লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসঘর

সপ্তম পর্ব

গওহরজান: এক সুরেলা অধ্যায়

এর পর থেকে গওহরজানের জীবনে শুরু হল সোনালি অধ্যায়। গ্রামোফোন রেকর্ডে ওঁর গাওয়া গানে সারা দেশের মানুষ মাতোয়ারা। এই সাফল্যের অগ্রগতি আমৃত্যু চলেছিল এবং সেই সময়ের অন্যতম আলোচিত ও সম্মানীয় সংগীত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে পুতুলনাচের প্রদর্শনীতে গওহরজান নামের একটা চরিত্র থাকত। তাঁর ছবি দিয়ে পিকচার পোস্টকার্ড তৈরি করা হত। এমনকী ভারতে ব্যবসার সুবিধার্থে সুদূর অস্ট্রিয়াতে তৈরি দেশলাই কাঠির বাক্সে তাঁর ছবি ব্যবহার করা হত।

গওহরের রেকর্ডের ছবি

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনা ও গ্রামোফোন কোম্পানির সৌজন্যে গওহরজান প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তিনি চিৎপুরের নাখোদা মসজিদের পাশের বাড়িটি কেনেন এবং সেই বাড়ির নাম হয় ‘গওহর বিল্ডিং’ পরবর্তীতে যা ‘সেলিম মঞ্জিল’ নামে পরিচিত হয়। ছয়টি সাদা আরবি ঘোড়ায় টানা অসাধারণ সুসজ্জিত তাঁর একটা নিজস্ব ফিটন গাড়ি ছিল। বহুমূল্য পোশাক ও অলংকারে সুসজ্জিতা হয়ে তিনি প্রায়ই ঘুরতে বেরোতেন।

তাঁকে কেন্দ্র করে সেই সময় অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। তিনি না কি তাঁর পোষা বিড়ালের বিয়েতে ১২০০ টাকা খরচ করেন এবং সেই বিড়ালের ছানা হবার পর ২০০০০ টাকা খরচ করে এক জমকালো পার্টি দেন।

আর একটি গল্প হল, এক সন্ধ্যায় গভর্নরের ফিটনের পাশ দিয়ে গওহরজানের ফিটন পার হচ্ছিল। পর্দার আড়ালে থাকা গওহরের সৌন্দর্য ও পোশাকের ঘটা দেখে গভর্নর তাঁকে বাংলার কোনো রাজপরিবারের মহিলা ভেবে নিজের ফিটন থামিয়ে টুপি খুলে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানান। পরে যখন তিনি জানতে পারেন যে, ওই মহিলা একজন বাঈ শ্রেণির, তখন আইন অমান্য করার জন্য তিনি গওহরের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং ১০০০ টাকা জরিমানা ধার্য করেন। কারণ, তখনকার আইন অনুযায়ী ভাইসরয় ও রাজপরিবারের মানুষজন ছাড়া অন্য কারো ছয় ঘোড়ার ফিটন ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। কিন্তু গওহরজান ধার্য জরিমানা দিয়েছিলেন এবং সেই ফিটন নিয়ে নিজস্ব ভ্রমণও চালিয়ে গেছেন।

এই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটে, যার থেকে গওহরজানের জীবন সম্বন্ধে ভাবনার আমূল পরিবর্তন হয়। দাতিয়া ছিল মধ্যপ্রদেশের এক ছোটো স্বশাসিত রাজ্য এবং সেখানকার মহারাজা ভবানী সিংহ বাহাদুর ছিলেন সংগীত ও শিল্পানুরাগী। গওহরজানের গানের সুখ্যাতি মহারাজার কানে পৌঁছেছিল এবং তিনি রাজদরবারে গওহরজানকে সংগীত পরিবেশনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু গওহরজান সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ হিসেবে জানিয়েছিলেন তিনি অনেক বড়ো বড়ো রাজদরদারে সংগীত পরিবেশন করতে অভ্যস্ত। দাতিয়ার মতো এক ছোটো রাজ্যে তিনি সংগীত পরিবেশন করতে রাজি নন। এতে মহারাজ খুব অপমানিত বোধ করেন এবং গওহরজানকে দিয়ে তাঁর রাজ্যে গান গাওয়ানোর প্রতিজ্ঞা করেন। বাংলার গভর্নরের সাথে দাতিয়ার মহারাজার সম্পর্ক ভালো থাকার ফলে দাতিয়ার যুবরাজের রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য পুনরায় আমন্ত্রণ পাঠান এবং ব্রিটিশ শাসকের কাছ থেকেও একই অনুরোধ আসার ফলে গওহরজানের পক্ষে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। গওহরজান সপারিষদ দাতিয়া যাবার জন্য একটা আলাদা ট্রেন পাঠানোর দাবি জানান এবং ১০০জন সঙ্গী সাথে তিনি দাতিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন। সেখানে গওহর ও তাঁর সাথীদের থাকার জন্য একটা বিলাসবহুল বাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং প্রতিদিন তাঁকে ২০০০ টাকা সাম্মানিক দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।

গওহর বিল্ডিং (বর্তমানে যার নাম "সেলিম মঞ্জিল")

নির্ধারিত দিনে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল এবং শুধুমাত্র গওহরজান ছাড়া আমন্ত্রিত সব শিল্পীদের অনুষ্ঠান হয়েছিল। গওহরজান দেখলেন প্রতিদিন তাঁর জন্য মহার্ঘ্য উপহার ও সাম্মানিক টাকা মহারাজ পাঠিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু সংগীত পরিবেশনার ব্যাপারে কোনো বার্তা পাঠাচ্ছেন না। এইভাবে প্রায় দিন ১৫ কেটে যাওয়ার পর গওহর বুঝতে পারলেন যে, তাঁর পূর্বের করা প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ মহারাজা এইভাবে উশুল করছেন।উপায়ান্তর না দেখে গওহর মহারাজের সাথে দেখা করেন এবং জানান যে, তিনি একজন শিল্পী। শিল্পীর কাছে তার নিজের কাজের মূল্য অনেক বেশি এবং সংগীত পরিবেশন করতে না পারার কারণে তাঁর শিল্পীসত্তা হাঁপিয়ে উঠছে। তিনি আর অর্থ চান না, শুধু গান গাইতে চান। তারপরেই মহারাজা গওহরজানের গানের আসরের বন্দোবস্ত করেন। শোনা যায়, এই ঘটনার পরে গওহরজানের দম্ভ অনেক কমে গিয়েছিল।

ইন্দোরের রাজদরবার থেকে গওহরজান ও তাঁর সংগীতকে বিশেষ সম্মাননা জ্ঞাপনের জন্য এক আসরের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে অনুষ্ঠান শেষে মহারাজা উপহারস্বরূপ পুরো মঞ্চটাই গওহরের উদ্দেশে নিবেদন করেন। এমন পুরস্কারের ঘোষণায় গওহরজান বিস্ময়বোধ করেন এবং যখন মঞ্চের চাদর সরানো হয় তখন দেখা যায় মঞ্চটি এক লাখ রুপোর টাকায় সাজানো রয়েছে। গওহরজান এই উপহার গ্রহণ করেন সেই অর্থ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে দেবার কথা ঘোষণা করেন।

একের পর এক অনুষ্ঠান ও রেকর্ডে প্রকাশিত গওহরের গান গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ইতিমধ্যে আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ১৯১১ সালের ২২শে জুন পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক। রাজা হবার পর তিনি কুইন মেরির সাথে তাদের সব উপনিবেশগুলিতে ভ্রমণের উদ্দেশে বের হলেন। ওঁর ভারতে আসাকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে দরবারের আয়োজন করা হয়েছিল। গওহরের ব্যক্তিত্বপূর্ণ উপস্থিতি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সাজসজ্জা ইত্যাদির কারণে সেই অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করার জন্য তাঁকে নির্বাচিত করা হয় এবং গভর্নরের অফিস থেকে এই মর্মে একটি চিঠি পাঠানো হয়। সেই বিশেষ দিনটিতে এলাহাবাদের প্রখ্যাত শিল্পী জানকী বাঈয়ের সাথে দ্বৈতগায়ন নিবেদন করেছিলেন গওহর। অপূর্ব সুরেলা নিবেদনের মাধ্যমে রাজপরিবারের উপস্থিত সব সদস্যদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে পঞ্চম জর্জ দু-জনের গানের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং দুই শিল্পীকেই ১০০টি গিনি উপহার দেন।

এর মাঝে রামপুরের রাজদরবারে সংগীত পরিবেশন করার সুবাদে রামপুরের দরবারের সভাগায়িকার পদে ভূষিত হন। রেকর্ডে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানের সাফল্য তাঁকে গগনচুম্বী খ্যাতি ও সাফল্য এনে দিলেও কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে একের পর এক দুর্ঘটনা গওহরজানের শরীরে ও মনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল। সম্পত্তি ও বাড়ির উত্তরাধিকার নিয়ে মামলা, প্রেমে ব্যর্থতা ও আপনজনের মৃত্যুতে তিনি নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে তিনি তাঁর প্রাণের শহর কলকাতা ত্যাগ করেন এবং মহীশুরের রাজা নলওয়াদি কৃষ্ণরাজের দরবারের সভাগায়িকা রূপে নিযুক্ত হন। তাঁকে ৫০০ টাকা মাসোহারা হিসাবে দেওয়ার চুক্তিপত্র তৈরি হয়েছিল। এছাড়া তাঁর বাসস্থান হিসাবে এক সুসজ্জিত বাড়ি বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর পরিচারিকার থাকা খাওয়া বাবদ আলাদা অর্থের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এই চুক্তির ফলে গওহরের মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয়। কিন্তু আর কোনো উপায় না থাকায় এই সামান্য মাসোহারার বিনিময়ে তিনি সভাগায়িকার পদটি গ্রহণ করেন। এইভাবেই ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে যেতে থাকে এবং গওহরের সংগীতে ভাটার টান আসতে থাকে। সাথে শরীরও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৯৩০ সালের তীব্র ঠান্ডায় তিনি কাবু হয়ে পড়েন। তাঁর নাচ গানের ইচ্ছে অনেক আগে থেকেই কমতে শুরু করেছিল। এর সাথে মানসিক অবসাদ ও আহার ত্যাগ তাঁকে আরও বিধ্বস্ত করে তুলেছিল। প্রবল জ্বর নিয়ে তিনি মহীশুরের কৃষ্ণরাজেন্দ্র হাসপাতালে ভর্তি হন। ডাক্তারদের সব চেষ্টা বিফল করে দিয়ে ১৯৩০ সালের ১৭ই জানুয়ারি কলকাতার বুলবুল, ভারতের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড শিল্পী ও সে-যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়িকা গওহরজানের জীবনের সুরের তার ছিঁড়ে যায়। সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় নির্জনে গানের বুলবুল তাঁর গান চিরতরে স্তব্ধ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে বেহস্তে পাড়ি দেন।

“গর ফসে দফন রহেঙ্গে ইয়ুহি আহোঁ কে হুজুম
শাম-আ-বালে নে লাহাদ হোগি খফা মেরে বাদ”

(আমার মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরেও আমার সমাধিতে শোকজ্ঞাপন হতে পারে ভেবে ভয় হয়। তাহলে আমার সমাধির পাশে থাকা বাতিটাও অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। তাই আমার সমাধিতে যাঁরা আসবেন তাঁরা যেন আমার জন্য শোকপ্রকাশ না করেন)

এখানে গওহরজানের রেকর্ডে গাওয়া কিছু গানের উল্লেখ করা হল:
১. ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে (বাংলা)
২. পহেল… (পেশোয়ারী)
৩. ফি মাসি নাও (বার্মিজ)
৪. জ্ঞানাবলি চম্পালি (গুজরাতি)
৫. সবকরিনা তারিয়া (তেলুগু)
৬. মাই লাভ ইস লাইক এ লিটল বার্ড (ইংরেজি)
৭. আয়ান্তা হাবিবি আনা গরিবান (আরবি)
৮. আয়ু না মাল হ্যায় (কুচতি)
৯. পাদ শাহেম মজুক ইয়েশা (তুর্কি)
১০. নজর তেরি হো গয়ি (হিন্দি)
১১. নামম মহিন সাসুর (সংস্কৃত)
১২. মালাপানি মিশইয়ারানি (পুস্তু)
১৩. আজ পাজায়ি মন চক গেরবা (ফারসি)
১৪. বসোহে দেয়া মেলিয়া মে নহি (পাঞ্জাবি)

তথ্যসূত্র:

স্মৃতির অতলে— অমিয়নাথ সান্যাল
My name is gawhar jaan – Vikram Sampat

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই