লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অর্ক অপুর গুচ্ছকবিতা

মোহনায় মন্থন যাত্রা


রঙের দাম বেড়েছে বলে সাদাকালো সংসারের দাগ ধরে আছে পাঠঘর। পড়শি আর স্বজনেরা সুযোগ পেলেই দাগে ঢেলে দেন— পাঠহীনতার উপহাস। সামান্য অপরাধ যোগ্যতা নেই বলে যে ঘরে প্রজাপতি ঢোকে না, সে ঘরের মানুষেরা “দাওয়াত বাড়িকে গোলাপ গন্ধ ভেবে” প্রতারিত হয়ে ফিরে এসে কাঁদে।

জল,
তুমিও কী
শুকিয়ে যাও
তাজা না রেখে চোখদানিতে ফুল!
পাপড়ি ঝরে ঝরে বন্ধ করো না স্কুল।


পরিবার পরিকল্পনার কথা শুনলেই আমার রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে। —আর মনে পড়ে এক এপ্রোন-আপার কথা যিনি ম্যাজিক টুথ পাউডার দিয়ে দাঁত মাজতেন। এনজিওর বেতনে হতো না বলে তিনি সব ঘরে গিয়েই হাসি ফেরি করতেন অথচ কেউ কিনত না সে হাসি। —অথবা কিনলেও দাম হিসেবে পাওয়া যেত একগ্লাস পানির সাথে দুটো নোনতা বিস্কুট। আমার সমস্ত শৈশব কাটিয়েছি এপ্রোন-আপার বিস্কুট ভাঙার কারুকাজ দেখে।
পরিবার পরিকল্পনার নাম শুনলেই মনে হয় কে যেন রবীন্দ্রনাথের পাশে বসে বিস্কুট খাচ্ছে।


মেয়েটার খুব জ্বর কাঁদে, ছেলেটা মাংস মাংস চেঁচায় গোলযোগ বাঁধে, বিষণ্ণ বউয়ের একটি একটি করে পাপড়ি ঝরে পরে ভাড়া বাড়ির ঘরে।
বাবার চশমার কাচ— বহু দাগে ঝাপসা হয়ে গেছে, কিছুই দেখা যায় না আজ।
মায়ের এটাই শেষ শাড়ি, জমছে বাড়ি ভাড়া।
বন্ধু হাসপাতালে জায়গা পায়নি, বারান্দায় পড়ে থাকে দেখতে ডাকে,
প্রাক্তন প্রেমিকার বরের চাকরি নেই— বার্তা পাঠায় ‘কিছুই কি নাই দায়!’

জীবনের তীব্র নীলে শাদা ঢেলে ঢেলে আকাশকে করে তুলছি চমৎকার আকাশি। সূর্য আরেকটু বামে চাপোতো… চিৎকার করে বলি— বাঁচতে ভালোবাসি।


সে’বার আকাশে জল জমেছিল খুব, তারপর সে কী সানাইশব্দময় বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল ঘন ঘন উৎসব আতশবাজির মতো। জানালায় দাঁড়িয়ে ভয় পাচ্ছিলাম বলে— বাবা তার সুরা পাঠের ভেতর আমাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন দলা পাকিয়ে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল টিনের সমস্ত উত্তাপকে আলগোছে শুষে নিয়ে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল উঠোনের ওপর কাদার পরত জমিয়ে। টর্চ হাতে আমরা উঠোনের কোণে আমগাছ তলে গিয়েছিলাম। মা তাড়া দিয়ে বলেছিল, “বৃষ্টিভেজা আমের আচার স্বাদের হয়, পড়শিরা যেন কেড়ে না নিতে পারে আমাদের স্বাদ। “আমার বোনটা বড়ো পাজি, আমাকে ছুমন্তর দিয়ে নিজে পেয়ে যেত বড়ো বড়ো আমগুলো। আমি ছোটো ছোটো যেগুলোই পেতাম, বাবা সেগুলোর দিকেই বিস্ময় নিয়ে তাকাত, হাসত। কী একটা শব্দে বোনটা সাপ সাপ বলে ফিরে গিয়েছিল ঘরের দিকে। বাবা আমার হাত ধরে শব্দের মোহনায় এগিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর মহাবিস্ময়ে দেখলাম পরিত্যক্ত পলিথিনে আটকে আছে বৃষ্টির উঠোনে নাচতে আসা এক কিংবা দুইটা কইমাছ। আমার চোখে ভেসে উঠেছিল ভাজা কইয়ের পিঠ, নাকে খেলতে লাগলো গরম ভাতের গন্ধ। বাবা আমার হাতে টর্চটি দিয়ে জ্যান্ত কই দুটো তুলে নিয়েছিল শিকারি হাতে। তারপর আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে বলেছিল, “চল মাছ দুটোকে পুকুরে ছেড়ে দিয়ে আসি।” আমি হতভম্ব হয়ে তার আবছা মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম আর টর্চের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল বাবার হাতে দুটি কই। বাবা আমাকে বুঝতে পেরে বলেছিলেন— “বিপদগ্রস্ত কাউকে আঘাত করতে নেই।”

তোমার বিয়ের কথা শুনে আত্মহত্যা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবেই।


আত্মহত্যাকাঙ্ক্ষী বালকেরে ধুনিয়ে দাও কামরাঙা ঠোঁটে, চুমুতে কত কী ঘটে!

চুমুতে কত কী ঘটে,
বালিকা নতুন কাপড় পরে ঠোঁটে,
কী নিখুঁত লেপে দিয়েছ বেনারসি থেকে লাল,
ধুনিয়ে ধুনিয়ে মিহি ওমময় করে তোলো— যমে ডোবা শীতকাল।

বালিকা— এই হৃদয়কে শ্রমিক করে তোলো
সেলাই মেশিন খোলো, ঠোঁটে ঠোঁটে রিপু করো
আবারো আবারো…
স্বপ্ন ছিঁড়ে ছিঁড়ে উলঙ্গ হয়ে গেছি, আর যেন না ছিঁড়ি,
দীর্ঘ ব্যবহারে ছিঁড়ে যাওয়া স্বপ্নের— রিপু জরুরি

আত্মহত্যাকাঙ্ক্ষী বালকেরে ধুনিয়ে দাও কামরাঙা ঠোঁটে, বাঁচিয়ে তোলো চটুল চুমুর চোটে।

Facebook Comments

পছন্দের বই