লেখক নয় , লেখাই মূলধন

এক নিখোঁজ… অচিহ্নিত গণকবরের দেশ

আথার জিয়া:

আথার জিয়া। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ডক্টরেট, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি ফুলেরটন থেকে কমিউনিকেশন নিয়ে দু-দুটো মাস্টারস করে বর্তমানে নর্দান কলোরাডো গ্রেলি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে সহকারি প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। না, এটাই জিয়ার একমাত্র পরিচয় নয়। জিয়া একজন সাংবাদিক, লেখক, এবং সম্পাদকও বটে। সবচেয়ে বড়ো কথা জিয়া হল কাশ্মীর নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ গড়ে তোলবার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব… একটা নাম। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, ফিকশন, কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘দ্য ফ্রেম’-এর জন্য ইতিমধ্যেই আমেরিকার অ্যানথ্রোপলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে পুরস্কৃত করেছে। এক্ষেত্রে যে-কথাটা না বললেই নয়, সেটা হল জিয়া তাঁর নৃতাত্ত্বিক কবিতার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত কাশ্মীর বিষয়ক ডিজিটাল পত্রিকা ‘কাশ্মীর লিট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও কিন্তু জিয়া। ২০১৫-১৬-তে আমেরিকার অ্যানথ্রোপলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে হিউম্যানিস্টিক অ্যানথ্রোপলজি সোসাইটির বোর্ড মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত করেন। এবং ২০১৭-তে অ্যানথ্রোপলজি সংক্রান্ত খবরের জন্য ফেমেনিস্ট অ্যানথ্রোপলজি সেকশন অ্যাসোসিয়েশন বুক রিভিউ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করেন। ২০১১-তে ‘ক্রিটিক্যাল কাশ্মীর স্টাডিজ’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জিয়া এবং যাদের কাজ ছিল কাশ্মীর অঞ্চলে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত গবেষকদের মধ্যে একটা আন্তঃবিষয়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করা। আসলে জিয়া এতদিন কী কী করেছেন, কী কী করে চলেছেন সেটা বলে শেষ করাটা বড়ো মুশকিলের, তার চেয়ে কাশ্মীরের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে গবেষণার কাজে ঘুরে-বেড়াবার সুবাদে জিয়া যে-অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন আমরা বরং সে-সবই শুনি তাঁর মুখ থেকে।

গদ্যে:  সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

ধর্ষণ যখন সেনাদের অস্ত্র হয়ে ওঠে

নতুন বছরের ক্যালেন্ডার মানেই ভূস্বর্গ কাশ্মীরের সেই অসাধারণ সব ল্যান্ডস্কেপ। আর ছেলেবেলা থেকেই সেইসব ছবি মাথায় নিয়েই বড়ো হয় কাশ্মীরের বাইরের ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ। কাশ্মীরের মানুষের কাছে এটাই বোধহয় সবথেকে বড়ো প্রাপ্তি আবার পরিহাস যে, গত ৭০ বছর ধরে এ দেশের আম-আদমির কাছে কাশ্মীর শুধুই একটা ক্যালেন্ডার আর সংবিধানের একটা ধারা (৩৭০) হয়েই রয়ে গেছে। কিন্তু সত্যিকারের কাশ্মীরের ছবিটা একেবারেই এর উলটো। ২০০৫-র একটি সমীক্ষা থেকে আমরা জানতে পারছি বিশ্বের যে-সমস্ত সংঘাতময় অঞ্চল রয়েছে তার মধ্যে কাশ্মীরের নারীদের ওপরই যৌন নিপীড়নের হার সবচেয়ে বেশি। যে ৫১০জনের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়েছিল তার মধ্যে ১১.৬ শতাংশের অভিজ্ঞতাই ভয়ংকর। সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে চেচনিয়া, সিয়েরা লিওন, শ্রীলঙ্কার মতো সংঘাতের শিকার হওয়া অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কাশ্মীরে ধর্ষণের সাক্ষীর সংখ্যা অনেক বেশি। সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের ১৩ শতাংশ বলেছেন, ১৯৮৯-র পর ধর্ষণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এবং ৮৯’ সাল থেকে যাঁরা ধর্ষণের কথা শুনেছেন তাদের অনুপাত ৬৩ শতাংশ। পাঁচজনের বেশি ধর্ষণের ঘটনা শুনেছেন এমন উত্তরদাতার অনুপাত ৫৯.৯ শতাংশ। যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ধর্ষণের ৫টিরও বেশি ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তাঁদের অনুপাত ৫.১ শতাংশ।

মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ১৯৯২ সালেই ভারতীয় সেনা ৮৮২জন কাশ্মীরি নারীকে গণধর্ষণ করেছিল। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক এ্যডুকেশনাল ডেভলেপমেন্ট ২০০-রও বেশি ওয়ার রেপের মামলা নথিভুক্ত করে। তবে লজ্জা এবং কলঙ্কের কারণে কাশ্মীরের অনেক ধর্ষণের ঘটনাই সামনে আসে না। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছেন যে, সেনাবাহিনীর মেজর বা তার থেকে উচ্চপদ মর্যাদার ১৫০-রও বেশি অফিসার যৌন নির্যাতন ও অত্যাচারের সঙ্গে যুক্ত। ভারত সরকার এ-সব জানা সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ২০১৬ সালে কাশ্মীরের মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবি পারভেজ ইমরোজ জানিয়েছিলেন, কাশ্মীরে সেনা দ্বারা যৌন হয়রানির ঘটনার মামলা দায়ের করাই যায় না। যে-সমস্ত এলাকায় জঙ্গিবাহিনীর কার্যকলাপ বেশি সে-সব জায়গায় ধর্ষণের ঘটনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ভারতীয় সেনা দ্বারা ধর্ষণের প্রকৃত কিছু ঘটনা এবার তুলে ধরা যাক। ১৯৯০-র ২৬ জুন জামির কোয়াডেমে তল্লাশির সময় বি.এস.এফ ২৪ বছরের এক নারীকে ধর্ষণ করে এবং পরের মাসে সোপোরের পুলিশ বি.এস.এফ-এর বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণের মামলা দায়ের করে। ১৯৯০-র ৭ মার্চ শ্রীনগরের চানপোরা এলাকায় সি.আর.পি.এফ তল্লাশি অভিযান চালাবার সময় বেশ কিছু সংখ্যক মহিলাকে ধর্ষণ করে। আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলবার জন্য ‘কমিটি ফর ইনিশিয়েটিভ ইন কাশ্মীর’-এর পক্ষ থেকে একটি দল ১২ থেকে ১৬ মার্চ সেখানে সার্ভে চালায়। সেই রিপোর্ট থেকেই আমরা জানতে পারি ২৪ বছরের নোরা এবং জাইনার কথা, ২০জন জোয়ান তাদের টেনে-হিঁচড়ে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। সেই ঘটনার সাক্ষী আরও দু-জন কম বয়সী কিশোরীর শ্লীলতাহানি করে জোয়ানেরা। ১৯৯১-র ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি কুপয়ারা জেলার কুনান ও পোসপোরা গ্রাম দু-টিতে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে ভারতীয় সেনার ৪র্থ রাজস্থান রাইফেল ব্যাটেলিয়ন পর পর দু-দিন ধরে গণধর্ষণ চালায়। অনুমান করা হয় ধর্ষিতদের সেই সংখ্যাটা ছিল ২৩ থেকে ১০০-র মধ্যে। উপত্যকা জুড়ে বিক্ষোভের কারণে ঘটনার দু-সপ্তাহ পর জেলা শাসকের একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে একটি এফআইআর হয়েছিল। ১৯৯১-র ২০ আগস্ট কুনান-পাসপোরার কয়েক কি.মি. দূরে পাজিপোরা-বালিপোরাতে একইভাবে সেনা দ্বারা ধর্ষিত হয়। সেই সংখ্যাটা ছিল ৮ থেকে ১৫ বা তার বেশি। ১৯৯২-র ১০ অক্টোবর ২২ গ্রেনাডিয়ার্সের একটি সেনা ইউনিট সাইদাপোড়া গ্রামে প্রবেশ করে, সেই ইউনিটের বেশ কিছু সেনা সেদিন ৬ থেকে ৯জন মহিলাকে ধর্ষণ করে, যাদের মধ্যে একজনের বয়স ছিল ১১ এবং একজন ছিলেন ৬০ বছরের এক বৃদ্ধা। ১৯৯২ সালে হারান ও গুরিহাখার আরও দু-টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ১৯৯৩-এ বীজবেহারা গণহত্যার আগে সেখানে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির একটা বড়ো ঘটনা ঘটেছিল। এবং পরে আগস্টে জঙ্গিদের আক্রমণের প্রতিশোধ নেবার জন্য বীজবেহারা শহরের উপকণ্ঠে গাধাঙ্গিপোরায় সেনারা এক মহিলাকে ধর্ষণ করে। ৯৪’র ১৭ জুন হাইহামা গ্রামে রাষ্ট্রীয় রাইফেলের একটি দল ৭জন মহিলাকে ধর্ষণ করে। সেই ধর্ষণের সঙ্গে মেজর রমেশ ও রাজকুমার নামে দু-জন অফিসারও যুক্ত ছিলেন।

সারা কাশ্মীর জুড়ে সেনা দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা এমন কোনো বছর নেই যে ঘটেনি। কোথাও ১২ বছরের কিশোরী ধর্ষিত হয়েছে তো কোথাও ১২জন কাশ্মীরি বালিকা ধর্ষিত হয়েছে। কোথাও আবার মা-মেয়ে দু-জনকেই ধর্ষণ করেছে সেনারা। অথবা মায়ের সামনে ৪ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে সেনারা। এমনও হয়েছে ৫০ বছরের মহিলাকে ধর্ষণের সময় শোনানো হয়েছে, যেহেতু সে মুসলিম তার সাথে এমনটাই ঘটবে, এবং এটাই স্বাভাবিক। কখনো আবার তল্লাশির নামে সেনা ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়েও ৪-৫ ঘণ্টা ধরে তার ওপর যৌন নিপীড়ন চালানো হয়েছে। রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েও ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে সেনারা। এই সমস্ত ঘটনাই আপনারা আর্কাইভের পাতা ওলটালে পেয়ে যাবেন। কিন্তু আর্কাইভের পাতার বাইরেও একটা বিশাল আন-রেজিস্টার্ড কাশ্মীর রয়ে গেছে, যাদের ধর্ষিত হবার খবর সরকারি কোনো দস্তাবেজে নথিভুক্ত নেই, এমনকী কোনো সংবাদপত্রের পাতাতেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বছরের পর বছর ধরে সেগুলো হয়তো কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রামে চড়াই-উৎড়াইয়ের মাঝে বরফে চাপা রয়ে যাবে। রয়ে যাবে হয়তো রান্নাঘরের উনুনের পাশে জমাট গোঙানির শব্দ হয়ে, রয়ে যাবে হয়তো রক্তাক্ত জামা-কাপড়ের মধ্যে জট পাকিয়ে আলমারির এক কোণে, রয়ে যাবে হয়তো মেঝের সেই কার্পেটের মধ্যে, যে-সমস্ত পায়ের শব্দ চেনে, বিশেষত সেনাদের ভারী বুট। রয়ে যাবে হয়তো সেই আর্তনাদ… যে-শব্দে বাড়ির পোষা ভেড়ার পালও চমকে উঠেছিল… চমকে উঠেছিল রাস্তার কুকুরগুলো।

গবেষণার কাজে সার্ভের সময় কাশ্মীরের গ্রাম-গঞ্জের অলিগলিতে ঘুরতে গিয়ে তাদের অনেকের সাথেই দেখা হয়েছিল আমার। কেউ-বা মুখ বন্ধ করে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন… ডাকলেও শুনতে পান না, একেবারে যেন বোবাকালা। কেউ আবার মেনে নিয়েছেন সব কিছু, কোনো কিছু আর মনেই করতে চান না। কেউ কেউ ঘটনার পর থেকে অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেছেন। কারো মা আবার সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ হাত চেপে ধরে বলেছেন আমি যাতে পাঁচকান না করি। কারণ, সমাজ সব কিছু জানা সত্ত্বেও মনে করে ধর্ষণ বিষয়টি অসম্মানের এবং একজন ধর্ষিতাকেও সকলে অসম্মানের চোখেই দেখে। কাশ্মীরের সমাজ যেহেতু রক্ষণশীল সেহেতু তারা ধর্ষিতাদের ওপরই দোষ চাপায় এবং মানসিক সমস্যা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এই ধারণা পোষণ করে যে, তাদের সমাজ অসম্মানিত হয়েছে ও সেই নারী তার পবিত্রতা হারিয়েছে। তাছাড়া ধর্ষণের ঘটনার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ, এমনকী পরিবার ভেঙে পর্যন্ত যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। যেমন ২০০৪ সালে ভারতীয় সেনা হামিদা নামে এক ১৬ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করার পর তার পরিবার তাকে বহিস্কার করে সমাজের কারণে। তার বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে যায়। বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরতে ঘুরতে একটা বিষয় নজরে এসেছে যে-সমস্ত অঞ্চলের ধর্ষণের ঘটনাগুলো জনসমক্ষে এসেছে সে-সমস্ত জায়গায় বিবাহ সংক্রান্ত খোজ খবর না হবার সামাজিক প্রবণতা রয়েছে। কুনান ও পোসপোরা গ্রামে সেনা দ্বারা ধর্ষণ হবার পর পুরুষেরা তাদের স্ত্রীদের ত্যাগ করার ঘটনাও ঘটেছিল। জঙ্গীদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে তাদের কেউ কেউ আবার স্ত্রীদের ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বটে তবে তাদের ওপর যথেষ্ট নির্যাতন চালাতেন। একজন ধর্ষিতা জানিয়েছিলেন, তার স্বামী তাঁকে অপবিত্র মনে করেন এবং এখনও দায়ী করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের সঙ্গেও তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। যে-মেয়েরা ধর্ষিত হয়নি অথচ ধর্ষিতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে তাদেরকেও সমাজ অন্য চোখে দেখে। আর এইসব কারণের জন্যই ধর্ষণের ঘটনা যাতে চার কান না হয় সেটাই চেষ্টা করেন কাশ্মীরের আক্রান্তদের পরিবার-পরিজনরা। আর ভারতীয় সেনারাও এটা খুব ভালো করে জানে যে, তারা যাই করুক না কেন তার খবর প্রকাশ্যে আসবে না। কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে যে-কথাটা বারবার মনে হয়েছে কাশ্মীরের মা-বোনেরা কতটা আগুন বুকে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে যাপন করছে। একদিকে নিজের পরিবার, সমাজের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান, অন্যদিকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান। মানুষগুলো কি কোনোদিনও বিচার পাবে না?

বিচার! সেও তো প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে ১৯৯৪ সালে ভারত সরকার ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত কিছু সেনাকে কোর্ট-মার্শাল করেছিল। সেরকমই একটি মামলায় ১৯৯৪-র ২৯ জুলাই এক বালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে ২ সেনাকে ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। কিন্তু এ তো শুধু একটা উদাহরণ মাত্র, আদতে কর্তৃপক্ষ অন্য সব নথিভুক্ত ধর্ষণ মামলার অপরাধীদের বিচার করতেই চায় না। এ ছাড়া তথ্য ঘাটলেই যেটা উঠে আসে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সবচেয়ে কম তদন্ত হয়েছে ধর্ষণের ক্ষেত্রে। সবথেকে বড়ো বিষয় ভারত সরকার সেনা ধর্ষণের ঘটনা স্বীকারই করতে চায় না। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হল নিউইয়র্ক টাইম-এ প্রকাশ হয় ১৯৯১-র ফেব্রুয়ারিতে কুনান-পোসপোরায় যে-গণধর্ষণ হয়েছিল, সে-বিষয়ে বিবৃতি দিতে গিয়ে ভারত সরকার বলেছিল সেখানে কোনো যৌন নির্যাতনই হয়নি। তাছাড়া ধর্ষণ প্রমাণ করা পদ্ধতিগতভাবে কঠিন, যেহেতু ঘটনাগুলো পুরোপুরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলিতে ঘটে। ধর্ষণের মামলা দায়ের করতে কাশ্মীরে নারীরা ভয় পান কারণ, সেনাবাহিনীর পালটা প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা কম-বেশি অনেকের জীবনকেই তছনছ করে দিয়েছে। হয় সেই পরিবারগুলোর অন্য সদস্যদের সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়েছে অথবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

বিচার প্রসঙ্গটা যখন উঠলই তখন যে-কথাটা না বললেই নয় সেটা হল কাশ্মীরের মানুষ কোনোদিনই প্রকৃত বিচার পাবে না, আর এই না-পাওয়ার পেছনের কারণ ভারত সরকারের তৈরি করা আইন আফস্পা। যে-আইনের ক্ষমতা বলে ১৯৯০-র জুলাই থেকে কাশ্মীরে সামরিক বাহিনী এক বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। আর সে-ক্ষমতা হল মানুষকে বিভিন্নভাবে অত্যাচার করবার অধিকার, হত্যা করার অধিকার, প্রমাণ লোপাটের অধিকার। আর এই আইনই এখন সামরিক বাহিনীর রক্ষাকবজ। আপনি, আমি ইচ্ছা করলেই এখন কোনো ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারব না। তার জন্য সরকারের কাছ থেকে আমাদের অনুমতি নিতে হবে। আর সরকার কখনোই অনুমতি দেবে না। আফস্পার কারণে কাশ্মীরের স্থানীয় বিচার-বিভাগ একেবারেই ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। সবথেকে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, আমরা যখন দেখি জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য দেশ গণ-ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী এই ধরনের অপরাধের জন্য ভারতকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বদলে বছরের পর বছর ধরে ছাড়পত্র দিয়ে চলেছে, বা মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে তখন ভাবি মানুষগুলো কার কাছে যাবে বিচার চাইতে? এত এত আইন তবে তৈরি হয়েছে কীসের জন্য? সবই কি তবে ভাঁওতা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাশ্মীরি নারীদের অসহায় মুখগুলো। তাদের জিজ্ঞাসাগুলো… “আমরা কি কোনোদিনও তবে বিচার পাব না?” মনে পড়ে যায়। ওদেরই মিলিত ভাবনার কথা। “জানেন মাঝে মাঝে মনে হয় সারা শরীরে বোমা বেঁধে ওদের সেনা চৌকিতে ঢুকে পড়ি, তারপর একটা শব্দে সব তছনছ করে দিই, এই অপবিত্র শরীরটাকে পবিত্র করার এ ছাড়া আর উপায় কী বলুন”। আজকাল কথাগুলো প্রায়ই মাথার ভেতর অনুরণনিত হয়… আর মনে হয়, আচ্ছা কাশ্মীরের নারীরা যদি বিচার পাবার জন্য সে-পথই অবলম্বন করেন তখন নিশ্চয়ই ভারত সরকার আবার সন্ত্রাসবাদের, রাষ্ট্রবাদের নতুন কোনো সংজ্ঞা আবিষ্কার করবে। কিন্তু প্রকৃত সত্য সেই অন্ধকারেই থেকে যাবে।

ফিরিয়ে দাও আমাদের নিখোঁজ সন্তানদের

আমার একটা কবিতার নাম ‘দরজা’। আর সে-কবিতাটি সৃষ্টি হবার পেছনের অন্যতম চরিত্র হলেন একজন কাশ্মীরি নারী, একজন মা, যে-মাসের পর মাস, বছরের পর বছর হিমালয়ের প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেও বাড়ির দরজা খোলা রেখে দিতেন। আমি প্রথমবার যখন তার সঙ্গে দেখা করতে যাই, তিনি আমাকে বাইরের দরজাটা বন্ধ না-করার জন্য বলেছিলেন, আমি ভেবেছিলাম অন্য কোনো অতিথি আসবেন বলে তিনি বোধহয় অপেক্ষা করছেন, কিন্তু আমি যতক্ষণ ছিলাম কেউ আসেননি। পরবর্তীতে আমি যতবার গেছি তিনি আমাকে ওই একই কথা বলেছেন, “দরজাটা বন্ধ করবেন না”। অবশেষে একদিন আমার কৌতূহলের নিষ্পত্তি ঘটাতে আমি তাকে জিজ্ঞাসাই করে বসি কেন তিনি আমাকে দরজাটা খোলা রাখতে বলেন? সেদিনই প্রথম জানতে পারি তিনি আসলে তাঁর নিখোঁজ ছেলের ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তার বিশ্বাস দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলে তার ছেলে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কাশ্মীরের হাজার হাজার খোলা দরজা, হাজার হাজার মা, স্ত্রী বছরের পর বছর ধরে এভাবেই অপেক্ষায় দিন গোনেন।

১৯৮৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কাশ্মীরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে জোরপূর্বক সেনাদের তুলে নিয়ে যাওয়া সেইসব নিখোঁজ তরুণ ও যুবকদের সংখ্যাটা ৮০০০ থেকে ১০০০০। আশ্চর্যের বিষয় হল এই দেশের মধ্যেই একটা রাজ্য কাশ্মীর যেখানে নিখোঁজ সন্তানের জন্য, স্বামীদের জন্য, পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের খুঁজে পাবার জন্য তাদের মায়েরা, স্ত্রীরা, সকলে মিলে আস্ত একটা সংগঠনই তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। যে-সংগঠনের নাম ‘দি অ্যাসোসিয়েশন অফ পেরেন্টস অফ ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পারসন’। পারভিনা আহাঙ্গার এবং আরও কয়েকজন মা-কে সঙ্গে নিয়ে যে-সংগঠনটি তৈরি করেছিলেন আইনজীবী পারভেজ ইমরোজ। পারভিনা আহাঙ্গারের লড়াইটা শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের ১৮ আগস্ট রাতের পর থেকে। সেই দুর্ভাগ্যজনক রাতে তার ছেলে ১৭ বছরের জাভেদ আহমদ আহাঙ্গারকে শ্রীনগর শহরের বাটমালু এলাকার বোদিপুরায় তার কাকার বাড়ি থেকে মধ্যরাতের অভিযানের সময় জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার করে। পরদিন সকালে নামাজের সময় ছেলের গ্রেফতারির বিষয়ে জানতে পারে পারভিনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে সে জানতে পারে ছেলেদের সনাক্ত করার জন্য একটা প্যারেড হয়েছিল বটে তাতে জাভেদের কাকাতো ভাই মুক্তি পেয়েছিল কিন্তু জাভেদকে সেনাবাহিনীর গাড়িতেই আটকে রাখা হয়েছিল। পরদিন পারভিন স্থানীয় থানায় মিসিং ডায়েরি দায়ের করে। এবং সারাদিন ধরে রাস্তায় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিলেন। পুলিশ তখন তাকে আশ্বাস দেয় তারা জাভেদকে ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ৯ দিন পর পুলিশ জানায় তাদের হাতে কিছুই নেই। এরপর পারভিনা থানার সামনে এমনই বিক্ষোভ শুরু করেন যে তৎকালীন সিনিয়র সুপারিনটেন্ডেন্ট বিষয়টির প্রতি নজর দিতে বাধ্য হন। এবং তিনি বলেন জাভেদ শ্রীনগরের সেনা হাসপাতাল বি.বি. ক্যান্টনমেন্টে রয়েছে। সেই সঙ্গে হাসপাতালে ঢোকবার পাশও দিয়ে দেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছলে সেনাকর্তারা পারভিনাকে এমন একজনের কাছে নিয়ে যায় যে, সে মোটেই তার ছেলে জাভেদ ছিল না। পুলিশ ও সেনাদের মিথ্যাচারে ক্লান্ত হয়ে ৬ মাস পর অবশেষে আদালতের দ্বারস্থ হন পারভিনা এবং আদালত পুলিশি তদন্তের নির্দেশ দিতে দু-বছর সময় নেয়। পুলিশ একটি তদন্ত রিপোর্ট পেশ করে যাতে তিন উচ্চপদস্থ সেনাকর্তা ক্যাপ্টেন কাটোচ, ক্যাপ্টেন দানিজ, ও মেজর গুপ্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এমনকী আদালতও তিন সেনাকর্তাকে তলব করে কিন্তু তারা বিচারকের সামনে হাজির হন না, পরিবর্তে তাদের পক্ষে উপস্থিত হওয়া আরেক সেনাকর্তা পারভিনাকে ১০ লক্ষ টাকা অফার করেন মামলাটাকে সরিয়ে নেবার জন্য। তদন্তে দোষীদের চিহ্নিত করা হলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। এবং পারভিনাকে বলা হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক যতক্ষণ না মামলাটি অনুমোদন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সেনাকর্তার বিরুদ্ধে সিভিল কোর্টে মামলা করা যাবে না। কিন্তু প্রায় ৪ বছর পারভিনার ছোটাছুটির পরেও কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো অনুমতি দেয়নি। তারপরেও ২৯ বছর পেরিয়ে গেছে পারভিনার লড়াই আজও জারি রয়েছে। তবে পারভিনা শুধু একা নয়। ৯০’র শুরুতে জোরপূর্বক নিখোঁজদের সংখ্যাটা এমন একটা উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে, সে-সময় কয়েকশো মানুষকে তাদের নিখোঁজ হওয়া প্রিয়জনদের খোঁজে বিভিন্ন থানা এবং সেনা অফিসের দোরে দোরে হত্যে দিতে হত। আর সেই সূত্রেই একে-অন্যের সঙ্গে পরিচয়, একে-অন্যের পাশে দাঁড়ান, হেবিয়াস কর্পাস পিটিশনের জন্য একে-অপরকে সাহায্য এবং অবশেষে ১৯৯৪ সালে আইনজীবী ও ‘জম্মু এন্ড কাশ্মীর কোয়ালিশন অফ সিভিল সোসাইটি’-র প্রতিষ্ঠাতা পারভেজ ইমরোজের সহায়তায় ‘দি অ্যাসোসিয়েশন অফ পেরেন্টস অফ ডিঅ্যাপিয়ার্ড পারসেনস’ (এপিডিপি)-র জন্ম। ধীরে ধীরে কাশ্মীরের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এপিডিপি-র কার্যক্রম সম্পর্কে ওয়াকিবহল হয় এবং সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে। হান্ডাওয়ারা, কুপওয়ারা, বন্দিপোড়া, বারমুল্লা, এবং অনন্তনাগের মানুষও যুক্ত হয় ফলে সংগঠন বড়ো হতে থাকে। এপিডিপি-র শুরুটা হয়েছিল পারভিনার রান্নাঘরে, সেখানেই সকলে মিলিত হয়ে আলোচনা করত। শুরুতে তারা হাইকোর্টের গেটের সামনে মিছিল নিয়ে যেত এবং রাস্তার পাশে বসে নিজেদের ছেলের ছবি সামনে রেখে জানতে চাইত, ‘তারা কোথায়?’

শুরু থেকেই অবশ্য এপিডিপি-র কাজকর্মকে সরকার ভালো চোখে নেয়নি। প্রথমদিকে বিক্ষোভগুলো পুলিশ লক্ষ করত। তারপর চাপ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে মারধর, শেষে আদালতের গেট থেকে টেনে হিঁচড়ে জেলে পর্যন্ত পাঠাত। ১৯৯৬ সালে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এপিডিপি-র অফিস ভেঙে দেয়। পারভিনাও কিছুদিনের জন্য কাশ্মীর ছেড়ে দিল্লী, কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছু করেই দমানো যায়নি পারভিনাকে, থামানো যায়নি এপিডিপি-র কাজকর্মকে। জন্ম থেকেই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুঁজে চলেছে সংগঠন। সেই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে, তথ্য প্রচার করছে। হারিয়ে যাওয়া মানুষদের আত্মীয় পরিজনদের আইনি সহায়তা করছে, হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন তৈরি করে দিচ্ছে। সকলকে সচেতন করতে ম্যানুয়াল বানিয়েছে। তাতে বলা আছে কেউ নিখোঁজ হয়ে গেলে কী কী করতে হবে। তথ্য দেওয়া-নেওয়ার জন্য এপিডিপি নিয়মিত মিটিং করে। এপিডিপি-র সবচেয়ে বড়ো কাজ হল সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা। এবং কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে-ঘটনা দিনের পর দিন ঘটিয়ে চলেছে তা আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরা। কাশ্মীরে আফস্পার মতো যে-সমস্ত অমানবিক আইন চালু রয়েছে সেগুলো বাতিলের জন্যও এপিডিপি নিয়মিত প্রচার চালিয়ে যায়।

এপিডিপি-র কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি সেনারা কাউকে তুলে নিয়ে গেলে পরিবারের লোকজনদের একটা জেল থেকে আরেকটা জেলে খোঁজ করে বেড়াতে হয়। কারণ, কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করে পরিবারের লোকজনদের হয়রানি করায়। আর সে-কারণেই কাশ্মীরের মানুষের আর সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা নেই। এমনকী বিচার ব্যবস্থার ওপরও নয়। এপিডিপি-র কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি, অচিহ্নিত গণকবরের কথা। সেনাবাহিনী গ্রামবাসীদের কাছে মৃতদেহ ফেলে যায় কবর দেবার জন্য, সন্ত্রাসবাদী বলে মিথ্যে নাম বলে যায়। গ্রামবাসীরা নিজের মতো করে পরিচয় তৈরি করে, কাঠের গায়ে লিখে টাঙিয়ে দেয়। কাশ্মীরে এরকম অচিহ্নিত গণকবরের সংখ্যা ৭০০০-এরও বেশি। ২০১১ সালে কাশ্মীরের রাজ্য মানবাধিকার কমিশন উত্তর কাশ্মীরের তিনটি জেলায় ২১৫৬টি অচিহ্নিত গণকবরের কথা স্বীকার করে। একইভাবে পুঞ্জ ও রাজৌরি জেলার ৩৮৪৪টি অচিহ্নিত গণকবরের কথাও সামনে আসে। সে-সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ পর্যন্ত বলেছিলেন কোন কবর কোন পরিবারের কোন আত্মীয়র সেটা নির্দিষ্ট করবার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে ২০১২-র ১৩ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীর সরকার রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের ডি.এন.এ. পরীক্ষা-সহ অন্যান্য সুপারিশগুলো মেনে নিতে অস্বীকার করে। ২০১৫-র ২৬ মার্চ এপিডিপি নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কিছু দাবি পেশ করেন, আজ পর্যন্ত সে-সব বিষয়ে সরকারকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এমনকী সরকার নিখোঁজদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্মারকও বানাতে দেয়নি। এপিডিপি-র উদ্যোগে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপণ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ তা ভেঙে দেয়।

কিন্তু এত কিছুর পরও প্রতি মাসের ২৫ তারিখ এপিডিপি-র নেতৃত্বে নিখোঁজদের মা-বাবা বা অন্য আত্মীয়রা নিখোঁজদের ছবি বুকে ঝুলিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্র প্রতাপ পার্কে জড়ো হন… প্রতিবাদ জানান। প্রতিবছর নিখোঁজদের ছবি দিয়ে তারা ক্যালেন্ডার বের করেন। ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক নিখোঁজকরণ দিবস পালন করে। নিখোঁজ হওয়া সন্তানদের ছবি ব্যাজ বানিয়ে বুকে পরে। ধর্ণা দেয়। সরকারের কাছে প্রশ্ন তোলে, দাবি জানায়, “তোমরা আমাদের সন্তানদের মৃত অথবা জীবিত কোথায় রেখেছ উত্তর দাও? তোমরা কি অস্বীকার করতে পারো তাদের নিখোঁজ হবার জন্য তোমরা দায়ী নও? আমরা জবাব চাই… জবাব দাও”। গত ২৯ বছর ধরে পারভিনারা একই প্রশ্ন করে চলেছে সরকারকে। এতটুকু ক্লান্ত হয়নি তারা। তারা প্রত্যেকে বিশ্বাস করে একদিন না একদিন তাদের সন্তান ঘরে ফিরবেই। সে-জন্যই তারা বলতে পারে, “আমি আমার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সন্তানের জন্য অপেক্ষা করব। একমাত্র মৃত্যুই থামাতে পারে আমার লড়াই”। সে-জন্যই প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেও আমরা দেখি হাট করে খুলে রাখা অসংখ্য দরজা… ‘খোলা দরজা’। আমরা দেখি অসংখ্য মানুষের ‘অপেক্ষা’ আর ‘অপেক্ষা’।

আথার জিয়ার কবিতা

ভাষান্তর: সোহেল ইসলাম

দেশভাগ


কাশ্মীরে আগস্ট মানেই
অবরোধ… হামলা…
গেরুয়ায় মোড়া ভারত
পাকিস্তান সবুজে ঢাকা

আর কাশ্মীর
বরাবরের মতো
তার বুড়ো, জোয়ান, যারা জন্মায়নি এখনও
তাদের রক্তে ভিজে

লাল


দেশভাগ
হাতে তুলে নেওয়া পাথর বদলে গেছে

কাশ্মীরে
প্রতিদিনকার খুন
অন্ধ হয়ে যাওয়া মুখগুলোই যেন দেশভাগের প্রত্যুত্তর
এখানে
মায়েরা নিখোঁজ সন্তানের অপেক্ষায় বেঁচে আছেন
বাবারা বেঁচে আছেন
দফনের কোদাল হাতে

প্রতিটা কবর বুকে লিখে নিয়ে জেগে আছে

আজাদি আজাদি আজাদি


রক্তে চপচপে যে-কাপড়গুলো শুকোয়
দিল্লি ও লাহোরে
লালচকে সেগুলোই কাশ্মীরি শাল হিসেবে বিকোয়

কাশ্মীর নামের কসাইখানার হুকে
উপড়ানো চোখ
দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা একটুখানি জিভ নিয়ে
মৃত হরিণের মতো ঝুলে রয়েছে
আজাদি চাওয়া মানুষগুলো

দুটো ক্ষুধার্ত জাতির খিদে মেটাবে বলে


ভাঙা নর্দমা পেরিয়ে ঘরে ফিরেছি
সংঘর্ষ, বুলেটের খোল, বুড়ো হাড় ডিঙিয়ে
ঘরে ফেরা

মেয়েটা আগলে রেখেছে বাগান
আগলে রেখেছে গ্রেনেড ঝলসানো গোলাপগুচ্ছ
আর বাকিটা নষ্ট করেছে শীত

কাঁদানে গ্যাসে লাল চোখ
তবুও সে বিদায় বলেনি

কাশ্মীরের প্রেমিক-প্রেমিকারাও আজ সন্দেহের আওতায়
যেহেতু তারা চেয়েছে… আজাদি

শুক্রবারের কাশ্মীর

প্রতি শুক্রবারই কাশ্মীরে আজাদির দিন
অন্যান্য দিনগুলোও তাই

ঝিলম জংধরা উদ্দেশ্যহীন তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা
ঠিক তার পাশেই
ঘোলাটে এক দেওয়ালকে আঁকড়ে ধরে
লোহার দরজারা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে
আর উপরের আকাশ তো
তারার আলোয় ঠাসাঠাসি

যে-দেওয়ালটা
প্রতি শুক্রবারের সাক্ষী
ইতিহাসের অনেক কথা শরীরে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতদিন
বলতে গেলে আজ সে প্রায় অক্ষরহীন

কাশ্মীরের মায়েরা সন্তানের তাজা রক্তে মাখামাখি
বাবারা একদম গুম মেরে গেছে
আর পুরোনো ফিসফিসানিগুলো
এবার গজগজ করে উঠে
আকাশের দিকে হাত মুঠো করে চাইছে―

আজাদি আজাদি আজাদি

কাশ্মীরে
প্রতিটা শুক্রবার বাঙ্কারে কাটে কত কার
অথবা শহরের এখানে ওখানে পালিয়ে লুকিয়ে

কাশ্মীরে শুক্রবার মানেই
না শেষ হতে চাওয়া ভালোবাসা নিয়ে
খোলা দরজার সামনে অপেক্ষা
আর ইতিহাসের প্রাচীন দেওয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা―

আজাদি আজাদি আজাদি

শুক্রবারের পরের দিন
কালো রঙের বালতি হাতে হাজির
কারো কারো হাতে সাদা রঙের বালতি
নিশ্চয় কাশ্মীর তার দেওয়াল ছেড়ে দেবে
প্রতিবাদের ধ্বনি লেখার জন্য
যাদের দরজা খোলা বন্ধেও বিরক্তি নেই
যাদের উঠোনে উন্মাদ দেশ প্রেমিকের অবাধ প্রবেশ
যাদের আঙুল জুড়ে
সস্তা সিগারেটের পোড়া দাগ
তারা তো চাইবেই আজাদি

প্রতি শুক্রবার জানে
সে তো নদীর মতন
শেষ বলে কিছু নেই
আগেও ছিল
এরপরেও সে শুক্রবারই থাকবে
এবং কাশ্মীরের জন্য ফিরিয়ে আনবে―

আজাদি আজাদি আজাদি

দরজা

খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, ফিসফিসিয়ে নিজেকেই বলল মেয়েটা
ডানদিকের মাদুরের উপরে
নিকেলের প্লেট, তামার বাটি
সাজিয়ে রাখা
তাতে ধবধবে সাদা ভাত
আর সবজির ঝোল
এ যেন তার ভুবনজোড়া সুখ

রাস্তা দিয়ে কারা যেন বলতে বলতে চলে গেল―
“খুন কা বদলা খুন সে লেঙ্গে”
মেয়েটার বুক কেঁপে ওঠে
তার কিছুদিন পর থেকেই লালচক
খুনে লাল
জানলা বন্ধ করতে গিয়ে
ঝনঝন করে কেঁপে ওঠে পাল্লা
এক মুহূর্তের জন্য হলেও
সে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চায়
দিনের আলোর থেকে
মানুষের প্রতিশোধের স্লোগান থেকে

গ্রিজ, কালিঝুলি আর দুঃখের ছাপ নিয়ে
বাড়ি ফেরা লোকটার মুখ দেখবে বলে
দাওয়ায় বসে
প্রতিদিনকার অপেক্ষা তার
সে কোনোভাবেই মনে করতে চায় না
কারা ট্রিগারে হাত রেখে
এই শীতের রাতেও মিশন সফল করতে ওঁত পেতে বসে আছে

বুকটা আবার কেঁপে ওঠে তার
যানবাহন ছুটে যাওয়ার মতো দ্রুত হতে থাকে স্পন্দন
মনে পড়ে যায়―
সেই কবে
ভারতের মানচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে
দাদুর সঙ্গে তোলা ছবি
আজ সব অতীত
এখন তো শুধুই গ্যারেজের ক্যাচ ক্যাচ শব্দ
আর দিনদিন বেড়ে চলা দারিদ্র্যতা

বন্ধ জানলার পাল্লায় কান রাখে মেয়েটা
আবার কারা যেন বলতে বলতে আসছে―
“খুন কা বদলা খুন”
লালচক আবার লাল হবে
তার আর ভালো লাগে না
শিশিরের মতো রাগের ঝরে পড়া ভালো লাগে না
বুকটা কেমন করে ওঠে আবার
চোখ ঘোলা হয়ে আসে কান্নায়
মুছে রাখা
কেরোসিনের স্টোভটাকেই মুছতে লাগে আবার
ফিসফিস করে ওঠে―
কোথায় লোকটা?
খাবারগুলো যে ঠান্ডা হয়ে এল

চোখের জল মুছতে মুছতে দরজা খুলতে গিয়ে
ধাক্কা খায়
মুখ থুবড়ে পড়ে অন্ধকারে
আগুনের মতো হু হু করে ওঠে ভেতরটা
রাস্তা ফুঁড়ে ছুটে আসছে কুকুরের কান্না
বাবার ঘর থেকে শোক
মায়ের ঘরে প্রার্থনার সুর
লোকটার যে আজ বাইরে যাওয়ার নিষেধ ছিল
খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে আসছে
সে নেই
দুনিয়ার কোত্থাও নেই
কিন্তু সে আসবে
তাকে যে আসতেই হবে
বাড়িতে ভাত বেড়ে বসে আছে সবাই

Facebook Comments

পছন্দের বই