লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

ছাদকাহন

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
দেখছি চেয়ে প্রথম তারা
সে যেন চায় আমার চোখে
তার দু-খানি নয়নতারা”

বাড়ি যেখানে আকাশে মিশে যায় তার নাম ছাদ। প্রত্যেক বাড়ির কিছু উড়ুক্কু আকাঙ্ক্ষা থাকে। আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি বাড়িটার ইচ্ছেমেঘ ডালপালা মেলে দেয় ছাদের শহর থেকে। ছাদে রোদ আসে, চাল শুকোয়, আবার সেই ছাদেই বৃষ্টি নামে, চাল ভিজে ভাত হয়, নরম হয় চোখ। পুরোনো বাড়ি ভূতে না পেলেও প্রমোটারে ঠিক পায়। কথাবার্তা শুরু হয়, দলিল দস্তাবেজ। মত বিনিময়। বনিবনা অথবা তার অভাব। নতুন নতুন আত্মীয় দেখা দেয় বাড়িতে। ফ্ল্যাট চাই তাদের। অসহায় প্রমোটার মেঘমল্লার শুনতে শুনতে ভাবে, এত ভাগ হলে আমি ফ্ল্যাট বেচব কাকে? চিরভঙ্গুর অথচ দণ্ডায়মান বাড়িটা ভাবে, সবক শেখাবে! কিন্তু কাকে? কী করে? ছাদের নয়নতারা গাছ পুরোনো বাড়ির নড়বড়ে ইটের ফাঁক থেকে মৃত্যুর আকাশে চাহনি চারিয়ে দেয়। নয়নতারা অসীম নক্ষত্রপথে জীবন মৃত্যুর সাহচর্যের মধ্যেও ছাদের প্রস্থানবিন্দুকে মনে রাখে।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
এখন ঘরে ফিরছে যারা
তাদের মনে শান্তি আসুক
শান্তি আনুক সন্ধ্যাতারা”

বাড়িটার মুখে ক্যান্সার। মুখ দিয়ে খাবার নামছে না। রাইস টিউব দেওয়া রয়েছে। ছাদের মুখের ঘা অনন্তে দগদগিয়ে উঠছে। ভাঙা ইটের ফাঁকে সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে। ছাদজজুড়ে লাল লঙ্কা শুকোতে দেওয়া আছে, আর দুপুরের স্নানের পর এলোমেলো খোলা চুল। বিনুনি বাঁধার দৃশ্য আজ একশো বছর ধরে মকশো করছে বাড়িখান। মানুষ বদলে যাচ্ছে, চুল বদলাচ্ছে কিন্তু বিনুনি কারুর না কারুর ঠিকই বাঁধা হতে থাকছে। ছাদের শহর আলোর ক্যামেরায় খোঁপা থেকে বিনুনির ইতিহাস লিখে রাখছে। দুপুরের ছাদ যখন টংঘর ভুলে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় বিকেলের ঘনায়মান ছায়া প্রচ্ছায়ার দিকে। ঠিক সেই সময় নয়নতারার ফুল কথা বলবে কিনা বুঝতে পারে না ফিকে হয়ে আসা রোদের সঙ্গে।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
ক্লান্ত হয়ে দিন ফুরোলো
এখন অবসন্ন যারা
তাদের জন্য সন্ধ্যেতারা”

কাকিমা বলতেন, কত করে বলছি, বাড়ি সারাতে না পারলে বেচে দেওয়াই ভালো। দেখবি আমি একদিন ঐ বাড়ি চাপা পড়েই মরব। মৃত্যু যেন নিশিডাকই দিয়েছিল অথচ রাত তো নামেনি তখনও? ভরদুপুরে ভূতের ঢ্যালা মারার মতোই সহসা নেমে এসেছিল এক পশলা মৃত্যু। নয়নতারার ছাদে। ফুল তুলতে গিয়ে কাকিমা যখন নীচে পড়ে যায়, ওঁর চোখের কালো সাদা হয়ে গিয়েছিল আর চোখের সাদা কালো। তবে কি সে চোখকে পুরো কালো বলব নাকি পুরো সাদা? নয়নতারা বুজে গেছিল। মুখের পান গলায় আটকে ছিল। বাড়িটা নিজেই নিজেকে ভাঙছিল একটু একটু করে। আর তার ভাঙনের খেলা দেখতে এসে নিজেরাই ভেঙে পড়ছিল অনেক অনেক মানুষ।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
কখন তুমি আসবে বল
অপেক্ষাতেই তন্দ্রাহারা
থাকবে আকাশ তারায় তারায়”

একটা ইট সরে গিয়েছিল নিজের জায়গা থেকে। বাড়িটার কিছু হয়নি। শুধু শরীর ভেঙে গেছিল পড়ে গিয়ে। মাথা, ঘাড় আর মেরুদণ্ড। কংক্রিটের ওপর যেখানে পড়েছিল কাকিমা, সেখানে তেমন রক্ত ছিল না। রক্তপাত হয়েছিল ভেতরে। রক্তপাত হয়েছিল শরীরের ভেতরে, বাড়ির ভেতরে, অদেখা কুলুঙ্গিতে রাখা না-দেখা প্রদীপের অগ্নিজ্বালা প্রথমে সংবিৎ নিয়েছিল, তারপর প্রাণ। বাড়ি ভেঙে পড়েনি শরীরের ওপর, বরং শরীর সরে গিয়েছিল বাড়ির থেকে। সেই সরণে মৃত্যুও স্মরণহীন হয়ে পড়েছিল।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল”

পোস্টমর্টেম তো হয়েছিল কিন্তু বাড়ির কি আর শাস্তি হতে পারে? হঠকারী বস্তুর মতো প্রাচীন আলয়ও হন্তারক অথচ নিরপরাধ। প্ৰোমোটার ভেবেছিল বাড়িটা অভিশপ্ত। খেয়ে নেবে সবাইকে। ফ্ল্যাট হতে দেবে না বলে খেতে শুরু করেছে। নাহ্, এ-বাড়ির কাজ না নেওয়াই ভালো। থাক বরং পড়েই থাক। যতদিন না ভেঙে পড়ে। অথচ এ-বাড়ি দুর্গম আকাশের মতো। আকাশ ভাঙে কেবল বৃষ্টিতে। নাহলে সে ফাইটার প্লেনকেও টেনে নামানোর ক্ষমতা রাখে।

“দেখছি চেয়ে প্রথম তারা”

কাকিমা একবার বলেছিল, ছেলে খেলে খেলে আধা ভেঙে ফেলেছিল জানালার কাঠ কিন্তু ছেলের কীর্তি বলে মায়াভরে আর বদলাতে পারেনি খিড়কির পাল্লা। আধভাঙাই রয়ে গিয়েছিল। কাকিমার তিন দশকের গৃহকর্ত্রী হয়ে থাকা জীবনে বাড়িটার সঙ্গে যা-ই কলহ দ্বন্দ্ব থাকুক না কেন, ভালোবাসার অধিকারও বই কম ছিল না। ছাদের ইচ্ছে ভিড় করে আসা দুপুরে মায়েতে মেয়েতে রোদ পোহাতে পোহাতে পানের ভাঁজে ভাঁজে ফেলে আসা সময়ের কথা ভাবত। সেদিনই খালি মেয়ে সঙ্গে ছিল না যখন নয়নতারা ফুলগুলো হাতছানি দেয় ছায়ার অবনতি কোণে। মেয়ে শুধু একটা শব্দ শোনে আর তারপর বাবার চিৎকার। কাকু জল তুলছিল নীচে। হাওয়া বেয়ে কাকিমা হঠাৎ নেমে এসেছিল কুয়োর পাশের রাস্তায়। তারপর হাসপাতাল, মর্গ, থানা, শ্মশান আর তদন্তহীন থেকে যাওয়া প্রতিভঙ্গুর ইমারত।

“সে যেন চায় আমার চোখে”

ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে পথ। ছাদ ভরে গেছে নয়নতারায়। উপচে গিয়ে ছাদ বেয়ে নীচে নেমে পথ গোলাপি করে তুলছে মৃত্যুমর্মর ফুলের মিছিল। ছাদ যেন আকাশে উঠতে না পেরে মাটির দিকে নেমে গেছে। উন্নতি কোণ থেকে অবনতি কোণের অঙ্কে বিভোর বাড়িটা স্বপ্নের কামনায় নিম্নগামী। ছাদের দু-পাশে দুটো জানলা,

“তার দুখানি নয়নতারা”

Facebook Comments

পছন্দের বই