লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গুলজারের কবিতা

ভাষান্তর: সঙ্গীতা দাস

থিম্পু-ভুটান

থিম্পু ছু… (ছু মানে নদী)
তোমার দেশগাঁয়ের নদী সব
আমার ওখানেও বইছে
এমনই আবাদ করে জমিন
এমনই নৌকা বোঝাই করে
পার করে দেয় পারাবার।

কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে ওদের জলে
তীব্র ফেনা তুলে।
চিৎকার শোনা যায়
নদীর কোমল শরীর ভাঙতে থাকে নিশ্চিত।

রাতের নীরবতার মাঝে থিম্পু ছু
কোন মন্ত্রোচ্চারণ কর তুমি
কী সেই প্রার্থনা?
সাগর সঙ্গমের কথা ভাবো,
না কি ভাঙচুর হওয়া থেকে বাঁচতে
চুপচাপ প্রার্থনা করে যাও তুমি?

নদী

নিজের মনে বিড় বিড় করতে করতে বয়ে যায় নদী
ছোট ছোট স্বপ্নে বুনে রেখেছে মন..
বালি তীরে আছড়ে পিছড়ে তো জীবন কাটল,
এখন ব্রীজের উপর উঠে বইতে চায় সে।

শীতকালে যখন কুয়াশা এসে ঢেকে দেয় ওর মুখ
আর হাওয়া ধুতির খুঁটে মুছে দিয়ে যায় অবয়ব,
কোন একবার সেও উড়ে যাবে ঐ হাওয়ার সাথে
আর উধাও হয়ে যাবে এই অরণ্য ছেড়ে।

কখনও এমন হয়
ব্রীজের উপর দিয়ে ট্রেন চলে যায় আর এই বহতা নদী থেমে যায় মুহূর্তকাল
একটি অভিলাষ নিয়ে..
হয়ত এক দিন আর একবার দেখতে পাবে সেই মেয়েটির মুখ
যে ফুল তুলসিতে পুজো দিয়ে নিজের বর কামনা করেছিল নদীর কাছে।

সেই মেয়েটিকে ধরে রেখেছে নদী
তার প্রতিবিম্বে।
আমিও রেখে দিয়েছি তার ছবি মনের অতলে।

বুড়ো নদ ১

নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বয়ে চলে এই বুড়ো নদ
কেউ বুঝি জানতে চায়,
নদী তীরে লোকেরা যা করে করুক
তাতে কী এসে যায় তোমার?
তুমি শুনো না, কান দিও না ওদের কথায়
ঘাটে দাঁড়িয়ে লচ্ছি কে যদি মিথ্যে বলে শালা! মাধব
লচ্ছির সাথে তোমার কী লেনাদেনা,ডুবে মরুক গে যাক!

এই তো নদের দু:খ
লচ্ছি যেদিন জন্মেছিল, মাতৃ নাভিমূল ছিন্ন করে এনে এই নদের হাতেই সঁপেছিল ঝুলন দাই…
আর নদ রেখে এসেছিল সে সব সাগরের গহীনে
কাল যখন পেট বাড়তে শুরু করবে এই লচ্ছির, ডুবে মরবে
আর সেই লাশটাও গায়েব করতে হবে তাকেই!
লাশ খুঁজে পেলে গাঁয়ের লোকে বদনাম দেবে

নিজেরই মনে বিড়বিড় করতে করতে বয়ে চলে বুড়ো নদ!

পর্বত

দোমড়ানো, থেঁতলানো পর্বত তবু চেষ্টা তো করেছিলো
পতনোদ্যত একটি গাছ কে আঁকড়ে রাখার
অথচ কিছু লোক তাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে
পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে গিয়েছিল- কারখানায়!
আর পাথর চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল পর্বত

বহু আঁচড়ে বিক্ষত করেছে মানুষ আমাকে
আমার মাথার উপর থেকে সাফ করেছে জঙ্গল ওদের কুঠার
আমার নদী
আমার প্রপাত নগ্ন করেছে
এই লোভ- নিমজ্জিত মানুষ!
আমার বুক তো চিরে যায় তপ্ত লাভায়
মানুষের বুক ফাটে না
পাথর হয়েছে সব!

অরণ্য

অরণ্যের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়
আমার পূর্বপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন,
আমি এক নবজাতক
এই গাছেদের গোষ্ঠী
উঠে এসে আমাকে দোলায় তাদের শাখায়

একজন ফুলের ঝুমঝুমি বাজায়, তো আরেকজন
চোখের পাতায় ছিটিয়ে দেয় সুঘ্রাণের পিচকারি
শ্মশ্রুময় অতিবৃদ্ধ বট, আমায় কোলে নিয়ে
অবাক হন,বলেন:
এখন তুমি হাঁটতে পারো!
একসময় আমাদেরই মত ছিলে তুমিও,
শিকড় ছিল মাটিতে
সূর্য ছোঁয়ার আশায় সর্বশক্তি ব্যয় করতে তুমি
তোমার আগে এসেছি পৃথিবীতে
টলমল পায়ে হাঁটতে দেখলাম তোমায়..
আমাদের শাখায় চড়তে,ঝাঁপ দিয়ে পড়তে
লাফালাফি করতে অনেক
কিন্তু দুপায়ে স্থির হয়ে যেদিন দৌড়লে,আর ফিরলে না
পাথর আর পাহাড়ের অংশ হয়ে গেলে তুমি!

কিন্তু সে যাই হোক..
তোমার শরীরে জল আছে
তোমার শরীরে মাটি আছে
আমাদেরই একজন..
আমাদের মধ্যেই আবার বপন করা হবে তোমায়
ফিরে আসবে আবার!

Facebook Comments

পছন্দের বই