লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ওয়ার্সান শায়ারের কবিতা

ভাষান্তর: সুদীপ ব্যানার্জী

[কবি পরিচিতি: সমকালীন যুবা কবিদের মধ্যে অন্যতম ওয়ার্সান শায়ার ১৯৮৮ সালে কেনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সোমালিয়ান দম্পতির সন্তান ও ব্রিটিশ নাগরিক এই কবি ২০১১ সালে তার ‘টিচিং মাই মাদার হাউ টু গিভ বার্থ’ নামক কবিতা সংকলনের মাধ্যমে পাঠকের সমাদর লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির প্রথম ‘আফ্রিকান পোয়েট্রি’ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৪ সালে তিনি লন্ডনের প্রথম ‘যুব পোয়েট লরিয়েট’ নির্বাচিত হন। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ‘পোয়েট ইন রেসিডেন্স’-এর সম্মানও লাভ করেন তিনি। ২০১৮ সালে তিনি ‘রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচার’-এর ফেলো নির্বাচিত হন। এক অভিবাসীর আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের আকুতি, কালো চামড়ার মানুষের বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাসের ছায়া ও সর্বোপরি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অত্যাচারে নারীর অবদমিত অবচেতন— কবির কবিতায় এক ভিন্ন স্বর গড়ে তোলে। সোমালিয়ার দীর্ঘকালীন গৃহযুদ্ধ ও এক রক্ষণশীল সমাজের উত্তরাধিকার এবং ব্রিটেনের খোলামেলা সমাজে বেড়ে ওঠা এক নারীর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব— কবির গভীর অনুভবে কেলাসিত হয়ে অনন্ত সম্ভাবনার সূচীমুখ খুলে দেয়। আমরা অবাক হই, চমকাই, শিহরিত হই, একাত্ম হই তার ভীষণভাবে মৌলিক এই কবিতা সফরে।]

বাড়ি
[The house]


আম্মি বলে সব মেয়েছেলের ভেতর
অনেক তালাবন্ধ ঘর। কামনার জন্য রান্নাঘর,
দুঃখের জন্য শোওয়ার ঘর আর উপেক্ষার ঘরটি বাথরুম।
মাঝেসাঝে, পুরুষ আসে— হাতে থাকে চাবি
মাঝেসাঝে, পুরুষ আসে— হাতে থাকে হাতুড়ি


আমি বলেছিলাম থামো, আমি বলেছিলাম না এবং ছেলেটা কথা শোনেনি।


মনে হয় মেয়েটির কোনো কুমতলব আছে,
মনে হয় ছেলেটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় ও নিজের কাছে
শুধু ওর জন্যই বেশ কয়েক ঘণ্টা পরও মেয়েটা
জেগে বরফে ভরা বাথটবে
শুকনো মুখ, মাথা নীচু করে তাকাচ্ছে ও
ছেলেটার নতুন, পরিচ্ছন্ন কৌশলে।


আমার শরীরের দিকে আঙুল তুলছি আর বলছি, ওহ্, এই পুরোনো মালটা? না, আমি একে এড়িয়েই গেছি এইমাত্র।


তুমি কি ওটাই খেতে চলেছ? বললাম আম্মিকে আমার আব্বার দিকে দেখিয়ে, আব্বা শুয়ে ডাইনিং রুমের টেবিলে, মুখ ঠাসা একটা লাল আপেলে।


যতই বাড়ছে আমার শরীর, তালাবন্ধ ঘরের সংখ্যাও বাড়ছে তত আর বাড়ছে চাবি হাতে পুরুষের আনাগোনাও। আনোয়ার জবরদস্তি পুরোটা ভেতরে ঢুকতে চায়নি, ভাবি এখনও, আমার অন্দরের আরও কত ঘরের দরজা খুলে ফেলা বাকিই থেকে গেল তার। বাসিলও এসেছিল, তিন বছর দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়েই ছিল, সংকোচে। জনি, নীল চোখ ছেলেটা, ও কিন্তু এসেছিল এক ব্যাগ যন্ত্রপাতি নিয়ে, অন্য মেয়েদের ওপর প্রয়োগ করেছে ও এগুলোই— একটা চুলের পিন, এক বোতল ব্লিচ, একটা সুইচব্লেড আর ভেসলিনের কৌটো। ইউসুফ তালার ফুঁটো দিয়ে ঈশ্বরের নাম ধরে চিৎকার করেছিল, না, কেউ সাড়া দেয়নি। ভিক্ষা চেয়েছিল একজন, পাশ থেকে আমার শরীরে চেপে জানলা খুঁজেছিল কেউ, কেউ-বা বলেছিল মাঝ রাস্তায় আছে ওরা, এসে পৌঁছাতে পারেনি আর কোনোদিনও।


ওরা বলল, পুতুলটা দিয়ে দেখাও কোথায় কোথায় তোমাকে ছুঁয়ে দেখেছে কেউ
আমি বললাম, আমাকে দেখতে পুতুলের মতো নয়, আমি অনেকটা বাড়ির মতো
ওরা বলল, তাহলে বাড়িটা দিয়েই দেখাও
এই যেমন: জ্যামের শিশি দিয়ে দুই আঙুল
এই যেমন: চানের জল দিয়ে একটা কনুই
এই যেমন: ড্রয়ার দিয়ে একটা হাত


আমার প্রথম প্রেম নিয়ে আপনাদের না বললেই নয়, ন-বছর আগে আমার বাঁ-বুকের নীচে গুপ্ত এক দরজা খুঁজে পেয়েছিল সে, আর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ভেতর। তারপর থেকে তার দেখা মেলেনি। খালি মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ঊরু বেয়ে কেউ একটা যেন হামাগুড়ি দিচ্ছে। তার নিজের পরিচয় দিলে, বোধহয় বাইরে বের করে আনতে পারি তাকে আমি। আশা করি অন্য কারোর কাছে, ছোট্ট শহরের হারিয়ে যাওয়া ছেলেরা, যাদের আম্মারা খুব সুন্দরী, যারা কুকর্ম করেছে আমার সাথে আর আমার চুলের চাতালে হারিয়েছে নিজেদের, তাদের কাছে লাফিয়ে চলে যায়নি ও। ওদের সাথে কিন্তু যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করেছিলাম আমি, একটুকরো পাউরুটি খাইয়েছি, ওদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে দিয়েছি একটুকরো ফলও। ব্যতিক্রম ওই নীলচোখ জনি, আমার মাথার চুল কুড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকেছিল সে-অন্দরে। বোকা ছেলে, আমার বেসমেন্টে যে-ভয়ের ঘর, সেখানে শেকল পরিয়েছি ওকে, ভাসিয়ে বয়ে চলে দিতে গানও চালিয়েছি আমি।


টিং… টং…
কে ওখানে?
কেউ না।

১০
পার্টিতে আমি নিজের শরীর দেখিয়ে বলি— ভালোবাসা এইখানেই আসে মরে যেতে। সু-স্বাগতম, আসুন ভেতরে, একদম নিজের বাড়ির মতোই ভেবে নিন। সবাই হাসে, ভাবে আমি ইয়ার্কি মারছি।

Facebook Comments

পছন্দের বই