লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

এই ২০২০ খৃস্টাব্দে বাংলা উপন্যাস লেখার ব্যাপারে দু-চারটে কথা

আমাদের এখানেই ভাবুন না, যদি সত্যজিৎ রায় শুধু লেখক হিসাবে থাকতেন, সিনেমা না বানাতেন, তিনি অস্কারের বদলে নোবেলটাই পেতেন। ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের ক্ষেত্রেও একই কথা। একই কথা তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, রাজেন তরফদারের ক্ষেত্রেও। ঋতুপর্ণ ঘোষ একজন খুবই বড়ো লেখক হতে পারতেন, আমার বিশ্বাস, যদি চাইতেন, এবং এই সাধনাতেই থাকতেন। আজও টালিগঞ্জে যে-পরিচালকরা সিনেমা বানাচ্ছেন, আজ থেকে ৭০ বছর আগে হলে তাঁরাই বাজারচলতি বাজারফাটানো উপন্যাসগুলো লিখতেন, যেমন একদা বিমল মিত্র লিখেছেন। বলা বাহুল্য, এঁদের শক্তি আজকের পুজো সংখ্যার উপন্যাস লেখকদের চেয়ে ঢের বেশি, সে যতই তাঁরা টুকলি-সিনেমা বানান, চমকসর্বস্ব হন। এঁরা উপন্যাসের লাইনে থাকলে, আমি লাইন শব্দটাই বলছি এখানে, পুজো সংখ্যার বাজারটা এঁরাই শাসন করতেন। আবার, আজ যদি জন্মাতেন, বিমল মিত্র বা গজেন্দ্রকুমার মিত্র মহাশয়রা উপন্যাস না লিখে হয়তো সিনেমাটাই বানাতেন, অথবা, আমার মনে হয় ডেইলি সিরিয়াল ওঁদের কাপ অফ টি হয়ে উঠত।

আজ যদি একটা উপন্যাস অবলম্বনে খুব সহজে সরাসরি সিনেমা হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই উপন্যাস সিনেমার কাছে দাসখত লিখে দিয়েই শুরু ও শেষ হয়েছে। বুঝতে হবে সে আসলে উপন্যাস নয়, একটা চিত্রনাট্যের আকরিক মাত্র। সিনেমার জন্য যে-কাহিনি দরকার হয়, সেই কাহিনি সাধারণত বেশ সস্তা দরের হয়। যেমন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় তাঁর দু-টি সিনেমার গল্প নিয়েছেন শংকরের উপন্যাস থেকে, উপন্যাসগুলো সিনেমাগুলোর তুলনায় রদ্দি। পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ আর সত্যজিতের ‘মহাপুরুষ’ কিন্তু একই কাহিনি নয়, দুটো আলাদা টেক্সট, এবং প্রায় প্রতিস্পর্ধী। আবার দেখুন, পরশুরামের ‘পরশপাথর’-ও সত্যজিতের সিনেমার তুলনায় আকরিক মাত্র। সত্যজিৎ রায় কোনোদিনই কি স্পর্ধা করতেন ‘ভূষণ্ডীর মাঠে’-র চলচ্চিত্রায়ণের? ওটা অসম্ভব। শিবরামের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ আমার মনে হয় না ওই লেখকের সিগনেচার কাজ, বরং ঋত্বিক ঘটক ওটাকে অন্য স্তরে তুলে দিয়েছিলেন।

নরমাক ম্যাকার্থির ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’ থেকে চার-চারটে অস্কার পাওয়া সিনেমা হয়েছে। সেই সিনেমায় যতটা পরিচালক কোয়েন ব্রাদার্স আছেন, ম্যাকার্থি নেই। আপনি গুগলে এই নামটা সার্চ করলে সিনেমাটাই দেখাবে, বইটা অনেক তলায়। এটার কারণ সিনেমার রমরমা। ম্যাকার্থির এই বইটার তুলনায় তাঁর অন্যান্য উপন্যাস সম্ভবত অনেক ভালো। বইটা থেকে সিনেমাটা অনেক আলাদা হয়েই ভালো। এটাও বলা যায়, ম্যাকার্থির এই ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’ নিজে আবার ১৯৭৩-এর সিনেমা ‘চার্লি ভ্যারিক’-এর সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। বুঝুন কাণ্ড! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উপন্যাসের চিত্রায়ণও রাবীন্দ্রিক হয়নি, স্বয়ং সত্যজিৎ ব্যর্থ হয়েছেন, পূর্ণেন্দু পত্রী ব্যর্থ হয়েছেন, তপন সিংহ বা ঋতুপর্ণ ঘোষও পারেননি। বিদেশে দেখুন, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ যে সিনেমা হয়েছে, এতে কেউ কেউ রেগে গিয়ে বলেছেন উপন্যাসটার অপমান হয়েছে। উইলিয়াম বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ যে সিনেমা হয়েছে, দেখে আমার তো ধন্যবাদ দিতেই ইচ্ছে করেছে। আবার হেমিংওয়ের ‘স্নোজ অব কিলিমাঞ্জারো’ বা ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ যে সিনেমা হয়েছে, আমাদের আফশোসই হয়, কেন হল, হওয়ার কি কোনো দরকার ছিল! অথচ, আমাদের লেখকরা তাঁদের উপন্যাস থেকে সিনেমা হলে নিজেদের বেশ সার্থক জ্ঞান করেন, ফেসবুকে শ্লাঘা প্রকাশ করেন প্রায় লালমোহন গাঙ্গুলি হয়ে যান অনেকেই। সিনেমার গল্প লেখার জন্য কিন্তু আলাদা পেশাদার রাইটার রাখা হত ক্ল্যাসিক যুগের হলিউডে।

আজকের উপন্যাস লিখিত হবে সিনেমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, যে-সিনেমা তার মুকুট কেড়ে নিয়েছে, তাকে হারাতেই হবে, এটাই আমি মনে করি, প্রয়োজন হলে তার অস্ত্রেই তাকে হারাতে হবে। সিনেমা যেন উপন্যাসকে হাইজ্যাক না করে, কিন্তু সিনেমার যা কিছু মালকড়ি, সেটাই বরং কেড়ে নিতে হবে। কিন্তু কেড়ে নেবে কারা? বাংলা উপন্যাসে আজও ভণ্ডামির শেষ নেই।

সফট কোর যৌন বর্ণনার মাধ্যমে আজও যে পাঠক জোটে, সেটা বাণিজ্যিক কাগজ দেখলেই বোঝা যায়। হার্ডকোর কিন্তু নৈব নৈব চ। কেন বলুন তো? হার্ড কোর একবার এসে গেলে পাঠক আর সেক্সের সুড়সুড়ির জন্য সাময়িকপত্র কিনবে না। স্মার্টফোন তো তাকে এমনিতেই হার্ডকোর দিচ্ছে! সে বাংলা উপন্যাসে সাব্লিমেশনের টানে আসে। এই কারণেই আমি ‘পর্ণমোচী’ লিখেছিলাম। সেক্স নিয়ে এই অন্তহীন ভণ্ডামির অবসান হওয়া উচিত। ‘নীতা তার প্লেট থেকে শেষ স্ট্রবেরিটা মুখে চালান করে দিল।’— এমনই সব বাক্যে বাজারমুখী বাংলা উপন্যাস শুরু হয়। এই বাক্যেও তো শুরু হতে পারে— ‘সায়ন্তনীর ভেজা যোনির ফাঁকে একটা আলগা চুল ঢুকে ছিল, ছিন্নমূল, সেটাকে দু-আঙুলে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে স্মরণজিৎ মেঝেতে ফেলে দিতে গেল, কিন্তু, আঙুলে লেগে যাওয়া রসে আটকে আছে, যেমন শৈশবের কিছু দাঁত খুলে এলেও মাড়ি থেকে খসতে চাইত না।’ এটাই দরকার। কারণ, সমাজের শোধন লেখকের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আপনার ফাকিং ভালো লাগলে আপনি পর্নহাব দেখুন, উপন্যাস পড়তে এলে উপন্যাসের জন্যই আসবেন। সেটা একমাত্র করা যায় হার্ডকোরের মাধ্যমেই, বিষে বিষক্ষয়। আফটার অল, কোন সমাজের জন্য লিখছি, সেটা মাথায় রাখতেই হবে। কবি পারেন সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লিখতে, ঔপন্যাসিক যে সেটা পারেন না, সেটা তাঁর দায় নয়, তাঁর দায়রা হয়তো।

কবিতার সঙ্গে উপন্যাসের কোনো লড়াই নেই। কোনো শিল্পমাধ্যমেরই কবিতার সঙ্গে কোনো লড়াই থাকতেই পারে না। কবিতা হল শিল্পের মাদার জেশ্চার। যেখান থেকেই একটা শিল্পমাধ্যম শুরু হোক, তার অবসান কবিতায় মিশে গিয়েই হয়, ওটাই মোহনা। কিন্তু, এটাও ঘটনা, মোহনার কাছে নদীর জলে লবণাক্ত স্বাদ থাকে, সেই স্বাদ উৎসে থাকে না, নদী অনেক দূর বহুদূর প্রবাহিত হয়ে গেলেও তার জলে ওই লবণাক্ত স্বাদ থাকে না। মোহনার লবণ যে তাকে সারা শরীরেই বয়ে বেড়াতে হবে, এমন ধারণা বেশ অবান্তর বলেই মনে হয়। আজকাল অনেকেই উপন্যাসের উৎস আর মোহনা এক করে ফেলছেন। কবিতার লবণ তাঁদের উপন্যাসে এতই বেড়েছে, যে প্রায় অপেয় হয়ে উঠেছে।
একটা উপন্যাসই যদি কবিতা হয়ে যায়, সে যদিও কবিতাই হয়ে ওঠা তার সার্থকতা সাব্যস্ত করে নিয়ে লিখিত হয়ে থাকে, সেই উপন্যাস পড়া যায় না। মানুষ একটানা দেড় ঘণ্টা হয়তো সঙ্গম করতে পারে, কিন্তু, দেড়দিন বা দেড়মাস ধরে একটানা সঙ্গম করা অসম্ভব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুই কামুক-কামুকীও সেটা পারবেন না। লোহার তৈরি লিঙ্গ আর যোনিও ক্ষয়ে যাবে। কবিতার মধ্যে যে আনন্দ, যে বিষাদ, তা সহ্য করা যায় কবিতার মাপ ছোটো বলেই। মহাকবিতা বা দীর্ঘকবিতার মধ্যে দেখবেন কবির আবেগের তীব্রতা প্রচুর কমে যায় এবং অঢেল গদ্যগুণ এমনকী গল্পগুণ প্রবন্ধগুণ এসে মিশে যায়, না হলে সেটা পড়া যায় না, লেখাও যায় না।
জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ বা ‘ফিনিগানস ওয়েক’-এর প্রসঙ্গ যদি তোলেন, সেগুলোও কিন্তু কবিতা নয়, উপন্যাসই, যেমন আগে বললাম, উপন্যাস কীভাবে লিখিত হয় এবং লিখিত হয় না তার ডকুমেন্টেশন। এবং জয়েসের কোনো উত্তরসূরী কিন্তু তৈরি হননি। উনি যে-কাজ করে গেছেন, সেটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো লোক মেলেনি, কারণ একজন লেখকের কাজ তিনি ছাড়া কেউই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। বলা হয় অগণিত লোক নাকি জয়েসকে অনুসরণ করেছেন, নাম করা হয় জেমস ব্লিশ, অ্যান্থনি বার্জেস, ফিলিফ ডিকের। কিন্তু, আপনিই বলুন, এই তিনটে নাম আপনি কি শুনেছেন? জেমস ব্লিশের লেখা ‘আ কেস অফ কনসেন্স’ বা ‘ব্ল্যাক ইস্টার’ কি আপনি পড়েছেন, বা পড়তে চাইবেন? আমি চাইব না।

আপনি যেমন যখন কবিতা লিখছেন, আপনাকে কবিতা লিখতেই হয়, আপনি যখন উপন্যাস লিখছেন, আপনাকে একটা গল্প বলতেই হবে, অথবা, একই ফ্রেমে একাধিক গল্প বলতে হবে। অতিসরলীকরণ মনে হল কি? কিছু করার যে নেই। এর কোনো অন্যথা হতে পারে না। হলে সেটা অস্বাভাবিক কিছুই হবে। গল্প বলাকে কি আপনি খুব সস্তা আর সোজা কাজ মনে করছেন? মহাশয়, মহাশয়া, আপনি আজ যদি একটা উপন্যাসে গল্প বলতে বসেন, সত্যিই যদি একটা অপূর্ব গল্প আপনি বলতে চান, যে-গল্প তার মধ্যে রেখেছে আত্মঘাতের বোমা, একটা উপন্যাসের ফ্রেমের মধ্যে সেটা তৈরি করতে আপনার গাঁড় ফেটে যাবে। আজ সকল গল্প বলা হয় গেছে। কোন গল্প এখন বসে আছে বলুন তো আপনার বলার অপেক্ষায়? পারবেন একটা নতুন গল্প বলতে, যা পৃথিবীতে এই প্রথম বলা হল, এই ২০২০-তে? আর এই চ্যালেঞ্জটা এড়িয়ে গিয়ে আপনি যদি প্রকরণসর্বস্বতার দিকে যান, যদি নিজেকে এই বলে ভোলাতে চান যে আপনি আপনার সময়ের জন্য লিখছেন না, ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্য লিখছেন, আপনি চালাকির মোড়কে ঢেকে বোকামিই করছেন। ভবিষ্যতের পাঠকের জন্য লিখবে ভবিষ্যতের লেখকরাই, আপনাকে সেখানে দরকার নেই। ভবিষ্যতের উপন্যাস লেখা হবে আপনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, ভুলে গিয়েই। আমাকেও ভুলে গিয়ে আমার পরের লেখক লিখবে। আমি ভালো করেই জানি সেটা।

আগের পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই