লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কাজী ওয়ালী উল্লাহর কবিতা

জীবনভঙ্গি

আশ্চর্য জীবনভঙ্গি আমি রপ্ত করেছি
ঘুমাব না, ঘুমালে জাগবই না
কেবল রোদের পরাগায়নে ঝিমিয়ে দুপুর কাটিয়ে দিই,
গার্মেন্টসের কাছেই একটা রিকশা বিলাসিতায় শ্লথ হয়ে আসে
একটা গানকে হাতে ধরে তোমার কাছে এনে রাখি, তারপর যাই আরও একটা গানের কাছে

সন্ধার পীড়িত আলো বইছে একা হাওয়ার সাথে
এবার অভিকর্ষ বল বৃষ্টি নামাতে পারে
ব্যালকনিগুলা চশমার কাচের মতো ভিজে যেতে পারে

প্রচলিত ব্যকরণে কিছুই ঘটছে না চতুর্দিকে,
দেখি, আর বিমূর্তবোধ জাগে
কেউ এত দূর থেকে ডাকে যে, কল্পনার সীমা পেরিয়ে যেতে হয়
আমার জানালার বাইরে ভূত, একাকিত্বের সুষমা
বিরহে তুচ্ছ হয়ে আছি, আমাকে অভিজাত করো, তাকিয়ে
তুমি না তাকালে তো মারা যেতে পারি,
শ্বাসপ্রশ্বাসে রুহ মানছে না

ভাঙাবাড়িগুলার ভেতর পৃথিবী এখনো কত প্রাচীন!
আমার ইচ্ছা করে, একটা গরাদবিহীন জানালা দিয়ে পালিয়ে যেতে
পোকা-ধরা একটা চারাকে, বৃষ্টিতে রেখে আসতে
একটা পুরানা সিনেমার জাহাজে চড়ে কোথাও চলে যেতে

গাছের বাকলে নাগের ত্বকের মতো কষ জমে আছে

পূর্বপুরুষের গ্রামে

গ্রামে এসে নিজেকে হঠাৎ মনে হল, কোনো চারাগাছ
তারাবনের ভিতর, যাকে লাই দিচ্ছে ইলশেগুঁড়ি
অর্ধেক পানিতে ডুবে থাকা
আর অনেক গ্রাম্য উদ্ভিদের কোলাহলে বিব্রত

এখানে লিরিকের পালক নেড়ে একটা সুর উড়ে বেড়াচ্ছে
কাফন সরায়ে শেষবার দেখার মতোন কাতর সন্ধ্যা
এখানে বইঠার ধ্বনি ব্যতিত অন্যকোনো কবিতার, ছন্দ মিলছে না
আর সমস্ত চিত্রকল্পই পুকুরের পাড়-ঘেঁষা নতুন বেতপাতায় ছাওয়া

জোঁকের হৃদয় কাঁপিয়ে যে বৃষ্টি নামে
তাতে ভাঙাবাড়িগুলার ঘ্রাণ ছড়ায় চারিদিকে
তাতে জানালায় আরো ঘন মরিচা জমে
দুলে উঠে আমার পূর্বপুরুষের ছাতা
দখলদারিত্বের কলহে দ্বিধাগ্রস্ত জমিগুলা ভেসে যায়

এই মরা খালের পারে তারাপাতা কেটে আমি বিছানা বানাই
আর অভিলাষী হই, একটা নৌকা বয়ে যেতে দেখার
তাহলে আমার শহর ছেড়ে পালানো চরিতার্থ হয়
তোমাকে নিয়ে বিয়ের পর চলে আসা যায়

একাকিত্বের প্রসঙ্গে

পাখি এমনই কেঁপে উঠে, যেন প্রেক্ষাগৃহ ভেসে যায়
হাওয়া ও পাতাদের মিলন-দৃশ্যে।
রোদ ধীরে ঢুকে পড়ে অভিমানী মহিলার দুপুরে
বিলানো কাপড়গুলো বিচলিত দেহে, বিষণ্ণ প্রবাহে উড়ে
নিজেকে জড়িয়ে ধরে, অনেকে ভরসা পায়
অনেকে মুদে রাখে চোখ।

এতসব বিড়ালের আঁচড়ভরা ভূবনে একটা ইঁদুরের বিষণ্ণতা
শৈশবের খোঁড়ল থেকে তুলে এনে, ছেড়ে দিয়েছি
যেন একাকিত্বের প্রসঙ্গে হৃদয় ভরে থাকে।

রাতগুলা সব আমার কাছে
একই ভঙ্গির নক্ষত্রে ঠাসা
যেন ওরা জাপানি মানুষ

উদাসীন সব চিত্রকল্পে খাতা ভরে রেখেছি
লিখে তারপর নিজেই ভুলে গেছি
ভাবার্থহীন কমাচিহ্ন এখনো ছাড়ে না

আমার নিদ্রা পুনর্বার একঘেয়ে হয়ে পড়ছে
স্বপ্নগুলা ট্রাজিক বৃষ্টিতে ভিজা
জানালা থেকে জাহাজের ভাসমানতা ঠাওরে দেখার মতো দূরে
আর তুমি পাখি পালছো আয়েসে আয়েসে।

শুধু একটা গদ্য লিখেছি বলে, কবিতার এতো ব্যথা।

বৃষ্টিতে

কোনো প্রস্তাব ছাড়াই বৃষ্টি এল
আর ভিজল নির্মাণাধীন বাড়ি।
এই গ্রামে, কিছু না, শুধু গার্মেন্টসের মেয়ের অভাবই
বেশ প্রকট হয়ে রইল।
যারা ভিজতে ভিজতে বোরকা আলগাবে।
প্রায় শুকিয়ে আসা কাপড়ের কাষ্ঠতা
বৃষ্টিকে উদ্বুদ্ধ করেছে কিনা জানি না।

হঠাৎই পালটে গেল গ্রামের প্রোফাইল পিকচার।

খাতুনগঞ্জ

সূর্যোদয়ের দিকে চেয়ে বসে থাকি,
যখন রেডিয়ো বাজিয়ে দেবে স্টেশন
রোদ আধোয়া মুখে বারান্দায় এলিয়ে থাকবে
রোদের কাদার ভিতর পথ ডুবে যাবে
বাতাসের তাপ তার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে খাতুনগঞ্জ ঢুকে পড়বে
ওখানে রিকশাগুলা এমনই শ্লথ যেন, ছাদে কারো পায়চারি
ওখানে ভাঙাবাড়িগুলাতে সওদাগরদের মরা-আত্মা
ওখানে চাঁদের আলোয় হলুদ ট্রাকেরা জ্যাম লাগিয়ে দেয়
ক্লান্ত ড্রাইভার গাড়ির ভিতর শুয়ে পড়ার পর
ভীরুলোকের জ্বরের গোঙানির মতো, কুকুরের বিমর্ষ হাই

আমার কোনো ব্যাবসা নেই, স্মৃতি আছে, মোড়ল পূর্বপুরুষ আছে
যারা এসব গলিকে পেলেপুষে স্ফীত করেছিল
আমি তাদের চূর্ণ গৌরবের ধূলা ঝাড়ছি
একা বাজিয়ে চলেছি পুরানা রেডিয়ো

জেলগেট থেকে বাঁয়ে মোড় নিলেই, প্রাচীন কোলাহল,
বৃটিশ শাসনের বিষণ্ণ বৃষ্টিতে বাড়িগুলা এখনো ভিজছে।

Facebook Comments

পছন্দের বই