সেই ধোঁয়া থেকে যেন জেগে উঠছে যার অভিব্যক্তি মানুষের মতো। ভারী স্ফীত তিনটে স্তন নিয়ে সে এগিয়ে আসছে চেয়ারের দিকে। মানুষ আর না-মানুযের সীমানা মুছে যাচ্ছে। চেয়ার, উপবিষ্ট নারী আর হয়েনায় দীর্ঘ ছায়া মিলে মিশে একহয়ে যাচ্ছে।

ছবির মধ্যে একটি মা-হায়েনা আর সাদা দোলনা ঘোড়ার মাঝখানে বসে। হায়েনা একই সাথে উর্বরা শক্তি ও রাত্রির রহস্যময় অন্য জগতের প্রতিনিধি। একজন নিঃসঙ্গ শিশু ক্যারিংটন নার্সারির এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা দোলনা ঘোড়ার সাথে এক কাল্পনিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দীর্ঘদিন ঘোড়াটি ছিল তার সঙ্গী। হায়না ও ঘোড়া বারবার বিভিন্ন অনুষঙ্গে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছেন তিনি। তাঁর লেখা গল্প ‘The Debutante’ যা ১৯৪০-এ ব্রের্তর ‘Anthology of Black Humour’-এ ছাপা হয়েছিল, সেখানে একটি হায়েনার কথা আছে যে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে আসা একটি মেয়ের বন্ধু হয়ে যায়। মেয়েটি তাকে জানায় সমাজে তার প্রথম আত্মপ্রকাশের সম্মানে তার মা যে বল নাচের আয়োজন করেছেন সেখানে সে কিছুতেই যোগ দিতে চায় না। তার হয়ে হায়না মুখোশ পরে সেই নাচের আসরে যায়। তার আগে মেয়েটির পরিচারিকাকে মেরে খেয়ে ফেলে তার মুখ চুরি করে নিজের মুখে বসিয়ে মেয়েটির বল নাচের গাউন পরে নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসে। তার শরীরের প্রাকৃতিক গন্ধ যখন সচকিত করে দিচ্ছে সবাইকে, মেয়েটি তখন ওপরতলায় একা বসে গালিভার্স ট্রাভেলস-এ মগ্ন। সে জানে না গায়ের অদ্ভুত গন্ধের জন্য কয়েকজন হায়েনাকে অপমান করায়, হায়েনা নিজমূর্তি ধরে মুখোশের মাথাটি সবার সামনে চিবিয়ে খেয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
১৯৪৭ সালে লেখা ক্যারিংটনের নাটক ‘পেলিলোপ’-এ খেলনা কাঠের ঘোড়া ‘টার্টার’-এর প্রেমে উন্মাদ হয়ে একটি মেয়ে তার বাবার প্রভুত্বর অগ্রাহ্য করে ক্ষীণবুদ্ধি মানুষ— যারা জাদুর ক্ষমতা বোঝে না, রাত্রিকে ভয় পায়— তাদের পৃথিবী ছেড়ে সাদা একটা মেয়ে ঘোড়া হয়ে টার্টারের সাথে অন্য এক পৃথিবীতে চলে যায় যেখানে অবাধ কল্পনা আর জাদুর ক্ষমতাকে সম্মান করে সবাই। ছবি আঁকার সাথে নাটক ও গল্প লেখা সমানে চালিয়ে গেছেন ক্যারিংটন। একই ব্যক্তিগত টোটেম তাঁর ছবি ও লেখাপত্রে সহজ পায়ে এসেছে। ১৯৩৭ সালে তাঁর প্রথম গল্প ‘The House of Fear’-এও ছিল এক বন্ধু ঘোড়ার কথা যে তরুণী নায়িকার অবচেতনার নিয়ন্ত্রক। তার সঙ্গী হয়েই তরুণীটি রহস্যময় ও ভয়ংকর নানারকম ধর্মীয় উদযাপন ও সংস্কারের পর মানুষের রূপান্তর ঘটতে দেখে চোখের সামনে। বার্ড সুপিরিয়র লপলপ নামের সেই বন্ধু ঘোড়াটি অবশেষে ভয়মুক্ত করে তরুণীকে।
সুররিয়ালিস্টদের ওপর ফ্রয়েডের গভীর প্রভাব ছিল। কিন্তু ক্যারিংটনের তেমন মাথাব্যাথা ছিল না ফ্রয়েড নিয়ে। তাঁর বিভিন্ন ছবি এবং লেখায় যে-ঘোড়ার, ক্ষুরের শব্দ ঘুরে ঘুরে আসে সেই ঘোড়া ফ্রয়েডের পরু-শক্তির প্রতীক নয়। বরং প্রাচীন কেলটিক রূপকথা তার উৎসে। ছেলেবেলায় আইরিশ মায়ের কাছে। এই সব কাহিনি শুনেই তাঁর বেড়ে ওঠা। আইরিশ উপজাতিদের চোখে সাদা ঘোড়া একটি পবিত্র প্রাণী সে বাতাসের চেয়েও দ্রুত আর উড়তে পারে হাওয়ায়। মরিস নাচের খেলনা ঘোড়া কেলটিক ধর্মবিশ্বাসে ঘোড়া-পুজোর সাথে সম্পর্কযুক্ত। মৃত্যু ও পুনর্জন্মের প্রতীক সে। সাদা ঘোড়ায় চড়ে সে কেলটিক দেবী ওয়েলশে Saga of Rhiannow-এ আসেন, তার আসা জীবন মরণের সীমানার বাইরে অন্য কোনো পৃথিবী থেকে।
কিন্তু ক্যারিংটনের কাছে সাদা ঘোড়া এই সব তত্ত্ব ও বিশ্বাসের বাইরে অন্যকিছু। ক্যারিংটনের সাদা ঘোড়া তাঁর পথনির্দেশক একজন পুরুষ সুররিয়ালিস্ট শিল্পী ম্যাক্স এর্নস্ট— যিনি তাঁর বন্ধু, তাঁর প্রেরণা, তাঁর প্রেমিক। ১৯৩৯ সালে এর্নস্টের যে-প্রতিকৃতি ক্যারিংটন এঁকেছিলেন সেখানে লাল ধর্মীয় পোশাক আর হলুদ কালোডোরাকাটা মোজা পরা অলেকিক চেহারায় এক পরিত্যক্ত বরফের দেশে একা হাঁটছেন এর্নস্ট। তাঁর পিছনে সাদা একটা বরফের ঘোড়া যেন বরফ থেকে অকস্মাৎ প্রাণবন্ত হয়ে জেগে উঠছে। সেই অলৌকিক পুরুষের হাতে লণ্ঠন। কিন্তু আলোর পরিবর্তে সেই লণ্ঠনের কাচের ভেতরে আর একটি ছোট্ট সাদা ঘোড়া। ১৯৩৭ সালে ক্যারিংটনের প্রথম দেখা হয় তাঁর ‘সাদা ঘোড়া’ ম্যাক্স এর্নস্টে সাথে। ১৯৩৯ সালে এর্নস্টকে জার্মান সেনা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত গভীর ভালোবাসা আর সৃজনশীল কাজে খুব অর্থময় সময় কেটেছিল তাঁদের। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত ‘Down Below’ গ্রন্থে তাঁর এই ভয়ংকর যন্ত্রণা ও JaltaThalecon Pol 7616901— ‘I wept for twenty four hours and indulged in voluntary vomittings induced by duinking orange blossom waster’ এরপর তিন সপ্তাহ ধরে চলতে থাকল তাঁর অনাহার ও দুঃসহ শারীরিক শ্রম ও যন্ত্রণা। এ সব কিছুর মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন এক ধরনের আত্মশুদ্ধিকরণ। তিনি চাইছিলেন আরও তীব্র ক্লেশ যার মাধ্যমে জীবন শুদ্ধ হবে। এড়াতে চাননি যন্ত্রণাকে। ভেঙে পড়েননি যখন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ‘They tore my clothes off brutally and strapped me naked to the bed accompanied by intense pain and vivid hallucinations.’

তার দ্বিমুখী সত্তার উন্মোচন আর নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে দেখার জন্য আয়নাকে একটি চমৎকার অস্ত্র বা উপায় হিসেবে দেখেছিলেন নারী সুররিয়ালিস্টরা। বাইরের বাস্তব আর অন্ত্যস্থ বাস্তবের মধ্যে যে-দূরত্ব ও এমনকী সংঘর্ষও থাকে, তাকে দেখার ও দেখানোর জন্য তাঁরা প্রতিফলন খুঁজলেন আয়নায়, স্থির জলে, আকাশে, বাতাসে। সবকিছুই আয়না হয়ে উঠল তাঁদের কাছে। বাইরের কৃত্রিম, মাংসভুক ও দমন উদ্যত পৃথিবীর থেকে তার অনুভূত একান্ত পৃথিবীকে সুদূর আর সংস্পর্শের বাইরে রাখার বিশ্বস্ত এবং অব্যর্থ উপায় হিসেবে আত্মপ্রতিকৃতিকে আশ্রয় করেছিলেন নারী সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা। ব্রের্তর তাত্ত্বিক আদর্শায়িত প্রাসাদের অন্তঃসারশূন্য ঘরগুলি তাঁরা দেখেছিলেন নিজেদের অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে। পুরুষ শিল্পীরা তাঁদের চেতন ও অবচেতনের বিপরীত মেরুর সংশ্লেষণ করেছিলেন অবদমিত বাসনায় মুক্তি ঘটিয়ে, বাইরের বস্তুপুঞ্জের মধ্যে নতুন রকমের আলোর খোঁজে। নিঃশব্দে নিজেদের অবস্থান সঠিক বুঝে নিয়ে নারীরা তখন ফিরে গেলেন তাঁদের একান্ত নিজস্ব পৃথিবীর দরজা খুলে দিতে। সুবরিয়ালিজমকে তাঁরা করে নিলেন তাঁদের উড়ান শুরুর ভূমি। এই আত্মঅভিযানে তাঁরা ব্রের্তর আদর্শবাদ আর তাঁর বিখ্যাত ম্যানিফেস্টো থেকে হাত ধুয়ে ফেললেন।

চিত্র: লিওনর ফিনি

লিওনর ফিনি (১৯১৮-৯৬) ‘The End of the World’ ছবিতে যে-নারীর মুখ আঁকলেন তাতে ‘আত্মপ্রতিকৃতি’-র স্বীকৃত ঘোষণা না থাকলেও সেই মুখ ছিল নির্ভুলভাবে তাঁরই। ছবিটি আঁকা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। সোনালি চুলের একজন নগ্ন নারী ছবিটির কেন্দ্রে। শান্ত মুখ— তিনি তাকিয়ে আছেন স্থির চোখে। পুষ্ট সুগঠিত বুক পর্যন্ত উঠে এসেছে আদিম জলাভূমি। মরে যাওয়া পশু পাখির মুখের হাড় ভেসে আছে মৃত্যুর মতো স্থির জলে। জলে সেই হাড় হয়ে যাওয়া মুখগুলোর ছায়া। পিছনে মেটে লাল আকাশ আর জল। কালো জল শান্তভাবে উঠে আসছে। জলের নীচে মেয়েটির প্রতিফলিত ছায়ামখ যেন পাশবিক, অন্ধকার মাখা হিংস্র। জলের ওপরে শান্ত নির্ভয় মুখটি যেন শান্তভাবে মানুষ আর পৃথিবীর অবসানকে নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করছে নিজের মধ্যে। জলের আয়নায় ওপরে ভেসে থাকা মুখটি জলের মুখকে নিজেরই অন্য এক মুখ হিসেবে দেখাতে সংকোচ করছে না। স্থির দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে যেন সে জানিয়ে দিচ্ছে আড়ালে থাকা সত্যগুলোকে।

ছবিটিতে ফিনির মৃত্যু বিষয়ে অনুভূত সত্য ধরা আছে। তেরো চোদ্দ বছর বয়সে জীবন ও মৃত্যু বিষয়ে শেষ ধাপ পর্যন্ত জেনে নেবার এক তীব্র আকুতি নিজের মধ্যে টের পেয়েছিলেন ফিনি। ত্রিয়েস্তে— যেখানে ফিনি থাকতেন সেখানকার নির্জন মর্গে একা আত্মস্থ ঘুরে বেড়াতেন সময় পেলেই। সময়ের সাথে এই আকর্যণ আচ্ছন্ন করে দেয় তাঁর জাগতিক সব অনুভূতি। মর্গের পিছনের একটা বড়ো হলঘরে সাধারণের জন্য যাত্রায় অনুমতি ছিল না। মর্গের প্রহরীর সাথে গল্প করতেন তিনি। প্রহরী একদিন সেই ঘরের কথা বলেন। ফিনিকে আর যখন খুশি সেখানে যাবার অনুমতিও দেয়। এরপর ফিনি তাঁর বেশির ভাগ সময় সেই অসংখ্য মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে একা ঘুরে বেড়াতেন। যেন গভীর ধ্যানে ডুবে থাকতেন সেই সময়টুকু। অজস্র নগ্ন মৃতদেহ, আয়োডিন টিংচারে যেন রং করা ছবির মতো। পায়ে নম্বর লেখা ট্যাগ ঝুলছে সবার। দূরে রাস্তায় সুন্দর পোশাকের ঝকঝকে মানুষজন আর কবরস্থানে সুন্দরভাবে ফুলে সাজানো মৃতদেহবাহী শকটের সাথে এই খোলা, গলা-পচা মৃতদেহগুলোর তুলনা করতেন। বাস্তব ও কৃত্রিমতাকে এভাবেই প্রথম চিনলেন তিনি নিজের মতো করে। তাঁর মনে হল সময়ের সাথে রূপ শেষ হয়, রক্ত মাংস মাটিতে মিশে যায়। কিন্তু হাড় থেকে যায় হাজার হাজার বছর। কঙ্কালের গঠন সুষমার মধ্যেই তিনি খুঁজে ফেলেন শাশ্বত অপরাপের। রক্তমাংসের শরীরের পাশে হাড়ের ছবি আঁকতেন ফিনি বাইরের পৃথিবী আর ভেতরের পৃথিবীর। নশ্বর ও ধ্রুবের বৈপরীত্য হিসেবে। সুররিয়ালিস্টদের সাথে যোগাযোগের অনেক আগেই ফিনি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবন ও মৃত্যু, ধ্বংস ও পুনরুজ্জীবনকে বুঝেছিলেন। তাঁর ছোটোবেলার এই কৌতূহল পরবর্তী সময়ে ম্যাসনের মতো আরও অনেক শিল্পীর ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। এক সমর্থন, এক অনুকূল পরিবেশ ফিনি পেয়েছিলেন সুররিয়ালিজমে। কিন্তু সুররিয়ালিজমের ধরাবাঁধা লক্ষ্য তাঁর সন্ধান ছিল না। ফিনির মতোই বেশিরভাগ নারী শিল্পী সুবরিয়ালিজমের বাহক মনে করেননি নিজেদের। ব্যক্তিগত অন্তর্বাস্তবতাই ছিল তাঁদের অন্বিষ্ট। দিগভ্রান্তির আঁধারে একটি জ্বলন্ত বন্ধু মোমবাতি— সুররিয়ালিজম তাঁদের কাছে ছিল এই।

স্কুল থেকে তাঁকে বহিষ্কার হতে হয়েছে মাঝে মাঝেই তাঁর অদম্য মনোভাবের জন্য। কিন্তু বুয়েনস আইরেসে জন্মানো স্প্যানিশ, ইতালীয়, আর্জেন্তিনীয় মিশ্র রক্ত ও মিশ্র ঐতিহ্যে পুষ্ট ফিনি মিলানে তাঁর কাকার বিশাল লাইব্রেরি পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন। নোভালিস, ফ্রয়েড এবং জার্মান রোমান্টিকদের লেখাপত্র নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা থাকার জন্য তাঁর মেধার কাছে নতুন দিগন্ত তুলে ধরার মতো আর কিছু ছিল না সুররিয়ালিজমের। এর মধ্যেই ত্রিয়েস্তে প্রতিকৃতি আঁকার কমিশনও পাচ্ছেন নিয়মিত। ইউরোপের প্রায় সব গ্যালারিও ঘুরে দেখা শেয। গ্রুপ 900 Italians-এর অনেক সদস্যই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যারা তাঁর ছবির সাথে তাঁর সম্মোহক রূপ ও উচ্ছল জীবনযাত্রায় সমানভাবে মুগ্ধ। স্বাভাবিকভাবেই ব্রের্তর ঝকঝকে আকর্ষক উপস্থিতি ও প্রভাবিত করার জাদুকরী ক্ষমতা তেমন স্পর্শ করল না ফিনিকে। ব্রের্তর একাধিপত্য অন্যান্য নারী শিল্পীরা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মেনে নিতে বাধ্য হলেও ফিনি ছিলেন শক্ত ধাতুতে গড়া। তিনি ব্রের্তর ব্যক্তি-বর্জিত সমবেত চর্চার তত্ত্বের তোয়াক্কাও করলেন না। লম্বা চেহারা, আকর্ষক মুখ, ঘন কালো চুলের প্রবাহ, বেড়ালের মতো বিস্ফারিত চোখ তাঁকে দূরত্ব ও সম্ভ্রম দিয়েছে সব জায়গায়। তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা আকর্ষণ নির্দ্বিধায় সরাসরি জানিয়ে দিতেন সবাইকে। ম্যাক্স এর্নস্ট-আকৃষ্ট হলেন প্রথমে। পল এলুয়ার তার ১৯৩৮ সালে বেরোনো কবিতার বই ‘Donner a voir’-এ একটি কবিতা উৎসর্গ করলেন তাঁকে। তাঁর উপস্থিতির জোরালো ধাক্কায় ব্রের্ত ও তাঁর স্ত্রী লম্বার সাথে রীতিমতো তর্ক হয় ফিনির। কারো নেতৃত্ব মেনে যৌথ সৃষ্টির মধ্যে তিনি তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। যৌনতা নিয়ে তাঁর অসীম কৌতূহলও তথাকথিত নীতিবাগিশ ব্রের্ত অনুমোদন করলেন না। ১৯৩৬ সালে পারীর এক প্রদর্শনীতে ফিনির ছবি দেখে একজন শিল্পী আগ্রহী হয়ে দেখা করতে চাইলেন। একটা নির্দিষ্ট কাফেতে যিনি দেখা করতে সম্মত হলেন। লাল রঙের যাজকের পোশাকে দেখা করতে গেলেন ফিনি। প্রশ্ন করা হলে ফিনি জানান যে, কার্ডিনালের এই পোশাকে মিথ্যার এক অসামান্যতা আছে। এই পোশাক ফিনি পরেন নারী শরীরের কোনো ধারণা তাদের থাকার কথা নয় এবং সামনের শিল্পীও যেন তাঁকে নারী বলে না ভাবেন। এই কঠিন বিদ্রূপ আরও শোনো কোনো শিল্পী পেয়ে থাকবেন। নিউইয়র্কের ছবির ব্যবসায়ী জুলিয়েন লেভি ১৯৩৭ সালে ইয়র্কে ফিনির আসন্ন প্রথম চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে আলোচনার জন্য এক রাতে ঠিকানা খুঁজে ফিনির অ্যাপার্টমেন্টে গেলেন। একটা পরিত্যক্ত ধ্বংস স্তূপের মতো অন্ধকার বাড়ি। আর কোথাও কেউ থাকে না সম্ভবত। তিনতলায় উঠে দরজায় টোকা দিতে ফিনি এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। কাঠের একটা কুচকুচে কালো মানুষ যৎসামান্য আলো নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। রীতিমতো অস্বস্তি নিয়ে একঝলক তিনি দেখলেন দরজায় নারীকে। নীল সিংহের কেশরের মতো নীল চুলের রাশ মুখ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাঁর চোখ ছিল মারাত্মক আকর্ষক। সারা শরীর যেন খাপছাড়াভাবে জোড়াতালি লাগানো। লেভির লেখা সেই বর্ণনা ছিল এরকম— ‘Head of a lioness, mind of a man, bust of a woman, torso of a child, grace of an angel and discourse of the devil…’ ব্যাপারটা লেভির কাছে ধাক্কা হিসেবে এলেও ফিনির উদ্দেশ্য তেমন ছিল না। আসলে এটাই ছিল তাঁর পৃথিবী। রক্তমাংস অতিক্রান্ত এক প্রাচীন জ্ঞান হিসেবে তিনি দেখাতেন শরীরকে। একজন জাদু-রসায়নবিদ যেভাবে তাঁর গন্ধক, জ্বলন্ত তরল ও দম আটকানো ধোঁয়ার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, রং ও ছবির মধ্যে সেভাবেই নিজের জীবন ঢেকে রেখেছিলেন ফিনি। ‘অনড় আর স্তব্ধ বলেই আমি ছবি এতো ভালবাসি।’ বলতেন এরকম। নাটকের দৃশ্যসজ্জার মতো যে-পৃথিবীকে বাইরে থেকে দেখা যায় আর ভেতরে নরকের অন্ধকার আদিম বিশৃঙ্খলার মাঝখানে নারী যেন তার সামাজিক অবস্থান ও সাধারণ প্রবৃত্তির জান্তবতার মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে। ১৯৩৯ সালে আঁকা ‘Ceremony’ ছবিতে দর্শক যেন একটি ঘটনার মাঝখানে হাজির হয়েছেন সহসা। আর যে-কোনো ছবির মতোই এই ছবিটিও দৃষ্টির সামনে একটি উপস্থাপনা বেশি কিছু নয়। কিন্তু তার বাইরেও অন্য কিছু যেন বলছে ছবিটি। দৃশ্যের কেন্দ্রে একটি নারীর অনাবৃত পিঠ। পাথরের একটা বেদির ওপর ডালপালা সমেত প্রাণবন্ত গাছের মুখোমুখি বসে সে ধর্মীয় কোনো আচারে ব্যস্ত। বেদির মাঝখানে একটা গর্তে অস্পষ্ট কিছু একটা রয়েছে যেন। সামনের দিকে মুখ করে একজন নারী দাঁড়িয়ে বসে থাকা মেয়েটির ব্যস্ততা উৎসুক চোখে দেখছে। বসে থাকা মেয়েটির নগ্ন অরক্ষিত বুকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির শক্ত বক্ষাবরণের সুরক্ষা যেন নারীর বাইরের চাপ ও ভেতরের অনিরাপত্তার নিঃশব্দ ভায্য। ভঙ্গিগুলি ধীর ও অর্থময়। রং শান্ত, সংহত। ফিনির নির্মাণকুশলতা ছবিটিতে দূরভিগম্যতা এনে দেয়। আখ্যাননির্ভরতা ও গাঢ় প্রতীকের বাইরে স্রেফ নিজের জোরে ছবিটি দাঁড়িয়ে থাকে।

একজন জাদু-রসায়নবিদ যেভাবে তাঁর গন্ধক, জ্বলন্ত তরল ও দম আটকানো ধোঁয়ার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, রং ও ছবির মধ্যে সেভাবেই নিজের জীবন ঢেকে রেখেছিলেন ফিনি।

যিনি কখনও এমন ছবি আঁকেননি যেখানে নারীদের মনে হয় আত্মশক্তিহীন, পুরুষদের অধীন এবং বিনীত। এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান ও অঙ্গীকার ছিল স্পষ্ট। ব্রের্ত এবং তার গোড়া পরাবাস্তববাদে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। ঘোষিতভাবে তিনি নামও লেখাননি তাঁদের দলে। কিন্তু পরাবাস্তববাদের কয়েকটি স্তম্ভ ধারণা— যেমন আপাত বিরুদ্ধ বস্তুদের জুড়ে দেওয়া, অবচেতনকে তুলে ধরা এবং প্রাচীনের পুনরুদ্ধার— ফিনি মেনে চলতেন। ১৯৪৭ সালে আঁকা ‘Chthonian Divinity watching over the sleep of a young man’ ছবিতে একটি নারী স্ফিংক্সের সজাগ, অপেক্ষারত চোখ যেন রাত্রি, জল ও পৃথিবীর প্রতিনিধি হয়ে উঠছে একটি নগ্ন ঘুমন্ত পুরুষের দিকে তাকিয়ে। প্রকৃতি অপেক্ষা করছে পুরুষের জেগে ওঠার। নগ্ন পুরুষটি যেন ধ্রুপদী রীতিতে আঁকা শায়িত নগ্ন নারীর মতো সুষমাময়। কিন্তু পুরুষটির শরীরের অ্যাসিড-ম্লান রং আর রাত্রির অশুভ আভা বিপর্যয়ের দমচাপা বার্তা বহন করছে।

স্ফিংক্স— এই মিশ্র প্রাণী ফিনির ছবিতে বারবার এসেছে চিন্তামগ্ন মুখে। একটি নিজস্ব নিভৃত উৎস আছে এর। শৈশবে ত্রিয়েস্তের, পার্কে অনেক রকম জীবজন্তু ছিল পাথরের। তার অদ্ভুত চেহারার জন্য স্ফিংক্স-এর মূর্তি আকৃষ্ট করত তাঁকে। স্ফিংক্সের পিঠে চড়ে খেলতে খেলতে নিজেকেও স্ফিংক্স কল্পনা করতে শুরু করেন। এবং সেই ধারণাটি তাঁর অবচেতনে ধরা থাকে পরবর্তী সময়েও। সভ্যতা মানুষের অন্তর্গত জান্তব গুণগুলি কেড়ে নিয়েছে। তার দেখা ও শোনার ক্ষমতা বিলুপ্ত প্রায়। সব শক্তি অন্তর্হিত। আদিমতা থেকে সরে এসে নিজের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে সে। এক বিস্মরণের, ঘুমে সে ডুবে আছে, যে ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রাণীদের সহজাত জাদুশক্তি এবং ইয়ুং কথিত অ্যানিমাসকে অস্বীকার করে সে ভুলে যাচ্ছে তার আগের পশুজীবন আর এই সময়ের সমাজ-জীবনকে। ছবিটি সম্পর্কে ফিনি এক জায়গায় বলেছেন— ‘the man in my painting sleeps because he refuses the animas role of the social and constructed, and has projected the responsibility of working in society toward those ends.’

জান্তব অস্তিত্ব ও সভ্যতা— এই দুই মেরুর মধ্যে ঘোরাফেরা করে ফিনির স্ফিংকস। এই দুই পৃথিবী জুড়ে তার বিচরণ। মৃত্যু, পচনশীলতা ও পুনর্জীবন-প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর করুণা ও স্যাতসেতে গন্ধের (ফিনির বন্ধু জাঁ জেনে যেমন বলেছিলেন ‘cruel kindness’ আর ‘swampy odors’) বৈপরীত্য ধরে রাখে ফিনির স্ফিংক্স।

চিত্র: লিওনারা ক্যারিংটন

একজন নিষ্প্রভ চিন্তাচ্ছন্ন নারী নতুন কোনো মুখের খোঁজে অনেক বাক্সে ঠাসা একটা জায়গায় এসেছেন। তাঁর আশা প্রত্যেক বাক্সে নতুন মুখ থাকবে। একটি খোলা বাক্স সামনে। তিনিই খুলেছেন সেটা। এবং দেখছেন তাঁর নিজেরই মুখ সেই বাক্সে রাখা। শূন্য দৃষ্টিতে সেই নারী তাকিয়ে আছেন। অন্য বাক্স আর খুলতে চাইছেন। কেননা তিনি বুঝেছেন অন্য সব বাক্সেও একই জিনিস দেখবেন। পরিবর্তন কোথাও নেই। নতুনের সন্ধান এখানে পণ্ডশ্রম। প্রাচীন জ্ঞানের মধ্যেই খুঁজতে হবে নতুনকে। বাক্সগুলো একইরকম। কিন্তু না খুললে এই বিপুল রহস্যকে ধরা যাবে না। দু’রকম ভাবনার সংকেত থেকে খুঁজে নিতে হবে রাস্তা। শিল্পী এই ছবির নাম দিয়েছেন ‘Encounter’.

আরেকটি ছবি ‘Tower’-এ পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা টাওয়ার এর ছাদে চারটে বড়ো পাখাওয়ালা একটি উইন্ডমিলের শূন্যে ভাসমান পা রাখার ছোট্ট একটা পিড়ির ওপর কোনোক্রমে টাল সামলে একটি মেয়ে অনেক দূরের কিছু একটা উৎসুক কৌতূহলে দেখছে। টাওয়ারের দু’পাশ দিয়ে দুটো রাস্তা একেবেঁকে চলে গেছে দিগন্তরেখায়। সেই রাস্তাই সিঁড়িতে সম্প্রসারিত হয়ে টাওয়ারের চূড়ায় উঠে এসেছে। অনেক দূরে রাস্তায় তিন চাকার একটা হালকা ফ্রেমে একইরকম ঔৎসুকে হাত তুলে টাওয়ারের দিকে আসছে আরেকটি নারী। এঁদের মধ্যে কেউ একজন ভারো। অন্যজন ক্যারিংটন।

চিত্র: রেমেদিওস ভারো

রেমেদিওস ভারো সরাসরি কোনো আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেননি। ভারোর বাবা ছিলেন হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার। যাঁর সাথে শৈশবে তিনি স্পেন এবং আফ্রিকায় বিস্তৃত ঘুরে বেড়াতেন সময় পেলেই। গণিত এবং নানারকমের গাড়ি তাঁকে আকৃষ্ট করত। করিংটন এবং ভারোর বন্ধুত্ব হয়েছিল ফ্রান্সে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ফ্রান্স ছেড়ে মেক্সিকোয় আশ্রয় নেন দু’জনেই আর একধরনের সজীব, পারস্পরিক নির্ভরতা ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে ডুবে যান পরস্পরের মধ্যে। ক্যারিংটন তখন ছবির জগৎ থেকে কিছুটা দূরে নিজের লেখায় মগ্ন। ভারো থমকে গেছেন গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থানের চেষ্টায়। কিন্তু ভারোর সাথে যোগাযোগ নিবিড় হবার পর তাঁরা এক যৌথ দুঃসাধ্য অভিযাত্রা শুরু করলেন তাঁদের সৃষ্টিকে সম্পূর্ণ নতুন আর গভীর এক দার্শনিক উপলব্ধির বাহন করে নিতে। তাঁরা নিজেদের স্বপ্ন, জীবনের সবটুকু গল্প, জাদু ও অলৌকিকে তীব্র টান— সব বিনিময় করতেন নিজেদের মধ্যে। ছবি তাঁদের কাছে হয়ে উঠল এক দিব্যতাময় দৃষ্টি, তাঁদের নিজেদের গভীর অভ্যন্তরে জ্বলন্ত মশাল হয়ে নেমে নিজেরই পথ খুঁজে নেওয়া। সেই পথ পার্থিব, অতীন্দ্রিয় আর আধ্যাত্মিক। যেখানে বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে দুর্নিরীক্ষ্য আত্মিক পরিত্রাণের খোঁজ করতে হয় শূন্যে ভাসতে ভাসতে। জর্জ ইভানোভিচ গুর্দিহয়েফ (১৮৭৭-১৯৪৯) ছিলেন একজন রুশ ধর্মপ্রচারক। ভারো তাঁর আদর্শে আকৃষ্ট হন। প্রাচ্য দর্শন বৌদ্ধতন্ত্র ও সুফিবাদেও আকর্ষণ ছিল তাঁর। ভারোর ছবিতে এ সবের তীব্র প্রতিচ্ছায়া আছে। হোলি গ্রেল এবং সমস্ত গ্রেল সাহিত্যও এক গোপন রহস্যময় আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের কথা বলে! সেই অনুসন্ধানের প্রতিধ্বনিই যেন ১৯৬০ সালে আঁকা ভারোর ছবি ‘Born Again’-এ। প্রাচীন ভগ্নস্তূপের মতো একটা ঘরে দেয়াল দরজা আসবাবের ওপর ছড়িয়ে যাচ্ছে শিকড়। ছাদ ভেঙে গেছে। দেখা যাচ্ছে রাতের অন্ধকার আকাশ আর আধখানা চাঁদ। ঘরটি যেন কাঠের তৈরি কোনো অজানা গুপ্তকক্ষ। দীর্ঘদিন এর সন্ধান করেনি কেউ। একদিকের পলকা পার্টিশন ভেঙে একজন খোলা চুল আর পূর্ণ বক্ষের নারী হঠাৎ যেন সেই ঘরের মধ্যে এসে পড়েছ, এমন অতর্কিত বিঘ্নিত দৃষ্টি তার চোখে। মেয়েটির পোশাকও যেন এই ঘরটির পার্টিসনের মতো খুলে পড়ছে তার শরীর থেকে। এই ঘরটিতে যেমন রহস্যময় পর্দার মতো দেয়াল ভেঙে প্রকাশ করছে মেয়েটি একইসাথে সে নিজেও যেন তার অজ্ঞানতায় পোশাক ছিঁড়ে নিজেকে প্রকাশ করে দিচ্ছে এই রহস্যময় ঘরটির কাছে। নানারকমের সিঁড়ি নেমে গেছে নানা দিকে। তারই এক কোণে একটা শিকড়ের গ্রাসে বন্দী টেবিলে রাখা ধর্মীয় পানপাত্র ‘চালিস’। তার ভেতরে রাখা তরলে (যা খ্রিস্টের রক্ত) ছায়া পড়েছে অনেক দূরের আকাশের চাঁদের। মেয়েটি সবিস্ময়ে দেখছে সেই প্রতিফলন। তার দ্বিধাগ্রস্ত ডানহাত যেন তার অজান্তেই ছুঁতে চাইছে সেই পাত্রটি।

অ্যালকেমি বা অপরসায়ণ আকৃষ্ট করত ভারোকে। ১৯৫৮ সালে আঁকা ‘The Creation of the Birds’ ছবিতে জ্ঞানী প্যাঁচার মুখোশ পরে শিল্পী ছোট্ট টেবিলে বসে কাজ করছেন। বাঁ হাতে মাগনিফাইং গ্লাস ধরা। জানলা দিয়ে রাতের আকাশের সুদূর একটি তারা থেকে আলো পড়ছে সেই গ্লাসে। কাচের ভেতর দিয়ে এসে সেই আলো বদলে যাচ্ছে রঙিন একটা পাখিতে। ডান হাতে ধরা তুলি। তুলিটি সরু তারে শিল্পীর হৃদপিণ্ডের জায়গায় রাখা ছোট্ট একটি বেহালার সাথে জুড়ে থেকে ভেতর দিয়ে সুরের স্পন্দন পাখিটিকে পৌঁছে দিচ্ছে। পাখিটির লেজের অংশ তুলি দিয়ে আঁকছেন শিল্পী। পাখিটি এর মধ্যেই উড়তে চেষ্টা করছে যেন। অন্য একটি পাখি টেবিলের কাছে উড়ছে।

প্যাঁচার মুখোশ পরা এই শিল্পী ভারো নিজেই। যেমন ‘Born Again’ ছবির নারীটির অনুসন্ধান ভারোর নিজের। ভারো বিশ্বাস করতেন নারীরা জ্ঞানের প্রতীক এবং অপরসায়ণ ও অলৌকিকের অনুভূতি সম্পন্ন। সুফী দর্শন, প্রাচ্য আধ্যাত্মবাদ, বৌদ্ধ তান্ত্রিকতার প্রভাবে তাঁর অন্তর্গত জীবন বদলে গিয়েছিল পুরোপুরি। গুর্দিইয়েফ সুরের মধ্যে মহান জগৎ অনুভব করতেন। ভারোর ছবিতেও শিল্পীর তুলিতে ঝংকার তুলছে। বেহালার সাথে বেঁধে রাখা তার।

ফলের বাজারে ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি দেখেছিলেন ডিমের আকৃতির ফলে ভরা কোনো চারাগাছ। কিনে নিয়ে আসেন সেই গাছ। জানলার ওপর চাঁদের আলোয় তাকে রেখে চারপাশে তিনি বিছিয়ে রাখলেন তাঁর ব্রাশ আর রঙের টিউব। দেখতে দেখতে এক ঘোরের জগতে চলে গেলেন তিনি এবং অনুভব করলেন চাঁদের আলো, নক্ষত্র, এই ফুল, এই রং তুলি এক অশ্রুত ঐকতানে বেজে উঠছে আর সৃষ্টির আগের শান্তিতে ফিরে যাচ্ছে পৃথিবী।

প্রতিধ্বনি যেভাবে ধ্বনিকে খোঁজে সেভাবেই ফ্রিডা খুঁজেছিলেন শরীরকে। তাঁর স্ব-চিত্রগুলির পরতে পরতে ঝরনার জলের নীচে অভ্রের ছুরির মতো ঝকঝক করে ওঠে তাঁর নিজের শরীর ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত যন্ত্রণাদীর্ণ রক্তমাংসের স্তব্ধ স্থির হিমস্রোত— তার ফেটিশ, তার পৃথিবী। নিজর শরীর যে ফেটিশ বা পবিত্র প্রতীক হয়ে ওঠে তাঁর কাছে— সঙ্গত কারণ আছে তার। অসম্ভব অজাগতিক বিশাল এক জীবনব্যাপী যন্ত্রণার উৎস তাঁর রক্তমাংস। ১৯১৩ সালে, ফ্রিডা কাহলো, পিতা জার্মান আর মা ভারতীয় মেক্সিকান, ছ’বছর বয়স তখন, পোলিওয় সরু হয়ে গেল ডান পা, বেঁকে গেল পায়ের পাতা। খুঁতটুকু ঢাকা দিতে ছেলেদের মতো ট্রাউজার পরা শুরু করলেন, আর একটু বড়ো হয়ে পা ঢাকা মেক্সিকান পোশাক। যখন মেক্সিকো সিটিতে জর্মন কলেজের ছাত্রী, ফ্রিডা হয়ে উঠলেন এক দুর্দান্ত টমবয়। বিদ্রোহী এবং অদম্য ছেলেদের দলের নেত্রী। অধ্যাপকদের নিয়ে রগড় করা হয়ে উঠল কলেজের প্রধান কাজ। বিখ্যাত মেক্সিক্যান মিউরালিস্ট দিয়েগো রিভেরা, যাঁকে ভবিষ্যতে বিয়ে করবেন ফ্রিডা, তার সাথে এখানেই দেখা হয়েছিল ফ্রিডার।

১৯২৫ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঈশ্বর নির্বাচিত করলেন ফ্রিডাকে চিত্রশিল্পী (মূলত আত্মপ্রতিকৃতির) হিসাবে। বৃষ্টির দিনে মেক্সিকো সিটির থেকে কোরোকান যাওয়ার পথে সাথে ছেলে বন্ধু আলেজান্দ্রো গোমেজ— দ্রুতগামী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা খেল বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা ইলেকট্রিক ট্রলির সাথে। চিৎকার কান্না রক্তস্রোত। একটা মোটা লোহার পাত ফ্রিডার শিরদাঁড়া চূর্ণ করে, তলপেট জনন অঙ্গ ছিন্ন ভিন্ন করে বেরিয়ে এসেছে রক্ত ক্লেদ মাংস মাখামাখি হয়ে। পরে দেখা গেল এ ছাড়াও ফ্রিডার কাঁধ, পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছে। এগারো টুকরো হয়ে গেছে ডানপায়ের হাড়, পায়ের পাতা ভেঙে দুমড়ে গেছে। ঈশ্বরের নির্বাচন প্রাথমিকভাবে শেষ হল। ক্রুশ কাঠের মতোই এক যন্ত্রণাময় শক্ত ফ্রেমে তিনমাস আটকে থাকলেন ফ্রিডা। অসাধারণ মনের জোরে বেঁচে উঠলেন, হাঁটা চলার শক্তিও অল্প অল্প ফিরে এল। প্রায় অলৌকিক যেন তাঁর এই ভস্ম থেকে ফের পাখির শরীর নিয়ে উড়ে আসা। কিন্তু তীব্র সর্বাত্মক, দুমড়ে মুচড়ে পাগল করে দেওয়া যন্ত্রণা, ক্লান্তি, দুর্বলতা সারাজীবন আর মুক্তি দিল না তাঁকে। পরের ঊনত্রিশ বছরে বত্রিশবার। অপারেশন সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে যার বেশিরভাগই মেরুদণ্ডে, পেলভিসে আর ডান পায়ে। প্রতিটি অপারেশন ব্যর্থ। সাতচল্লিশ বছরের জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময় তাঁকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে রক্তস্রোত ঝরিয়ে যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন বেহুঁশ হয়ে কাটাতে হয়েছে। যন্ত্রণাকে ভুলতে ডুবে থেকেছেন মেক্সিকান মদ টাকিলা, নানা ধরনের মাদক আর সিগারেটে। কোনো বন্ধু নেই, সঙ্গী নেই। মাকে বারবার আঁতুর ঘরে যেতে হয়েছে। ছোটোবেলা নার্সের হাতে বেড়ে ওঠা। মায়ের প্রতি কোনো অনুভূতি নেই। বাবা ব্যস্ত তাঁর কাজের পৃথিবীতে। এক অদ্ভুত কাজ করল মেয়েটি। নিজের অস্তিত্বকে দ্বিখণ্ডিত করে সৃজন করল কাল্পনিক। একটি বন্ধু। নিজের যন্ত্রণা, হতাশা, অবরুদ্ধ স্বপ্ন ও বাসনার জগৎ খুলে দিল তাঁর কাছে। ছেলেবেলার স্নেহহীনতাকে ভুলতে পারেনি মেয়েটি। সেই বঞ্চনা রাগ বর্ণনা করেছে ‘My Nurse and I’ ছবিতে যেখানে FACS767 637 Gh12163163 ‘with the face of a grown woman and the body of a little girl, in the arms of my nurse, milk dripping from her breast.’ (placas TERTE*t balloallotis 1677) জায়গায় প্রি-কলাম্বিয়ান টিওটিহায়াকান মুখোশ— যেখানে মিশে যায় ম্যাডোনা ও শিশুর বাইবেলীয় অনুষঙ্গের সাথে আদিম মাতৃকা রূপ। যৌনতা, মাতৃত্ব ও মৃত্যু একাকার হয়ে যায় এখানে।

হাসপাতালের বিছানায় সাদা চাদর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। বিছানায় শুয়ে এক যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠা নগ্ন নারী। স্ফীত পেটে হাত রাখা। হাতে ধরা পাঁচটি রক্তবাহী শিরার শেষ প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাঁধা একটি সদ্যোজাত শিশু, একটি শামুক, মানুষের কোমরের হাড়, একটি তালা, একটি ছিন্ন ফুল। অনেক দূরে শহরের আকাশরেখা। ‘হেনরি ফোর্ড হাসপাতাল’ নামের এই ছবিটি ফ্রিডা কাহলোর আঁকা। ছবিটির নগ্ন নারী তিনি নিজে। তাঁর নিরুপায় গর্ভপাতের মুহূর্তটি ধরা আছে এখানে। সেই যন্ত্রণা ও হাহাকারে দীর্ণ মুহূর্তে তিনি দেখছেন ক্ষমা প্রার্থনার ধরনে হাত জোড় করে থাকা একটি শিশুকে জন্ম হল না যার। তালাটি যেন তাঁর পূর্ণ নারীত্বের জগতে প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ করে আছে। দুর্ঘটনায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া যে কোমরের জন্য তার গর্ভধারণ বারবার ব্যর্থ হয়ে যায়— ছবিটিতে এসেছে সেই পেলভি। এসেছে শামুক আর ছিন্ন ফুল তার জনন-ব্যর্থ স্ত্রী-অঙ্গের প্রতীকে। ‘My painting carries within the message of pain… painting completed by life. I lost three children. Painting substituted for all this.’ দিনলিপিতে লিখেছিলেন ফ্রিডা। মাতৃত্ব ও শিল্পের সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে যখন তিনি দ্বিধায়, তখনকার একটি লিথোগ্রাফে দেখা যায় তার দু’পাশে একটি প্রাণ ও একটি প্যালেট। সিদ্ধান্তহীন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি মাঝখানে।

শরীরের ভঙ্গুরতা, সীমাবদ্ধতা ও যন্ত্রণা তিনি মানতে পারেননি। সৃষ্টির সাথে জড়িয়ে থাকা তীব্র ব্যথাকে উন্মাদের মতো প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এই যন্ত্রণায় তো কোনো আড়াল থাকে না। ১৯৩২ সালে যখন তাঁর সন্তানের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল ফ্রিডা আঁকলেন এমন ছবি যা তাঁর ছবির আগে আর আঁকা হয়নি কখনও। ছবিটির নাম ‘My birth’ একদম মুখোমুখি ক্লোজ-আপ নেওয়া একটি স্ফীত স্ত্রী-অঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তস্নাত শিশু-ফ্রিডার মাথা। নিষ্প্রাণ। জন্মদাত্রীর মুখ সাদা কাপড়ে ঢাকা। বিছানার একটু ওপরে ম্যাডোনার ছুরিবিদ্ধ যন্ত্রণাময় মুখ। স্তব্ধ মৃত দু’টি প্রাণ। কিন্তু গোটা ছবিটি ফ্রিডার চিৎকারে কান্নায় খানখান হয়ে যাচ্ছে যেন। একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার। ফ্রিডার চেতনা জড়িয়ে ছিল খ্রিস্ট সন্ত ও শহীদদের ছবি যার মেক্সিকান নাম রিট্যাবলো। কিন্তু ফ্রিডার এই ছবিগুলি রিট্যাবলো থেকে যোজন-দূরত্বে দাঁড়িয়ে। এই ফ্রিডার শরীরে উর্বরতা আছে, মাতৃত্বের তৃষ্ণা আছে, রক্তপাত আছে, কিন্তু জন্মদানের ক্ষমতা নেই। মেক্সিকান লোকগাথায় ‘লোরোনা’ অশুভ নারীর আর্কিটাইপ। আগ্রাসী যৌনতা নিয়ে মাতৃত্ব ও প্রেমের বিরুদ্ধে যে হিংস্র দাঁড়িয়ে। প্রেমিকের প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণায় যে শিশুহত্যা করে চলে। ফ্রিডার ছবিতে নানাভাবে ফিরে এসেছে এই লোরোনা। সারাজীবন ফ্রিডা এঁকে গেছেন তাঁর নিজস্ব এই পৃথিবী। বাস্তবতাকে তিনি আরও বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। শরীরের অপূর্ণতা, ব্যর্থতা আর যন্ত্রণা তাঁর জীবনের কেন্দ্রে ছিল। তাঁর ছবির কেন্দ্রেও তিনি রেখেছেন তাঁর সেই শরীর। উর্বর শরীর আর তীব্র যৌনতার মধ্যে কোথাও মৃত্যুর মতো এক অনুভূতি আছে বিশ্বাস করতেন ফ্রিডা। তাঁর ‘Dream’ ছবিতে ঘুমন্ত ফ্রিডা, চাদরে ও লতাপাতায় শরীর জড়ানো, ঘুমের উষ্ণতা ও আমেজ তার মুখে। খাটের ছত্রি-র ওপরে আরেকটি বিছানায় সারা শরীর বিস্ফোরক দিয়ে জড়িয়ে, একটি কঙ্কাল শায়িত যার বুকের কাছে ল্যাভেন্ডারের গুচ্ছ। যে-কোনো নারী চিত্রশিল্পীর সাথে পুরুষ শিল্পীর দেখার চোখ আলাদা। প্রজনন, পুরুষের আঁকা ছবিতে, আসে শরীরের প্রতীকে। কিন্তু নারীর প্রজনন ভাষা খুঁজে পায় গাছপালা, বৃষ্টি, পৃথিবীর ঋতুচক্র, আকাশের রং এবং এমনকী মৃত্যুর মধ্যেও। কর্ম ও রঙের সংগতি ও সুরমূর্ছনা, জীবন এর ভেতর দিয়েই চলতে থাকে— বিশ্বাস করতেন ফ্রিডা। জ্ঞান, ধ্বংস, প্রতীক, সতর্কীকরণ, মারী, ক্ষত, পবিত্র ও নোংরা, আক্ষেপ ও কলুষ থেকেই অগ্নিদগ্ধ পাখির মতো উঠে এসেছেন ফ্রিডা। নিজের শরীর থেকেই জীবনকে জেনেছেন। তাঁকে পরাবাস্তববাদীর তকমা লাগানো হলে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ‘They thought I was a surrealist, but I wasn’t. I never painted dreams. I painted my reality.’

একদম মুখোমুখি ক্লোজ-আপ নেওয়া একটি স্ফীত স্ত্রী-অঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তস্নাত শিশু-ফ্রিডার মাথা। নিষ্প্রাণ। জন্মদাত্রীর মুখ সাদা কাপড়ে ঢাকা। বিছানার একটু ওপরে ম্যাডোনার ছুরিবিদ্ধ যন্ত্রণাময় মুখ। স্তব্ধ মৃত দু’টি প্রাণ।

কেমন সেই রিয়ালিটি? সেই বাস দুর্ঘটনার পর লোহার বিছানায় অজস্র পেরেক লাগানো ফ্রেমে সম্পূর্ণ অনড় পড়ে থাকেন তিনি ছ’মাস এবং তার টের পান শুয়ে শুয়ে আয়নার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত জীবন দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারবেন না তিনি। সারা ঘরের দেয়াল ও সিলিং আয়নায় মুড়ে দিলেন। বাইরের পৃথিবী এইভাবে ধরা পড়লো। আর অনেক বেশি ধরা পড়লো আয়নায় নানা কোণ থেকে তাঁর ঝাপিয়ে পড়া শরীর। তার চেতনা ও চিন্তার কেন্দ্রে এল তাঁর নিজের শরীর।

চিত্র: ফ্রিদা কাহলো

নিজের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শরীর হয়ে উঠল তাঁর জীবন দেখার, জীবনকে অনুভব করার চোখ। অগণন আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন সারাজীবন। আত্মপ্রতিকৃতিই ছিল তাঁর আত্মার চিকিৎসা ও আরোগ্যের পথ। নিজের শরীরকে কোনো মোহ নিয়ে দেখেননি, দেখাননি। লাবণ্য ও আবেদন তাঁর লক্ষ্য নয়। আবার কোনো অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তাও তাঁর শরীরের উদ্দেশ্য ছিল না। শরীর তাঁর ছবিতে এসেছে ‘ফেটিশ’ হয়ে, এক বস্তুকাম বা অস্বাভাবিক অনুরক্তির বিষয় হয়ে, যেখানে শরীর এমন এক বস্তু (thing) হয়ে ওঠে যা মূর্তিহীন, যা থেকে উপচে পড়ে আমাদের প্রত্যেকের অনুভূতি ও জীবন। তাঁর ‘Broken Column’ ছবিতে নগ্ন ফ্রিডা দাঁড়িয়ে। তাঁর শরীরে লোহার মেরুদণ্ড। কোমরের কাছে সাদা এক টুকরো কাপড়। সারা শরীরে অজস্র পেরেক। মনে পড়তেই পারে খ্রিস্টের কথা, আইকনের কথা। কিন্তু ক্রুশবিদ্ধ খ্রিস্টর মুখে যে-দিব্যতা, ফ্রিডার মুখে তা নেই। তাঁর মুখের রেখায় যন্ত্রণা, চোখে জল। সারা জীবন যত ছবি এঁকেছেন তিনি তাঁর এক-তৃতীয়াংশই আত্মপ্রতিকৃতি। ‘Tree of Hope’ ছবিতে স্ট্রেচারে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে আছেন ফ্রিডা, পিঠে দীর্ঘ ক্ষত, যেন ডানা দু’টি কেটে ফেলা হয়েছে। আরেকজন ফ্রিডা ক্যামেরার সামনে বসে আছেন যেন মেক্সিকান রঙিন পোশাকে। সারা শরীরে নানারকম চিকিৎসা সংক্রান্ত নল লাগানো। হাতে ধরা ক্রাচ ও একটি ব্যানার। শায়িত মৃত একটি শরীর থেকে যেন পুনরুজ্জীবন পেয়ে গেছে আর একটি শরীর। এটি হল একরকম দেখা। কিন্তু পিছনের পটভূমির সাথে মিলিয়ে দেখলে অন্য একটি দৃষ্টিকোণ চলে আসে। ছবিটির পটভূমিতে আছে রিক্ত, প্রখর সূর্যতাপে ফেটে যাওয়া, একটি মাঠ। দিগন্ত রেখার ওপরে মেঘাচ্ছন্ন দু’রকমের আকাশে একই সাথে সূর্য ও চাঁদ। মেক্সিকোর মাটি চৌচির। সেই মাটির মতোই, ফ্রিডাও ছিন্নভিন্ন ও রক্তাক্ত। স্ট্রেচারে শুয়ে। ছবির যে-অংশে চাঁদ সেখানে লাল রিবনের ফুল চুলে বেঁধে বসে আছেন দ্বিতীয় ফ্রিডা।

আর একটি ছবি ‘The Two Friends’. ১৯৩৯ সাল। কুড়ি বছরের বড়ো বিখ্যাত মুরালিস্ট স্বামী দিয়েগো রিভেরার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হতে চলেছে ফ্রিডার। নিঃসঙ্গ যন্ত্রণায় আঁকলেন দু’জন ফ্রিডা বসে আছেন পাশাপাশি, হাত ধরে। পোশাকের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে দু’টি হৃদপিণ্ড একটি ধমনী দিয়ে জোড়া। শরীর থেকে রক্তবাহী নল বেরিয়ে এসে একজনের সাদা টেবুয়ানা স্কার্ট রক্তে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফ্রিডার হাতে ফরসেপ। রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। ছবির ফ্রিডা হাতের ফরসেপে রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করলেও রক্তমাংসের ফ্রিডা জীবনে কখনও সেই চেষ্টা করেননি। তেত্রিশ বার অপারেশন হয়েছে তাঁর শরীরে। অস্তিত্বের আরও গভীরে যে-রক্তপাত তা আমাদের ধারণারও পরপারে। রক্ত বুঝতেন ফ্রিডা। জানতেন যে, একবার শিরামুখটি খুঁজে পেলে আর কোনো পরিশ্রম নেই, দায়িত্ব নেই, সংকোচ নেই। রক্ত নিজেই সব কিছু থেকে মুক্তি দিয়ে যায়। ভেতরে কিছু খুলে যায়। যা খুশি করার বাধা নেই তখন আর। এই রক্তে থাকি আমিই। তবু ওই রক্তে আমি নেই যেন। কোথাও নেই কিছুতেই। ‘I live some place else now’ একটি অমোঘ সত্য, নারী শিল্পীদের জন্য। দর্পণের প্রতিফলিত ছবির মতো তাঁদের জীবন। যেখানে তাঁরা আছে বলে মনে হয়, সেখানে তাঁরা নেই আসলে। অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত এই দর্পণতাকে ফ্রিডা ছবিতে ধরেছেন তারই একাধিক মুখকে ছবিতে এনে। ‘Two Nudes in a Forest’ উজ্জ্বল জীবন্ত গাছপাতায় আর নরম ঘাসের মাটির ওপর নগ্ন ফ্রিডা বিষণ্ণ ও পরাভূত— কালো এবং নগ্ন আরেক ফ্রিডার কোলে মাথা রেখে শুয়ে। তার বাঁ উরুর ওপর কালো রঙের ফ্রিডার পা। মাটির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া শিকড় মাটির ওপর থেকে দৃশ্যমান। কালো ফ্রিডা যেন প্রকৃতি ও প্রজননের মুখ যাঁর কোলে প্রজনন-শক্তিহীন ব্যর্থ ফ্রিডা শায়িত। এরকমই আরেকটি ছবি ‘Roots’. ফুটিফাটা মাঠে শায়িত ফ্রিডার শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে শিকড়ের মতো মোটা শিরাগুলি। শিকড়ের বা শিরাগুলির প্রান্তে জীবন্ত সবুজ পাতারা ফুটে উঠেছে। নিজের অনুর্বর রক্তে উর্বরতা ফিরিয়ে দিচ্ছেন ফ্রিডা মাটিকে। এখানে মাটিই হয়ে উঠেছে রিক্ত ছিন্নভিন্ন ফ্রিডার দ্বিতীয় মুখ।

যে-আয়নার কথা একটু আগে বলছিলাম আমরা সেই আয়না অসহায়ভাবে যা তুলে ধরে তা ফ্রিডার অস্তিত্বের দুলে যাওয়া পেণ্ডুলামের দু’টি প্রান্ত। তাঁর বাইরের ভিতরের বাস্তবতা, তার দৃশ্যমানতা ও দর্শক সত্তা, তাঁর বহিরঙ্গ ও বাস্তবের দুই মেরু যেন এসে আশ্রয় খুঁজে পায় তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিগুলিতে। কৃত্রিমতা ও অনর্গল প্রবণতার মেলবন্ধন ঘটে সেখানে।

ফ্রিডার জীবনে পরস্পর বিরুদ্ধ দু’টি স্রোতের উপস্থিতি সবসময়ই। বাবা মায়ের সূত্রে তাঁর রক্তে ইউরোপ ও মেক্সিকোর রক্ত, সংস্কৃতি, প্রাচীন ও আধুনিকতা, সুস্থতা ও অসুস্থতা, উভযৌনতা নারী ও পুরুষদের সাথে— এই দ্বৈত থেকেই উঠে এসেছিল তাঁর ছবি ‘My Grandparents’, ‘My Parents and I’ (১৯৩৬)। শৈশবে যে কোবাল্ট-নীল বাড়িটিতে তিনি ছিলেন, ছবিটিতে দেখা যায় সেই বাড়ির চত্বরে ফ্রিডা, নগ্ন, লাল রিবন্ হাতে দাঁড়িয়ে। এই ছবির পেছনে তাঁর বাবা মাকে জড়িয়ে পৌঁছে গেছে দুই প্রান্তে সস্ত্রীক পিতামহ ও মাতামহদের কাছে। ফ্রিন্ডার নাভির সাথে ছবির ওপরে মায়ের গর্ভের নাড়ির যোগসূত্রের হালকা একটা প্রতিধ্বনি আছে ছবিটিতে। আবার তাঁর কুড়ি বছরের বড়ো বিখ্যাত মিউরালিস্ট স্বামী দিয়েগো রিভেরার সাথে সম্পর্ক ভেঙে যাবার পর ‘The Two Frindas’ আত্মপ্রতিকৃতিতে দেখা যায় ফ্রিডার দু’টি সত্তাকে— আংশিক ইউরোপীয় ও আংশিক মেক্সিকান, রক্তাক্ত হৃদয়ের বিশ্বস্ত স্ত্রী আর স্বাধীন স্বাবলম্বী নারী, ঐতিহ্যময় মেক্সিকান পোশাকে। যতদিন তিনি দিয়েগোর স্ত্রী ছিলেন তাঁর শিল্পচর্চাকে হালকা সৌখিনতা বলেই ধরে নেয়া হতো। কাহলো যখন টের পেলেন এটা, তিনি নিজের শিল্পী সত্তাকে সরিয়ে, দাম্পত্য জীবনের দায়িত্বে ডুবিয়ে দিলেন নিজেকে। যদিও ফ্রিডা ও দিয়েগো দু’জনেই বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন, তবু ওঁদের সম্পর্ক ছিল তীব্র নির্ভরতা, পারস্পরিক পুষ্টি, আর ভালোবাসার— যার প্রমাণ ফ্রিডার ডায়েরি যেখানে অসংখ্যবার ফিরে ফিরে এঁকেছেন দিয়েগোর মুখি, লিখেছেন

Diego          beginning

Diego          builder

Diego          my child

Diego          my boy friend

Diego          painter

Diego          my love

Diego          my husband

Diego          my husband

Diego          my friend

Diego          my mother

Diego          my father

Diego          my son

Diego          me

Diego          universe

Diego in my urine-Diego in my mouth-in my heart, in my madness, in my sleep. ফ্রিডা কাহলোর ছবি সম্পর্কে দিয়েগো একবার বলেছিলেন ‘যন্ত্রণাঋদ্ধ কবিতা’— যে-কবিতার শিকড়ে রয়েছে, দুঃখজনকভাবেই, কাহলোর শারীরিক যন্ত্রণা ও অনুভূতির একাকিত্বে যতখানি, তার চেয়েও বেশি দিয়েগোর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর দিয়েগোর থেকে পাওয়া রক্তপাতহীন আঘাতগুলি। যদিও রাশিয়া থেকে নির্বাসিত ট্রটস্কির সাথে মেক্সিকোয় নিজের বাড়ি ‘ব্লু হাউসে’ তীব্র ইন্দ্রিয়ঘন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ফ্রিডার (স্বামী দিয়েগো আর ট্রটস্কির স্ত্রী নাতালিয়া সেডোভা দু’জনেই তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন), তবু নিজের বোনের সাথে স্বামীর গোপন সম্পর্ক যখন জানলেন ফ্রিডা, নিঃস্ব এবং অসহায়ভাবে ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেলেন তিনি। ১৯৪০ সালে ‘Self Portrait with Cropped Hair’ আঁকলেন দিয়েগো রিভেরা থেকে বিচ্ছিন্ন ফ্রিডা, ছবিতে তাঁর প্রিয় মেক্সিকান গাউন নেই, দৃষ্টিতে সেই ‘জীবন’ নেই, তাঁর প্রিয় কেশপাশ পুরুষের মতো কর্তিত, পুরুষের পোশাকে ফাঁকা চেয়ারে একা বসে ফ্রিডা, নিজের নারীত্বকে সমূলে উৎপাটিত করেছেন তিনি।

চিত্র: দিয়েগো রিভেরা

দিয়েগো রিভেরা, যাঁর মুখের অসংখ্য স্কেচে ভরতি ছিল তাঁর ডায়েরির পাতা। সেই রিভেরা যেখানে প্রতিকৃত হয়েছেন ফ্রিডার ছবিতে, সেখানে বাস্তব আর ফ্যান্টাসি মিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি হয়েছে। কোথাও তাকে দেওয়া হয়েছে তৃতীয় চোখ, কোথাও ফ্রিডার শরীরে মিশে আছেন দিয়েগো (‘Diego and I 072197’ ‘Diego in my thoughts’) ‘Thinking of Death’ pfaco f1695 PAGT TAC3 C316201 মৃত্যুর প্রতীক। বাইরে ছড়িয়ে থাকা বস্তুগুলির মধ্যে, ফ্রিডার অন্তর্নিহিত পুরুষসত্তা বা অ্যানিমার একটা প্রকাশ আছে। তাঁর অধিকাংশ ছবিতে রক্তস্নাত তিনিই কেন্দ্র। বিচ্ছিন্ন বস্তুখণ্ডগুলির অস্তিত্ব শুধু ফ্রিডার রক্তবাহ শিরার সাথে যুক্ত হয়ে আছে বলেই অর্থময়। শরীরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ধাতুখণ্ডের জন্য তিনি সন্তান ধারণে অক্ষম ছিলেন। কিন্তু বারবার জেদি গর্ভধারণ এবং গর্ভপাতের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর ব্যর্থ আক্রোশ— নিজের অক্ষমতার জন্য। তাঁর ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীর আইকন হয়ে ওঠে যন্ত্রণার। অসহায়তার। Mariao Parniola বলেছেন ফেটিশ প্রতীক নয়, অন্য কিছুর চিহ্ন বা আকারও নয়। সে বৈধ শুধু নিজের কাছেই, তার মুক্তি তার স্বায়ত্বশাসনে। আত্মপ্রতিকৃতি বিষয়ে ফ্রিডার এই তীব্রতা তার বেঁচে থাকার অন্যতম উপায়। আরোগ্যর অন্যতম শর্ত যেন। বাস দুর্ঘটনা, পোলিও, বারবার গর্ভপাত, বত্রিশবার ভূতুড়ে শল্যচিকিৎসা, মৃত্যুর আগে হাঁটু থেকে কেটে বাদ দেওয়া ডান পা— শুধু এই শরীরেরই অধিকার থাকে সমস্ত পার্থিব বন্ধন মায়া মোহ লাবণ্য ও সংকোচ ছিড়ে নিয়ে নিজেকেই একমাত্র বিষয় করে তোলার। সেই শরণই হয় তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্র, পৃথিবীর দিকে খুলে ধরে রাখা সাহসী বুক যে পৃথিবী শুধু তরবারি হয়ে বল্লম হয়ে কেটে বসে গেছে তার মাংসে, এফোঁড় ওফোড় করে দিয়েছে তাকে। তাঁর ছবি আমাদের স্বস্তির পরপারে। ‘My Birth’ ছবিতে তিনি দেখছেন এক মহিলা রক্তাক্ত জননপথ থেকে বেরিয়ে আসছে পূর্ণ বয়স্ক ফ্রিডার মাথা। এরকম ফেটিশিজম, শুধু ফ্রিডাই পারেন ভাবতে। ফেটিশ পুজোর বিষয় করে তোলে না কোনো কিছুকে। কোনো জাদু আয়নাও তুলে ধরে না সামনে। সে তার বিষয়টিকে শুধুমাত্র বিষয় হিসেবেই চূড়ান্ত গুরুত্ব দেয়। ফ্রিডার আত্মপ্রতিকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তার ফেটিশ— তাঁর ছিন্নভিন্ন শরীরের মাংস হাড় চর্বি ও কাথ— যা তাঁর নিজের নয় আর, এমনকী অন্যেরও নয়। তারা স্রেফ বিষয়; থাকতে এসেছে।

ফ্রিডার বিখ্যাত আত্মপ্রতিকৃতি ‘Broken Column’ ছবিটির কথা, যেখানে বস্তু ও নিজের শরীরকে সমান গুরুত্ব ও নৈর্ব্যক্তিকতায় দেখেছেন ফ্রিডা কাহলো। শরীরের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া লোহার পাতকে যেন সসম্মানে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে শরীর (ক্রুশবিদ্ধ খ্রিস্টের ছবিতে পেরেক বা কাটার মুকুটকে এরকম সম্মান দেবার কথা ভাবাই যায় না), প্রবল কোনো ভূমিকম্পে যেন বিশাল অন্ধকার ফাটল সেই শরীরের মধ্যে। ছিটকে যাওয়া থেকে, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া থেকে শরীরকে রক্ষা করছে আনুভূমিক চারটি ধাতুবন্ধনী, যা যান্ত্রিক আর নিস্পৃহ। সেই বন্ধনী যেন স্রেফ দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজটির জন্য। শরীরের সে কেউ নয়। শরীরও গ্রহণ করেনি তাকে, নির্ভর করেনি তার ওপর। লোহার পাত, ধাতুর কর্সেটের মতো মুখও একটি বস্তুই শেষ পর্যন্ত। দৃশ্য ও অদৃশ্যের মধ্যে যে-দ্বিধান্বিত, দোটানায় পড়া সীমারেখা, ফ্রিডা ভেঙে দিয়েছেন তাঁকে। সারা জীবন তাঁর শরীর যুদ্ধ করে গেছে মৃত্যুর সঙ্গে।

ফ্রিডার আত্মপ্রতিকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তার ফেটিশ— তাঁর ছিন্নভিন্ন শরীরের মাংস হাড় চর্বি ও কাথ— যা তাঁর নিজের নয় আর, এমনকী অন্যেরও নয়। তারা স্রেফ বিষয়; থাকতে এসেছে।

কিন্তু এই অসমযুদ্ধের আয়ু তো অনন্তকাল হতে পারে না। ১৯৫৩ সালে তাঁর শেষ প্রদর্শনীতে ভিড়ে উপচে পড়ছে রাস্তাঘাট। সবাই উদ্বিগ্ন। হাড় কেটে ফেলা, রক্তপাতে ফ্যাকাসে শরীর আর মরফিনে আচ্ছন্ন চেতনা নিয়ে ফ্রিডা কি আসতে পারবেন! তখনই শোনা গেল অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। হাসপাতালের স্ট্রেচারে শায়িত ফ্রিডাকে শুইয়ে দেওয়া হল মেঝেয়। উপস্থিত দর্শকদের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে দিলেন ফ্রিডা। হাসলেন, কৌতুক করলেন, গান গাইলেন, পান করলেন মেক্সিকান মদ ট্যাকিলা আর কথা বললেন প্রচুর। বিপুল সাফল্য পেল সেই প্রদর্শনী।

ফ্রিডা ফিরে এলেন হাসপাতালে। তাঁর ডান পায়ে তখন গ্যাংগ্রিন ছড়িয়ে পড়েছে। যন্ত্রণার জন্য মারাত্মক রকমের ড্রাগ নিতে হতো তখন। ফ্রিডা ভেবেছিলেন আগের বারের মতো এবারও কয়েকটা আঙুল কেটে ফেলা হবে। যখন চিকিৎসক জানালেন আঙুল নয়, এবার ডান পা কেটে ফেলতে হবে এক মর্মান্তিক চিৎকার উঠে এসেছিল তাঁর গলা থেকে। ডাক্তার দিয়েগো রিভেরা, বান্ধবী আদেলিনা সবাই বোঝাতে শুরু করলেন তাঁকে। যদিও ফ্রিডার মতোই তারাও জানতেন মৃত্যু— ফ্রিডা যার নাম দিয়েছিলেন ‘লা চিংগাদা’ (বুন্ধু) বা ‘লা দিয়েনতোনা’ (মুখের সবথেকে পুরোনো দাঁত)— তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। উদ্যাপনাটুকুই শুধু বাকি। কাঁদতে কাঁদতেই ড. ফরিলকে ফ্রিডা বললেন, ‘আমি প্রস্তুত।’ অপারেশনের আগের রাতে শিশুর মতো মাটিতে বসে ফ্রিডা খেলছিলেন আদেলিনার দেওয়া খেলনা হরিণ আর বাঁদর নিয়ে। ডায়েরিতে এর মধ্যেই এঁকেছেন তাঁর কাটা পায়ের কয়েকটি ড্রইং। সেই ড্রইংগুলোর নীচে লিখে রেখেছেন— ‘আর কী প্রয়োজন পায়ের, যখন আমার রয়েছে ডানা, উড়ে যাবার জন্য?’ অথবা ‘ওরা আমার থাবা কেটে ফেলবে এবার, তাতে কী যায় আসে?’

অপারেশন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল ফ্রিডাকে। নকল পায়ের লাল চামড়ার জুতোয় তিনি বেঁধে নিয়েছিলেন ছোটো ছোটো ঘণ্টা, যাতে হাঁটার সময় তারা বেজে উঠে যাতে তাঁর শরীরের এই খুঁতটাকে বাইরের চোখে আড়াল করা যায়। আরও বেশি ধরতে চাইলেন দিয়েগোকে, ফেরাতে চাইলেন অন্যান্য সম্পর্কগুলো থেকে। পারলেন না। চিকিৎসকের অবাধ্য হলেন। মাঝরাতে যন্ত্রণায় অন্ধ হয়ে স্নান করতে শুরু করলেন। ১২ জুলাই ১৯৫৪ ভোর রাতে একা বাড়িতে একা ফ্রিডা তীব্র জ্বরে ও যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন ফ্রিডা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সকাল ছ’টায় নার্স এসে দেখলেন চোখ খোলা নিথর ফ্রিডাকে। নিজেকে নিঃশেষ করে নিজেকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তাঁর প্রতিটি ছবিতে। খুব কম শিল্পীই তাঁর মতো করে। নিজের অনুভূত অস্তিত্ব এ যন্ত্রণাকে আঁকতে পেরেছেন। এমন ভয়াবহ ধারাবাহিক যন্ত্রণা সহ্যও করতে হয়নি আর কোনো মানুষকে। ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা নিজেদের পরিচালনা করি আমাদের নিজেদেরই দিকে, সহস্র সত্তার মধ্য দিয়ে— পাথর, পাখি, প্রাণী, নক্ষত্র— আমাদেরই উৎস থেকে। লিখেছিলেন, ‘আমি লিখছি তোমাদের কাছে আমার চোখ দিয়ে।’

খুলে রাখা এই চোখ কোনোদিন বন্ধ হতে পারে না।

Facebook Comments

পছন্দের বই