লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অলোকপর্ণার ধারাবাহিক উপন্যাস: আফিম (শেষ পর্ব)

চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান

মেঝেতে থালা নিয়ে ভাতের পাহাড়ের আড়ালে বসলেন ফয়জুল রহমান।

পাত্র থেকে ডাল ঢেলে দিল বড়োমেয়ে, মাছ ভাজা সাজিয়ে দিল থালায়। পানির গেলাস সামনে রেখে সে বলল, “আর কিছু লাগলে কইয়েন।”

ভাত ভাঙতে ভাঙতে ফয়জুল রহমান বললেন, “ছুডোটারে দেখি না… ইশকুল গেছে?”

দাঁতে দাঁত পেষে রোশন আরা। জবাব দেয়, “সে এহন আর ইস্কুলে পড়ে না, কলেজ। আর তার বিয়া হই গেছে।

“শ্বশুর বাড়ি কোথায়?”

রোশন আরা বলে, “কলকাতা।”

ফয়জুল রহমান চুপ করে শোনেন। আর ভাত ভেঙে ডাল দিয়ে মাখতে থাকেন। তারপর একদলা ভাত হাতে নিয়ে বলেন, “আমারে কিছু জিগাইবি না?”

রোশন আরা বলে, “না। জিগামু না। আপনার কিছু কয়ার হলে আপনে কয়েন।”

“সেদিন সকালে উইঠা দেখলাম তর মায় শুইয়া আছে পাশে। তার হাত পা সুতার মতো লিকলিক করতাছে। ফিনফিনে সুতার মতো পাতলা হইয়া শুইয়া আছে সে। মুখে তার কোনো হাসি নাই। আলো নাই। অথচ সেদিন খুশির ঈদ। মন উচাটন হইল মোর। একটা কাগজে লিখলাম, চললাম। আমাকে খুঁজো না।”

রোশন আরা সরাসরি ফয়জুল রহমানের চোখের দিকে তাকাল। “খুঁজো না” আর “খোঁজ কোরো না”-র ধাঁধার মাঝেই ফয়জুল রহমান বলে যেতে থাকলেন, “ঘর ছেড়ে বাহির হইয়া সাইকেলে উঠলাম। প্যাডেল করতে করতে এমন একটা রোখ চাইপা গেল যে, ভাবলুম থামুম না। তারপর বেলাশেষে দেখলাম এক আদিগন্ত বিস্তীর্ণ ক্ষেতির মাঝে আমি দাঁড়ায় আছি। আশেপাশে কেউ নাই। আকাশে জ্বলতাছে সহস্র কোটি তারা! পরদিন সকালে সেই ক্ষেতির চাষীদের সাথে ভাব জমাইলাম। তারপর মাস কয়েক সেখানেই ধান, কলাই চাইষ হল। একদিন জমি দেখতে মালিক আইলেন। তাঁর সহিত আলাপ হইতে তিনি আমারে খামারের দায়িত্ব দিয়া গেলেন। এরপর সেই খামারে সাতাইশ বৎসরব্যাপী ভুলে মনের বালাই কোদাল চালাইয়া— কলাই চাইষ কইরা আমি মালিকের সংসারে এত এত ধনসম্পদ জোগান দিলাম যে, মালিক মরণের আগে আমারে জমির অর্ধেক ভাগ দিয়া গেলেন।”

চুপ করে রোশন আরা তাকিয়ে থাকে তার সামনে বসে থাকা মানুষটার পানে। তারপর বলে, “আপনার মনে আছে, একদিন আমারে লইয়া আপনে মেলায় গিয়াছিলেন, আমারে বাতপতাকা কিনা দিছিলেন…”

ফয়জুল রহমান হাসিমুখে বলেন, “হ, কাগজের রঙিন বাতপতাকা, তারপর আমরা চটপটি খাইছিলাম, তর আম্মুর লাইগা কাচের চুড়ি কেনা হইছিল”

রোশন আরা ধীরে ধীরে বলে, “আমরা হাওয়াই মিঠাই খাই নাই।”

ফয়জুল রহমানের মুখ থেকে হাসি মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যায়, কঠিন মুখে তিনি আবৃত্তি করেন,— “আমরা হাওয়াই মিঠাই খাই নাই।”

“আপনার সাইকেল বাহিরে তৈরি আছে। যখন খুশি বাইরয় যাইতে পারেন।” শান্ত স্বরে রোশন আরা বলে,— “তবে অনুরোধ করি, আইসা যখন পড়ছেনই, দিনকয়েক থাইকা যাইয়েন।” রোশন আরা এ কথা বলে আফিমের নেশার মতো ঘোরে ঢুলতে ঢুলতে চলে যায়।

বড়োমেয়ের বিছানায় শুয়ে অস্থির শ্বাস নিচ্ছে করিমন প্রেসারকুকার। সিটি দিতে দিতেও দিচ্ছে না। কোনোক্রমে নিজেকে চেপে রেখেছে করিমন কুকার। বুক ধকধক করছে তার। পেটের মধ্যে অদ্ভুত থমকে আছে সুলেইমান রেজা। ফয়জুল রহমান ওঘরে বসে ভাত খাচ্ছেন,— যে-ঘরে সে করিমন বিবির গতরে বুলডোজার চালিয়েছে গত এক বছর। পেটের উপর হাত রাখতেই করিমন বিবি সুলেইমান রেজার হিংসুটে এক লাথি খায়। তখনই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে আসেন ফয়জুল রহমান। তাঁকে দেখে করিমন ফুটবল ধড়মড় করে উঠে বসে আর পিঠে টান খেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “আল্লা গো!”

ফয়জুল রহমান এসে করিমন বিবির হাত ধরে ফেলেন আর ডেকে ওঠেন, “করিমন জান!”

মনে মনে করিমন ঘুড়ি ছিটকে যায়। বড়োমেয়ের স্পর্শের মতো ফয়জুল রহমানের স্পর্শও আমুল বদলে গেছে। না নরম, না শক্ত, সেই স্পর্শের কোনো সংজ্ঞা হয় না। শুধু আগের মতো ফয়জুল রহমানের স্পর্শে করিমন বিবির বুকের ভিতরের সেই আছাড়ি-পিছাড়িটা আর হচ্ছে না। চুপ করে বসে থাকে করিমন অন্ধকার।

ফয়জুল রহমান করিমন বিবির কপালে টোকা দিয়ে অন্ধকারকে আবার ডাকেন,— “করিমন জান, বাড়ি আছ?”

করিমন অন্ধকার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “আপনার করিমন জানরে ছাইড়া গেছিলেন ক্যান আপনে?”

ফয়জুল রহমান করিমন বিবির মুখ দুই হাতে তুলে ধরে বলেন,— “কোরবানির ইদে সক্কাল সক্কাল উঠে মাইয়াগো ঘরে গিয়া দেখি রোশনারা জাহানারা এরে অরে জড়ায় ঘুমায়। কী মায়াই না ছড়ায় আছে অগো মুখে। এত্ত মায়া যে ইচ্ছা হইল মইরা যাই। একখান কাগজ লইয়া লিখলাম, চললাম। আমারে খুঁজো না। তারপর সাইকেল লইয়া রেল লাইনের সামনে গিয়া খাড়াইলাম। সাইকেল থুইলাম লাইনের ধারে। নিজে উইঠা আইলাম লাইনে। ঘণ্টা দুই তিন দাঁড়াইবার পর বুঝলাম ট্রেন অবরোধ। মরা হইল না। সাইকেলে চইড়া বইলাম আবার। সাইকেল চালায় চালায় পাও ব্যথা হইল যহন, দেখলাম এক কবরস্থানে আইসা পড়ছি। সারারাত সেই গোরস্থানে ভূত প্রেতের লগে শুইয়া রইলাম। সকালে উইঠা দেখি আমিও য্যান মইরা প্রেত হইয়া গেছি। মরণের পর, সাতাইশডা বৎসর সেই কবরখানায় হরেক মাইনশেরে কবর দিছি আমি। এত কবর দিছি, এত কবর দিছি যে, আর কেউ বাইচা নাই যার কবর হইতে পারে।”

করিমন নিস্তব্ধ তাকিয়ে আছে ফয়জুল রহমানের দিকে।

করিমন বিবির মুখ থেকে হাত নামিয়ে ফয়জুল রহমান বলে চলে,— “হগল কবর খোঁড়া হইলে আবার সাইকেলের কথা মনে পড়ল। আর ফিরা আইলাম।”

চুপ করে বসে আছে করিমন নৈঃশব্দ্য, একহাতে পেট ধরে রেখে। পেটের ভিতর সুলেইমান রেজাও চুপ করে শুনেছে ফয়জুল রহমানের সব কথা। ফয়জুল রহমানের চোখ পড়ে সুলেইমান রেজার উপর। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “কমাস হল?”

“সাড়ে আট”

“কী নাম অর?”

পেটের দিকে চেয়ে করিমন বিবি বলে,— “সুলেইমান রেজা।”

ফয়জুল রহমান জুলজুল চোখে সুলেইমান রেজার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

আফিমখেকো ঘোরের ভিতর থেকে করিমন বিবি বলে,— “আপনার নাম?”

ফয়জুল রহমান থতমত খেয়ে যান। কী বলবেন বুঝতে পারেন না। তারপর ধীরে ধীরে বলেন,— “রবিউল করিম।”

সুলেইমান রেজাসমেত করিমন বিবি চুপ করে বসে থাকে।

করিমন বিবির স্তব্ধতার সামনে দাঁড়িয়ে ফয়জুল রহমান বলে,— “ভুল হইয়া গেছে। আমারে মাপ করবেন।”

অবেলায় ঝিঝিঁর ডাক শোনা যায়। করিমন নিবিড় চুপ করে ফয়জুল রহমানকে দেখতে থাকে।

দুই হাত জড়ো করে তিনি বলেন,— “আমার কেউ নাই। আমি একা! আমি ভুল করছি। আমারে মাপ করেন!”

করিমন বিবি অস্ফুটে বলে, “ভুল কইরা আইয়া পড়ছেন?”

ফয়জুল রহমান মাটির দিকে চেয়ে থাকে।

করিমন বিবি অনুযোগ করে ওঠে,— “ভুল কইরা আইছেন?! ভুল কইরা! ভুল করছেন?!”

ফয়জুল রহমান অবাক হয়ে করিমন বিবির দিকে চায়। তারপর দু-খানা হাত দিয়ে করিমন বিবির মুখ আলোর দিকে তুলে ধরে।

করিমন বিবি নির্বিকারে প্রশ্ন করে চলে,— “সাতাইশডা বৎসর লাগল আপনার ভুল করতে? সাতাইশডা বৎসর লাগল আপনার আইতে?”

চোখ ছাপিয়ে অভিমানী পদ্মানদী করিমন বিবির গাল বেয়ে গলা বেয়ে টোপা টোপা বুক বেয়ে পেটের উপর গিয়ে থামে। পেটের ভিতরের আকাশে দু-খান তারার মতো সে অশ্রুদ্বয় মিটিমিটি জ্বলতে থাকে। পেটের ভিতর থেকে সুলেইমান রেজা চক্ষু মেলে সেই অশ্রুদের পানে চেয়ে থাকে।

প্রথম পর্ব:

অলোকপর্ণার ধারাবাহিক উপন্যাস: আফিম

দ্বিতীয় পর্ব:

অলোকপর্ণার ধারাবাহিক উপন্যাস: আফিম (দ্বিতীয় পর্ব)

তৃতীয় পর্ব:

অলোকপর্ণার ধারাবাহিক উপন্যাস: আফিম (তৃতীয় পর্ব)

চতুর্থ পর্ব:

অলোকপর্ণার ধারাবাহিক উপন্যাস: আফিম (চতুর্থ পর্ব)

পঞ্চম পর্ব:

অলোকপর্ণার ধারাবাহিক উপন্যাস: আফিম (পঞ্চম পর্ব)

Facebook Comments

পছন্দের বই