লেখক নয় , লেখাই মূলধন

হাসনাত শোয়েবের কবিতা

সন্তান প্রসবকালীন গান-৪

চিত্ররথ, এই নাও তোমার মহাভারত। গানের পাশে ফেলে গেছ ঢাল-তলোয়ার। বধ করো সুর ও সংহিতা। দক্ষিণে অগস্ত্য গেছে, তারও দক্ষিণে মৃগ। তাদের ফিরিয়ে নাও এবার। তুমুল হর্ষধ্বনির পাশে লিখে রাখো বৃহস্পতিবার সকাল, যখন সকল নারীই যোজন-গন্ধ্যা। গান্ধর্ব তাদের রীতি, কৃষ্ণ তাদের বর। সন্তান প্রসবকালীন গানে তারা ভুলে গেছে লয়-সুর। ওই দেখ, একা একা কাঁদছে তোমার হস্তিনাপুর।

***
সকলেই একা, তোমাদের পুত্রসমান। তাদের জন্য লিখো গান, সুর দাও, দাও অসুর। বিমর্ষ কৌরব পুত্রদেরও আছে হৃদয়। আহত বাঘের দাঁত ব্যথার যন্ত্রণাও তারা বুঝতে পারে। তারাও লিখেছে গান সুমহান। এই পথ ধনুর্বিদদের, অস্ত্রচালকরা তাই অযৌন; শিকারীরা বৃহন্নলা। মৎসান্যায়ীরা তাদের ঈশ্বর ও আপেল শিকার একমাত্র ধর্ম। তারা জানে না গান, সুরও ভুলে গেছে। আছে কেবল হৃদয়, তার ওপর জন্মানো মহাভারত।

***
যে হৃদয়, কালিকাপ্রাসাদে হারিয়ে ফেলেছিল সুর। তার পথ থেমে গেছে সেই প্রাসাদেই। ফেলে আসা ধুলো উড়ে গেছে দক্ষিণে, অগস্ত্যের খোঁজে, হারিয়ে ফেলেছিল বেণী। তার সন্ধানে গিয়েছিল শিখণ্ডীও। পড়ে আছি, যারা দুপুরের সিয়েস্তা। এখানে ফোরাত, এখানেই কুরু। তোমরা লিখেছ গান, দুপুরে হারানো সুরে। তার পিছু ছুটে গেছি মৃত ধনুর্বিদ। কুড়িয়ে নিয়েছি অসুখের ফল। নাম লেখা ছিল তোমার, মুছে দিয়েছি। ফল নিয়ে ফিরে আসি ঘরে।

***
সেই সব ফল, তাদের অসুখ। ক্রমশ ছুটে গেছে হাসপাতালের দিকে। সারি সারি মৃত লাশ শেষে পড়ে থাকে। অসুখের ফল তার বিমর্ষতা নিয়ে, ফিরে আসে তোমার ঘরে, যুদ্ধের ময়দানে। ঘোড়ার আস্তাবলে অসংখ্য সংসপ্তকের ভিড়ে পড়ি শুয়ে যাবতীয় ঈর্ষা নিয়ে। কালও যাবে সে রোগীর পথ্য হয়ে। গাণ্ডীব ছুঁড়ে পেড়ে নেবে আরো ফল। অট্টহাসি ছুঁড়ে দেবে তোমাদের ক্রুতার দিকে।

***
ক্রুতাকে বলো ফিরে যাও, তীব্র অসুখের পাশে গোল হয়ে বসো। মনে আছে সেইসব আলখাল্লাধারীদের, যারা তোমাদের কানে তুলে দিয়েছিল নকল গান, গ্রামোফোন ও মেঘমল্লার। ভাঙা রেকর্ডের পাশে গোল হয়ে বসো, তোমার মনে পড়বে তামুরা কাফকা, জ্যাজ ও বৃষ্টির পূর্বাভাস। এসবের ভেতর কেটে কেটে সাজানো শরীর, তার কাছেই হাত পেতেছে গান। নকল মিউজিয়াম, ঘুরে ঘুরে দেখি। গ্রামোফোন, গান শোনাও আবার। নকল গানে বৃষ্টি নামাবে মিঁয়া তানসেন।

***
নকল গান, কতকাল বাজাবে বিভৎস রেকর্ডার? যেটুকু দূরত্ব, ভিড় করে আছে বিপন্ন ড্রামার।, থ্রোনজুড়ে কেবল কাঁটা আর কাঁটা। তার সুর ও লয়ে তামাম দুনিয়া। আটকে আছে এই ভোর, ভোরের আজান। কোথাও ফুটছে ফের ক্রিসেনথেমাম। আহত দিন, গড়িয়ে যাবে আরও কিছুদূর? সাক্ষী দিচ্ছে দুপুর, তোমার আহার।

***
সাক্ষী দুপুরের বিষণ্ণ রং। যার নিচেই ফুটছে ফুল, পৃথিবীর ফুল। আসো, তোমায় এবার ফুল দেখাব। তীব্র সুগন্ধের আড়ালে তুমি ফেলে যাবে যৌনজীবন। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব বসন্তের দিকে, একটি পথকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব বসন্তের দিকে। ছোটো ছোটো ফুল, ভুলবশত ফুটে আছে। তাদের বকে দাও, দাও নিশানা। তাক করে রাখ বন্দুক, এক দুই তিন- দ্রিম। ফুটো হয়ে গেল ফুলের জীবন, তোমার যৌনতাও। না, এইখানে কোন গান নেই, সুর নেই, শব্দও নেই। নৈঃশব্দ্য পেরুনোর আগেই প্রাণত্যাগ করেছিল সমস্ত বান্দিশ। তুমিও তাই শোনোনি কোন গান, অমরত্বের সুসংবাদও।

***
অমরত্বই তোমাদের গন্তব্য। সুসংবাদ ছাড়াই পৌঁছে যাবে কোন এক বিকেলে। সব বিকেলই গেছে নিঃসন্তান দম্পতির দিকে, তারা জানে না কোন গান । তুমি পৌঁছে যাও গানের মাস্টার। তাদের শেখাও সন্তান প্রসবকালীন গান, কেড়ে নাও অমরত্ব। দুপরের পরই যেটুকু ঘুম, সেটুকুই গান। খরগোশ দেখার ছলে তারা হারিয়ে ফেলেছিল সমস্ত যন্ত্রসংগীত, এমনকি পুরুষত্বও। তবুও অমরত্ব তোমাদের গন্তব্য, পেয়ারা বাগান দেখতে দেখতে সে পথ পাড়ি দেবে একদিন।

Facebook Comments

পছন্দের বই