লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবির হোসেনের কবিতা

কবির হোসেনের কবিতা

বৈদ্যুতিক শালবন

এই-যে দেখছেন শালগাছের বৈদ্যুটিক খুঁটি, রোপন করা আছে রাস্তা/ঘরের পাশেই, এর গোঁড়ায় নিয়মিত পানি অথবা রাসায়নিক সার দিলে বিদ্যুতের ফলন পাবেন ভালো। আলোর জন্য বাল্বে বাল্বে পৌঁছে যাবে বৈদ্যুতিক জ্বালানি। এবং ফ্যানের নিঃশ্বাস থেকে উৎপন্ন হবে অক্সিজেন। শহরজুড়ে অসংখ্য শালগাছ নিয়ে যে শালবন, ঘরে বসেই পাওয়া যাবে তার সুবিধা। এবং ডাইনিং-রুমে বসেই সারা যাবে বনভোজন। কল ছেড়ে তালের রস পাবেন অবশ্যই, যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঘরের পাশের খুঁটিটি তালগাছের দিতে পারেন।
আমি দিয়েছি ধানগাছের— কুকার সংযোগ দিতেই ভরে ওঠে ভাতে।

কালো বক

কলসের পানি যতটা কম হলে একটি কাককে বক হয়ে যেতে হয়, তারচেয়েও কম পানি রেখে একটি কলস পেতে রাখি উঠোনে। কণ্ঠে তীব্র তৃষ্ণা নিয়ে একটি কাক উড়ে এসে ধরা পড়ে, কলসে গলা বাড়িয়ে পানি খেতে গিয়ে বক হয়ে যায়; তারপর তৃষ্ণার কথা ভুলে হঠাৎ ক্ষুধার্ত হয়ে উঠলে— মাছ ধরতে নেমে পড়ে কলসে। আমরা কলসের ঢাকনা ফেলে বকটি ধরে ফেলি, এক টানে খুলে ফেলি তার উকিলের পোশাক।
বকের মাংশ খেয়ে বাবা রায় দেন— বিভিন্ন মাছের স্বাদ পাওয়া যায়।

ফটোকপির দোকানদার

ভাল্লুকের হাত থেকে কাউকে রক্ষা করার সাহস নেই আমার, না-আছে পাহাড় চূড়ায় উঠে মেঘের চাক থেকে মধু সংগ্রহ করার। আমি তো বৃষ্টির অপেক্ষায় পাদদেশে ঘর তুলেছি, আর কাজ করি ফটোকপির দোকানে। প্রতিদিন ফটোকপি করি আমার প্রতিটি দিন। একেকটি দিন আসলে একেকটি পাতা। যদিও একটি পাতাই ফটোকপি করি প্রতিদিন। আর অপেক্ষা করি বৃষ্টির।

যেদিন বৃষ্টি হয়, কেবল সেদিনের পাতাটি ভিজে যায়।

সমবয়সী

পানির জ্বালানিতে আমি আর হাঁটব না মা, পানি পান করে পায়ের গতি বাড়ানো যায় না। হেঁটে হেঁটে আমি যখন যৌবনে, আমার সমবয়সী বন্ধুটি গাড়িতে চড়ে চলে যায় বার্ধক্যে। তার বার্ধ্যক্য সন্ধ্যার নারকেল খায় আর আমার যৌবন সাঁতরায় কেবল ডাবের জলে। মা, তার গোটাদিন দেখে ফেলার বয়সে আমার কেন দুপুর হবে? গ্লাসে গ্লাসে পানি খেয়েও গাড়ির পাশে হাঁটতে পারি না, দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় গোপন পা।
ডিজেল পান করে দৌড়াবো মা, টায়ারের জুতো পরে।

উচ্চতর কৃষিবিজ্ঞান

ফসলি এক জমিতে ধানের গোছার মতো কতগুলো বিল্ডিং রোপন করা হয়েছিল। আশ্চর্য, মাটি এতটাই উর্বর যে এক মৌসুমে সবকটা বিল্ডিংই তরতাজা হয়ে উঠল। আবার বিল্ডিংগুলোতে ফলনও ফলেছে দারুণ— একেকটা বিল্ডিং-এ ফলেছে পঞ্চাশ কিংবা ষাট সত্তর তলা। ফসল কাটার দিনে আরেক আশ্চর্য দেখতে পেলাম। ফসল না কেটে চাষি ক্ষেতে রেখেই ফসল বিক্রি করে দিতে লাগল, আর লোকজন ফসল কিনে ফসলের ভেতর ঢুকে পড়তে লাগল পরিবারসহ।
আশ্চর্য, নবান্নের উৎসব করে ফসলগুলো মানুষ খেতে লাগল!

একজন সিনেমাপ্রেমি অন্ধ

দাঁত ব্রাশের সাথে প্রতিদিন সকালে নিয়মিত কান পরিষ্কার করে যে অন্ধ লোকটি, তাকে সকলেই চিনে একজন তুখোর সিনেমাপ্রেমী হিসেবে। কান পরিষ্কার করেই টেপ রেকোর্ডার নিয়ে বসে পড়ে, তারপর ক্যাসেট চালু করে রেকর্ডার কানে লাগিয়ে শুনতে থাকে অডিও সিনেমা। তার সিনেমা শোনার এই নেশার সাথে কোনো মাতালই পেরে ওঠে না, যেন গোগ্রাসে গিলছে সব। নিয়মিত হলেও যায়, নতুন নতুন সিনেমা শুনে আসে। নতুন পুরনো সব সিনেমা শোনা হয়ে গেছে তার, এখন কান পরিষ্কার করে বসে আছে মুক্তিপ্রাপ্য সিনেমার অপেক্ষাতে।
এই ফাঁকে তার মনে পড়ে নির্বাক চলচ্চিত্রের কথা, যার অস্তিত্ব প্রমাণিত নয় তার কাছে।

ট্রাফিক

গাছে ঝুলে থাকা সবুজ ঘড়িটা কেবল ঠিকঠাক চলছে। প্রতি সেকেন্ডে নড়ে উঠছে পাতা আর ডাল নড়ছে মিনিটে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় গাছও অবশ্য হেলে পড়ে কিছুটা। সবুজ ঘড়িটার নিচেই একটি হলুদ ঘড়ি, যার কাটাগুলো বার্ধক্যে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আর ঝুলে আছে যে ডালে, তৃষ্ণায় শুকিয়ে যাচ্ছে। পেকে যাওয়া হলুদ পাতাদের সাথে সে একদিন ঝরে পড়বে অনায়াসে। আর একটি লাল ঘড়ি, ডালে ঝুলতে গিয়ে বারবার ঝরে পড়ছে গাছের নিচে।
গাছতলায় কত কত লাল ঘড়ি, কাটাগুলো আটকে গেছে ট্রাফিক সিগন্যালে।

ডারউইনের বাসায় ডেভিড কপারফিল্ড

যতটুকু পেছনে এলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে, ততটুকু পৌঁছে দেখি আমার দেয়ালটা নেই। দেয়ালের খোঁজে আমি পেছন দিকে যেভাবে হাঁটছি, যে কেউ দেখে তাঁর ভেতরে বিশ্বাস গেঁড়ে নিচ্ছে ভূতের অস্তিত্ব। হারিয়ে যাওয়া সেই দেয়াল, পিঠের কাঙ্ক্ষিত বিছানা যেন, যার ওপর বসে পা দুলিয়ে একজন ঘুড্ডিবালক সুতা গুটিয়ে নিচ্ছে আমাকে টেনে। সেই সুতার টানে, পেছন দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বেখেয়ালে এক বটির উপর ধপাস করে পড়ে যাই। দ্বিখন্ডিত আমি লক্ষ্য করি— আমার কোমর থেকে পা অব্দি খণ্ডিত অংশ তড়পাচ্ছে রুইমাছের মতো। কিঞ্চিৎ হেসে, দরজায় বসে ঝিমানো এক মা’কে ডেকে বলি— মাগো, এভাবে যেখানে সেখানে বটি দাঁড় করে রাখবেন না, বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। জেগে ওঠা অপরিচিত প্রাচীন মা, মুখে ভার এনে বলেন— বঁড়শি কেনার টাকা নেই বাবা, তাই দীর্ঘদিন ঘরের কোণে পড়ে থাকা অব্যবহৃত বটিটা উঠানে পেতে রেখেছিলাম।

আমার বিখ্যাত জামাটি

জামাটা পরতে পরতে সেটা আমি হয়ে গেছি, মা। বাবাকে বলে দিও সেটা পরে বের না হতে। আমাকে পরে বাবা বের হলে বন্ধুরা বাবাকে আমার নাম ধরে ডেকে বসবে। আমার ভেতরে বাবা ঢুকে গেলে, স্বামীর খোঁজে তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বিব্রতবোধ জাগবে। তারচে বরং আমাকে তুলে রাখো ঘরের পুরনো হ্যাঙ্গারে। সেখান থেকে নামিয়ে কোলে করে মুখে খাবার তুলে দিও। ময়লা হলে কুসুম জলে স্নান করিয়ে দিয়ো। রোদে শুকিয়ে ফের হ্যাঙ্গারে রাখতে গিয়ে যদি টের পাও তার ভেতরে বিবিধ কলুষ— দাগ, অদৃশ্য ময়লার নানাবিধ দুর্গন্ধ; এবং এইসব কলুষ, ময়লা ধুতে গিয়ে যদি তোমার হাত নুয়ে পড়ে, তার ভেতরে মুখ লুকিয়ে বলো শুধু……
আমি তো জামা খুলে মাছের দম নিয়ে বসে আছি নদীর তীরে। তাৎক্ষণিক নেমে পড়ব আজীবন স্নানে।

কাঁটাতার

বৃষ্টির একটি ফোঁটা কাঁটাতারে কেটে জল ও পানি হয়ে যায়।

Facebook Comments

পছন্দের বই