লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অভিষেক নন্দীর কবিতা

জীবাশ্ম বংশ

বোতাম খোলার শব্দে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
বুকের লোম থেকে
ঘাসের রূপান্তর—
একটা বুনো দাঁতাল-ফড়িং
স্বপ্নের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসে
তাড়া করে নিয়ে বেরাচ্ছে গচ্ছিত ছায়াপাখি-কে…

আমি ও আমার পূর্বপুরুষ উলঙ্গবাগানে মুক্তি ঢেকে আছি

উনুন জ্বেলে পুড়িয়েই যাচ্ছি পারিবারিক চপ্পলগুলো,
ফুরোচ্ছে না পথ…

শর্টকাট

দাউদাউ উনুনের নীচের ঘর—
মা মেখেছে আতর, আর মেয়ে
ফাটলে ফাটলে ভরেছে ন্যাপথলিনের গন্ধ

পুলিশের তাড়া খেয়ে বাপটা দরজা ভেঙে পালিয়েছিল
নতুন দরজা আসেনি; শুধু জানলা বন্ধ হয়…
১২.১২ রিখটার স্কেলে খাট কাঁপলে
মাঝরাত্তিরে মেয়ের ঘুম ভেঙে যায়;
মায়ের অলীক-শঙ্খের মতো দেহটিকে পেঁচিয়ে ধরে থাকে
বাপ-কাকার মতো পাইথনেরা…

ও জানে,
মায়ের চিৎকার আর হাঁড়ির চাল সমানুপাতিক
ও চেনে,
সারা ঘরে জ্বলতে থাকা অ্যাসিড-বাল্বের আলো

ব্রহ্মাপ্রজাপতির মতো উড়তে থাকে মেয়েটি
শহরের জঞ্জালের গভীরে থুবড়ে পড়লে,
হাতের মুঠোয় উঠে আসে
মায়ের ছেঁড়া ব্লাউজে জড়ানো মেরুদণ্ডটা!

ভাড়াবাড়ি

রাত-বিরেতে যাদের বুকপকেট হাতড়াই
রক্ত নয়, ডানা ঝাপটানোর সম্পর্ক রাখে তারা

মাউথ-অর্গানের মতো প্রিয় ডাকগুলো,
অথচ ভূমিকা থেকে ভাগশেষের অন্তরবর্তী ফাঁকে
ফুঁ মারলেই গলা পর্যন্ত গেঁথে যাচ্ছে শাবল!

চরনামৃত-ছোবলগুলো বাম-অলিন্দে লুকিয়ে
স্তব্ধতার বালিয়াড়ি থেকে উঠে এল পিছুডাক,

মানুষ মানুষ বলে চিৎকার করছ কেন?
আমি তো সেই তিনপাশ ভেঙে পড়া
ভারতবর্ষের একটা এক-কামরা’র ঘর!

ক্যালেন্ডার

আমরা দু’জন অবিকল ভিন্ন দুটি রাত
বকুলের গন্ধ মেখে ঘুম আসলে
বিজ্ঞানীদের অজান্তে ছায়া’রা বড়ো হয়

এই পেরেকহীন উলঙ্গ শরীর,
যতবার দাঁড়িয়েছি
তুমি নিরামিশ হাতে
ওজনবৃদ্ধির ওষুধ গিলিয়েছ আমায়…

গোখরোর মতো লম্বা লম্বা তাঁবুতে
আচমকা নেচে উঠেছেন দেবদূত

যে ঘরে বজ্রপাতের শব্দটুক ধরে না
যে ঘরে বিষণ্ণ মেঘরঙা থুতু’র বিজ্ঞাপন
দেয়াল ভেঙে,
ভয়ানক পেশি ফুলিয়ে,
রাষ্ট্রকুণ্ডের জরায়ুতে
আজ আমাদের চূড়ান্ত ভালোবাসার দিন!

অনাথের দল

অভিজ্ঞ মিস্তিরিরা অন্ধকার মাখিয়েছিল ঘরে
সঞ্চয়ের খাতায় টগবগে কৃত্রিম সূর্যের জেরক্স

ফুটফুটে বাচ্চাগুলোর নাভিমূলে ঈশ্বর নেই
কামুকগুলোর খেয়াল মন্দিরের উপসংহারস্নাত
ছেঁড়া চপ্পলটার দিক মাত্র

কত ফেরিওয়ালা, ফুচকাওয়ালা, বইওয়ালা
ভ্রু-পল্লবের জাদুবাক্যেও দোরগোড়া থেকে
খালি হাতে ফুরিয়ে গ্যাছে প্রাচীন গর্তের দিকে

ওদের একটা সাতমহলা নৌকা চাই শুধু

অভিভাবক বটবৃক্ষের তিনভাগ জলের ওপারেই
ওদের জন্মদিনওয়ালার যোনিআকৃতি দোকান।

ব্যবসা

কসাই-এর রক্তগুলো ব্যবসার শিশিতে ভরতি
ঐ রক্তে বীজের মুখ দ্যাখা যাবে?

কোলাহল থামলে,
সারা ঘর জুড়ে থুতু লালা গড়াবে;
মুখ থেকে নদী পর্যন্ত লম্বা একটা পিপাসা
লাশের ঠোঁট চুঁইয়ে ঠেকবে নাভিতে…

তারপর— একবার কবরে নামব,
একবার শ্মশানে উঠব…

অঙ্ক

প্রতিদিন পতাকা উত্তোলনের শেষে, আমি
গাছতলায় বসে বাচ্চা পড়াই;
রবীন্দ্রনাথের নাম শোনেনি,
এমন একটি মেয়ে এসে পিঠে মাথা রাখে।

চুরি যাওয়া জঙ্গলের মতো চুল। বুকের-ওপর
নির্ঘাত আছড়ে পড়েছে ফুটব্রীজ।
নিয়ম করে স্বামীর দেওয়া কালশিটে-দাগ পিঠে।
গরীব বাচ্চাগুলোর খাতাবই নেই;
মেয়েটি রোজ রোজ এসে পিঠ পেতে বসলে
কালশিটে দাগগুলো গুনে গুনে ওরা অঙ্ক শেখে…

ছুটির পরে হরলিক্সের বোতলে জল এনে
ওর ব্যথায় ঢেলে দিই।
পরেরদিন আরও দু-খানা দাগ বাড়িয়ে দেয়, ওর স্বামী।

স্বপ্নে পাওয়া দেবতা

অথচ, ফুলশয্যার রাতেই বাবা-মা’র আগুনে পোড়া দেহ…

দেখতে পাচ্ছি
শোবার ঘরে আকাশ কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটার—
সমস্ত কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে…
টেনে হিচড়ে লম্বা করছে ঘাসপাতার নাভি…

সিংহ পোষে, ময়ূর পোষে, হাতি ষাঁড় সাপ… কী নেই

আমি বোবা, কথা বলা আসে না;
এই তোমরা শোনো—

মেয়েটিকে একবার ঈশ্বর বলে ডাকো দেখি!’

ইরেজার

মায়ের মতো বাবার কোনো সেলাই মেশিন নেই

ছিঁড়ে যাওয়া বুক, অসুস্থ হাসি, ফুটিফাটা দাড়ি নিয়েও
কোনোদিন মায়ের সেলাইঘরে দাঁড়ায়নি সে—
এখন চুপিচুপি থাকে…
আমার অঙ্ক খাতা থেকে দু-তিনটে শূন্য চুরি করে,
সমস্ত অভাবের সাথে গুণ করতে যায়!

অন্যপিঠে, মা ঠাকুরঘরে আর্যভট্ট-র ছবি টাঙিয়ে
সারারাত প্রার্থনা করতে থাকে
বোন আর আমি যেন ইস্কুল থেকে লালকালির গোল্লা নিয়ে আসি!

লোকসান

এই মাথা নীচু করে থাকার শহরে
তুমি আকাশ বিক্রি করতে আসা ফেরিওয়ালা!

পরিচিতি:
বাড়ি নদিয়া জেলার বাদকুল্লা নামক মফঃস্বলে। বাংলা বিষয়ের ছাত্র। কবিতা লেখার পাশাপাশি গান শুনতে এবং সিনেমা দেখতে ভালোবাসে।

Facebook Comments

পছন্দের বই